সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব-২+৩

0
335

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’

[০২]

– নূরজাহান

–“ভাইয়া আজকে কি রান্না করেছো?”

কথাটা বলে প্রিয়ম চেয়ার টেনে বসে পড়লো। একে একে সব খাবারের ঢাকনা তুলে দেখল। খাবারের আইটেম দেখে প্রিয়মের মুখে হাসি ফুটল। ওর পছন্দের সর্ষে ইলিশ রান্না হয়েছে। প্রিয়ম প্লেট নিয়ে ঝটপট খেতে বসে গেল। ইলিশ মাছ ওর খুব পছন্দ। আর সর্ষে ইলিশ হলে তো কোনো কথায় নেই। সে মাছের বড় বড় দু’টো পিচ প্লেটে নিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছে। প্রিয়ম আজকে ওর বড় ভাইয়ার বাসায় এসেছে। সে ওর বাবা মায়েরর সঙ্গে রাজশাহীতে থাকতো। তবে এখন থেকে সে এখানে থাকবে। প্রিয়ম একজন গায়ক। ওর শখ বিখ্যাত একজন গায়ক হওয়া। সে নিজের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টায় আছে। প্রিয়ম মুখের খাবারটুকু গিলে ওর ভাইকে ডেকে বলল, “ভাইয়া তুমি খাবেনা?”

প্রিয়মের বড় ভাই প্রত্যয় ফোনে কথা বলতে বলতে এসে প্রিয়মের পাশে বসল। প্রিয়ম পানি খেয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় কথা বলা অবস্থায় প্রিয়মের প্লেটে ভাত আর মাছ তুলে দিল। প্রিয়ম প্রত্যয়কে নিষেধ করছে, না দিতে। প্রত্যয় প্রিয়মের কথা শুনল না বরং সে খেতে ইশারা করল। আজকে প্রত্যয়ের দুইটা অপারেশন করতে হবে। সকালে ছয়টাতে একটা আর আরেকটা রাত দশটাতে। এসব নিয়ে সে ফোনে কথা বলছিল। আর বাকি সময়টুকু অন্য সব পেশেন্ট দেখবে। প্রত্যয় কথা বলে কল কেটে প্রিয়মকে বলল,

-“ফ্রিজ থেকে দই বের করে রেখেছি। ঠান্ডা টা কমলে তারপর খাবে।”

প্রিয়ম খেয়ে উঠে নিজের এঁটো প্লেট আর হাত ধুয়ে নিল।
নিজের এঁটো প্লেট ধোয়ার অভ্যাসটা সে প্রত্যয়ের থেকে শিখেছে। প্রিয়ম আবার গিয়ে ভাইয়ের পাশে বসল। প্রত্যয় প্রিয়মকে বলল,
-“বাসায় থাকবে নাকি এখন বের হবে?”

-“এখন আর বের হবো না। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে এখন ঘুমাব।”

-“আচ্ছা! বিকেলে দু’জন লোক আসবে উনারা আসলে দরজা খুলে দিও।”

-“কিসের লোক?”
-“রান্না আর রুম পরিষ্কার করার জন্য। আমি তো সময় পাব না।”

–“ওনাদের আসতে হবেনা। আমি আছি সব ম্যানেজ করে নিব।”

প্রত্যয় প্রিয়মকে নিষেধ করল। কিন্তু প্রিয়ম কোনো কথা শুনল না। তাই প্রত্যয় লোক দু’টোকে আসতে নিষেধ করে দিল। প্রিয়ম দই নিয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে গেল। প্রত্যয় খেয়ে রেডি হয়ে প্রিয়মকে বলে হসপিটালে চলে গেল। প্রিয়ম বাসায় এখন একা আছে। সে সোফাতে শুয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখল, তারপর উঠে গিটার নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। প্রত্যয়ের বেলকণিতে একটা ময়না পাখি খাঁচাতে ঝুলানো আছে। প্রত্যয় ময়নাপাখির নাম দিয়েছে কলি। প্রত্যয় কলিকে ছোট ছোট কয়েকটা শব্দ শিখিয়েছে। যেমন; আল্লাহ, বিসমিল্লাহ্, আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছো, দাঁড়াও, কই যাচ্ছো, সুন্দর, দুষ্টু। কলি এই শব্দ গুলো বলতে শিখে গেছে। কিন্তু সালামটা ঠিক মত দিতে পারো না, বড়গুলো শব্দ এজন্য। তবে প্রত্যয় যখন সুন্দর করে স্পষ্টভাবে কলির সামনে ,”আসসালামু আলাইকুম।” বলে তখন প্রত্যয়ের দেখে কলিও স্পষ্টভাবে বলার চেষ্টা করে।

কলি প্রিয়মকে দেখে সবগুলো বুলি পরপর আড়তাতে লাগলো। প্রিয়ম কলির দিকে তাকিয়ে বলল,”পাগল করে দিবি নাকি?” কলি এই কথা শুনে সেও বার বার বলতে থাকলো, “পাগল করে দিবি নাকি।” প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে কলির দিকে তাকিয়ে গিটারের সুর তুলল। তখন কলি চুপ হয়ে গেল।

পলক দুইদিন হসপিটালে থেকে পলক এখন সুস্থ আছে। রনিত পলককে কক্সবাজারে বেড়াতে নিয়ে গেল। দু’জনে কিছুদিন আলাদাভাবে সময় কাটাবে ভেবে। বিশেষ করে রনিত পলককে বোঝাতে চাই, সে খারাপ স্বামী নয়। পলকের মনে ওর প্রতি ভুল ধারণা গুলো সে দূর করতে চাই। রনিত যে খারাপ ছেলে তা কিন্তু নয়। সেও বুদ্ধিমান একজন ছেলে। একটা ভুলে জন্য তাকে দোষারোপ করা উচিত হবে না। আর দোষারোপ যদি করতেই হয়। তাহলে প্রথমে সমাজ, ওদের বাবা মা, কাজি , এই কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে দোষটা রনিতের কাছে আসছে। রনিত তো একা দোষী নয়। ওর আগে পিছে আরো দোষী আছে।

আমাদের সৃষ্টিকর্তা প্রতিটা মানুষকে শারীরিক চাহিদা দিয়ে তৈরী করেছেন। সৃষ্টির শুরু থেকে এই ধারা চলে আসছে। যদি শারীরিক চাহিদা বলে কিছু না থাকতো, তাহলে বংশ বিস্তার হতো না। পৃথিবীটাও অনেক আগে রসাতলে চলে যেতো। শারীরিক চাহিদা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত দেওয়া। এটাকে অমান্য করা, হাসহাসি করা, বাজে মন্তব্য করা উচিত না। সৃষ্টিকর্তা মানুষের শারীরিক চাহিদা পূরনের বৈধতাও দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে রনিত ও তো মানুষ । ওর তো কিছু চাহিদা আছে। সে তো ওর বিয়ের করা বউয়ের কাছে গেছে। হ্যাঁ, সে একটু সময় নিয়ে আরও সচেতন হতে পারত। তবে যাই হোক সে এখন অনুতপ্ত।

তুয়া আর মিতু দু’জনে ছাদে বসে আছে। তুয়ার আম্মু একটু দূরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করছে। তুয়া বাদাম খাচ্ছে আর খোসা গুলো মিতুকে ছুঁড়ে মারছে। মিতু রেগে তুয়ার দিকে মটমট করে তাকাচ্ছে। তখন তুয়া খিলখিল করে হেসে আরো বেশি করে খোসা ছুঁড়ে দিচ্ছে।

প্রিয়ম এখানে নতুন এসেছে সে এখানকার কিছু চিনেনা। আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য সে রেডি হয়ে বের হল। কয়েক ধাপ এগোতেই ওর মাথার উপর পানি জাতীয় কিছু একটা পড়ল। প্রিয়ম ওর শার্টের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকাল। ওর শার্টে কেউ কাদা মাটি ছুঁড়ে মেরেছে। প্রিয়ম উপরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। তাই বিরক্ত হয়ে আবার রুমে ফিরে এলো। মিতু আর তুয়া ছাদে বসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তুয়া ইচ্ছে করেই কাঁদা ফেলেছে কারন মিতু বলেছে,
— “ওই সাদা শার্ট পরা ছেলেটার গায়ে কাঁদা মারতে পারলে, আমার সব বাদাম তোকে দিব।”

এজন্য তুয়া প্রিয়মের গায়ে কাঁদা ছুঁড়ে মারল। মিতু ভেবেছিল তুয়া করবেনা। কিন্তু সে কাজটা সম্পূর্ণ করে ওর বাদামগুলো নিয়ে নিল। প্রিয়ম আজ আর বের হলো না। সে শার্ট বদলে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিল। কারন ওর ধুলাবালিতে এর্লাজি বেড়ে যায়। প্রত্যয় ওর পেশেন্ট দেখে কেবল বাসায় ফিরল। ওরা দোতলায় থাকে এজন্য লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে, সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। প্রত্যয় কলিংবেল চাপ দিয়ে পেছনে ঘুরতে যাবে। তখন একটা বাচ্চা মেয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল,”কানাচুর থাবো।”

প্রত্যয় বাচ্চাটা দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। প্রত্যয়কে হাসতে দেখে সেও হাসলো। প্রত্যয় হাঁটু গেড়ে বসে বললো,
–“রাজকন্যা তোমার নাম কি?”

–“আমি নাজতন্যা ইত্তে ।”

–“ওহ আচ্ছা! তোমার নাম ইচ্ছে, খুব সুন্দর নাম। তুমি কি খাবে বললে?”

–“কানাচুর থাবো।”

প্রিয়ম এসে দরজা খুলে দেখে প্রত্যয় কারো সঙ্গে কথা বলছে। প্রিয়ম এগিয়ে এসে দেখে দুই পাশে ঝুঁটি করা একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যয় হেসে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বাসায় ঢুকলো। রান্নাঘরে গিয়ে পুরো চানাচুরের প্যাকেট মেয়েটিকে দিয়ে সোফায় বসিয়ে দিল। প্রিয়ম ইচ্ছেকে কোলে নিতে গেল। কিন্তু ওর কোলে এলো না। প্রিয়ম বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বিরবির করে বলল,
-“মেয়ে মানেই প্যারা।”

ইচ্ছে কথাটা শুনে খাওয়া থামিয়ে প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রত্যয় ফ্রেশ হতে গেছে। প্রিয়ম বসে একমনে টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছে। ইচ্ছে উঠে সোফার উপর দাঁড়িয়ে প্রিয়মের চুল শক্ত করে টেনে ধরে চিৎকার করে বললো,
–“তুমি প্যালা। তুমি মেলা খালাপ প্যালা।”

প্রিয়ম ওর চুল ছাড়ানো চেষ্টা করছে কিন্তু ইচ্ছে আরো শক্ত করে ধরছে। প্রিয়ম প্রত্যয়কে জোরে জোরে ডেকে উঠলো। প্রত্যয় ওদের চিৎকার শুনে দ্রুত পায়ে এসে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল। প্রিয়ম মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
–“ভাইয়া এই বিচ্ছুটাকে কোথায় পেলে? উফ! আমার চুলের জান শেষ।”

ইচ্ছে প্রত্যয়ের কোল থেকে নেমে আবার প্রিয়মের কাছে যাচ্ছিল। তখন তুরাগ এসে দরজা নক করে। প্রত্যয় ইচ্ছে কে কোলে নিয়ে দরজা খুলে দেয়। তুরাগ ইচ্ছে দেখে প্রাণ ফিরে পায়। প্রত্যয় তুরাগের সাথে কুশল বিনিময় করে তুরাগের সাথে প্রিয়মের পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রিয়ম সালাম দিয়ে তুরাগের সাথে কথা বলে।

তুরাগকে দেখে ইচ্ছে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল, “দান আমাতে প্যালা বলেছে।” তুরাগ রেগে যাওয়ার ভান করে বলল, “কার এত সাহস আমার জান পাখিকে প্যারা বলেছে। তাকে এক্ষুনি আমি চিনি খাইয়ে মেরে ফেলব।” তুরাগের কথা শুনে প্রত্যয় প্রিয়ম দু’জনে হেসে দিল।

ইচ্ছে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে প্রিয়মকে দেখিয়ে দিল। প্রিয়ম হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতটুকু বাচ্চা এত পাকা? তুরাগ প্রিয়মকে বকে ইচ্ছেকে কোলে নিল। প্রত্যয় হেসে ইচ্ছে কে বলল,”আবার এসো কেমন।” ইচ্ছা মিষ্টি হেসে বলল,”কানাচুর দিবে?” প্রত্যয় চানাচুরের প্যাকেট ইচ্ছেকে দিয়ে বলল,”হুম দিবো তো।” ইচ্ছা প্যাকেটা হাতে নিয়ে বলল,”আচ্ছা তাহলে আছব।” তুরাগ হেসে ইচ্ছেকে নিয়ে চলে গেল। ইচ্ছেরা নিচ তলায় ভাড়া থাকে, সে তুরাগদের বাসায় বেশি থাকে। তার পছন্দের খাবার চানাচুর। যে ওকে চানাচুর দেয় সে তার কাছে চলে যায়। ওর চানাচুর এতটাই পছন্দ যে ওকে চানাচুর খোর ডাকলেও ভুল হবে না।

সন্ধ্যার পরে প্রত্যয় আর প্রিয়ম দুই ভাই হাঁটতে বের হল৷ প্রত্যয়ের আজকে পেশেন্ট কম ছিল। এজন্য বাসায় চলে এসেছিল। ওরা দু’ভাই হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর অবধি গেল। তখন প্রত্যয়ের হসপিটাল থেকে কল আসল। ওকে এখন যেতে হবে তাই প্রিয়মকে বলল,” প্রিয়ম আমি হসপিটালে যাচ্ছি, তুমি সাবধানে ফিরে যেও।” প্রিয়ম বলল, “তুমি সাবধানে যেও।” প্রত্যয় “আচ্ছা” বলে চলে গেল।

প্রিয়ম একা একা কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে বাসায় ফিরল। আর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে তুয়ার সঙ্গে ধাক্কা খেল। তুয়া তখন ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। ফলস্বরুপ তুয়ার হাতে থাকা ডিম দু’টো প্রিয়মের বুকে লেগে ফেটে গেল।
প্রিয়ম তুয়াকে দাঁড়াতে বলে দ্রুত রুমে ঢুকে দু’টো ডিম এনে তুয়ার মাথায় ফাটিয়ে বলল,

–“এবার ঠিক আছে। বাহ্! আপনাকে দারুণ লাগছে।”
,
,
,

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’

[০৩]

নূরজাহান

প্রিয়ম তুয়ার মাথায় ডিম ফাটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তুয়া দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে আছে। প্রিয়ম বলল, “এটাকে বলে টিট ফর ট্যাট।”

তুয়ার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে রাম ধোলাই দিতে। কত্ত বড় খাটাশ, বদলাও নিয়ে নিলো। দু’জনের শরীর থেকে ডিমের আঁশটে গন্ধ আসছে। তুয়া চলে আসতে যাবে তখন প্রিয়ম হেসে বলল, “আমার নাম প্রিয়ম আর তোমার নাম কি গো রাগিণী?”

তুয়ার আম্মু তুয়াকে ডাকছেন। তুয়া বলল,”আসছি আম্মু।”

প্রিয়ম হাসতে হাসতে বলল, “তোমার নাম টুপা? বাহ্! একদম ইউনিক নাম। ”

তুয়া একবার রাগী চোখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে আমি পরে দেখে নিব।”

প্রিয়ম বাঁকা হেসে ওদের ফ্ল্যাটের দরজা দেখিয়ে বলল, “আমাকে যখন দেখতে ইচ্ছে করবে আমার বাসায় চলে এসো, টুপারাণী।”

“আপনি মারাত্মক অসভ্য একটা ছেলে।”

“ধন্যবাদ।”

তুয়া রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। প্রিয়ম হাসতে হাসতে বাসায় ঢুকে গেল। প্রিয়মকে আজ মোট তিনবার শাওয়ার নিতে হলো। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! প্রিয়ম শাওয়ার নিয়ে রান্না করতে গেল। প্রত্যয় আর প্রিয়ম দু’জনেই রান্না করতে পারে। বাসায় মাঝে মাঝে ওরা নিজেরা রান্না করে ওদের আব্বু-আম্মুকে খাওয়ায়। প্রিয়ম ওর আম্মুকে ভিডিও কল করল। ওর আম্মু মিথিলা রায়হান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছোট রাজকুমার কি রান্না করছেন? আমার বড় রাজকুমার কই?”

প্রিয়ম ফোনটা একসাইডে রাখে, চুলার পাওয়ার কমিয়ে প্যানে থাকা গরম তেলে পেঁয়াজ ছেড়ে নাড়তে নাড়তে বলল, “ভাইয়া হসপিটালে। আমি মাংস আর খিঁচুড়ি রান্না করছি। বাবা এখনো বাসায় ফিরেনি, আম্মু?”

“না! ফোন দিয়ে বলল ফিরতে নাকি রাত হবে।”

“ওহ।”

“তোদের ওখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো, আব্বু?”

“না, আম্মু।”

মা-ছেলে কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটল। ওদের আব্বু-আম্মু সামনের সপ্তাহে এখানে চলে আসবেন। মিথিলা ছেলেদের ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে নারাজ। উনাদের সব কিছু গুছিয়ে নিতে এক সপ্তাহের মতো লেগে যাবে। তারপর সবাই এখানে এসে সেটেল হবেন। প্রিয়ম গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে রান্না করতে থাকল। প্রত্যয় কখন ফিরবে তাঁর কোনো ঠিক নেই। আজকেও তাঁকে ওটিতে ঢুকতে হয়েছে। ওর খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। সারাদিন সে হসপিটালে থাকে। আবার কখনো কখনো রাতেও বাসাতে ফিরে না। একজন দায়িত্বশীল ডাক্তারের রেস্ট বলে কিছু থাকে না। আর প্রত্যয় নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মতো ছেলে নয়। তাঁর যত কষ্টই হোক। প্রত্যয় সর্বদা চেষ্টা করে নিজের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করতে।

প্রিয়ম রান্না করে খেয়ে বাকিটা হটপটে তুলে রাখল। ভিডিও কলের মাধ্যমে ওর রাজশাহীর বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিল। সবাইকে সে খুব মিস করছে। সোফাতে টান টান হয়ে শুয়ে সে বেশ কিছুক্ষণ টিভি দেখল। কলি বেলকণিতে বুলি আওড়াতে আছে, সে এখন প্রত্যয়কে ডাকছে। প্রিয়ম কলির ডাকাডাকি শুনে বিরবির করে বলল, “এই ফাজিল পাখিটা আমার কান বয়রা করেই ছাড়বে।”

প্রিয়ম কলিকে বেলকণি থেকে এনে খেতে দিল। কলি এখন ঠুকরে ঠুকরে কাঁচা মরিচ খাচ্ছে। ওর পছন্দের খাবার ঝাল। কলি এখন খাচ্ছে আর একটা বুলি আওড়াচ্ছে, “শুভ রাত্রি! শুভ রাত্রি!”

তুয়া বাসায় গিয়ে প্রিয়মকে ইচ্ছেমতো গালি দিল। সে এই রকম বেয়াদব ছেলে একটাও দেখে নি। আর ওকে ‘টুপা’ বলে ডাকল। ওর এত সুন্দর নামটার ইজ্জত শেষ করে দিল। তুয়াও এর শেষ দেখেই ছাড়বে। তখন ইচ্ছের আম্মু তুয়ার আম্মুকে ফোন করে দু’টো ডিম দিতে বলেছিল। ইচ্ছে নাকি তখন নুডুলস খাওয়ার বায়না ধরেছিল। ওদের ফ্রিজে ডিম ছিল না। তুয়া তখন ইচ্ছেদের বাসায় ডিম দু’টো দিতেই যাচ্ছিল। কিন্তু প্রিয়মের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ধাক্কা গেলে গেল। আর ওই বিশ্রী ঘটনাটা ঘটল। তুয়া রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “ব্যাটা বজ্জাত! দাঁড়া, দেখ আমি তোর কি ব্যবস্থা করছি।”

পরেরদিন সকালে তুয়া আর মিতু কলেজ যাওয়ার জন্য বের হলো। প্রত্যয় সারারাত হসপিটালে থেকে তখন বাসায় ফিরছিল। মিতু প্রত্যয়কে দেখে অবাক হয়ে বলল, “স্যার! আপনি এখানে?”

প্রত্যয় হেসে জানাল সে এই বিল্ডিংয়েই থাকে। মিতু একবার তুয়ার দিকে তাকাল। প্রত্যয় মিতুকে পলকের কথা জিজ্ঞাসা করল। খুব ব্যস্ত থাকায় প্রত্যয় পলকের আর খোঁজ নিতে পারেনি। মিতু জানাল পলক এখন সুস্থ আছে। প্রত্যয় মুচকি হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তুয়া বলল, “একজন প্রত্যয় আর আরেকজন প্রিয়ম। এরা মনে হয় দুই ভাই হবে, বুঝলি? এই ডাক্তারটা ভালোই তবে উনার ভাইটা আস্ত বেয়াদব।”

মিতু আর কথা বাড়াল না। দু’জনে গল্প করতে করতে কলেজে চলে গেল। তুয়া আর মিতু দু’জনেই ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।

প্রত্যয় চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। প্রিয়ম এখনো ঘুমাচ্ছে, এজন্য প্রত্যয় আর ওকে ডাকল না। হার্টের অপারেশন করা এক পেশেন্টের অবস্থা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য সে সারারাত প্রায় জেগেই ছিল। ঘুমটা না হওয়ার কারণে ওর শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। প্রত্যয় শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হলো। এরপর রান্না করে খেয়ে নিলো। সারারাত জেগে ছিল বলে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

প্রিয়মের আজ সকাল দশটার সময় একটা প্রোগ্রাম আছে। কালকে রাতে ঘুমানোর আগে সে এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিল। তাই সকাল পৌণে নয়টার দিকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। প্রত্যয়কে একটা মেসেজ করে সে গিটার নিয়ে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে প্রিয়মের ইচ্ছের সাথে দেখা হলো। ইচ্ছে প্রিয়মকে দেখে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেল। প্রিয়ম মনে মনে বলল, “এই বিল্ডিংয়ের সব মেয়ে গুলোই এমন বারুদ নাকি!”

একসপ্তাহ পরে প্রিয়মের আব্বু-আম্মু প্রত্যয়ের ফ্ল্যাটে চলে আসলেন। মিথিলা রায়হান এসেই আগে দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বাসাটা এবার যেন প্রাণ পেল। মা ছাড়া বাসাটাও যেন এতিম হয়ে গিয়েছিল। উনারা আসার সময় অনেক আসবাবপত্রও এনেছেন। সেই আসবাবপত্র দিয়ে ফ্ল্যাটটাকে আরো পরিপাটি করে সাজালেন। প্রিয়ম ওর বাইক পেয়ে গেছে। ওকে আর পায় কে, সে ছুটল পুরো শহর ঘুরতে। সে এখানে থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করবে। সে সুবাদে ওর ব্যাচের কয়েকজন বন্ধুও জুটে গেছে। প্রত্যয় অর্ধেক বেলা বাসায় আছে। সে ওর আম্মুর কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ওর আম্মু ছেলের চুল টেনে দিতে দিতে বললেন, “আব্বু, প্যারিস থেকে ডাক্তারী পড়া সম্পূর্ণ করে তবেই ফিরলে। তুমি তো এখন যথেষ্ট স্বাবলম্বী। এবার তোমার জন্য মেয়ে দেখি?”

“আম্মু, এত তাড়া কিসের?”

“একটা লাল টুকটুকে বউ আনতে হবে তো। বউ ছাড়া যে বাসা পরিপূর্ণ হয় না।”

“আম্মু, আমি বিয়ে নিয়ে এখন ভাবছি না। আমাকে আর একটু সময় দাও।”

“লক্ষী একটা বউ আনব তোর জন্য। যে আমার রাজকুমারকে চোখে হারাবে, বুঝলি?”

“সে পরে দেখা যাবে।”

প্রত্যয় কথাটা কোনো রকম কাটিয়ে দিল। ওর কেন জানি লজ্জা লাগে নিজের বিয়ের কথা বলতে। তাছাড়া সে এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছেও না। সে আরেকটু সময় নিয়ে নিজের জায়গাটা আরো পাকাপোক্ত করতে চায়। বিয়ে মানে কারো সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়া। তাঁকে সর্বোচ্চ ভালো রাখার চেষ্টা করা। তাঁকে সবদিক থেকে আগলে রাখা। তাই প্রত্যয় চাচ্ছে নিজেকে আগে গুছিয়ে নিতে।

প্রত্যয় দেশে ফিরে নিজস্ব একটা হসপিটাল তৈরী করেছে। এই হসপিটালের ইঞ্জিনিয়ার ওর বাবা ইশতিয়াক রায়হান। ছেলের স্বপ্ন পূরণের জন্য উনি সবটা নিজে হাতে করেছেন। প্রত্যয় নিজের হসপিটাল ছাড়াও কয়েকটা হসপিটালে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে সেবা প্রদান করে। সে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেশ ভালো পরিচিতি লাভ করেছে। বিশেষ করে ওর চিকিৎসা, মার্জিত ব্যবহার আর বিনয়ী কথা বার্তার মাধ্যমে। প্রিয়ম একটু চঞ্চল টাইপের হলেও প্রত্যয় একদম শান্ত স্বভাবের। সে ওর কথার মাধুর্যতা দিয়ে মানুষের মন কাড়তে সক্ষম হয়।

তুয়ার আম্মু ইচ্ছেদের বাসায় যাচ্ছিলেন। প্রত্যয়ের আম্মুকে দেখে উনিই আগে কথা বললেন। কথা বলতে বলতে দু’জনে নিচে গেলেন। তুয়ার আম্মু প্রত্যয়ের আম্মুকে অনেকের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। একই বিল্ডিংয়ে যখন থাকবেন তখন সম্পর্কটাও ভালো হওয়া প্রয়োজন।

কলেজ থেকে ফেরার পথে তুয়ার সামনে প্রিয়ম বাইক থামাল। হঠাৎ এমন করাতে তুয়া ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। রিকশা না পাওয়াতে কড়া রোদের মধ্যে সে হাঁটছিল। রোদের প্রখর তাপে ওর মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। তাঁর মধ্যে প্রিয়মের এই কাজে ওর রাগে যেন উচ্চ মাত্রায় বেড়ে গেল। প্রিয়ম ঠোঁটে কোণে বাঁকা হাসি রেখে ফুটিয়ে বলল, “কি গো টুপা! এ কি অবস্থা তোমার?”

“আমার সামনে এসে এভাবে বাইক থামালেন কেন?”

“ভয় পেলে বুঝি? আহারে বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়েছে। আমার জানামতে এভাবেই বাইক থামাতে হয়।”

“আমাকে শিখাতে এসেছেন?”

“তুমি শিখলে আমার শিখাতে সমস্যা নেই।”

তুয়া প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রিয়ম তুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তুয়া মুখের ঘামটা মুছে বলল, “চলুন বাইক নিয়েই একটা বাজি হয়ে যাক।”

,,

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,!