সুখের পাখি পর্ব-০৭

0
616

#সুখের_পাখি


তনু কিছুটা শান্ত হয়েছে। তবে ফোঁপাচ্ছে এখনও। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিল। নাক টেনে বাচ্চা মেয়েদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

–‘বাবা শুনলে বকবে। তুমিও তো আমাকে খারাপ মেয়ে ভাববে। আমি পড়াশোনা করি না শুধু শুধু স্কুলে যাই। এমনটা ভাববে সবাই।’

–‘কে এমনটা ভাববে? কার অত সাহস! তুই এসব কথা ভেবে মন খারাপ করিস না তো মা। কেউ তোকে খারাপ ভাববে না। অনেকদিন গ্যাপ গেছে তো। আরও নতুন স্কুল। সবকিছু বুঝেশুনে নিতে একটু সময় লাগবে এই যা। নইলে তুই যে ভালো ছাত্রী এটা আমি জানি।’

–‘তুমি ভাবছো না তো তনু পড়াশোনায় একেবারে গোল্লা?’

সাবিনা তনুর কথায় হেসে ফেলল। তনুর মাথায় আলতো করে ভালোবেসে চাপড় দিয়ে বলল,

–‘পাগলি মেয়ে। কাপড় পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়। সেই সকালে না খেয়ে বের হয়। সারা দিন কোনো খাওয়া নেই। এখনও পেটে কিছু পড়েনি। এরকম না খেয়ে থাকলে ভালো নাম্বার আসবে কীভাবে শুনি? পরীক্ষায় ভালো করতে হলে ভালো করে রাত জেগে পড়তে হবে। রাত জেগে পড়তে হলে শরীরে শক্তি লাগবে। ঠিকমতো না খেলে সেই শক্তিটা আসবে কোত্থেকে হ্যাঁ!’

–‘আমি পরীক্ষা ভালোই দিয়েছি ফুপু আম্মা। সবগুলো অংক করেছি। একটাও বাদ রেখে আসিনি। তবুও আমাকে একশো থেকে মাত্র বত্রিশ দিল! সব ওই বুইড়া টাকলার শয়তানি। ওই শয়তান ইচ্ছে করে আমাকে ফেল করিয়ে দিয়েছে। আমি জানি ও আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। একদিন ওর ক্লাসে মিতার সাথে কথা বলেছিলাম বলে আমাকে আর মিতাকে ওই টাকলা পুরো ক্লাস দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ওই শয়তান ইচ্ছে করে আমার খাতায় দুই তিনটা শূন্য বেশি লাগিয়ে অংক ভুল ধরেছে।’

তনুর পাগলামি কথাবার্তা শুনে সাবিনা তরুণী মেয়েদের মতো খিলখিল করে হাসতে লাগল। তনু কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে ফুপু আম্মাকে দেখছে। এভাবে হাসার কী হলো তনু বুঝতে পারছে না। সাবিনা অনেকক্ষণ হাসল। হাসি থামাতে পারছে না সে। তনু মুখ বাঁকিয়ে বসে রইল। ফুপু আম্মার হাসি পাচ্ছে! তার তো রাগে গা জ্বলছে। ওই বুইড়া টাকলা অংক স্যারকে খুন করতে ইচ্ছে করছে। শয়তানটা জেনে-বুঝে ওকে কম নাম্বার দিয়েছে। সাবিনা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে কোনোরকমে বলল,

–‘ওরে তনু, তুই কী দিয়ে গড়া রে! এরকম পাগল মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি। তুই এখনও বাচ্চাই রয়ে গেছিস। কবে বড় হবি রে তনু?’

–‘তুমি জানো না ফুপু আম্মা। আমি তোমাকে একদিন স্কুলে নিয়ে যাব। ওই স্যার সত্যিই একটা মিচকা শয়তান। তুমি ওর মুখ দেখেই পেটের শয়তানি ধরতে পারবে।’

সাবিনা হাসতে হাসতে বলল,

–‘আচ্ছা যাব। এখন তুই কাপড় ছেড়ে বাইরে আয়। তুই লাফালাফি ছুটাছুটি না করলে আমার বাড়ি ভূত বাড়ি মনে হয়।’

সাবিনা চলে যায়। তনুর মন হালকা হয়েছে। তবে এখনও মন খারাপ ভাব পুরোপুরি কাটেনি। সে পরীক্ষায় ফেল করেছে শুনলে ইহান ভাই তার সম্পর্কে কী ভাববে? ভাববে সে অনেক খারাপ একটা মেয়ে। যে মেয়ে পরীক্ষায় ফেল করে সে ভালো হয় নাকি? তনুর সব চিন্তা যেন ইহানকে নিয়েই। ফেল করেছে বলে তার কষ্ট হচ্ছে না। ইহান তার সম্পর্কে কী ভাববে সেটা নিয়েই যেন কষ্ট হচ্ছে।

সাবিনা বিকেলে ছাদে আসে। ইহানের সাথে তার জরুরি কিছু কথা আছে। সে অবশ্য তনুকে নিয়েই কথা বলতে এসেছে। দরজার সামনে এসেই সাবিনা বলল,

–‘তুই যে কেন বেডরুমে থাকিস না বুঝি না আমি। ছাদের এই মুরগির খোপে পড়ে আছিস। আমার বাড়িতে এতগুলো ঘর কেন দিয়েছি? থাকার মানুষ নেই যখন তখন বাড়ি বিক্রি করে দেই। পায়রার খোপের মতো ছোট ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠি।’

কয়েকটা সিঁড়ি বেয়েই সাবিনার হাঁপানি উঠে গেছে। ঘনঘন দম নিচ্ছে সে।

–‘আমার হাঁটুতে ব্যথা। সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। এটা খুব ভালো করেই জানিস তুই। তবুও এই আস্তানা ছাড়তে রাজি না। ছেলের কথা মনে পড়লে আমি যে এসে তোকে দেখে যাব সেটাও পারি না। ঘরে থাকলে অন্তত যেতে আসতে আমাদের কয়েকবার দেখা তো হতো। এখন তো সেটাও হয় না। এখন তোদের কাছে আমার কোন দাম নেই। আমি মরে যাই তখন বুঝবি মা কী জিনিস।’

ইহান মায়ের শেষের কথায় বিরক্ত হলো। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,

–‘মরার কথা আসছে কেন মা!’

সাবিনার রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল,

–‘আসবে না! অবশ্যই আসবে। একশোবার আসবে। আমি মরলে তোরা শান্তি পাবি। আমার মর্মও বুঝবি। কথায় আছে না, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝা যায় না। তেমনই মা থাকতে মায়ের মর্ম বোঝা যায় না।’

–‘বাজে বকো না তো মা। কী এজন্য এসেছ সেটা বলো।’

সাবিনা চুপ করে থেকে রাগ সামলে নিলেন। ছেলে, স্বামী কারো কাছে তার দাম নেই। স্বামী সারাবছর দেশ-বিদেশে থাকে। স্ত্রী একা বাড়িতে কীভাবে সময় কাটায় সেটা উনার ভাবার বিষয় না। আর ছেলে দুইটা। বড়টাও হয়েছে বাপের মতো হাড়বজ্জাত। বিদেশে পড়াশোনা করবে সে! কেন দেশে কি কলেজ ভার্সিটির অভাব পড়েছে? লোকে দেশে থেকে লেখাপড়া করছে না? ছোট বান্দর সারাদিন গিটার হাতে এই ছাদের ঘরে পড়ে থাকে। স্বামী সন্তান নিয়ে তার গুছিয়ে সংসার করার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। তনুরা এসেছে বলে তার দিনগুলো এখন আগের থেকে ভালো যাচ্ছে। সে এতো মানুষ ভালোবাসে অথচ তার বাড়িতেই মানুষ নেই। ছেলেদের বিয়ে করিয়ে বউ আনবে। ওদের ছেলেমেয়ে হবে। তার বাড়ি মানুষে গমগম করবে। নাতি নাতনিদের নিয়ে ছুটে খেলে তার দিন কেটে যাবে। কই কিছুই তো হলো না। হলেও কবে হবে কে জানে। সে বেঁচে থাকতে এসব স্বপ্ন সত্যি হবে? নাকি মরে গিয়ে উপরে বসে এসব দেখতে হবে!

–‘কী হলো মা? কী ভাবছ। কিছু হয়েছে? বাবা কল করেছিল। আমাকে নিয়ে তোমায় কিছু বলেছে।’

ইহানের চেহারা শক্ত হয়ে যাচ্ছে দেখে সাবিনা তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,

–‘না,না। তোর বাবা কিছু বলেনি। অন্য ব্যাপারে এসেছি।’

–‘হুম। ব্যাপারটা কী বলো।’

–‘তনুকে প্রাইভেট পড়া তো তুই।’

–‘কি!’

–‘চেঁচাচ্ছিস কেন?’

–‘তোমার কথা বুঝলাম না।’

–‘তনুকে প্রাইভেট না পড়ালেও কয়টা দিন এমনিতেই পড়া। ওকে একটু অংক টংক দেখিয়ে দিবি। একটু বুঝিয়ে দিবি। নতুন স্কুলে এসে মেয়েটার পড়াশোনায় বড় রকমের চাপ পড়েছে। কয়দিন আগে পরীক্ষা গেল না। আজ রেজাল্ট দিয়েছে। অংকে খারাপ হয়েছে। পাগল মেয়ে এই নিয়ে বাড়িতে এসে সে কী কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে! আমি অনেক বুঝিয়ে ওকে শান্ত করেছি। পাগল মেয়ে শেষে এটা বলছে, বুড়ো টাকলা অংক স্যার নাকি ইচ্ছে করে ওকে ফেল করিয়ে দিয়েছে। ওই শয়তান নাকি তনুকে দেখতে পারে না। ক্লাসেও দাঁড় করিয়ে রাখে। ওর সঠিক অংকে নাকি দুই তিনটা শূন্য বেশি লাগিয়ে ফেল করিয়ে দিয়েছে। শোন মেয়ের কথাবার্তা! তনুটা এখনও ভীষণ বাচ্চা রে। মা মরা মেয়ে ওকে আমি আরও আগেই কেন নিজের কাছে নিয়ে আসলাম না। বাবারা কি মায়ের মতো ভালোবাসা দিতে পারে? মেয়েটার এতদিন হয়তো অনেক কষ্ট হয়েছে। মেয়েদের কত কথা থাকে যা শুধু মায়েদের সাথে শেয়ার করা যায়। চাইলেও সব সমস্যার কথা বাবাকে জানানো যায় না। ওকে আমি আমার কাছেই রেখে দেব। এখানে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাবে।’

সাবিনা নিজের সাথেই যেন কথা বলছে। ইহান মায়ের কথাগুলো শুনল। কতক্ষণ চুপ থাকল। তারপর কী যেন ভেবে বিরক্ত গলায় বলল,

–‘আমি কাউকে পড়াতে টড়াতে পারব না মা।’

সাবিনা আশ্চর্য চোখে ছেলেকে দেখল। বিস্ময় মাখানো গলায় বলল,

–‘কেন?’

–‘আমার কাজ আছে। ভীষণ ব্যস্ত দিন কাটে আমার। হাতে একদম সময় নেই।’

সাবিনা তেত উঠে বলল,

–‘কী এত কাজ তোর শুনি! সারাদিন তো শুয়ে বসেই কাটাস। তবুও নাকি হাতে সময় নেই। তোর কোন কথা শুনতে চাই না আমি। তনুকে পড়াবি তুই। তুই বরাবরই অংকে ভালো ছিলি। নিজের জ্ঞান নিজের ভেতর রেখে না দিয়ে অন্যের মাঝেও একটু বিকশিত কর। তনুকে পড়ালে তোর জ্ঞান কমে যাবে না।’

–‘স্কুলে স্যারদের কাছেই তো পড়তে পারে।’

–‘বাড়িতে তুই থাকতে স্কুলে স্যারের কাছে পড়তে যাবে কেন? তুই সময় নিয়ে বুঝিয়ে পড়াবি। এতে তনুরই ভালো হবে। কিছু না বুঝলে যখন তখন তোর কাছ থেকে জেনে নিতে পারবে। তুই তো আর স্যারদের মতো সময় ধরে ত্রিশ মিনিট, এক ঘন্টা পড়াবি না।’

ইহান বিড়বিড় করে বলল,

–‘ওটাই তো সমস্যা মা। যখন তখন আমার ঘরে চলে আসবে। ওই মেয়ে বেশিক্ষণ আমার সামনে থাকলে…

কথা শেষ করার আগেই সাবিনা ধুম করে ইহানের পিঠে তাল ফেলল। ইহান ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে বাঁকা হয়ে গিয়ে বলল,

–‘মা!’

–‘বিড়বিড় করিস কী হ্যাঁ? মায়ের কথা শুনিস না তুই। দিনদিন আমারও অবাধ্য হচ্ছিল! মেরে পিঠের ছাল তুলে দেব তোর। বেশি বড় হয়ে গেছো এটা ভেবো না। আমি এখনও তোকে মারতে পারব। তোর বিয়ে হয়ে গেলে দুই তিন বাচ্চার বাপ হলে তখনও তুই আমার হাতে মার খাবি। ছেলেপুলে বউয়ের সামনেই খাবি।’

–‘আচ্ছা, আচ্ছা। পাঠিয়ে দিও তোমার ভাইঝিকে। কিন্তু আমার একটা শর্তে আছে। ওর কোন তেড়িং বেড়িং মানব না আমি। আমার কাছে পড়লে আমাকে স্কুলের স্যারদের মতোই মানতে হবে। দরকার পরলে মেরে মেরে পড়াব। তখন কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বলতে পারবে না। আর তোমার আদরের ভাইঝিও তোমার কাছে বিচার দিতে পারবে না। আমার ছাত্রীকে আমি যেভাবে খুশি সেভাবে পড়াব। কারো নাক গলানো পছন্দ করব না। তোমারও না। রাজি আছো?’

সাবিনা অসহায় মুখ করে ছেলের মুখের দিকে তাকাল।

–‘তুই মারবি ওকে?’

–‘ইচ্ছে করে তো আর মারব না। তবে দরকার পড়লে মারতে হবে।’

–‘তোর যা রাগ বাবা! এখন তো আমার ভয়ই হচ্ছে। মেয়েটাকে বেশি বকাঝকা করিস না। মারিসও না। একটু মানিয়ে নিস তুই। ও তো এখনও অনেক ছোট। তুই বড় না। বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করিস।’

–‘ভাই!’

ভ্রু কুঁচকে ইহান মা’র দিকে দেখল। সাবিনা নির্বিকার।

–‘হ্যাঁ ভাই। তনু আমার ভাইয়ের মেয়ে হলে ও তোর মামাতো বোন না! তুই ওর ভাই হোস না।’

–‘তোমার নিজের তো কোনো ভাইবোন নেই মা। সব তো পাতানো ভাই। মুখে বলা ভাই। লতাপাতার ভাই। ওই মেয়ে আমার বোন হয় কীভাবে? আমার কোন বোন টোন লাগবে না। আমি কারো ভাইও হতে পারব না। অত দায়িত্ব আমাকে দিয়ে পালন হবে না।’

–‘আচ্ছা, আচ্ছা। অত রেগে যাচ্ছিস কেন তুই? ভাই হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে না। তুই শুধু মেয়েটাকে মারধর করিস না। যা অভিমানী মেয়ে! অল্প বয়স। ওর ভালোর জন্য কিছু করলেও সেটা এখন ও বুঝবে না। সেই বয়স ওর হয়নি।’

–‘হুম

চলবে🍁

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা