প্রতীক্ষা পর্ব-০১

0
171

প্রতীক্ষা
১ম পর্ব
শেখ জারা তাহমিদ

১.
বছর পাঁচ আগে, ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে পাশ করে বেরিয়েছে আশফিক। ভালো রেজাল্টের জোরে মেরিন ইন্জিনিয়ার হিসেবে মার্চেন্ট নেভীর চাকরি পেতে সময় লাগেনি। জয়েন করেছিলো নামকরা শিপিং ইন্ডাস্ট্রির একটা কার্গো জাহাজে। ক্যাডেট মেরিন ইন্জিনিয়ার হিসেবে বারো মাস চাকরির পর যা ইনকাম হলো, সব নিয়ে চলে গেছিলো সিংগাপুর। ছয়মাস পড়ালেখার পর পরীক্ষা দিয়েছে। র‍্যাংকে এগিয়ে, আগের জাহাজেই জয়েন করেছে ফোর্থ ইন্জিনিয়ার হিসেবে। চাকরি করেছে ষোলো মাস। তারপর আবারও গিয়েছে সিংগাপুর। পড়ালেখা, পরীক্ষা শেষে পাঁচমাসের মাথায় যখন দেশে ফিরেছে তখন ও থার্ড ইন্জিনিয়ার। থার্ড মেরিন ইন্জিনিয়ার আশফিক হামিদ।

আশফিকের আব্বা, ভূঁইয়াসাহেব। মিঠাভাঙা গ্রামের অনেকগুলো জমির মালিক। এককালে তার পূর্বপুরুষের জমিদারি ছিলো। বংশপরম্পরায় ভূঁইয়াসাহেবের গায়ের রং কালো। রাগী, একরোখা মানুষ তিনি। গ্রামের লোকজন তাকে মান্য করে। যেকোনো বিচারকার্যে তিনি মধ্যমণি।

ভূ্ঁইয়াসাহেবের এগারো ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েরা সকলেই তার গায়ের রং পেয়েছে৷ ছেলেমেয়ে কারো প্রতিই বিশেষ টান দেখান না তিনি। তবুও বোঝা যায় বড়ছেলে আশফিক তার অতি প্রিয়।

২.
কুমিল্লা। সাতনরী গ্রাম। ইলেকট্রিসিটি আসেনি তখনও। সৌরবিদ্যুতের চল থাকলেও সেটা আছে গুটিকয়েক অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে। বাকীদের ভরসা সেই তালপাখা আর হারিকেনেই। ক্যামেলিয়ার নানা বাড়িতে অবশ্য দুটোই আছে। ওর নানা বিদেশ থেকেছে বহুবছর। সেই সুবাদে টাকাপয়সা নেহাৎ কম নয়। ক্যামেলিয়ার আব্বা সরকারি চিকিৎসক। আম্মা গেরস্থ বাড়ির বড় বউ। মা-বাবা থাকতেও ক্যামেলিয়া কেন নানাবাড়ি থাকে, তার পেছনে ছোট্ট একটা গল্প আছে।

ক্যামেলিয়ার দাদাবাড়ী মিঠাভাঙা গ্রামে। তার আব্বারা সাত ভাই। ভাইদের মধ্যে তিনি বড়। ভাইয়েরা সকলেই বিয়ে-থা করলেও, কারোই সংসার আলাদা হয়নি তখনও। অতবড় সংসারের অতগুলো মানুষ। অবস্থাসম্পন্ন ঘর তাদের। তবুও যেন টান পরে যায়। তাই ক্যামেলিয়াকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো তার নানাবাড়িতে। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই চলে গেছিলো ও। চার ভাইবোনের মাঝে বড় ক্যামেলিয়া, তার আব্বার প্রিয় কন্যা। অমন অজপাড়াগাঁয় থেকেও শখের বশে তিনি নাম দিয়েছিলেন ক্যামেলিয়া।

পাঁচ বছর আগে, ১৯৯৩ সালে ক্যামেলিয়া তখন ইন্টার পরীক্ষার্থী। আশফিকের সঙ্গে দেখা হবার কোনো কারণ না থাকলেও সেবার ওদের দেখা হয়েছিল।

৩.
১৯৯৩ সাল। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি ফিরছিলো আশফিক। চিঠি পাঠিয়ে ফেরার দিনক্ষণও জানিয়েছিলো। তবু বাসস্ট্যান্ডে কাউকে না দেখে অবাক হলো ও। বিস্ময় চেপে নিজেই বেবিট্যাক্সিতে উঠে বসেছিলো।

দৌলতপুর বাজারে এসে একজন নেমে গেলো। তখনই উঠেছিল ক্যামেলিয়া। ছোট্ট একটা ব্যাগ হাতে। সুতির কামিজ পরা সাধারণ দেখতে মেয়েটাকে দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখার কিছু ছিলো না আশফিকের। তবুও দেখলো। ক্যামেলিয়া যখন বললো মিঠাভাঙা কান্দারপার নামবে, তখনই দেখলো! মনে প্রশ্ন জাগলো, কান্দারপারে কার বাড়ি যাচ্ছে মেয়েটা। তাও একা! শহর থেকে এলো নাকি? ও চট্টগ্রাম থাকে পাঁচ বছর হলো। এর আগে তো গ্রামেই থাকতো। তখনও দেখেছে বলে মনে পরলো না।

ক্যামেলিয়ার অবশ্য অত খেয়াল নেই। কে তাকালো না তাকালো তা দেখার সময় নেই। সে চিন্তিত। বাড়ি আরও ঘন্টাখানেকের পথ। অথচ বেলা পরে গেছে। কতখনে পৌঁছুবে ও? আব্বা ঘরে থাকলে ওকে আর আস্ত রাখবে না। নানীজানের কথামতো পরদিন সকালে রওনা করলেই পারতো। ভয়ে উত্তেজনায় ও দরদর করে ঘামছে।

ক্যামেলিয়া যখন বাড়ির সামনে নামলো তখনও মাগরিবের আজান পরেনি। ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে ডাক্তার বাড়ির দিকে চলে গেলো ও। অথচ জানলোই না তার দিকে তখন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে কেউ।

৪.
আশফিকের হঠাৎ কী হলো ও বুঝতে পারছিলো না। শেষ বিকেলের আলোয় দেখা মেয়েটাকে হুট করেই যেনো ভালো লেগে গেলো। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট টার্মের সাথে ও পরিচিত। কিন্তু এরকম কিছু আদোও হতে পারে সেটা কখনোই মনে হয়নি ওর।

আশফিক বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়ি পর্যন্ত কী করে গেছিলো বলতে পারবে না। কেনো চিঠি পাঠানোর পরও কেউ বাসস্ট্যান্ডে গেলো না সেই প্রশ্নটা করতেও ভুলে গেলো। আম্মা যখন বলছিলো তারা কোনো চিঠি পায়নি তখনও কিছু বলতে পারছিলো না।

একটা ঘোরে ও যেনো তলিয়ে যাচ্ছিলো।

৫.
ঘন্টাখানেকের জন্য দেখা মেয়েটার কথা ভেবেই আশফিকের রাত কেটে ভোর হয়েছিলো। এতো জার্নি করে এলো! কত ক্লান্ত ও! তবুও ঘুম হলো না! বিরক্ত হয়ে অবশেষে উঠেই পরলো। টের পেলো খিদে পেয়েছে। গতকাল রাতে আম্মা করেছিলো ওর প্রিয় খুদের ভাত। লাল মরিচের ভর্তা। সাথে ভাজা মাছ। কিন্তু ও খেতে পারলো কই!

নাহ! মেয়েটাকে খুঁজে পেতেই হবে৷ কিন্তু খুঁজবে কোথায়? ডাক্তার বাড়ি চলে যাবে সরাসরি? গিয়ে কী বলবে? নামটাও তো জানা নেই!

৬.
গোমড়া মুখে বাড়ির উঠানে বসে আছে ক্যামেলিয়া। ও ভেবেছিলো আব্বা বকবে। অথচ বকলো কি না সদা শান্ত আম্মা! আম্মার এক কথা। বেলা পার করে একা ও কেনো এলো। বিপদ হলে কী করতো! কিন্তু বিপদ তো হয়নি। সেটা আম্মা বুঝলে তো।

বড় ফুপুর মেয়ে, শাহিনুর আপা। ওকে আজকে দেখতে আসছে। শহর থেকে। দুপুরে। ক্যামেলিয়াদের বাড়িতেই আয়োজন হচ্ছে। ভাগ্যিস শানুপার চিঠিটা গতকাল সকালে পেয়েছিলো। নয়তো ওকে তো কিচ্ছু জানায়নি কেউ। দূরে থাকে বলে ও কী দূরের মানুষ? হাবিজাবি ভেবে মন খারাপ করার সুযোগটা সেভাবে হলো না ক্যামেলিয়ার। শহরের অতিথিরা এসে পরেছে। ও ছুটে গেলো শানুর কাছে।

শাহিনুর কে ছেলেপক্ষের বেশ পছন্দ হয়েছে। আপ্যায়নেও সন্তুষ্ট। শহরে ছেলে দেখতে যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে অবশেষে তারা বিদায় নিলো। চমকপ্রদভাবে গ্রামে এই খবর রটে গেলো। শহর থেকে ডাক্তারবাড়ির মেয়েকে দেখতে এসেছে! পছন্দও করেছে! আহা! কী রাজকপাল!

ছোট্ট একটা গ্রাম। খবরটা ঘুরে ঘুরে আশফিকের কান পর্যন্ত ঠিক চলে এলো! কার বিয়ে? সেই মেয়েটার নাকি? জীবনে প্রথমবার একজনকে ভালো লাগলো। তার কি না বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো! রাগ লাগলো ওর। ভূঁইয়াসাহেবের রাগটাও যে আশফিক পেয়েছে সে কথা মিঠাভাঙা গ্রামের কে না জানে!

রাগের বশে সেদিন রাতে ও বন্ধুদের নিয়ে ডাক্তার বাড়ির বড় ডাব গাছটা থেকে ডাব চুরি করলো! ডাবের পানি খেয়ে সেই ডাব আবার ছুড়ে মারলো ডাক্তার বাড়ির টিনের চালে! বাড়ির লোক যখন চোর ভেবে হাঁক-ডাক ছাড়লো, ওরা তখন দৌড়ে পালালো। অতদিন পরে বাড়ি এসেছে ভেবে আশফিকের বন্ধুরা এটাকে অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে নিয়ে দারুন মজা করলো।

এতসবের পরেও কী আশফিকের রাগ কমেছিলো? ও কী আদোও রেগে ছিলো? নাকি হুট করে পছন্দ করে ফেলা মেয়েটা বিয়ের কনে হতে পারে সেই আশংকায় অস্থির বোধ করছিলো?

চলবে।