সুখের পাখি পর্ব-০৮

0
588

#সুখের_পাখি


সাবিনা যখন তনুকে কাল থেকে ইহানের কাছে পড়তে যেতে বলল। কথাটা শুনে তনুর মাথায় আস্ত আকাশটাই যেন ভেঙে পড়ল। এর থেকে ভালো ফুপু আম্মা তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো। সেটা হাসি মুখে মেনে নিতে পারত তনু। কিন্তু ইহানের কাছে পড়তে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। ইজ্জতের ফালুদা করতে চায় না তনু। ইহান জেনে যাবে সে অংকে বত্রিশ পায়। ফেল করা ছাত্রী ও। সাবিনা বলতে থাকে তনু শুনে যায়। মাথা দোলায়। হু হা করে।

–‘শুনছিস না নাকি তনু? ইহানের কাছে কাল থেকে পড়তে যাবি।’

তনু এতক্ষণ ভেবে একটা উপায় পেয়েছে। সে তাৎক্ষণাৎ বলে উঠল,

–‘আমি তো স্কুলে প্রাইভেট পড়ি ফুপু আম্মা।’

–‘পড়লেও ওইটা ছেড়ে দিবি। ইহান অনেক ভালো অংক পারে। সাইন্স নিয়ে পড়েছে ও। তোকে সুন্দর করে বোঝাবে। তখন দেখবি অংকে তোর নাম্বার সত্তর আশির উপরে আসবে।’

তনু বুদ্ধির ঘোড়া ছুটিয়েও আর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। ফুপু আম্মা যেভাবে চেপে ধরেছে। তাতে ওর ছোটা মুশকিল হয়ে যাবে।
তনু ইহানের কাছে পড়তে যাবার ভয়ে রাতে বাবার সাথে কথা বলল। সরাসরি বলতে পারল না। অন্য ভাবে বলল,

–‘বাবা আমরা কবে এই বাড়ি থেকে চলে যাব?’

–‘আমি তো যেতেই চাইছিলাম। গত মাসেই ভাড়া বাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। সাবিনা শুনে অনেক রেগে গেল। ওর কসম দিল। বলেছে আর কোনোদিন এই বাড়ি ছেড়ে যাবার নাম নিলে ওর মরা মুখ দেখব।’

তনু বিড়বিড় করল।

–‘এবার হয়েছে কাজ।’

–‘কিছু বললি?’

–‘না।’

তনু কতক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবল। তারপর বলল,

–‘ফুপু আম্মা আমাকে ইহান ভাইয়ের কাছে প্রাইভেট পড়তে বলছে।’

–‘ভালোই তো। এতে তোরই সুবিধা হবে।’

–‘কচু হবে।’

–‘এমন বলছিস কেন? ইহান পড়াশোনায় অনেক ভালো।’

–‘তাই তো অর্ধেক ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ঝুলে আছে। পুরোটা হতে পারল না। হওয়ার আগেই পড়াশোনাই ছেড়ে দিল। অত ভালো ছাত্র তাহলে মাঝপথে এসে ব্রেক কষলো কেন?’

তনুর এলোমেলো কথা আজ বাবা বুঝতে পারেন না। মেয়ের মাথায় হঠাৎ হঠাৎ পাগলামির ছিট উঠে। তখন যা মুখে আসে তা বলে।

–‘ফুলি আপা, ইহান ভাই কেমন রাগী গো? মানে ওর রাগের ধরনটা কেমন? বকাবকি করে? নাকি মারেও।’

–‘ভাইজানের তো রাগ নাই। আমি তো দেখি নাই। আমি অন্যায় করলে ভাইজান পুরষ্কার দেয়। মাথা খারাপ মানুষ বুঝছো তনু। পাগলাটে। মাথায় পাগলামির ছিট আছে। ওইদিন মাছের পুসকুনি ভাইঙা ফেললাম। আমারে গালি দিল না। চাকরি নট করল না। উল্টা পাঁচশো টেকার কচকচা নোট হাতে দিল। তবে আম্মাজান কয় ভাইজানের নাকি অনেক রাগ। রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না।’

ফুলি গলা খাদে নামাল। তনুর দিকে ঝুঁকে এসে এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

–‘এই বাড়ির বড় সাহেব আছে না। ভাইজানের আব্বা। উনার সাথে ভাইজানের বনিবনা হয় না। আমি কয়েকদিন বাপ বেটার চিল্লাচিল্লি শুনছি। কেউ থেকে কারো গলা কম না। বাপ এক চিক্কার দেয়। পোলা আরও জোরে দুইটা দেয়। বাপের লগে রাগ করেই তো পড়াশোনা ছাড়ছে। গানবাজনা সাহেবের শত্রুর সমান। ভাইজান বাপেরে শিক্ষা দিতে ওইসব জিনিসই ধরছে।’

তনু আজ ফুলি আপার কাছে নতুন খবর পেল। এই কথাগুলো আগে জানত না সে। এই বাড়িতে আসার পর ইহানের বাবার সাথে ওর সম্পর্কের কথা কেউ তনুকে জানায়নি। তনু জানতোই না বাবা ছেলেতে এতো রেষারেষি। তাহলে বাবাকে জ্বালাতে ইহান ভাই পড়াশোনা ছেড়েছে। আর সেদিন তনু বোকার মতো কতগুলো কথা বলল ইহান ভাইকে। উনি পড়াশোনার গুরুত্ব ঠিকই বুঝেন। শুধু রাগে আর জেদের বশে নিজের ফিউচার নষ্ট করছেন। অবশ্য ওর গানের গলাও মাশা-আল্লাহ। নাম করতে পারবে একসময়।

–‘ইহান ভাইয়ের বাবার অনেক রাগ?’

–‘আরে দূর রাগ। ওই বেডা ভাইজানরে দুই চোখে দেখতে পারে না।’

–‘কেন দেখতে পারে না?’

তনুর অবাক লাগল। কোন বাবা আবার ছেলেকে দেখতে পারে না কীভাবে? ইহান ভাই কি ওর নিজের ছেলে না?
ফুলি বলতেই যাচ্ছিল। তখনই তার ডাক পড়ল। ইহান ডাকছে।

–‘ফুলি। এই ফুলি, চা কোথায়? এখনো চা দিলি না। চাকরির মায়া কেটে গেছে নাকি তোর?’

ফুলি তাড়াহুড়ো করে উঠে। ফিসফিস করে বলে,

–‘পরে কমুনে। এহন যাই বুঝছো। নইলে ভাইজান আমার চাকরি নট করে দিবে।’

তনু ভাবনায় পড়ে যায়। এই বাড়ির অনেক কথাই সে এখনও জানে না। ইহান ভাই সম্পর্কে তার এখনও অনেক কিছুই অজানা। ফুলি আপার কাছে ইহান ভাই ফেরেশতার মতো মানুষ। আবার ফুপু আম্মা ওকে রাগী বলে। তনু নিজেও সেটাই ভাবে। তার সাথেও তো একদিন রাগ দেখিয়েছে। তবে সেটাকে রাগ না বলে খারাপ ব্যবহার বললেই ঠিক হবে। পরে অবশ্য সরিও বলেছিল। নিজে থেকে গানও শুনিয়েছে। তনুর ছোট মাথা এতো চাপ নিতে পারে না।

–‘দূর! ইহান ভাই অর্ধেক ভালো। অর্ধেক খারাপ। ৫০% রাগী, বদমেজাজি। ৫০% মিষ্টি স্বভাবের ভদ্র ছেলে।

পরের দিন তনুকে ইহানের কাছে পড়তে যেতে হলো। তনু স্কুল থেকে আসার পর সাবিনা কম করে হলেও একশো বার ইহানের কাছে পড়তে যাওয়ার কথা তনুকে মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। তনু না করার কোন কারণই খুঁজে পাচ্ছে না। আর সে না করলেও ফুপু আম্মা তার কথা শুনবে নাকি?
রাজ্যের দ্বিধা, সংশয়, জড়তা নিয়ে তনু বইখাতা হাতে নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। ইহানের ঘরের সামনে এসে যেন পা পাথর হয়ে যায়। আর এক পা-ও আগাতে পারে না। দরজার সামনেই জমে দাঁড়িয়ে থাকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম হচ্ছে তনুর। তনু বেশ বুঝতে পারছে আজ সে কিছু একটা উল্টাপাল্টা করে বসবে। ইহান ভাইয়ের সামনে ভয়ে জ্ঞান হারালে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে যাবে। সে যে ইহানকে মনে মনে কত ভয় পায় তা শুধু তনুই জানে। কাঁপা হাতে দরজায় টুকা দিয়ে মৃদু গলায় তনু ডাকল।

–‘ইহান ভাই!’

সাথে সাথে ভেতর থেকে ইহানের গলা ভেসে এলো।

–‘কে তনু? এসো।’

তনু তবুও সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে না। একটু সময় এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। থ্রী কোয়ার্টার তো সারাক্ষণ খালি গায়ে থাকে। ঘরে সে জামা গায়ে দিয়ে বসে থাকবে এমনটা ভাবাই যায় না। তনু ইহনাকে একটু দিল। জামাকাপড় পরে নিক।

–‘কী হলো? চলে গেলে নাকি?’

–‘না,না। যাই নি।’

বলতে বলতে তনু ভেতরে এলো। যাক বাবা, ইহান আজ অন্তত খালি গায়ে নেই। কালো একটা টিশার্ট পরে আছে। ফর্সা গায়ে এতো মানিয়েছে! তনু হাঁ করে চেয়ে থাকল। ইহান বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে থাকল। বলল,

–‘বসো। মা বলছিল তুমি নাকি পড়তে আসবে। তা কী নিয়ে পড়ছো?’

তনু ইহানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তার হয়েছেটা কী হ্যাঁ? এরকম পাগল পাগল লাগছে কেন? ইহান উত্তরের অপেক্ষায় আছে। এই মেয়েকে পড়ানো তার জন্য রিস্কের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। অল্পবয়সী মেয়েগুলোর মন কখন কী চায় আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। ইহান এবার কঠিন গলায় ধমকের সুরে বলল,

–‘কথা বলছো না কেন? এরকম বোবা লেগে থাকলে তো তোমাকে পড়ানো মুশকিল হয়ে যাবে।’

চিউচিউ করে তনু বলল,

–‘সাইন্স। সাইন্স নিয়ে পড়ছি।’

ইহান বিরক্ত হলো। মনে মনে বলল,

–‘অংকে বত্রিশ পায় ওই মেয়ে নাকি আবার সাইন্স নিয়ে পড়ছে! ফেল করে আবার কান্নাকাটি করে স্যারের বদনাম করে। স্যার ইচ্ছে করে ফেল করিয়ে দিয়েছে। এই মেয়ে তো সাঙ্ঘাতিক চিজ। দেখা যাবে আমার কাছে পড়ে আমার নামেও বদনাম করে বেড়াচ্ছে।’

–‘বিছানায় বসো। আজ প্রথম দিন। পড়াব না আজ। পড়াশোনা কাল থেকে শুরু হবে। শোনো, আমার কাছে পড়ার সময় কোন তিড়িংবিড়িং চলবে না। যেটুকু সময় পড়তে আমার কথা শুনতে হবে। পড়ার সময় আমি তোমার স্যার বুঝলে। চেনা মানুষ তাই এটা ভেবো না যে পড়া না পারলে ছাড় দেব তোমাকে। আমার অনেক রাগ জানো তো? রেগে গেলে তোমার পিঠে বেতও ভাঙতে পারি। ধমকের আগেই যে কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে ফেলতে তেমনটা মোটেও চলবে না।’

তনু ঢোঁক গিলল। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। ওই বুইড়া শয়তানই তো ভালো ছিল। নতুন করে এই আজরাইলের হাতে পড়ল। তনুর কপাল এতো খারাপ কেন? শিক্ষক ছাত্রীর ভালোবাসা নিয়ে কতো গল্প উপন্যাসই তো পড়েছে সে। তনু মনে মনে বলল,

–‘আমার কপালে হয় বুইড়া টাকলা স্যার জুটবে। যে আমাকে ফেল করিয়ে দিবে। নয় ফুপু আম্মার থ্রী কোয়ার্টার ছেলে জুটবে। একটা সুন্দর ভালো মানুষ কেন আমার স্যার হতে পারে না?’

–‘পানি খাবে তনু?’

–‘হ্যাঁ! না, না। পানি খাব না।’

–‘আচ্ছা। বই বের করো তো দেখি তুমি কতটুকু পারো। আর কেমন পারো।’

তনুর এই মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু উপায় নেই। পালাতে সে পারবে না। আর পালালেও কাল তো আবার আসতেই হবে।
ইহান বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে এমন একটা ভাব করল যেন সে আগে থেকে তনুর ফেল করার কথাটা জানে না।

–‘পরীক্ষা না দিয়েছিলে। রেজাল্ট দিয়েছে?’

হায়, হায়! রেজাল্টের কথা শুনে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তনুর। এখন কী বলবে? কীভাবে বলবে, ইহান ভাই আমি ফেল করেছি। ফেল্টুস ছাত্রী আমি। আপনার ছাত্রী একটা ফেলুরি স্টুডেন্ট। যে অংকে একশো থেকে মাত্র বত্রিশ পায়। এক নাম্বারের জন্য ইজ্জত হারায়।’

তনুর মুখের অবস্থা দেখে ইহানের মজাই লাগছে। ভেতরে ভেতরে হাসছে সে। মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ইহান সরাসরি তনুকে দেখছে না। আড়চোখে দেখছে। তনু তো তার দিকে তাকাচ্ছেই না। ভুলেও তাকালে ইহান চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।

–‘কী হলো? রেজাল্ট দেয়নি!’

–‘দিয়েছে।’

–‘অহ। কোন সাবজেক্টে কত পেয়েছ?’

তনুর এখন কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে। জীবনে কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে সে! লজ্জা পেতে পেতে মরে গেলে এই দায় কে নিবে?
কাঁদো কাঁদো মুখ করে তনু মাথা নুইয়ে বসে আছে।
ইহান অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল,

–‘ইংরেজিতে কত পেয়েছ?’

–‘ঊনআশি।’

–‘বাহ! এক নম্বরের জন্য এ’প্লাস মিস। আরেকটু ভালো করে পড়লে এ’প্লাস পেয়ে যাবে। আর অংকে?’

তনু যদি ম্যাজিক জানতো তাহলে এক্ষুনি অদৃশ্য হয়ে যেত। আর কখনও ইহানের সামনে পড়ত না। কক্ষনো না।

–‘অংকে কত পেয়েছ তনু?’

ইহান নাছোড়বান্দা। আগে থেকে জেনেও মেয়েটাকে লজ্জা দিচ্ছে। এমনটা করতে ভালো লাগছে তার। তনুর লজ্জা রাঙা মুখ, অপমানে নুইয়ে ফেলা মাথা, দুঃখে কষ্ট ছলছল করা চোখ। সব মিলিয়ে এইভাবে তনুকে দেখতে ইহানের ভালো লাগছে। মায়া লাগছে মেয়েটার উপর। আবার ওকে জ্বালানোর লোভও সামলাতে পারছে না।

–‘বত্রিশ।’

ইহান আর কথা বাড়াল না। সে বুঝতে পারছে আরও কথা বাড়ালে তনু এখন কেঁদে ফেলবে। মা যদি জানতে পারে প্রথম দিনই ইহান তার আদরের ভাইঝিকে কাঁদিয়েছে তাহলে তার নিজের কপালেও খারাবি আছে। তাই তনুকে আর না ঘাঁটিয়ে ইহান ছোট্ট করে বলল,

–‘অহ।’

চলবে🌼

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা