সুখের পাখি পর্ব-০৬

0
635

#সুখের_পাখি


তনুর স্কুলে প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গাধার মতো রাতদিন খাটাখাটুনি করে তনু পরীক্ষা দিচ্ছে। দিনরাত এক করে পড়াশোনা করে। সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। ফুলি আপার সাথে আড্ডা দেয় না। ফুপু আম্মার সাথে চায়ের আড্ডাও বাদ যাচ্ছে আজকাল। সারারাতও পড়ে। ইহানের জ্বালা রোজ রাত একটার পরেই শুরু হয়ে যেত। তনু ফুপু আম্মাকে বলে ইহানের গান বন্ধের ব্যবস্থা করে। ইহান এখন রাতে গান গায় না। দিনেও না। তনু শান্তিতে পরীক্ষা গুলো দিতে পারছে। পরীক্ষার দিনগুলো তনু দিনের আলো খুব কমই দেখেছে। খাওয়াদাওয়ার প্রতিও মনোযোগ দেয়নি। তনুর পরীক্ষা শেষ হয়। হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। স্বস্তির শ্বাস নেয়। এখন কয়দিন দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটাবে। কয়দিন যা চাপ গেছে বাবাহ!

–‘ফুলি আপা! ও ফুলি আপা! কই গো তুমি?’

–‘ও মা! তনু নাকি? সূর্য কোন দিক দিয়া উঠছে আজ! আজ যে তনুর দেখা পেলাম।’

–‘দূর, পরীক্ষা ছিল। কয়দিন আমার উপর দিয়ে তুফান গেছে ফুলি আপা। পড়াশোনা তো করোনি। করলে বুঝতে পারতে শালার পড়াশোনা কত প্যারা দেয়। বয়ফ্রেন্ডের প্যারা সহ্য করা যায়। পড়াশোনার প্যারা সহ্য করা যায় না বুঝলে।’

–‘অহন তো পরীক্ষা শেষ।’

–‘হ্যাঁ। ফুলি আপা আজ বাইরে ফুচকা খেতে যাবে?’

ফুলি উৎসাহী গলায় বলল,

–‘তুমি খাওয়াইলে যামু।’

–‘আচ্ছা। আমিই খাওয়াব। তুমি শুধু আমার সাথে যেও।’

তনু ফুলির সাথে কথা বলে ছাদে আসে। তার মনে ক্ষীণ আশা ছাদে এলে যদি ইহান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। তার পরীক্ষা শেষ। এখন ইহান ভাই রাতে গান গাইতে পারে। দু’দিন ধরে ইহানের গান না শুনে তার ঘুম আসে না। ইহান হয়তো জানে না যে তনুর পরীক্ষা শেষ। তনু কতক্ষণ ছাদে এলোমেলো ভাবে হাঁটে। সাহস করে ইহানের ঘরে উঁকি দেয়। আজ ইহান কেমন মুডে আছে? আজও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না তো। ইহান ভাই ওরকম ভাবে কথা বললে দু-তিন দিন পর্যন্ত তনুর মন খারাপ থাকে। সেই মন খারাপ সবাই বুঝতে পারে। কোনোভাবেই কেউ তনুর মন ভালো করতে পারে না। থেকে থেকে তনুর তখন কান্না আসে। সে নিজেও বুঝে না কেন এমন হয় তার।

–‘তনু! ভেতরে এসো।’

ইহান তনুকে ডাকে। তনুর বুকের ভেতর কেউ ড্রাম পেটাতে শুরু করেছে। গুপ্ত এক অভিমান মনের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তনুর গলা কাঁপে। চোখ জ্বালা করে। ইহান নরম সুরে আবার ডাকে।

–‘ভেতরে এসো তনু।’

তনু ইহানের ডাক উপেক্ষা করতে পারে না। অভিমানে বুক ভার হয়ে থাকলেও ইহানকে সেটা বুঝানোর উপায় নেই। ভেতরে আসে সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইহান তনুকে দেখে। মনে মনে হাসে। মুখে বলে,

–‘বসো। কোন কাজে এসেছিলে?’

–‘হু, না। না মানে, কোন কাজে না। এমনি এসেছি।’

–‘ওহ আচ্ছা। বসো তাহলে।’

তনু বসে। ইহান তনুর উপস্থিতি ভুলে গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তনু অনেকক্ষণ বসে থাকে। চুপিচুপি কয়েকবার চুরি করে ইহানকে দেখে। ইহান তাকে একফোঁটাও গুরুত্ব দিচ্ছে না। দিব্যি নিজের কাজ করছে। তনুই বোকা। সেধে সেধে কেন এসেছে সে। যেচে পড়ে ঢঙ দেখাতে কে বলেছিল তাকে। তনু মনে মনে নিজেকে গালি দেয়৷ নিজের উপর রাগ হয়। ইহানের উপর অভিমান হয়।

–‘ইহান ভাই!’

–‘হুম।’

–‘আমার পরীক্ষা শেষ।’

–‘অহ। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’

–‘ভালো।’

–‘ভালো হলেই ভালো। পড়াশোনাটা জীবনে ভীষণ জরুরি তনু। পড়াশোনা ছাড়া তুমি জীবনে কিছুই অর্জন করতে পারবে না। তাই মন দিয়ে পড়ো কেমন।’

–‘আপনি তাহলে ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করলেন না কেন ইহান ভাই?’

ইহান তনুর দিকে তাকায়। তনু নিজেও ভাবতে পারেনি সে এমন একটা কথা বলে বসবে। ইহান এই বুঝি রেগে যাবে। তার উপর রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। কিন্তু ইহান সেরকম কিছুই করল না। তনুর ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ভীষণ মিষ্টি করে সে হাসল।

–‘আমি তো গায়ক হবো। গান আমার নেশা তনু। এই নেশাকেই আমি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। পড়াশোনা যেটুকু করেছি তাতে ভক্তদের অটোগ্রাফ দিতে পারব।’

–‘গায়করা বুঝি শুধু অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য পড়াশোনা করে? অনেক গায়কই গানের পাশাপাশি অনেক বড় বড় ডিগ্রিও অর্জন করে। আপনিও নাহয়…

তনু ইহানের দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়। ইহানের দৃষ্টি তার কথা কেড়ে নেয়। তাকে বোবা করে দেয়৷ ইহান এই বাচ্চা মেয়ের মুখে জ্ঞানের কথা শুনে হাসে। তার এই হাসি বড় রহস্যময়। সেই রহস্য তনুর ছোট মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না। ইহান নিজে থেকে আর কিছু বলছে না। তনুই বলল,

–‘আমার পরীক্ষা শেষ ইহান ভাই। এবার থেকে আপনি আবার আগের মতো রাতে গান গাইতে পারেন। আমার কোন সমস্যা হবে না।’

তনু এই কথাটা বলার জন্যই এসেছিল। কথাটা বলা হয়ে গেলে তনু আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। আর দাঁড়ানোর মানেও হয়না। ইহান এখন ভালো আছে। একটু পরে হয়তো ধমকে উঠবে। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। তার আগে তনুই চলে এলো।

আজ রাতে তনু বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল। ঘুম আসছেই না তার। নিজের উপর এত বিরক্ত লাগছে। দুই হাতে চুল টেনে ধরল তনু।

–‘মরার ঘুম! কোথায় গেলি তুই? তোকে পেলে কাঁচা মরিচ দিয়ে কচলে খেতাম। পানি দিয়ে গুলে শরবত বানিয়ে খেতাম।

আর ঠিক তখনই শোনা গেল।

shayad kabhi na keh sakun main tumko
Kahe bina samajh lo shayad…

Shayad mere khayal main tum ik din,
milo mujhe kahin pe gum shayad,

Jo tum na ho, rahenge hum nahi.
Jo tum na ho, rahenge hum nahi…

Na chahiye kuch tumse zyada tumse kam nahin….

Jo tum na ho, toh hum bhi hum nahi…

ইহানের গলা! তনু কেন যে এতো খুশি হলো, খুশিতে চোখে পানি এসে গেছে তার। ইহান ওর কথা শুনেছে। তনু বুঝতে পারল, এতদিন ইহানের গলা মিস করেছে সে। আর তাই প্রতিরাতে এমন ছটফট করত সে। তনু সব ভাবনা একপাশে রেখে ওঠে বসে সব মনোযোগ দিয়ে ইহানের গান শুনছে। কী মিষ্টি গলা! কী মিষ্টি সুর! ইহান কি শুধুই গান গাইছে। নাকি গানের কথাগুলো কাউকে শোনাতে চাইছে। কাকে উদেশ্য করে গায় সে? সবাই তো কাউকে না কাউকে উদেশ্য করে গায়। যে গান লিখে সে নিজেও তার কল্পনায় কারো মুখ সামনে এনে তার জন্য গান লিখে। কথাগুলো তাকে উদেশ্য করে। যা কখনও হয়তো ওই মানুষটাকে বলা হয়নি বা হবে না। সে কথাগুলো গানের মাধ্যমে মানুষটাকে শোনাতে চায়। শোনায়। ইহানের সেরকম কেউ আছে কি?

–‘ইহান ভাই কি কাউকে ভালোবাসে? ওর গার্লফ্রেন্ড আছে?’

তনু এলোমেলো সব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। কয়দিন পর ওর রেজাল্ট দেয়। পরীক্ষা সে ভালোই দিয়েছিল। এতো কষ্ট করে রাত জেগে পড়েছে। সব সাবজেক্ট থেকে ভালো নাম্বারই এলো। শুধু অংশে বত্রিশ এসেছে। মানে ফেল। এক নাম্বারের জন্য ফেল! তনু কখনও ভাবেনি সে ফেল করবে। গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় মোটামুটি ভালো ছাত্রীই ছিল সে। হঠাৎ স্কুল পাল্টানো, আবার মাঝে কয়েকমাস গ্যাপ যাওয়ায় পড়াশোনার এই অবস্থা হয়েছে ওর। অত ভালো ছাত্রী না হলেও এর আগে কখনও ফেল করেনি সে। তাই আজও এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। নিজে হেরে গেছে। ক্লাসের এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে লজ্জা পেয়েছে। বাড়িতে গিয়ে বাবাকে কী বলবে? বাবা কত কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া করিয়েছে। ফুপু আম্মা! উনাকেই বা কী বলবে তনু। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না তনুর। মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। ফুলি পেছন থেকে ডাকে, তনু কোন সাড়া দেয়নি।

–‘এই তনুটা আজব মেয়ে! কহন ওর কী হয় ও নিজেও জানে না। এই মাইয়ার সাথে ভূত পেত্নী আছে।’

ঘরে গিয়ে ব্যাগ ছুড়ে ফেলে, কাপড় না ছেড়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে তনু। দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে থাকে। সাবিনা ওকে ডাকতে আসে। ওর পাশে বসতে বসতে বলে,

–‘কী কাণ্ড! কাপড় না ছেড়ে শুয়ে আছিস দেখছি। স্কুল থেকে ফিরেছিস। কাপড় ছাড়বি। কিছু খাবি। তা না তুই এখন শুয়ে আছিস। ফ্যানটাও চালাসনি। আজ যা গরম পড়েছে।’

সাবিনা নিজে গিয়ে ফ্যান চালু করে দিল।

–‘এই তনু, কী হয়েছে তোর? কী রে। এই মেয়ে!’

ফুপু আম্মার অনেক ডাকাডাকির পর তনু উঠে বসে। ফুপু আম্মা কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তনু কেঁদে ফেলে। ওকে কাঁদতে দেখে সাবিনা হতভম্ব। ব্যস্ত হয়ে তিনি তনুকে ধরে জানতে চাইছেন,

–‘এই মা, এই তনু। এভাবে কাঁদছিস কেন তুই? কে কী বলেছে তোকে? ইহান কিছু বলেছে? বকেছে ও তোকে? এই তনু, কথা বল মা। না বললে আমি বুঝব কীভাবে? অমন করে কাঁদে না মা। কান্না থামা না একটু। বল আমাকে কী হয়েছে।’

তনুর ফর্সা মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। নাকের ডগা লাল হয়ে ওঠেছে। চোখ দু’টো জলে ভেজা ফোলা ফোলা। ফোঁপাতে ফোপাঁতে তনু যা বলল তা সাবিনা প্রথমে বুঝতে পারল না। কপালে ভাঁজ ফেলে সে আবার জানতে চাইল,

–‘কী বলছিস তুই মা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। স্পষ্ট করে বল। বল না রে তনু। কী হয়েছে তোর। আমার তো প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে রে।’

–‘আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি ফুপু আম্মা।’

এবারও কথা স্পষ্ট হলো না।

–‘কি?’

–‘আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি। অংকে বত্রিশ পেয়েছি। একের জন্য ফেল। গ্রামে থাকতে আমি কখনও ফেল করিনি। আমি খারাপ ছাত্রী না। সব সময় ষাট সত্তরের উপরে পেয়েছি। এবার আমি কেন ফেল করেছি?’

এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে তনু এভাবে কাঁদছে! সাবিনা ভেবেছিল কী না কী হয়ে গেছে। এই মেয়ে আস্ত পাগল। ফেল করলে কেউ এভাবে কেঁদেকেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলে। তনু এমনিতেই কাঁদছে সাবিনা ওকে রেজাল্ট খারাপ করা নিয়ে আর বকতে পারবে না। নিজের ছেলেদের লেখাপড়ায় সাবিনা কখনও নাক গলায়নি। ওরা নিজেদের মতো পড়েছে। ভালো রেজাল্টও করেছে। সাবিনা তনুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

–‘এর জন্য এভাবে কাঁদছিস তুই? পাগল মেয়ে। পাশ, ফেল তো মানুষই করে। এবার ভালো করতে পারিসনি। সামনের বার ভালো করবি। এটা তো ফাইনাল পরীক্ষা না। সামনে আরও কত পরীক্ষা বাকি আছে। এই নিয়ে এখন মন খারাপ করলে হবে? কান্নাকাটি করলে নাম্বার বেড়ে যাবে? যদি বলিস বেড়ে যাবে তাহলে আমিও তোর সাথে কতক্ষণ কাঁদি।’

চলবে🌼

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা