সুখের সন্ধানে পর্ব-২১+২২

0
281

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২১

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মিথিলার বাবার দিকে। মনে মনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম ওর চোখের ভাষা পড়ে। এমনভাবে কড়া করে কোনোদিন আমার সাথে কথা বলেছে মনে পড়ছে না। সংসারের প্রতি উদাসীন থাকার কারণে টুম্পা মাঝেমাঝে কান্নাকাটি করে যখন ওর নামে নালিশ করত তখন অনেক সময়ই আমি আসাদকে বকেছি, কড়া করে কথা বলেছি। কিন্তু প্রত্যুত্তরে সে এভাবে কোনোদিনই রিয়্যাক্ট করেনি। আমাকে যথেষ্ঠ সম্মান দিয়েই সে কথা বলেছে। আমি ভাবলাম সেই সময়কার আসাদ আর এই আসাদের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য । সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক বদলে গেছে। তাই সেই অধিকারবোধের জায়গা এখন আর আমার নেই। এজন্য খুব ঠাণ্ডাভাবে ব্যাপারটাকে হ্যান্ডেল করতে হবে। নয়ত কিছুতেই মেহরাবকে নেওয়া যাবে না। উলটো মিথিলাকেও যেতে দিবে না আর। আর সেক্ষেত্রে আমার জোর খাটানোর আর কোনো অধিকারও থাকবে না।

আসাদ ঘরে ঢুকেই পারুলের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে বসে কী দেখছ? আপার জন্য রান্নাবান্নার আয়োজন করো। রাতে খেয়ে যাবেন আপা। আপা খাসির মাংস আর ইলিশ মাছ খেতে খুব পছন্দ করেন। ফ্রীজে কি খাসির মাংস , ইলিশ আছে? না থাকলে বলো নিয়ে আসি।

পারুল আস্তে করে বলল, আছে। আমি এখনি রান্না বসাচ্ছি। উনি বলল, এখনি চলে যাবেন বললেন তাই আর রান্নার আয়োজনে যাইনি।

– মানে কী? সে বলল আর তুমি হাত পা গুঁটিয়ে বসে থাকবে? টুম্পা থাকতে আপা কখনোই না খেয়ে এ বাড়ি থেকে যান নি। যত ব্যস্তই থাকুক টুম্পা তাকে না খাইয়ে যেতে দেয়নি। আজ ভুল করেছ কিন্তু আর কখনো আপা আসলে তার অনুমতির অপেক্ষা করবে না।

পারুল আর কোনো কথা না বলে কিচেনের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। আমি আসাদকে বুঝতে চেষ্টা করছি । ওর মধ্যে আসলে চলছে কী? আসাদকে দেখতে আগের থেকে অনেক বয়স্ক মনে হচ্ছে। মাথার চুলগুলি সব পেকে গেছে প্রায়। আসাদ খানিকক্ষণ মিথিলার সাথে কথাবার্তা বলে এসে আমার সামনের সোফায় বসল। আমি ওর ব্যবসায় বাণিজ্য আর শরীরের খোঁজখবর নিতে নিতে এক ফাঁকে মেহরাবের কথা তুলতেই বলল,

– আপা, আমি আপনার দুশ্চিন্তা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপা, আমি তো এখনো বেঁচে আছি। মেয়েটাকে নিয়ে গিয়েছেন। আমি অনেক ভেবে দেখেছি মিথিলার পাশে এ সময় ওর মায়ের প্রয়োজন। মাকে ছাড়া মেয়েদের জীবন চলার পথ খুব কঠিন। আমি কখনোই ওর মায়ের অভাব পূরণ করতে পারব না যেটা হয়ত কিছুটা হলেও আপনি পারবেন। তাই মেয়েটাকে আমি আপনার সাথে যেতে দিয়েছি। টুম্পা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তাই ঘরে আসতেই মন চায় না। আরেকদিকে মিথিলাও নেই। নিজের বাসাতেই নিজেকে অচেনা মনে হয়। তাও নিজের কষ্টটাকে কিছুটা হলেও ভুলে থাকি যখন মেহরাবের মুখখান দেখি। ওরা দু’ভাইবোনই দেখতে মায়ের মতো হয়েছে। ওদের দিকে তাকিয়ে আমি টুম্পাকে খুঁজে বেড়াই। আপনি যদি মেহরাবকেও মিথিলার মতো আমার কাছা থেকে দূরে সরিয়ে দেন তবে আমার কী উপায় হবে একবার ভেবে দেখুন! বাকী যে ক’টা দিন আছি একটু ভালো করে বাঁচতে চাই আপা। ওরাই তো আমার অক্সিজেন।

আসাদের কথা শুনে দু’চোখ ভিজে এল আমার। আমি কোনোরকম করে নিজেকে সংবরণ করে বললাম, আমি বুঝিরে, ভাই। কিন্তু এটা কিন্তু স্বার্থপরের মতো করে বললে তুমি? তোমার নিজের একটু ভালো করে বেঁচে থাকার জন্য ওদের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারো না।

– আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন । সবাই বলে আমি নাকি আর ওদের বাবা নেই, তালুই হয়ে গেছি। আমার বিছানায় মৃত্যুশয্যায় প্রহর গুনতে থাকা মাও কাল আমাকে এ কথাই বলল। আমি শুধু শুনেছি কিছু বলতে পারিনি। হ্যা, সত্যিই তো আমি তালুই হয়ে গেছি। আমি অপারগ বাপ ওদের। বলতে বলতে চোখের কোণের ভেজাভাব লুকাতে সে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছল।

পারুল এটা সেটা নেয়ার অজুহাতে বারবার ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়িয়ে কালক্ষেপণ করছে । আমি তলচোখে তাকিয়ে খেয়াল করছিলাম ব্যাপারটা। ওবশ্য ব্যাপারটা আসাদেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে মনে হচ্ছে।

– উফ , আপা! আজ যা গরম পড়েছে। এখানে রান্নাঘরে চুলা জ্বলবার কারণে আরো গরম লাগছে। আমাদের রুমে চলেন না। এসি দিয়ে বসে কথা বলি, প্লিজ!

আমি বুঝতে পারলাম আসাদ আসলে এখান থেকে পারুলের আড়ালে যেতে চাচ্ছে। আমিও আর আপত্তি না করে ওর পেছনে পেছনে টুম্পার বেডরুমের দিকে গেলাম। টুম্পা চলে যাবার পরে এই প্রথম ওর রুমে ঢুকেছি। ঢুকেই বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হলো। দেয়ালের সাথে টুম্পা আর আসাদের বিয়ের তারিখ টুম্পা নিজের হাতে সেলাই করে লিখে বাঁধাই করে টাঙ্গিয়ে রেখেছিল। সেটা নজরে পড়লো না। রুমের ডেকরশনেও বেশ ভিন্নতা। টুম্পার ব্যবহৃত ওয়্যারড্রব আর ড্রেসিং টেবিলটাও চোখে পড়ল না। খুব অবাক হলাম। সেগুলি তো ব্যাবহার অযোগ্য ছিল না। তবে সেগুলিকে বাদ দিয়ে নতুন কেন? মনের মধ্যে খচখচ করছে খুব। আসাদকে ভাবছি জিজ্ঞেস করব। কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে না কেন যেন আবার। বোনটাই নেই সেখানে স্মৃতির খবর নিয়ে কী আর হবে? বারবার টুম্পার সেই ওয়ালম্যাটটার স্থানে চোখ যাচ্ছিল । সেখানে বেশ বড়সড় একটা রেডিমেড কেনা ওয়ালম্যাট ঝুলছে।
আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে আসাদ বলল, আপা, যেটা খুঁজছেন সেটা স্টোররুমে।

– কেনো?

– বোঝেনই তো ! সংসারটা এখন টূম্পার না পারুলের। কী আজব তাই না? সবকিছু কে করেছে আর কে এসে সব ভোগ করছে?

– তুমি কিছু বললে না?

– কী বলব ,বলেন? কত আর অশান্তি করা যায় ? ঝগড়াঝাঁটি করা আমার ধাঁতে নেই। কোনোদিন টুম্পার সাথেও গলা উঁচিয়ে কথা বলিনি। বলিনি বললে ভুল হবে আসলে আমি পারিই না। এটা আপনি তো জানেনই। কত চেষ্টা করি নিজেকে শোধরাতে কিন্তু কিছুতেই পারছি না। বরং এখন আগের চেয়েও আরো অকম্মা হয়ে গেছি।

– বুঝেছি , একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম আমি। আচ্ছা, এখন মেহরাবের কথা বলো!

– কী বলব? বলেই তো দিয়েছি ,আপা। আমি আমার ছেলেটাকেও মেয়ের মতো কোলছাড়া করতে পারব না।

আসাদের কথায় যুক্তি আছে বুঝলাম। কিন্তু সে মেহরাবকে এত আদরই যদি করবে তবে আবার এভাবে ছেলেটাকে মারছে কেন দু’দিন পর পর সেটা বুঝতে পারছি না।

– এতই ভালোবাসো তবে ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকানোর সুযোগ হয়েছে তোমার? ওর হাল হয়েছে কী?
– দেখেছি আপা! খাওয়া দাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই । রাতভরে ফোন চাপে। ঘুম ঠিকমত না হলে এমনই হয়। এত ছোট মানুষের এত অনিয়ম শরীর নিতে পারেনি।

– খাওয়া হবে কী করে? ছেলেটা একটা দিনও নাস্তা পায় না। এসব কী? টুম্পা থাকতে কী এমন হয়েছে কোনোদিন? তুমি বিয়ে করেছ ওদের যাতে অযত্ন না হয় সেজন্য। কিন্তু এসব কী হচ্ছে? তুমি মেহরাবের গায়ে হাত তুলেছ কার ইন্ধনে আমি কি ভেবেছ বুঝিনি?

আসাদ খানিকসময় চুপচাপ থেকে বলল,

– আপা, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি। আমি কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাইনি। আমার আত্মীয় স্বজন জোর করে বিয়েতে রাজী করিয়েছে। বিয়ের পরে কিছুদিন মনে হয়েছিল দ্বিতীয়বার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম কতবড় ভুল করেছিলাম আমি। পারুলের মন ভালো করার জন্য ওর ছেলেকে এখানে রাখার কথা বললে আমি রাজী হলাম । ভাবলাম ওর মন ভালো থাকলে হয়ত আমার সংসারকে, আমার বাচ্চাদেরকে আপন করে ভাববে। তাছাড়া একটা বাচ্চা মা ছাড়া থাকা কত কষ্টের সে তো আমি নিজের চোখেই দেখছি আমার বাচ্চাদের দেখে। সবকিছু ভেবে রাজী হয়েছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ নেই। বরং এখন উটকো ঝামেলা মাথায় পড়েছে। ছেলেটাকে একদিনও নাস্তা দেয় না , টিফিন থাক দূরের কথা। এই ঝামেলা সেই ঝামেলা বলে সে সকালে উঠেই না। কয়েকদিন রাগারাগি করেছি এ নিয়ে কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হতে থাকে। কারণে অকারণে মেহরাবকে নিয়ে অভিযোগ করতেই থাকে। পরে এটার হাত হতে নিস্তার পেতে মেহরাবকে টাকা দিয়ে দেই দোকানে খাওয়ার জন্য। এছাড়া আর আমি করবই কী বলেন!

– সবই যদি বোঝ তবে ওর গায়ে হাত তুলছ কেনো?
– মিনিটে মিনিটে ওর বিরুদ্ধে নালিশ শুনতে শুনতে আমি তেতো তেতো হয়ে গেছি। সারাদিন কাজের টেনশানের মধ্যে থাকি। এমনিতে মনে হয় টুম্পা চলে যাবার সময় হয়ত আমার ভাগ্যের চাবিকাঠিও সাথে করে নিয়ে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা তেমন ভালো না। আশেপাশে আরো কয়েকটি ফ্যাক্টরি উঠেছে। আমার সেকেলে যন্ত্রপাতি দিয়ে ওদের আধুনিক ফিটিংসের ফ্যাক্টরির প্রডাকশান , কোয়ালিটির সাথে পাল্লা দিয়ে এগুতে পারছি না। অর্ডার কমে যাচ্ছে দিন দিন। কোনোরকম টিকে আছি। বাড়িটা নিজেদের বলে এখনো কিছু আয় হচ্ছে । ভাড়া দেওয়া লাগলে কী যে হতো! নিজের খামখেয়ালিপনার কারণে চাকরিটা হারালাম। এখন এটাও যদি হারিয়ে ফেলি তবে একদম পথে বসতে হবে। সীমিত আয়ে সংসার চালাতে হয়। কিন্তু এটা পারুল একদমই মেনে নিতে পারে না। তার আগের স্বামী আগে তার কাছে বাণ্ডেল বাণ্ডেল নোট পাঠাতেন সৌদি থেকে, সেই গল্প সকাল বিকাল খোঁটা দিয়ে শোনাতে তার একটুও দেরি হয় না। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভুগি সারাক্ষণ। এর মাঝে যদি মেহরাবের নালিশ শুনতে হয়! তার উপর মেহরাবের পড়াশুনায় একদমই মন নেই । বাসায় এসে টিচার পড়িয়ে যায় কিন্তু তার মাথায় কিচ্ছু নাকি ঢোকে না। পরপর তিনটা পরীক্ষায় ম্যাথে ফেল করেছে। এসব শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায় একদম। কিন্তু তারপরেও যদি বিবেক হতো! সারারাত সারাদিন গেমস নিয়ে পড়ে থাকে। ওই সাদমান ছেলেটাকে এটা সেটা নিয়ে খোঁটা দেয় সে। কিছু ধরতে দিতে চায় না। এ নিয়েও নাকি নিজেদের মাঝে হূলস্থুল কাণ্ড করে। আর সাদমানকে সে সহ্য করতে না পেরে ওর ছোট মাকেও সহ্য করতে পারে না। তাকে নানান আজেবাজে কথা বলে আজকাল। সব শুনে শুনে আর কন্ট্রোল করতে পারি না নিজেকে। কী করব বলুন আমিও তো মানুষ! সব রাগ যেয়ে ওর উপরে ঝাড়ি। আর ও যে আমাকে কেন বোঝে না সেটাই বুঝি না। কেন যে কাজ নিষেধ করি সেসব কাজই করে?

– ওর বয়সটাই এখন এমন। তোমাকে বুঝতে হবে। তাছাড়া ওর জীবনের উপর দিয়ে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল। নিজেকে সেট করতে পারছে না এই পরিবেশে। তুমি যেহেতু বুঝতেই পারছ যে পারুলকে এ সংসারে রাখা মানে ঝামেলা কমানো নয় বরং বাড়ানোই তবে এখনো ওর সাথে রিলেশান রাখছ কেন? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ওর সাথে বাকী জীবনেও কখনো সুখী হতে পারবে না।

– আমি জানি আপা।

– তাহলে আবার কী?

– একটা সমস্যা হয়ে গেছে, আপা। আমিও নিজে একটা বেশ বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম মনে মনে। কিন্তু….

– কিন্তু কী? থেমে গেলে কেন? পারুল কি সন্তান সম্ভবা?

– একটু আমতা আমতা করে আসাদ বলল, জি আপা। আমি আসলে এমন টা চাইনি। আমি এবোরশান করানোর কথা বললে সে কিছুতেই রাজি না। আমি তো তার ব্যাপারটা বুঝি। আমি একদম হাত পায়ে শেকল পরার মতো অবস্থায় আছি। না পারছি ফেলতে , না পারছি গিলতে।

– আমি কিছুসময় চুপচাপ থেকে বললাম, তাইলে কী আর করা! ফেলার যেহেতু অপশন নেই যত তেতোই হোক এবার গিলতেই হবে। আচ্ছা, এবার তোমার সমস্যা বুঝলাম। কিন্তু মেহরাবকে তুমি দিতে চাচ্ছ না কেন?

– আপা, একজন তো আছেই আর কত ঝামেলা বাড়াবেন?

– ওরা আমার কাছে ঝামেলা হবে কেন? ওরা তো আমার সন্তান! আমি মোটেই ঝামেলা ভাবি না।

– জানি আপা। আপনি আছেন বলেই নিশ্চিন্তে আছি ওদের নিয়ে। মাঝেমাঝে তো পারুলের অত্যাচারে মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছি। বুঝি না কেন যে আমার আগে টুম্পাকেই যেতে হলো? আমি যেতাম। আল্লাহ আমাকে দেখল না? আজ আমি না থাকলে আমার দশটা বাচ্চা থাকলেও টুম্পা ঠিকই ম্যানেজ করতে পারত। আর আমি?

– মন খারাপ করে আর কী হবে! আল্লাহর সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তুলবার কী সামর্থ্য আমাদের? মানকে শান্ত করো। তুমি মেহরাবকে যাবার অনুমতি দাও। ও যেতে চাইছে । দু’ভাইবোন একসাথে থাকবে। এত বড় বাড়ি আমার । কোনো অসুবিধাই হবে না।

– আপা, একেক করে তো সেটাই হচ্ছে যেটা পারুল চাইছে। মিথিলা চলে গেল এখন আবার মেহরাবও যদি চলে যায় ! এভাবে সে জিতে যাবে?

– সেও তোমার বাচ্চার মা হচ্ছে। তাই তাকেও দেখেশুনে রাখো। সব মানুষ একরকম হয় না। হার জিতের কিছু নেই। মাথা ঠাণ্ডা করো। এখানে থাকলে মেহরাব কতটা মানসিক অত্যাচারের মধ্যে থাকবে বুঝতে পারো? সারাদিন তুমি থাকো না। ওই মা ছেলের মধ্যে ওকে থাকতে হয়। আর তুমিও ওকে ভুল বোঝ! ওর দিকটা ভেবে দেখ , প্লিজ! তাছাড়া ওরা একটু ম্যাচিউর হলেই আমি এখানে পাঠিয়ে দিব। তখন আর কেউ ওদের সাথে মিসবিহেভ করার সাহস পাবে না।

আসাদ কোনো কথা বলছে না। আসাদকে একদম চুপচাপ দেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম! ওকে ভাবার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।

রাতের খাবার দাবার শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। মেহরাবের মন খুব খারাপ। তেমন কিছু খায়ও নি। মিথিলারও একই অবস্থা। আসাদের রায়ের অপেক্ষায় আছি। জানি না সে কী বলবে! তবে আমার বিশ্বাস যে ভেবেচিন্তে ছেলের ভালোটাই নিশ্চয়ই বেছে নিবে।

আমি আর মিথিলা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আসাদ মেহরাবের উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার যা যা নেওয়া দরকার প্যাক করো। মিথিলা সাহায্য করো মেহরাবকে। ও তোমাদের সাথেই যাচ্ছে।

আমি আসাদের এমন সিদ্ধান্তে ভীষণ খুশি হলাম। যাক, অবশেষে সে বুঝতে পেরেছে। মিথিলা আর মেহরাবের এ কথা শুনে প্রথমে খুব খুশি খুশি ভাব হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন কালোমেঘে ছেয়ে যায় ওদের চেহারা। আপন আঙিনা ছেড়ে যাওয়া এত সহজ কি? মায়ায় মাখা প্রতিটি মুহূর্তকে ধূলায় মিশিয়ে অন্য ভুবনে মিশে যাওয়ার মাঝে কোনো সুখ থাকে না। তাই ওদেরও নেই। মুহূর্তেই বিষাদের কালো ছায়ায় ভরে উঠল পুরো পরিবেশ। পারুল কিছুটা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও আমার বুঝতে আর বাকী নেই তার অন্তরের কথা।

বাপ ছেলের জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছি না একদমই। হায়রে নিয়তি!

বাসায় পৌঁছে দেখলাম প্রিয় তখনো ফেরেনি। ওর বাবা মনে হয় রুমে। আমি ওদেরকে নিয়ে আমার শাশুড়ির রুমে গেলাম। উনি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার সাথে মেহরাবকে দেখে খানিকটা অবাক হলেন।

– এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সরি, আম্মা।

– না , না! ঠিক আছে। এই যে মিথিলার ভাই না?

– জি আম্মা। ওকে নিয়ে এলাম। এখানেই থাকবে আজ থেকে। কোনো সমস্যা নেই তো আম্মা? সৎ মায়ের সংসার বোঝেনই তো! খুব কষ্টের মাঝে থাকছে । আমি সহ্য করতে না পেরে আপনার অনুমতি না নিয়েই নিয়ে এসেছি। কারণ আমি জানি আপনি কখনোই না করবেন না।

– আমার শাশুড়ি আস্তে করে বললেন, না , সমস্যা আর কী! এত বড় বাড়ি, একজন মানুষের জন্য আর কতটুকুই বা লাগবে। যাও ওকে একটা রুম দিয়ে দাও।
আম্মার কথা শুনে বুকের উপর থেকে যেন পাথর নেমে গেল। এবার সেলিমকে নিয়ে চিন্তা। প্রিয়কে নিয়েও যে চিন্তার শেষ নেই তা নয়। তারপরেও আমার বিশ্বাস ওকে বুঝিয়ে বললেই বুঝবে।

চলবে…

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২২

আপাতত গেস্টরুমে মেহরাবের থাকার ব্যবস্থা করলাম। মিথিলা ওর কাছেই আছে। সেলিম বা প্রিয় কাউকেই দেখছি না। হয়ত রুমেই আছে। প্রিয়র রুমের সামনে থেকে যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম ওর রুমের দরজা দেওয়া । তাই আর নক করলাম না। রুমে ঢুকতেই সেলিম জিজ্ঞেস করল,

– এত দেরি করলে যে? শুনলাম সেই লাঞ্চের পর নাকি বেরিয়েছিলে। আর এখন মিড নাইট।

– সো সরি! একটু দেরি হয়ে গেল। জানোই তো পুরান ঢাকার ওদিকে যেতে আসতে যে জ্যাম ! গাড়িই আগায় না একদমই।

– ওহ, টুম্পার বাসায় গিয়েছিলে?

– টুম্পার বাসা বলছ কেন? ওখানে এখন আর টুম্পার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম আমি।

– এটাই বাস্তবতা। মেনে নিতে শেখো। নতুনের আগমনে পুরাতনের নাম নিশানা গায়েব হবে এটাই স্বাভাবিক।

– হুম! সেটাই তো দেখে এলাম।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ভাবছি মেহরাবের কথা ওকে কী করে বলি। ব্যাপারটা ও কিভাবে নিবে সেটাই বুঝতে পারছি না। সেলিম বিছানার উপরে বালিশে হেলান দিয়ে মোবাইলে স্ক্রলিং করছিল। আমি একটু কাছাকাছি যেয়ে বসে আস্তে করে বললাম,

– তোমাকে না জানিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি। প্লিজ, রাগ করো না। আসলে পরিস্থিতি এমন যে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারিনি। হুট করে ডিসিশান নিয়ে ফেলেছি।

– কী করেছ সেটা বলো।

– মেহরাবকে এখানে থাকবার জন্য নিয়ে এসেছি। এখানকার একটা স্কুলে ভর্তি করে দিব ভাবছি। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকানো যায় না একদম। ওই পারুল ওর একদমই যত্ন আত্তি করে না। যত্ন আত্তি থাক দূরের কথা ওকে একটা দিনও নাস্তা পর্যন্ত খেতে দেয় না। আমি এটা কী করে সহ্য করি বলো!

– বাহ! ভালো করেছ তো! করেই যখন ফেলেছ তখন আর বলার কী দরকার। একসাথে আগামীকাল খাবার টেবিলেই দেখা হতো। ও হ্যা আসাদকেই বা রেখে এলে কেন? ওকে ওর বউ যত্ন আত্তি করছে তো? নাস্তাপানিই কী ঠিকমতো দিচ্ছে কি না খোঁজখবর নিও। আসাদ আসলেও ভালো হতো তাহলে ওকে নিয়েও তোমার দুশ্চিন্তা করতে হতো না। বাচ্চাদের মতো আসাদকেও নিশ্চয়ই দেখে রাখতে বলে গিয়েছে তোমাকে টুম্পা।

খুব খারাপ লাগল সেলিমের এমন কথা শুনে। তার কথার ধরণ আর টোন শুনে আমি বুঝে গেলাম সে মেহরাবকে এখানে আনা একদমই পছন্দ করেনি। না করুক ! আমার এখন সেলিমের এসব গুঁতা মারা কথাবার্তা শোনার সময় নেই। মেহরাবের জন্য এ বাড়িতে জায়গা চাই। সেটা যে করেই হোক! তাই সেলিমের এসব কথা গায়ে লাগানো যাবে না একদমই। আমি মৃদু হেসে তার কথার সাথে সম্মতি জানালাম এমন একটা ভাব করে থাকলাম।

পরেরদিন খাবার টেবিলে মেহরাবকে দেখে প্রিয় কিছুটা অবাক হলো। মিথিলা ভার্সিটিতে চলে গেছে আগেই। মেহরাবের সাথে প্রিয়র তেমন কথাবার্তা বা পরিচয় নেই। দু’ একবার দেখা স্বাক্ষাত হয়েছে এই। হলেও ওদের দু’জনের বয়সের এত পার্থক্য যে ওদের আলাপ খুব বেশি কখনোই হতোই না। কেমন আছ পর্যন্তই সম্পর্ক সীমাবদ্ধ । মেহরাব ভয়ে ভয়ে আছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে । মেহরাবের সাথে প্রিয়র কিছুটা আলাপ চারিতা হলেও সেলিমের সাথে একদমই হলো না। স্বাভাবিক রাখার জন্য আমি মেহরাবকে এটা সেটা তুলে দিচ্ছি। কিন্তু সে ভয়ে কিছুতেই খেতে পারছে না যেন!

খাওয়ার মাঝে হঠাৎ সেলিম বলে উঠল, মেহরাব তো দেখছি বেশ বড় তাইলে ! লম্বায় তো আমাকে ধরে ফেলবে আর দু’এক ইঞ্চি হলেই। তোমার কথা শুনে আমি তো ভেবেছিলাম এখনো বাচ্চা ছেলে রয়ে গেছে হয়ত। এত বড় ছেলেকে কী করে ওর স্টেপ মাদার টর্চার করে? তোমার তো নিজেকে নিজের প্রটেক্ট করতে পারার কথা! তোমার বয়সের অনেক বাচ্চারা তো আজকাল পুরো সংসারের হালই ধরেছে । আর তুমি নিজেকেই প্রটেক্টই করতে পারছ না। এভাবে কতকাল সাপোর্ট নিয়ে চলবে? পৃথিবীটা এত সহজ নয়। দু’মুঠো ভাতের জন্য কত যুদ্ধ করতে হয় বুঝতে শেখা উচিত তোমার। তবেই জীবনের মানে বুঝবে।

কথাগুলিতে মেহরাবের কতটুকু কষ্ট লেগেছে জানিনা কিন্তু আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। সেলিম যে মেহরাবকে সহজভাবে নিবে না সেটা আমি এবার পুরোপুরি নিশ্চিত। ওকে এখানে রাখতে আমার বেশ বেগ পেতে হবে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমাকে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
প্রিয়র সাথেও তেমন কথা হলো না মেহরাবের। আমি চেয়েছিলাম ওদের আলাপ চারিতা হোক। কিন্তু ছেলেটা ভয়ে একদম জড়সড় হয়ে আছে। প্লেটের খাবার কমছেই না। আমি ওর ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করছি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ মায়া হলো। আল্লাহর কাছে জানতে মন চাইছে এই বাচ্চাটা কী অন্যায় করেছে ? কেন ওকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে? চোখটা ভিজে উঠল। তাড়াতাড়ি করে চোখের পানি গোপণ করলাম।

সেলিম আর প্রিয় চলে যাবার পর আমি আম্মার রুমে যেয়ে খানিকসময় কাটিয়ে মেহরাবের রুমে গেলাম। মন খারাপ করে ছেলেটা বসে আছে। মেহরাব খুবই সেন্সিটিভ ধরণের ছোট থেকেই। ও অল্পকথায়ই অনেক কিছু বোঝে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

– কি ব্যাপার বাবা! নতুন পরিবেশে ভালো লাগছে না ? নাস্তাটাও খেলি না ঠিকঠাক।

– আজকাল নাস্তা খাওয়ার অভ্যাস নেই তো তাই ক্ষুধা ছিল না , রূম্পা মা!

– আহারে! সোনাবাচ্চা আমার! কত কষ্ট করেছে এতদিন। আর কোনো কষ্ট হবে না , বাবা। এক মা চলে গেছে আরেক মা তো এখনো বেঁচে আছে ।

– আংকেল আর ভাইয়া আমার এখানে থাকাটা কী পছন্দ করছেন না, রূম্পা মা ?

– আরে না ! কে বলল তোকে? তোর আংকেল এমন করেই কথা বলে। উনি বলল বিধায়ই তো তোকে নিয়ে আসলাম এ বাড়িতে।

– ওহ! আমি ভাবলাম!

– আচ্ছা, এসব চিন্তা বাদ দিয়ে রেডি হয়ে নে দ্রুত। আমরা নতুন স্কুলের খোঁজখবর নিতে বের হবো। আমি অলরেডি কয়েক জায়গায় কথা বলে রেখেছি। তোর যে স্কুল পছন্দ হবে সেটাতেই ভর্তি করব।

– আমার খুব ভয় হচ্ছে। নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু!

– এটাকে ভয় বলে না , বোকা ছেলে। বল টেনশান হচ্ছে। দু’চারদিন যেতেই দেখবি সব ওকে হয়ে গেছে।

আজকাল প্রিয় একটু কেমন যেন দূরে দূরে থাকে। ডাইনিং টেবিলে আগে খাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ বসত। কিন্তু এখন একদমই অপেক্ষা করে না। আমি কিছুদিন ধরে মেহরাবকে নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি। নতুন একটা স্কুলে ভর্তি করার পরে কম কাজ তো থাকে না। তাই প্রিয়র সাথে বসে একটু কথা বলা হয় না। তবে এটা আমার নজরে এড়াচ্ছে না যে প্রিয় আজকাল খুব ব্যস্ত কিছু একটা নিয়ে।

আজ মেহরাবের স্কুলের সব ধরনের ফর্মালিটি মোটামুটি শেষ। তাই নিজেকে খুব রিলাক্স মনে হচ্ছে। মেহরাবও এই ক’দিনে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। মিথিলা যেমন একদমই সেলিমের সামনে আসে না মেহরাব ঠিক তার উল্টো। ও সব সময় খেতে বসবে সবার সাথে। টেবিলে একদমই কথা হয় না সেলিমের সাথে ওর। যা বলার দু একটা প্রিয়র সাথে হয়। আমার শাশুড়িরও ওকে নিয়ে আসা মনে হচ্ছে খুব একটা পছন্দ হয়নি। দেখা হলে দায় সারা দু’একটা কথা বলে। এটা অবশ্য উনাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বেশিরভাগ শশুর বাড়ির মানুষের ন্যাচারই এমন। উনাদের পক্ষের গাদাগাদা মেহমান এসে বছরের পর বছর থাকবে, বউ রান্না করে তিন ওয়াক্তের জায়গা ছয় ওয়াক্ত খাওয়ালেও কোনো দোষ নেই। সেটা নিয়ে বউ উহ শব্দও করা যাবে না , কিন্তু বউয়ের বাপের বাড়ির কেউ এসে থাকলে সেটা হজম করা বেশ কষ্টের ।

রাতে ফ্রি হওয়ার পরে প্রিয়র রুমে নক করলাম। ও দরজা খুলছে না দেখে আমি নিজেই দরজার নবে মোচড় দিতেই দরজা খুলে গেল। তার মানে ভেতর থেকে দরজাটা লক করা ছিল না। রুমে ঢুকে দেখলাম মেহরাব কারো সাথে ভিডিওতে কথা বলছে। দরজার দিকে পিঠ করে থাকায় আমাকে দেখতে পায়নি। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম একটা মেয়ে ওর সাথে হাসি হাসি মুখে কথা বলছে। প্রিয় কথা বলায় এতটা ব্যস্ত যে পেছন থেকে যে আমি রুমের মধ্যে ঢুকে পড়েছি সেটা আর তার একদমই খেয়াল নেই। কানে হেডফোন গুঁজে থাকাতে আমি কথা শুনতে পাচ্ছি না।
আমি ওকে কিছু না বলেই ওর বিছানায় এক পাশে বসলাম। একটু বাদেই প্রিয়র আমার দিকে চোখ গেল।

সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো । নিবিষ্ট মনে একাগ্রচিত্তে ফোনে কথা বলা এবং আমাকে দেখার পরে হন্তদন্ত হয়ে ফোন কেটে দেওয়া এই দুয়ের মাঝে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছি আমি।

– আম্মু, তুমি? তুমি এখানে কখন এলে? কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, প্রিয়।

– এইতো! দরজা নক করেছিলাম কিন্তু তুমি দরজা খুলোনি তাই নবে মোচড় দিতেই দরজা একাই খুলে গেলো । কার সাথে কথা বলছিলে এত মনোযোগ দিয়ে?

– না, মানে আম্মু! ও বিন্দু। আমার এক ফ্রেন্ড।

– বিন্দু ? একসাথে পড়াশুনা করো?

– একসাথে ঠিক না। ও অন্য ডিপার্টমেন্টে তবে আমাদের ভার্সিটিতে। আমার দুই ব্যাচ জুনিয়র।

– তবে সে আবার ফ্রেন্ড কী করে? নাকি অন্য কিছু, বাবা?

– তেমন কিছু না, আম্মু। হলে তোমাকেই আগে জানাব টেনশান করো না।

– তবে কেমন কিছু?

– ওর সাথে কথা বলতে ভালোই লাগে। খুবই জলি মাইন্ডের মেয়ে। তোমার মন খারাপ থাকলে দুই মিনিট ওর সাথে কথা বললেই মন ভালো হতে বাধ্য। খুবই হাসিখুশি ।

– বাহ , ভালো তো! তা বিন্দু তো ঢাকাতেই থাকে তাই না?

– পড়াশুনার জন্য ঢাকাতেই থাকে ফুফুর বাসাতে। তবে ওদের বাড়ি কক্সবাজারে। ওখানে ওর দাদাবাড়ি। কিন্তু ওর বাবা মা থাকেন চিটাগংয়ে।

– কী করেন ওর বাবা?

– উনি পোর্টে জব করেন।

– ক’ভাই বোন ওরা?

– তিন ভাই বোন ; ওর পরে দুই জন ভাই।

আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম বিন্দুর সাথে প্রিয়র সম্পর্কটা আসলে কোন ধরণের! মনে হয় কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি ওর কথাবার্তা শুনে।

– হুম! বুঝতে পারলাম!

– কী বুঝলে?

– বুঝলাম কেন আজকাল আমার ছেলে খুব ব্যস্ত থাকে । কেন তড়িঘড়ি করে রুমে চলে আসে।

– তুমি যেমনটা ভেবেছ তেমন কিছুই না আম্মু।

– আচ্ছা, মেয়েটাকে একদিন নিয়ে এসো তো!

– আচ্ছা, সে না হয় আনব। কিন্তু , তুমি আবার উলটাপালটা ভেবে আব্বুর কানে দিও না।

– তোমার আব্বুর কানে কেন দিব? সে কেমন তা তো জানোই। সবকিছুতে ওভার রিয়্যাক্ট করে।

– থ্যাংক ইউ , আম্মু। এখন কেন এসেছ বলো।

– তেমন কিছুই না। তোমার সাথে কথাই হয় না তাই এসেছিলাম। এমনি জরুরি কিছু না।

প্রিয়র রুম থেকে বের হতে হতে মনে মনে ভাবছি সত্যিই যদি ছেলেটা ওই মেয়েটাকে ভালোবাসে তবে তো বিপদ হয়ে যাবে। সেলিম জীবনেও এমন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে দিবে না। শুধুই সেলিমই না আমার শ্বাশুড়িও রাজি হবেন না। এদের কাছে মানুষের মূল্য এখনো টাকা দিয়েই হয়। আমি চাই না এই সংসারে আরেকজন রূম্পা আসুক যে সারাজীবন আমার মতোই হীনমন্যতায় ভুগবে । আজ প্রিয় পাগল হয়ে বিয়ে করবে কিন্তু ক’দিন বাদে পাগলামী যখন কেটে যাবে ঠিকই তখন বাপের মতো নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে পস্তাবে। তাই এ ধরণের সম্পর্ক শুরুতেই শেষ করা ভালো। প্রিয়কে বোঝাতে হবে এসব নিয়ে। এই নিয়ে না বাবা ছেলের মাঝে আবার কোনো ক্লেশ সৃষ্টি হয় সেই ভয় পাই আমি। সেলিম যখন আমাকে বিয়ে করার কথা বলেছিল তখন আমার শাশুড়ি রাজি না থাকলেও সেলিমের বাবা রাজি ছিলেন। কিন্তু এখানে সেলিমই কখনই রাজি হবে না। বাপ ছেলে দু’জনই জিদ্দি। কেউ কাউকে এ ব্যাপারে ছাড় দিবে না একদমই । খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম।

প্রিয়র রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালাম। সেলিম বেশ উচ্চস্বরে কারো সাথে কথা বলছে। কী হয়েছে জানার জন্য দ্রুত সেখানে পৌঁছাই ।

“এতরাতে কেন টিভি দেখতে হবে? তাও আবার এত লাউড সাউন্ড দিয়ে। পড়াশোনা কিছু কি নেই? এত টাকা খরচ করে যে ভর্তি করেছে তোমার খালা সেদিকে কি হুশ আছে?
এমনিই কী আর তোমার স্টেপ মাদার মিসবিহেভ করে তোমার সাথে। দাও, রিমোট দাও। আর রুমে যাও। পড়াশুনা করো। যত্তসব! “

কথাগুলি বলতে বলতে সেলিম প্রায় ছিনিয়ে নেবার মতো করে মেহরাবের হাত থেকে টিভি রিমোটটা টেনে নিলো। মেহরাবের তো এতক্ষণে ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম। সে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল ।

আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিলাম। মানুষটা কোনোদিনই বদলাবে না। মেহরাব আর মিথিলাকে দেখলেই যেন ওর গায়ে জ্বালা ধরে যায়। মিথিলা ব্যাপারটা বুঝে বলে সে পারতপক্ষে সেলিমের মুখোমুখি হয় না। কিন্তু মেহরাব এতকিছু হয়ত বুঝতে পারে না তাই মিথিলার মত আত্মগোপণে থাকতে পারে না। তাছাড়া মিথিলা মেয়ে মানুষ। মেয়েদের চার দেয়ালে বন্দী থাকায় কোনো সমস্যা নেই। মেহরাবের জন্য থাকাটা সত্যিই খুব কষ্টের।

আমি সেলিমকে কিছু বলতে বা জিজ্ঞেস করতে গেলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। বেশি কিছু হলে সরাসরি বলবে ওদের বাসায় পাঠিয়ে দিতে। তখন আবার আরেক বিপদ।

আমি মেহরাবের রুমে গেলাম। যেয়ে দেখি মাথা নিচু করে টেবিলে একটা বই খুলে নিয়ে বসে আছে। পড়াতে যে মনোযোগ নেই সে ওর চোখ দেখেই বুঝতে পারছি। আমাকে দেখেও চুপচাপ বসে আছে। আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম, কি রে বাবা! আংকেলের কথায় রাগ করেছিস? আংকেল কিন্তু তোর ভালোর জন্যই বলেছে। বেশি বেশি পড়াশুনা না করলে ভালো রেজাল্ট হবে কী করে? আম্মুর মনের আশা পূরণ করতে হবে না? অনেক বড় হতে হবে বাবা।

আরো কিছুক্ষণ ওকে ভালোমন্দ বুঝিয়ে আমি রুমে চলে এলাম।

সেলিমও ততক্ষণে রুমে এসেছে । সোফায় হেলান দিয়ে ফেইসবুকিং করছে মনে হলো।

– কী ব্যাপার ! এত তাড়াতাড়ি টিভি দেখা শেষ?

– হুম! গম্ভীরভাবে বলল সেলিম।

– ছেলেটাকে ওভাবে ধমক না দিলেও পারতে!

– কমপ্লেইন করেছে নাকি?

– নাহ! আমি নিজেই শুনেছি। ওর সাথে ভালো করে কথা বললে কি খুব কষ্ট হয়? খেয়াল করছি ও আসার পর থেকেই তুমি পায়ে পায়ে ওর ভুল খুঁজে বেড়াচ্ছ! এটা কি ঠিক ? ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে না হলে বলো না। জানো তো কাউকে পছন্দ না হলে তার পদে পদে দোষ খুঁজে পাওয়া খুব বেশি স্বাভাবিক।

– তোমার কাছ থেকে আমার আচার আচরণ শিখতে হবে? তোমার ভাগ্নে ভাগ্নীকে ঠিকঠাক করে চলতে বলো।

– আচ্ছা, ঠিক আছে! তোমার সাথে কথা বলাই বৃথা। বলে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

সেলিমের সাথে শেষ কবে ঝগড়া করেছি মনে নেই। প্রতিদিনই ঝগড়া করার মতো ইস্যু তৈরি হয়। আমি নিজেকে বড় কষ্টে সংবরণ করি। এখন আর এসব একদমই ইচ্ছে করে না। বয়স তো কম হলো না। সে নিজে থেকে শোধরাতে না চাইলে আর করার আছেই বা কী আমার? কিচেনের টুকিটাকি কাজ শেষ করে ভাবলাম ঘুমানোর আগে একবার মিথিলা আর মেহরাবকে দেখে আসি।

মিথিলার রুমে যেয়ে ওকে পেলাম না। বুঝে গেলাম ভাইয়ের কাছে গেছে। মেহরাবের দরজার সামনে যেয়ে থেমে গেলাম। মিথিলা আর মেহরাব কথা বলছে।

– আপা, আমাদেরকে আংকেল পছন্দ করে না , তাই না?

– আরে না ! এমন কেন হবে?

– তুইও রূম্পা মায়ের মতো মিথ্যে বলিস। আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। আমি যাই করি আংকেলের সেটাই পছন্দ না। খাওয়ার সময় শব্দ করা যাবে না, আস্তে কথা বলতে হবে, বড়দের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বড়দের আগে খাওয়া শুরু করা যাবে না। টিভি দেখা যাবে না , সিড়িতে শব্দ করা যাবে না, ছাদে যাওয়া যাবে না আরো কত কত নিয়ম!

– বুঝতেই যদি পারিস তবে আংকেলের সামনে যাস কেন? আমাকে দেখিস কখনো যেতে? একটু কম যাবি সামনে। তবেই আর ঝামেলা হবে না কোনো!

– তুই তো মেয়ে মানুষ! সারাদিন রুমের মধ্যে থাকা যায়? ফোনটাও নিয়ে গেছে রূম্পা মা!

– সারাদিন কোথায় ? ছুটির দিন ছাড়া তো আংকেল সারাদিন বাসায় থাকে না। একটু ম্যানেজ করে চলতে শিখ।

– এর চেয়ে বাসাতেই ভালো ছিলাম। নিজের বাসাতে স্বাধীনভাবে ঘোরাফিরা করতে পারতাম। এখানে রূম্পা মা ছাড়া কেউই ভালো করে কথা বলে না। ভাইয়াও তেমন কথা বলে না।

– আরে সে বড় মানুষ! আর তুই একটা পুচকি! তোর সাথে সে কী কথা বলবে?

– তারপরও ?

– মন খারাপ করিস না তো! নতুন এসেছিস তো ! ধীরে ধীরে সব সয়ে যাবে। স্কুলে যখন অনেক বন্ধু বান্ধব হয়ে যাবে দেখবি সময় কীভাবে কেটে যাবে! আর বেশি খারাপ লাগলে আমার রুমে আসবি। গল্প করতে করতে দেখবি সময় কেটে যাবে। এই যে একটার পর একটা ঝামেলা করিস টুম্পা মায়ের এতে মন খারাপ হয় বুঝিস!

– হুম, বুঝি তো ! সাবধানে চলব এখন থেকে কথা দিলাম।

– গুড বয়। এবার ঘুমা। আমিও যাই । আমার আবার সাতটার সময় বেরুতে হবে। গুড নাইট।

আমি আর ওদের দু’ভাইবোনের সামনে গেলাম না। ওরা নিজেরাই এখন অনেক বোঝে। সত্যিই জীবন কতকিছু শিখিয়েছে ওদের। বাকি জীবনটা এভাবেই যুদ্ধ করেই ওদের আগাতে হবে। বাস্তবতা কত নিষ্ঠুর! শুধুমাত্র মা নেই পৃথিবীতে অথচ ওদের আজ সব থাকতেও কিছুই নেই । জীবন বড়ই বিচিত্র।

চলবে…