সুখের পাখি পর্ব-০৪

0
721

#সুখের_পাখি


সাবিনা এখানকার একটা স্কুলে তনুকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তনু স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। স্কুলে নতুন বন্ধুবান্ধবও বানিয়ে ফেলেছে। তনুর সবথেকে ভালো বন্ধু হয়েছে মিলি নামের একটা মেয়ে। মিলির নামের মতই মিলি সবার সাথে নির্দ্বিধায় মিশতে পারে। তনু ওর গ্রামের কথা প্রায় ভুলেই গেছে। অল্প সময়েই শহরের জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ফুপু আম্মার বাড়িটাও তার পছন্দ হয়েছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে সারাক্ষণই ফুলি আপা নানান কথা বলে হাসিয়ে মারে। ফুলি বয়সে তার থেকে দুই তিন বছরের বড় হলেও ওকে সমবয়সীই মনে করে। ফুলিকে সে, ফুলি আপা ডাকে। প্রথম কয়দিন ফুলি আপত্তি করেছিল। ওর মুখে আপা ডাক শুনে কপাল কুঁচকে নাক উঁচিয়ে বলেছিল,

–‘আপা, আপা করো কেন অত?”

তনু অবাক গলায় বলেছিল,

–‘ওমা! তুমি আমার বড় তো। তোমাকে আমি নাম ধরে ডাকব নাকি?”

–‘তাই বইলা কথায় কথায় আপা ডাকবা?”

–‘তোমাকে আপা ডাকতে আমার ভালো লাগে। আমার নিজের তো বড়/ছোট কোন ভাই বোনই নেই। তাই তোমাকে আপা ডেকে শখ মেটাব। বুঝলে ফুলি আপা।”

ফুলি হার মেনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল,

–‘আচ্ছা ডাইকো। ভাল্লাগলে আর কী কওন যাইব!”

তনু এটাকে নিজের বাড়ি ভেবে থাকছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, লেখাপড়া করে যাচ্ছে। কেউ তাকে কিছু বলে না। কেউ কোন কাজে বাধা দেয় না। সে নিজের স্বাধীন। ফুপু আম্মার মতো ভালো মানুষ এই দুনিয়ায় আর দুইটা হয় না। নিজের মেয়ের মতো আদর করে ওকে। কত ভালোবাসে। মায়ের মতন তার খেয়াল রাখে।
ইহান তার চিলেকোঠা ছেড়ে নিচে আসেই না বলতে গেলে। ওকে নিয়েও তনুর কোন মাথা ব্যথা নেই। প্রথমদিকে ইহানের সাথে ভাব জমাতে চেয়েছিল সে। কিন্তু ফুপু আম্মার এই ছেলে আস্ত বজ্জাত। প্রথম দিন যখন তনু ছাদে ইহানের ঘরে যায় সেদিনই ইহান তার সাথে বাজে ব্যবাহর করে। তনু শুধু কথা বলতেই গিয়েছিল। কথায় কথায় যদি বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাহলে তো আরও ভালো। বন্ধুত্ব না হলেও অবশ্য সমস্যা নেই। তনু তিড়িংতিড়িং করে ছাদে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খোলাই পেয়েছিল। উঁকি ঝুঁকি পেরে ভেতরে দেখেছে। কেউ নেই। তাই অনুমতি না নিয়েই ভেতরল ঢুকে গেল। ঘরটা আহামরি কিছু না। মোটামুটি মানুষ থাকার উপযোগী। কিন্তু একে অগোছালোই বলা যায়। বিছানার চাদর কুঁকড়ানো। সোফায় চায়ের কাপ। আলনায় জামা-কাপড়ের স্তুপ। ফ্লোরেও জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তনু নাক কুঁচকে বলে,

–‘ছি! এত নোংরা! এই ঘরে মানুষ থাকে? ফুলি আপা তো বলেছিল ফুপু আম্মার ছেলে নাকি এই ঘরেই থাকে বেশিরভাগ সময়।”

ইহানের গিটারের দিকে নজর গেলে তনু ওটাকে হাতে নেয়। বাজাতে জানে না। তবুও চেষ্টা করে টুংটাং আওয়াজ তুলে। সেই আওয়াজ শুনেই হয়তো হঠাৎ দেয়াল ফুঁড়ে ইহান বেরিয়ে আসে যেন। দেয়াল না পর্দা টানানো ছিল। তনু লক্ষ করেনি। ইহান ঘরে এসে তনুর হাতে ওর গিটার রেখে রেগে যায়। ছোঁ মেরে ওর থেকে গিটার নিয়ে নেয়। ইহান এখনও খালি গায়ে। এই ছেলের সত্যিই কোন কাপড় নেই। নয়তো মনে হয় কাপড় গায়ে দিলে গা জ্বালা করে। নইলে চব্বিশ ঘণ্টা খালি গায়ে টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। লজ্জাহীন বেলাইজ্জা পুরুষ মানুষ। তনু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তবুও হাসার চেষ্টা করে বলে,

–‘আমি ভেবেছিলাম আপনি ঘরে নেই। বাইরে থেকে দেখতে পাইনি তো।”

গিটার হাতে নিয়ে শান্ত মুখে ইহান বলে,

–‘কারো রুমে যাওয়ার আগে নক করে যাওয়া সাধারণ ভদ্রতা। আর কারো জিনিসে হাত দেওয়ার আগে তার পারমিশন নেওয়াও ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। নক না করে আসা, পারমিশন না নিয়ে কারো জিনিস ধরা অভদ্রতার মধ্যে পড়ে। এটুকু জ্ঞান তোমার থাকা উচিত।”

এই অপমান তনু সহ্য করতে পারল না। সেই দিনের পর থেকেই ছাদে যাওয়া বন্ধ করল। ইহানের সাথে কথা বলাও সেদিনের পর থেকেই বন্ধ হয়েছে। আগেও অবশ্য কথা কোথায় বলত। সামনে পড়লে হাই হ্যালো এটুকুই তো। ওইদিনের পর তা-ও বন্ধ হলো। তনু ইহানকে দেখলেও না দেখার মতো চলে। ওকে পাত্তা না দিয়ে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে। বাজে লোক। সেদিন ওরকম অপমান করতে পারল! তনুর চোখে পানি চলে এসেছিল। ফুপু আম্মার কাছে বিচারও দিতে চেয়েছিল। কী মনে করে দেয়নি সে-ই জানে।

এবাড়িতে শুধু ইহান বাদে সবাই তনু বলতে পাগল। সকালে স্কুলে যাবার সময় ফুপু আম্মা টিফিন ব্যাগে ভরে দেয়। তনু স্কুল থেকে ফিরলেই প্রতিদিন ফুলি আপা জিজ্ঞেস করবে,

–‘আজ স্কুলে কী কী করলা তনু? কয়টা পোলা চোখ টিপ দিল? এই তোমারে কেউ প্রেমপত্র দেয় না? তুমি দেখতে তো মাশাআল্লাহ সুন্দর। তোমার পিছে তো পোলাগো লাইন লাইগা যাওনের কথা।”

তনু ফুলির কথা শুনে খিলখিল করে হাসে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে ওর হাসির শব্দে বাড়িটা গমগম করে। দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। ফুলির কথায় তনু গম্ভীর মুখে উত্তর দেয়।

–‘না গো ফুলি আপা আমি মনে হয় ততটাও সুন্দরী না। দেখো না, আজ পর্যন্ত একটা ছেলেও আমাকে দেখে চোখ টিপ দিল না। না কারো থেকে কোন প্রেমপত্র পেলাম। অন্তত একটা পেলেও নাহয় নিজেকে সুন্দরী হিসেবে দাবি করতে পারতাম।”

দু’জন একসাথে শব্দ করে হেসে উঠে। ফুলি দুপুরের রান্নার জন্য ফুলকপি কাটছিল। তনু স্কুল থেকে ফিরে ঘরে যায়নি। কাপড়ও ছাড়েনি। স্কুল ড্রেস পরেই ব্যাগটা ছুড়ে রেখে হলে সোফায় শুয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে রিমোট নিয়ে টিভি ছেড়ে দিয়ে ফুলির দিকে ফিরে গল্প করতে লাগল। টিভিতে গান চলছে তনু উপুড় হয়ে শুয়ে দু’পা নাচাতে নাচাতে স্কুলের গল্প করে যাচ্ছে।

–‘আচ্ছা ফুলি আপা তুমি পড়াশোনা করলে না কেন? স্কুলে কত মজা হয় তুমি জানো? আর পড়াশোনা ছাড়া তো জীবনে কিছু করাও যায় না।”

ফুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার জীবনের কষ্টের কথা তনুকে বলে,

–‘আমার কী আর লেখাপড়ার কপাল আছে গো? ওই কপাল নিয়া আমি জন্ম নেই নাই। ছয় ভাই বইনের অভাবের সংসারে জন্ম নিছি। বাপ মা সহ মোট সদস্য আট জন। সবার ভরণপোষণ, খাওয়োন নিয়াই টানাটানি। তুমি আবার লেখাপড়ার কথা কও! খালি পেটে লেখাপড়া ভাল্লাগবো? নাকি খালি গায়ে? আমি পরিবারের তিন নাম্বার সন্তান। আমার বড় দু’জনও মানুষের বাড়িতে কাম করে। আমরা বড় তিনজন কাম করে ছোট তিনজনের লেখাপড়ার খরচ চালাই। আব্বাও কম খাটে না। এইসব দুঃখের কথা তোমরা বুঝবা না বইন। এমনিতে কী লোকের বাড়িতে কাম করতে আইছি? আমাদের কী লেখাপড়া করার শখ ছিল না? পেটের কষ্টের কাছে সব স্বপ্ন মাটি দিছি বইন। দুইটা ভালো খাইতে পারি, দুইটা ভালো পরতে পারি। মাস শেষে বাড়িতে বাপ মা’র কাছেও কিছু পাঠাইতে পারি। এতেই আমার সুখ।”

ফুলি আপার কথা শুনে তনুর চোখ দিয়ে পানি চলে আসছে। অথচ ফুলি আপা কত অবলীলায় বলে যাচ্ছে। একটুও কষ্ট হচ্ছে না যেন। আল্লাহ সবাইকে বড়লোক দিলো না কেন? নয়তো সবাইকে গরীবই দিত। একজনকে বড়লোক, একজনকে গরীব দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন তিনি। কেউ বেশি পেয়ে সেটার মর্ম বুঝে না। আর কেউ না পেয়ে কষ্ট পায়। তনু কথা ঘুরিয়ে নিল। বলল,

–‘তুমিও তো কম সুন্দরী না ফুলি আপা। তুমি কয়টা প্রেমপত্র পেয়েছ? কত সুন্দর করে সেজে বাজারে যাও তুমি। নিশ্চয় অনেকে চোখ টিপ দেয়। কেউ একজনের কথা বলো না ফুলি আপা। আমি কিন্তু আমার সব কথা তোমাকে বলি।”

ফুলি যেন লজ্জা পেল। গাল লাল করে বলল,

–‘কত জনেই তো ভালোবাসার কথা কইতে আহে। আমিই পাত্তা দেই না। এসব করা ভালা না গো।”

তনু আগ্রহী হয়। ফুলি আপাকে খেপায়।

–‘ওমা! কে বলল ভালো না। প্রেম ভালোবাসাকে তুমি খারাপ বলছো? আমি তো প্রথম সুযোগেই প্রেমে পড়ে যাব। কিন্তু আফসোস কোন ছেলেই তো আজ পর্যন্ত আমার সামনে প্রেমের কথা বলতে আসলো না।”

–‘ফুলি কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোকে। কানে কথা যায় না। অবশ্য যাবে কীভাবে? ফালতু আলাপে ব্যস্ত আছিস।”

ইহানের গলা শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে তনু। পাজামা উপরে উঠে গিয়েছিল। ঝুঁকে টেনে নামানোর চেষ্টা করে তনু। ফুলি ভাইজানকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।

–‘সরি ভাইজান। সত্যই আপনার ডাক শুনি নাই।’

ইহান কখন এসেছে কে জানে। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে? তনুর বলা সব কথা শুনে নিয়েছে নাকি? হায় কী লজ্জা! তনু কখনও মুখ দেখাতে পারবে ওই বজ্জাতের সামনে? এমনিতেই তনুকে ও অভদ্র ভাবে। এবার কী ভাববে কে জানে? ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল আজ।
ইহান তনুকে কটাক্ষ করে ফুলিকে বলল,

–‘তোকে আজেবাজে সব মানুষদের সাথে মিশতে না করেছিলাম ফুলি। দেখা যাচ্ছে আমার কথার কোন দামই দিসনি তুই। খিদে পেয়েছে আমার। খাবার টাবার কিছু থাকলে ঘরে নিয়ে আয়।”

ইহান চলে গেলে তনু মুখ বাঁকাল। রাক্ষস একটা। সারাদিন খালি খাই খাই। তনুর কিছুটা মন খারাপ হলো। ইহান ভাই তার সাথে এরকম আচরণ করে কেন? ইহানের বাজে আচরণের মানে খুঁজে পায় না সে। কোন কারণ ছাড়া শুধু শুধু তাকে দেখতে পারে না!

–‘ফুলি আপা ইহান ভাই আমাকে দেখতে পারে না কেন? আমাকে না দেখতে পারার পেছনে কারণটা কী? উনাদের বাড়িতে আছি বলে এরকম ব্যবহার করে?”

ফুলি সাথে সাথে মাথা নেড়ে আপত্তি জানায়। সে তো জানে ভাইজান কেমন মানুষ। শুধু যে কেন তনুর সাথেই এমন করে, কে জানে?

–‘না, না তনু। ভাইজান ভীষণ ভালো মানুষ। আমি যে এই বাড়ির কাজের লোক তবুও ভাইজান আমারে কোনদিন ধমক দিয়া একটা কথা কয় নাই। খালি যে তোমার লগে কেন এমুন করে আল্লাহ মাবুদ জানেন।”

তনুও রাগ করে বলল,

–‘তোমার ভাইজান ভালো মানুষ না ছাই। আস্ত বদ লোক। হাড় বজ্জাত। পেটে পেটে শয়তানি। শিরা-উপশিরায় শয়তান নাচানাচি করে। মিচকা শয়তান একটা। ওদের বাড়িতে আছি বলেই এত দাম দেখায়। ওর দাম দেখতে আমার বয়েই গেছে। ফুপু আম্মা এত ভালো মানুষ। উনার পেট থেকে একটা মিচকা শয়তানের পয়দা হলো। খবিশ!”

চলবে🍂

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা