সূর্য ডোবার আগে পর্ব-০৮

0
564

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৮
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

লম্বা লম্বা পায়ে দৌড়ে নিজের কম্পার্টমেন্টে ফিরে এলো অভিমন্যু, ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহুর্তে। হালকা একটু ঘাম দিচ্ছে, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে একটা মেয়েলী পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ পেলো অভিমন্যু, নিজের অজান্তেই হালকা হাসিতে ভরে গেল ওর মুখ। কি গেল আগের দেড় ঘন্টা! এখনো যেন মেয়েটার উড়ন্ত ভিজে চুলের ঝাপটা এসে লাগছে ওর মুখে। তিতির পাখির মতো নরম একটা শরীর, থেকে থেকে কেমন যেন কেঁপে উঠছিলো ওর শক্ত হাতের মধ্যে। আর একটুও কি ধরে রাখা যেত না এই সময়টুকু? কিছু কিছু মানুষ অল্প সময়েও হঠাৎ করে মনে এমন এক রেশ রেখে যায়, যে সহজে ভোলা যায় না। কোমল ভালোলাগার একটা মিষ্টি রেশ নিয়ে অভিমন্যু ফিরে গেল নিজের বার্থে।

ওদের কামরাটা বেশ ফাঁকাই আছে এখনো অবধি, পরে লোক উঠবে হয়তো। আর্মড ফোর্স, এক্স সার্ভিসম্যান, তাদের পরিবার মিলিটারিদের জন্য রিজাভর্ড এই কামরাতে ট্রাভেল করতে পারে, যদিও মাত্র চার পাঁচটি সুপারফাস্ট ট্রেনেই এই সুবিধা আছে। সাধারনদের জন্য ট্রেনের বাকি ১৪-১৫টা কম্পার্টমেন্ট বরাদ্দ, মিলিটারিদের জন্য এই ৭২টা রিসার্ভ বার্থ রাখা। যেকোন পদমর্যাদার লোক নায়েক, সুবেদার থেকে শুরু করে মেজর জেনারেলরাও এই কামরায় যাতায়াত করেন। অভিমন্যুর সাথেই এই কম্পার্টমেন্টে যেমন নর্থ ইস্টার্ন স্টেটসে পোস্টিং আরও তিনচার রেজিমেন্টের মুখচেনা সেনাও যাচ্ছে এই ট্রেনে – বাঙালী, বিহারি, ওড়িয়া সব মেশানো। অভিমন্যুকে দেখেই হইহই করে উঠলো সবাই — “স্যার আপ কাঁহান থে ইতনে দের তক? ওয়োহ্ লডকি কো আপনে কামরা তক পহুচা দিয়ে?”

মৃদু হাসলো অভিমন্যু। ট্রেনের জানলা দিয়ে এদের অনেকেই দেখেছিল শিয়ালদা স্টেশনে গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর পাগলের মতো দিগবিদিক শূণ্য হয়ে ছুটছে এক তরুণী, কালো টপ ব্লু জীনস, হাতে লটবহর, মাথায় চুড়ো করে বাঁধা চুল। হইচই লেগে গিয়েছিলো ওদের কামরায়, আর প্ল্যাটফর্ম শেষ হওয়ার ঠিক আগেই অভিমন্যু ট্রেনে তুলে নিয়েছিল সেই তরুণীকে। কয়েকজন তো হাততালিও দিচ্ছিলো, সিটি মারছিলো… পুরো ফিল্মি সীন!! আসলে সেনাদের জীবনের রোজানামচায় বৈচিত্র্য খুব কম থাকে, বছরের কটাদিনই বা এরা পরিবার পরিজন, বিশেষ করে মা-বোন-স্ত্রী-প্রেমিকাদের সাথে সময় কাটাতে পারে? তাই ছোটোখাটো সাধারণ ব্যপারগুলো থেকেই আগামী সাত আট মাসের এন্টারটেইনমেন্টের রসদ খুঁজে নেয় এরা। তবে যা হলো তা খুব একটা ছোটোখাটো ব্যপারও না! ভাগ্যিস অভিমন্যুর চোখে পরেছিলো পিঠে রুকস্যাক, হাতে আর একটা ব্যাগ সামলাতে সামলাতে জিনস টপ পরা একটা রোগা পাতলা মেয়ে মরিয়া হয়ে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ছুটছে! ও হাত বাড়িয়ে না ধরলে মেয়েটা তো আজ পাক্কা ট্রেনের তলায় চলে যেত।তার ওপর আবার কামরায় উঠেই মেয়েটা যে ওমন করে সেন্সলেস হয়ে যাবে অভিমন্যু ভাবতেও পারে নি। সত্যিই ফিল্মি গল্প!

এদিকে অভিমন্যুকে ওভাবে আপনমনে মিটি মিটি হাসতে দেখে কয়েকজন সেনা হুল্লোড় শুরু করে দিল — “ভাবী মিল গয়ি, ভাবী মিল গয়ি”! কেউ কেউ শাহরুখ কাজলের সীন করতে লাগলো, কামরায় হুলুস্থুলু অবস্থা! হাসি পেলেও নিজের পদমর্যাদার কথা ভেবে একটু কড়া চোখে তাকালো অভিমন্যু, দেখে ওরই অধস্তন এক আর্মি ক্যাডেট হাসতে হাসতে বললো— “মাফ কিজিয়ে স্যর,পর আভি আপ ভি অফ ডিউটি হ্যয়, অউর হম সবভি! থোড়া এন্টারটেইনমেন্ট তো বনতা হ্যয়।”

অভিমন্যু আর কিছু বললো না।বেশ কিছুক্ষন পর একজন বাঙ্কের ওপর থেকে তার গীটার নামিয়ে অভিমন্যুকে দিলো, কিছু সেনানী অভিমন্যুর সীটের কাছে চলে এসে আবদার করতে লাগলো — “স্যর কুছ গানা হো জায়ে?”

দরাজ গলায় এক ওড়িয়া নিজেদের একটা ফোক গান ধরলো, সবাই শান্ত হয়ে বসে শুনতে লাগলো। ভাষার পার্থক্য হতে পারে, সুরের টান তো মনে বাঁধা। গীটার বাজাতে বাজাতে হঠাৎ অভিমন্যুর মনে পড়লো ওর এতদিনের সাথী আর্মি জ্যাকেটটা তো মেয়েটার কাছেই রয়ে গেছে। তারপরই ওর মাথায় স্ট্রাইক করলো….. দেড়ঘন্টা মেয়েটার সাথে থেকে অভিমন্যু ওর নাম অবধি জিজ্ঞেস করে নি! মনে মনে নিজেকে একটা লাথি কষালো অভিমন্যু। সত্যিই কি দিনদিন আনসিভিলাইজড হয়ে যাচ্ছে ও???

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই যখন নিজের বাঙ্কে উঠে ঘুম দিচ্ছে, এতগুলো শ্রান্ত লোকের বিভিন্ন সুরের নাসিকা গর্জনের মধ্যে অভিমন্যুর আর ঘুম এলো না! ট্রেনের খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে ভিজে মাতাল হাওয়া। কি এক অস্বস্তিতে ছটফট করছিল ও, চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছিল একটাই দৃশ্য – কালো টপ আর নীল জীনস পড়া অস্পস্ট এক নারী ছুটে আসছে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে, অনেক চেষ্টা করেও তার হাতটা ধরতে পারছে না ও। বাকি রাতটা জেগেই কাটিয়ে দিল অভিমন্যু, ওর হাতে আর বুকে লেগে থাকা মেয়েলী পারফিউমের মিষ্টি গন্ধটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো!

*****************************__*************************

অভিমন্যু সেন!
.
.
মনে মনে বেশ কয়েকবার নামটা আওড়ালো তিন্নি। কেমন যেন রাগী রাগী! আর অদ্ভুতও! খালি শাসন ফলাতে চায়! তাও কেমন একটা অদ্ভুত চৌম্বকশক্তি আছে লোকটার কথা বলার ধরণ, গলার ব্যরিটোন, সবেতেই। তারপরই, মনে মনে নিজেকে দুটো চড় আর পাঁচটা লাথি কষালো তিন্নি। ছিঃ ছিঃ। এতক্ষন কি ভাবলো লোকটা ওর সম্বন্ধে? নির্লজ্জ বেহায়া একটা! একবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, একবার গায়ে ঢলে পড়ছে এরপর আবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েও পড়ছে! লোকটার কাছে নিজের কি দারুন ইম্প্রেশনটাই না বানালো তিন্নি!

অভিমন্যু সেনের কথা ভাবতে ভাবতেই সীট নাম্বার ৪২র দিকে এগোলো তিন্নি আর তখনই সায়ককে দেখতে পেল!

যেন ভুত দেখেছে এমনি অবাক হয়ে সায়ক এগিয়ে এলো
— আরে! তুই কোথা থেকে? আমরা তো ভাবছিলাম তুই বোধহয় ট্রেন ধরতেই পারিস নি।

হালকা হাসলো তিন্নি। — ভুল করে আর্মি কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়েছিলাম! বর্ধমানে চেন্জ করলাম!

সায়কের সাথে বাকিদেরও মুখ হাঁ হয়ে রইলো। তারপরই সমবেত চিৎকার শুরু হয়ে গেল — “আর ইউ ক্রেজি? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? হোয়াট ওয়ার ইউ থিঙ্কিং?”

হাঁউমাউ করে উঠল সায়ক — তুই এতটা ইরেসপন্সিবল আমি ভাবতেই পারি নি। অন্তত আমায় ফোন করতে পারতিস? তুই জানিস আর্মির লোকেরা কতো ডেন্জারাস হয়?

একমুহুর্তে মুখটা তেঁতো হয়ে গেল তিন্নির — ডেঞ্জারাস? দেশের সুরক্ষার ভার যাদের হাতে, 365X24 আওয়ার্স যারা বর্ডারে দাঁড়িয়ে থেকে দেশকে রক্ষা করছে তারা ডেঞ্জারাস তো হবেই কিন্তু আমার মতো সাধারণ পাবলিকের জন্য কেন?

ততোধিক জোরে সায়ক চেঁচিয়ে উঠলো — “তুই কি জানিস আর্মি নিয়ে? মেয়েদের সাথে কেমন বিহেভ করে ওরা তুই দেখেছিস? এতো এতো নিউজ, এতো রিউমার ওদের নিয়ে, সে কি এমনি এমনি? যদি তোকে কিছু করে দিতো? যদি ট্রেন থেকে নামতে না দিতো? যদি ওরা তোকে আটকে রাখতো ওই কম্পার্টমেন্টে? কি করতিস তখন? কে খবর দিতো আমাদের? তোর বাড়ির লোক তো আমায় দোষ দিতো!”

–চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে আমি পড়ে যাচ্ছিলাম সায়ক, ওই আর্মিরই একটা লোক আমায় বাঁচিয়েছে!

— “ওহ মাই গড! আর ইউ অলরাইট?”
খুব স্টাইল করে চুল কাটা, দেখতেও তেমনই স্টাইলিশ একটা মেয়ে উঠে এলো ওর সিট ছেড়ে।

বাকি সবার উদ্দেশ্যে বললো — “তোরা থাম এবার, জার্নি শুরু হতে না হতেই এমন ঝামেলা শুরু করে দিলি, শান্ত হয়ে বস দেখি! হাই সীমন্তিনী, আমি পিয়াসা, সায়কের স্কুল ফ্রেন্ড, এরা হলো অতনু, নির্মাল্য, মেঘা ….”

একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো পিয়াসা। তিন্নি এক দুজনকে আগে থেকেই চেনে যদিও, কমন কলেজ বা অফিস প্রজেক্টে চেনা মুখ, যদিও গলায় গলায় বন্ধুত্ব নেই, শুকনো হাই হ্যালো বা মাঝে মাঝে চা খেতে গিয়ে অফিসের নিচে দেখা হয়! একমাত্র মেঘা ওদের প্রজেক্টেই কাজ করতো ছয়মাস আগেও, এখন অন্য প্রজেক্টে চলে গেছে!

মেঘা উঠে এলো তিন্নির পাশে, ওকে জড়িয়ে ধরে বললো — “কত্ত রোগা হয়ে গেছিস রে তুই! কি ডায়েট ফলো করছিস আমাকেও বল, দিন দিন বেলুনের মতো ফুলছি, ভুঁড়ি এবার মাথায় গিয়ে ঠেকবে! “

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো, তিন্নিও হেসে ফেললো! সত্যিই মেঘা অনেক হেলথি হয়েছে আগের থেকে! আসলে সারাদিন ১০-১২ ঘন্টা অফিসের এসিতে বসে বসে কাজ করে ওদের সবারই গায়ের রং ফ্যাকাশে , আর কোমরের পর থেকে ভারী শরীর হয়ে গেছে, ডেইলি ট্রেনে ৩ ঘন্টার সফর না করলে তিন্নিরও তাই হতো বোধহয়! একটু আগের গুরুগম্ভীর পরিবেশটা হালকা হয়ে গেছে, সবার হাসি ঠাট্টার মধ্যে মেঘাই পয়েন্ট আউট করলো — “এই জ্যাকেটটা আবার কার? তোর নিশ্চয়ই নয়?”

চমকে উঠলো তিন্নি! এই যাহ! অভিমন্যুর জ্যাকেটটা ফেরত না দিয়েই চলে এসেছে ও, খেয়ালই ছিল না! লোকটাই বা কিরকম? তিন্নি না হয় নিজের দিকে তাকায়নি তাই বলে লোকটা নিজের জিনিস চেয়ে নিয়ে ফেরত যাবে না?

পিয়াসা ততক্ষনে ফোড়ন কেটেছে – “এটা কি সেই মিস্ট্রি হিরো আর্মি ম্যানের জ্যাকেট? মাই গুডনেস! এতো পুরো ফিল্মি ব্যাপারস্যাপার! “

কে একটা সিটি মারলো! সবাই এতো জোরে হেসে উঠেছে। আশেপাশের বার্থের লোকেরা রীতিমতো ওদের সব কথা শুনতে পাচ্ছে! তিন্নি বিব্রত হয়ে বললো — “কি অদ্ভুত তো তোরা! এখনো আমার লাগেজ রাখার ব্যবস্থা করলি না আর এসব শুরু করে দিলি?“

শশব্যস্ত হয়ে সবাই জায়গা ছেড়ে দিল। সায়ক ওকে সিটিং আরেঞ্জমেন্ট বুঝিয়ে দিলো, ওদের সবার একসাথে সিট্ পড়ে নি, টোটাল ১০ জন যাচ্ছে ওরা , ২-৩ জন কে সায়কও চেনে না, ওরও “কমন” ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড! উইকেন্ড গেটওয়ে গ্রুপ থেকে সবাই জড়ো হয়েছে, তিন্নিকে নিয়ে ৪টে মেয়ে,৬ জন ছেলে! এস ওয়ান কামরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৭টা সিট্, বাকি সিট এস টুতে পড়েছে, সবাই এখন এখানেই আছে যদি TTকে বলে কোনোভাবে একসাথে সবার সিটিং আরেঞ্জমেন্ট করা যায়, একান্তই না হলে মেয়েরা সবাই আর সায়ক, অতনু, নির্মাল্য এই কামরায় থাকবে, বাকি ৩টে ছেলে এস টু-তে চলে যাবে । খাওয়া নিয়ে চিন্তা নেই, ট্রেনের খাবার নেওয়া হয়ে গেছে, তাছাড়া বাড়ি থেকেও টুকিটাকি অনেকছু আনা হয়েছে, সবাই ভাগ করে খেয়ে নেবে ওরা সবাই আর সকাল ৭টা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে যাবে!

দারুন প্ল্যান, তিন্নির বেশ ভালো লাগলো, এটাই ওর প্রথমবার বাড়ির লোক ছাড়া এক এক বন্ধুদের সাথে বেরোনো! বেশ একটা নতুন রকমের উত্তেজনা হচ্ছে, তার সাথে সবাই এক-ই বয়সী, বিশাল হইচই হচ্ছে!এরকম পরিবেশে আগে কখনো তিন্নি থাকে নি! একটা সাইড লোয়ার বার্থে ওর রুকস্যাকটা রেখে বাড়িতে ফোন করে বাবাকে জানিয়ে দিলো ট্রেনে উঠে গেছে, এতক্ষন নেটওয়ার্ক ছিল না বলে ফোন করতে পারে নি। মিনিট দশেক বাবার সাথে কথা বলে, ট্রিপের প্ল্যান, মোটামুটি জানিয়ে ফোন ছেড়ে দিলো তিন্নি, তারপর সবার সাথে গল্পে যোগ দিলো। যদিও কেউ লক্ষ্য করলো না, মাঝে মাঝেই জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তিন্নি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে – হতে পারে প্রথম বার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার নতুন অভিজ্ঞতার জন্য অথবা, মা-বাবার জন্য মনখারাপও হতে পারে, নাকি রোদে পোড়া সেই চওড়া কপাল, ভুরুর কাছে কাটা দাগ, বাদামি চোখ আর হাস্কি গলায় কথা বলা আর্মি অফিসার অভিমন্যু সেনের জন্য?

শুধু তিন্নিই জানে এতো হাসি আনন্দের মধ্যেও কেন ওর মনের গভীরে কি একটা অস্বস্তির চোরাকাঁটা খচখচ করছে!

রাত সাড়ে ১০টাতেই কপার্টমেন্টের আলো নিভিয়ে দিলো, হালকা নীল ডিম্ লাইটে আর ওদের গল্প জমলো না, সবাই যে যার জায়গায় শুতে চলে গেলো। তিন্নি নিলো সাইড লোয়ার বার্থটা। ফোনে গান চালিয়ে কানে হেডফোন গুজে ট্রেনের বালিশে মাথা রেখেও তিন্নির চোখে ঘুম এলো না, ট্যাব খুলে কবিতা পড়তেও ওর মন বসলো না। স্লীপার ক্লাসের খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে ভিজে হাওয়ার সাথে মেশা মনকেমনের গন্ধ। অদৃশ্য মনটা বলে উঠলো — সে নেই, সারাজীবনের মতো সে হারিয়ে গেছে এ দুনিয়ায়। বুকটা ধক করে উঠলো যেন। শেষে অভিমন্যুর জ্যাকেটটা জড়িয়ে ধরে, জানলা দিয়ে উল্টো দিকে ছুটে চলা রাতের নিশ্চুপ পৃথিবীর দিকে শুধু নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো তিন্নি! যতবার ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে, একটাই মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে আসছিল বার বার — অভিমন্যু সেন! আবারও একটা শিরশিরানি ছড়িয়ে যাচ্ছে তিন্নির সারা শরীরে। ঝমঝম শব্দে রাতের নর্থবেঙ্গল মেল-ট্রেন ছুটে চললো পরের স্টেশনের দিকে আর একরাশ মনকেমন আর অদ্ভুত এক কান্না মেশানো ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে একদৃষ্টিতে তিন্নি তাকিয়ে রইলো বাইরের অন্ধকারের দিকে।
ওর কানে কানে অরিজিৎ সিং তখন বলছে

Mila jo tu yahan mujhe
Dilaun main yakeen tujhe
Rahun hoke tera sada
Bas itna chaahta hu main

Thodi jagaah dede mujhe
Tere paas kahin reh jaaun main
Khamoshiyan teri sunu
Aur door kahin na jaaun main

চলবে।