সুখের পাখি পর্ব-০৫

0
683

#সুখের_পাখি


তনুর বাবা ওর সাথে এই বাড়িতে তাদের থাকার ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে এসেছে। অনেক দিনই তো হলো এখানে পড়ে আছে ওরা। সাবিনা কিছু না বললেও ওর স্বামীর তো আপত্তি থাকতেই পারে। কেউই নিজের বাড়িতে উটকো ঝামেলা চাইবে না। তনু বাবার কথা শুনে কিছুটা চিন্তিত মুখে বলে,

–‘এটা তুমি ঠিক বলেছ বাবা। ফুপা বাড়িতে এলে আমাদের দেখে আপত্তি করতে পারে। হয়তো আমাদের সাথে ভালোই আচরণ করবে। আমাদেরকে সামনে কিছু বুঝতে দিবেন না। কিন্তু আড়ালে ফুপু আম্মার সাথে এই নিয়ে ঝামেলা বাঁধতে পারে। আমাদের এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াই উচিত।’

–‘আমিও এটাই ভাবছিলাম।’

–‘কিন্তু বাবা আমরা যাব কোথায়?’

‘যাব কোথায়?’ এটাই এখন একমাত্র প্রশ্ন। এই ঢাকা শহরে ওরা চিনেই বা কতটা? কোথায় যাবে? বুড়ো বয়সে কেউ কাজ দিবে উনাকে? কাজ না করলে ভাড়ি ভাড়া, তনুর স্কুলের খরচ কীভাবে চালাবে? সাবিনার কাঁধেও বেশিদিন বোঝা হয়ে থাকা যাবে না। বাবা ভাবেন। তনুও বাবার ভাবনার সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের মনে মনে ভাবে। এখানেই তো ভালো আছে ওরা। তাই বলে এখানে থাকা, খাওয়া, পড়ার সুযোগ সুবিধা পেয়ে নিজেদের আত্মসম্মান ভুলে যাবে! অন্যের ঘাড়ে বোঝা হয়ে চেপে বসবে! না। চলে যাওয়াই ঠিক হবে। ফুপু আম্মা হয়তো অনেক জোর করবে। ওদের থেকে যেতে বলবে। ফুপু আম্মার কথা না শুনে চলে গেলে হয়তো রাগও করবে। তবুও যেতে হবে। নিজের চোখে ছোট হয়ে গেলে বেঁচে থাকার মানে থাকবে না। এসব ভেবেই সারাটা বিকেল তনুর মন খারাপ ছিল। আজ তার ছোটাছুটি একদম কমে গেছে। ফুলি কয়েকবার এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে ডেকে গেছে। সে প্রতিবার এক কথাই বলেছে।

–‘ফুলি আপা আমার মন ভালো নেই। ডেকো না আমাকে।’

ফুলি ভেতরে আসেনি। দরজার সামনে থেকেই উৎকণ্ঠিত গলায় জানতে চেয়েছে।

–‘মন খারাপ ক্যান তনু? কে তোমারে কী কইছে? ভাইজান বকছে?’

–‘না।’

–‘বকে নাই! তাইলে মন খারাপ ক্যান? মন খারাপের কারণটা তো কইবা।’

–‘ফুলি আপা। আমার এমনিতেই মন খারাপ হয়েছে। সব সময় মন খারাপের নির্দিষ্ট কোন কারণ থাকে না। মাঝে মাঝে এমনিতেই বিনা কারণে মন খারাপ হয়।’

তনুর কথা ফুলি কিছুই বুঝতে পারে না। চিন্তিত মুখে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে চলে যায়। দশ বিশ মিনিট পর আবার আসে। আবার ডাকে। তনু এবার আর কথা বলে না। চুপচাপ শুয়ে থাকে।
ফুলি আর ডাকতে আসেনি ঠিকই। কিন্তু ইহানের গিটারের সুর ঠিকই কানে ভেসে আসে। তনু উঠে বসে। আজ দিনের বেলা থ্রি কোয়ার্টার গান গাইছে।

–‘আমার মন খারাপ অথচ থ্রি কোয়ার্টারের মনে রঙ লেগেছে। আজ দিনদুপুরে গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে। প্রতিদিন তো রাত একটার পরে মনে রঙ লাগে। আজ ঠিক দুপুরে লেগেছে। উহম অসহ্য! এই বাড়িতে মন খারাপ করে কিছুসময় শুয়েও থাকা যাবে না।’

তনু বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। পা টিপেটিপে ছাদের দিকে যেতে লাগল। ইহানের সাথে দেখা হয়ে যাবার ভয়ে ছাদে আসেই না সে। ফুপু আম্মার বজ্জাত ছেলের যা বাজে ব্যবহার! কখন ধমকে দেয় কে জানে? সেই ভয়েই তনু এখন আর ইহানের ঘরের আশেপাশেও আসে না। সেদিন তো একটু গিটারটাই হাতে নিয়েছিল। বাজাতে চাইছিল, ভেঙে তো ফেলছিল না।
তনু দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর দেখল। ইহানের দেখা পেল না। তবে গলা শোনা যাচ্ছে। ইহান ভেতরেই কোথাও আছে।

…..তোর মন খারাপের দেশে যাব প্রেমের খেয়ায় ভেসে।
তোর মনটা ভালো করে দেব অনেক ভালোবেসে। ডাকলে কাছে আসিস…..

গানটা শুনে তনুর কেনই যেন লজ্জা লাগতে লাগল। মনে হচ্ছে এই গানটা ওর জন্যেই গাওয়া হচ্ছে। কারণ এই মুহূর্তে ওরও তো মন খারাপ ছিল।

–‘ইশশ কেউ যদি সত্যিই আমার মন খারাপের সময় এই গানটা শোনাত। তাহলে সাথে সাথে আমার মন ভালো হয়ে যেত। কিন্তু আফসোস সেই কেউ টাই তো নেই। সেই মানুষটার অভাবে আমার জীবন মরুভূমি হয়ে আছে।’

তনু আবার গান শোনায় মনোযোগ দিল। ইহানের গানের গলা সত্যিই সুন্দর। তনু না চাইতেও প্রশংসা করে ফেলছে।

–‘উনি ইঞ্জিনিয়ার না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভালোই করেছেন। সবাই যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয় তাহলে গায়ক নায়ক কে হবে? উনি গান গেয়ে সত্যিই একদিন নাম করবে। দেশের সবাই উনাকে উনার গলার জন্য চিনবে।’

–‘এখানে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গান শোনা হচ্ছে! ‘

–‘বাবাগো!’

হঠাৎ কারো গলা পেয়ে তনু ভয় পেয়ে যায়। ধরফরিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়ায়। ইহান ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কখন এলো? সে যে এখানে আছে তা কীভাবে জানল? তখন দেখে ফেলেছিল তাকে?
তনু ভয় পেয়ে বুকে থুথু দেয়। বুক ভরে দম নিয়ে বলে,

–‘এভাবে কেউ কাউকে ভয় পাইয়ে দেয়!’

ইহানের মুখে সামান্য হাসি দেখা গেল। হাসিটা খুব সামান্য হলেও তনু ঠিকই লক্ষ্য করল। থ্রি কোয়ার্টার হাসতেও জানে! হাসলে তো সুন্দরই লাগে। ওর গানের গলার মতো ওর হাসিটাও সুন্দর।

–‘এভাবে চুরি করে কেউ কারো গান শুনে!’

তনুর রাগ হলো। বারবার চুরি করে, চুরি করে বলছে কেন? সে চুরি করে গান শুনতে যাবে কেন? এই কাওয়ালি সঙ্গীত নিচে তার ঘরে বসেও শোনা যায়। যা গলা ছেড়ে গায় উপরে এসে শোনার কোন দরকার পড়ে না। তনুও মুখ বাঁকিয়ে সাথে সাথে জবাব দেয়।

–‘কারো ঘরে গেলে তো আবার অসভ্য অভদ্র হয়ে যেতে হয়। তাই ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না।’

ইহান এবার তনুকে দেখিয়েই হাসল। তনু ড্যাবড্যাব চোখে ইহানের দিকে চেয়ে থাকল। চোখের পলক ফেলল না। ইহান ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরেকটু হাসল। বলল,

–‘ভেতরে এসো।’

তনু নড়ল না। ভেতরে যাবে না সে। সেদিনের অপমান এখনও ভুলেনি তনু। ইহান হঠাৎ একটা কাজ করে বসল। তনুর কনুই ধরে টেনে ওকে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

–‘আরে আসো তো। আর সেদিনের জন্য সরি। এবার তো রাগ ঝেড়ে ফেলো। সেদিন আমার মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল। তার উপর তুমি আবার অনুমতি না নিয়ে আমার গিটার ছুঁয়েছিলে। তখন আরও রাগ উঠে যায়। আবারো সরি তনু। ওইদিন তোমার সাথে আমার ওরকম ব্যবহার করা ঠিক হয়নি।’

তনুর সব রাগ ফুঁস হয়ে গেল। এতো সুন্দর করে গুছিয়ে সরি বলার পর কারো রাগ থাকতে পারে? তনু অন্যদের কথা জানে না। তবে তার রাগ থাকবে না। যেমন ইহানের সব বাজে ব্যবহার এক নিমিষে ভুলে বসে আছে সে।
ইহান খাটে বসল। তনুকে সোফায় বসতে ইশারা করলো।

–‘সোফাটায় আরাম করে বসো। তুমি গান শোনো? গান শুনতে পছন্দ করো? আমার গান শুনেছ কখনও তুমি?’

–‘অতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে কীভাবে দেব?’

ইহান হেসে ফেলল। গিটার হাতে নিয়ে বলল,

–‘গান শুনতে পছন্দ করো আর না করো। এখন আমার একটা গান গাইতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ভালো না লাগলেও তোমাকে শুনতে হবে। বসে থাকো চুপচাপ। আমার অর্ধেক গানের মাঝে ওঠে যেও না। তাহলে ওটাও কিন্তু অভদ্রতা হবে। শুনতে কষ্ট হলে কান চেপে ধোরো কেমন?’

তনুর বলতে ইচ্ছে করছিল, এতটাও বাজে গাননা আপনি। আপনার গান আমি শুনেছি। বলা যায় প্রতি রাতে আপনার গান শুনেই আমার ঘুম আসে। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই ইহান গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে গাইতে লাগল।

….তোর মন খারাপের দেশে যাব প্রেমের খেয়ায় ভেসে… তোর মনটা ভালো করে দেবো অনেক ভালোবেসে….

…..ডাকলে কাছে আসিস পারলে একটু হাসিস, বুকটা রাখিস পেতে ভালোবাসা নিতে।
সব অভিমান ভেঙে দেবো তোর কাছে এসে…..

ইহান গাইতে গাইতেই একবার তনুকে দেখল। তনু চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে গান শুনছে। ইহান মুচকি হাসল।

….মনগড়া অভিযোগ জানি ভুলে যাবি তুই, কাছে এসে আলতো করে যদি তোর হাতটা ছুঁই…

শুনতে শুনতে তনুর কান গরম হয়ে যাচ্ছে। গালও লাল হয়ে গেছে। ইহান চোখ বুজে গাইছে। তনু তার পরের সারাটা সময় এক ধ্যানে পলকহীন ভাবে ইহানকে দেখে গেছে। হঠাৎ তনুর কী হলো তনু নিজেও জানে না। তার এতো লজ্জা পাচ্ছে কেন সে বুঝতে পারছে না। সাধারণ একটা গানই তো গাইছে ইহান। এই গান শুনে তার কান দিয়ে কুকারের সিটি বের হওয়ার মানে কী? তনু বসে থাকতে পারল না। একপ্রকার ছুটে পালিয়ে এলো সে। তার এখনও মনে হচ্ছে গানটা ইহান ভাই তার জন্য গাইছে।

–‘নিজেকে কী ভাবিস তুই তনু? কোন রাজ্যের রাজকুমারী? তোর জন্য ইহান ভাই কেন গান গাইবে? খেয়েদেয়ে কাজ নেই উনার। নিজেকে এতো গুরুত্বপূর্ণ ভাবছিস কেন গাধী।’

পরের দুইটা দিন তনুর ভীষণ ব্যস্ততায় কাটল। স্কুল থেকে একগাদা বাড়ির কাজ দিয়ে দিয়েছে। অংক স্যারটা এমন পাষাণ। আজরাইল একটা। ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়ে গুলোকে দিয়ে অংক করিয়ে ওদের জান নিতে চায়। এমনিতেই তনু অংকে কাঁচা। তার উপর আবার এতো জ্বালা। বাড়ির কাজ করে না নিয়ে গেলে আবার পুরো ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়ের সামনে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে।

–‘জ্বালা জ্বালা আর ভালো লাগে না। লেখাপড়াই ছেড়ে দেব। পড়াশোনা করতে করতে মরে গেলে ভূত সমাজে শিক্ষিত ভূত হয়ে কোন লাভ হবে না।’

তনু বই খাতা বিছানায় ছড়িয়ে রেখে উঠে যায়। অত প্যারা নেওয়া সম্ভব না। মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইহানের সাথে দেখা করতে যায় তনু। সেদিন ওভাবে চলে আসার পর থেকে আর দেখা হয়নি। তনুকে ছাদে যেতে হলো না। ইহান আজ নিজের বেডরুমে আছে। কোথাও বেরুবার জন্য রেডি হচ্ছে সে। বেশ সাজগোজ করেছে। ছেলেদের অবশ্য সাজগোজই বা আর কী? এই শার্ট প্যান্ট পরবে। চুলে জেল লাগাবে। হাতে ঘড়ি গায়ে একটু পারফিউম। ব্যস।
তনু ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

–‘আসব ইহান ভাই?’

–‘না। আমি এখন বের হবো।’

ইহানের কথায় আবার আগের মতন রুক্ষতা এসে গেছে। সেদিন তনু যে ইহানকে দেখেছিল সে যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। হয়তো হারায়নি। ইহানের দুইটা রূপ। একটা ভীষণ কোমল। আরেকটা ভীষণ কঠিন। ইহান সব সময় কঠিন রূপে থাকে। মাঝে মাঝে তার ভেতর থেকে সেই কোমল রূপটা বেরিয়ে আসে। সেটাও আবার খুব অল্প সময়ের জন্য।
ইহান তনুর দিকে তাকাল না পর্যন্ত। তনুকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তনুর কেনই যেন কান্না পেয়ে গেল। তার সাথে ভালো ভাবে একটু কথা বললে কী এমন ক্ষতি হয়ে যায়!

–‘আর কখনও আপনার সাথে কথা বলব না। কোনোদিনও না। আপনাদের বাড়িতে থাকি বলেই এরকম করতে পারেন। নইলে এমন কঠিন ব্যবহার করতেন না। চলে যাব। সারাজীবন এই বাড়িতে থাকব না। জলদিই অন্য কোথাও চলে যাব। তখন আর বাজে ব্যবহার করার জন্য তনুকে পাবেন না।’

চলবে🌸

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা