সূর্য ডোবার আগে পর্ব-১২

0
506

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-১২
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়লেও ট্রাকের ভেতরে বসে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না, তবে রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। হেলেদুলে ভাঙা পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে ট্রাকদুটো আর ভেতরে সবাই টিনের পুতুলের মতো নেচে নেচে চলেছে! ধরে বসার জন্য সবার সামনে একটা করে দড়ির হাতল ঝুলছে ট্রাকের ছাদ থেকে, তিন্নিও ধরতে গেল একটা হাতল, অভিমন্যু আটকালো –“অনেকটা রাস্তা এখনও, অতক্ষণ ধরে থাকতে পারবেন না, আমাকে ধরে বসুন।“

এমনিতেই অভিমন্যুর পাশে ওরই পরনের জামা পড়ে বসে থেকে তিন্নির অস্বস্তির শেষ নেই , গায়ের কম্বলটাও কুটকুট করছে পায়ের কাছে.. কে জানে ছারপোকা আছে কিনা!! তার ওপর আবার নাকি অভিমন্যুকেই ধরে বসতে হবে? কিন্তু উপায়ন্তরই বা কি! ট্রাকে ওদের সাথেই বসে থাকা আর্মির বাকি আট দশজন যারা, সবার চোখ সেই কখন থেকে ওদের দুজনের দিকেই নিবদ্ধ! একটা ঢোঁক গিলে মনের চোরাগোপ্তা অস্বস্তিটুকু সামলে নিলো তিন্নি! খুব সন্তর্পনে নাম-কে-ওয়েস্তা ভাবে কোনরকমে অভিমন্যুকে ধরে বসতে, চাপা হাসির শব্দ এলো একটা অভিমন্যুর তরফ থেকে। নীচুস্বরে তিন্নি জিজ্ঞেস করলো — কি হলো?

গলায় হাসির আভাস রেখেই অভিমন্যু বললো
— নাহ্ ম্যাডাম! হাসি পেলো এই দেখে …. পরপর দুইবার আপনার প্রাণ বাঁচালাম তারপরও এতো অস্পৃশ্য আমি?

কি বলা যায় এর উত্তরে? মুখ নিচু করে নিলো তিন্নি, চুপ করে রইলো অনেকক্ষন। তারপর বললো – আপনি এখানে কি করে এলেন তা তো বললেন না?

— আপনার চা দোকানি সবচেয়ে কাছের আর্মি চেকপয়েন্টে খবর দেয়, আমরাও এই রাস্তা দিয়েই ফিরছিলাম টীম নিয়ে। SOS আসে -একজন মহিলা ট্যুরিস্টকে তার সঙ্গীরা আ্যব্যান্ডন করে চলে গেছে। কলটা টেকওভার করি, এসে দেখলাম “আপনি”! কিন্তু যাই বলুন ম্যাডাম, আপনার ট্রিপ কিন্তু দারুন কাটছে!! একবার ট্রেনে কাটা পড়তে যাচ্ছেন, একবার বন্ধুরা ফেলে চলে যাচ্ছে …

বড় একটা শ্বাস ফেললো অভিমন্যু। ওর কথার রেশ ধরেই খুব আস্তে করে তিন্নি বললো – ডেস্টিনেশনও চেঞ্জ!…

— মানে?

— আসলে আমাদের গ্যাংটক আসার কথাই ছিল না। যে হোটেল বুক করেছিল, সে দার্জিলিংয়ের বদলে ভুল করে গ্যাংটকের হোটেল বুক করে ফেলে, দুটো হোটেলের একই নাম!!

অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে কয়েকপল তিন্নির দিকে তাকিয়ে রইলো অভিমন্যু। তারপর অবাক গলায় বললো — আপনাদের জেনারেশন এতো-টা ইরেস্পন্সিবল কেন বলুন তো?

একটু হলেও রেগে উঠলো তিন্নি!
— আপনাদের জেনারেশন মানে? আপনি কি অন্য জেনারেশন থেকে বিলং করেন নাকি?

দুদিকে মাথা নাড়লো অভিমন্যু – না ম্যাডাম আপনাদের থেকে আমরা অনেক আলাদা!! নো কম্প্যারিসন!

অভিমন্যুর কথার টোনে কি যেন ছিল, তিন্নির চিড়বিড়ানি রাগটা ফুলে ওঠার আগেই নিভে গেল! আস্তে করে বললো — সে জানি।

গাড়ি চলছে নিজের মতো। আর কারো দিকে না তাকিয়েও তিন্নি বুঝতে পারলো ট্রাকে বসে থাকা বাকি দশজোড়া চোখ তখনও ওদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে। হাঁ করে গিলছে দুজনের সব কথোপকথন, গা টেপাটেপিও করছে! এদিকে অভিমন্যুর যেন কোন ভ্রুক্ষেপই নেই! সটান হয়ে বসে আছে, অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না ভালো, বোঝা যায় না কোনদিকে তাকিয়ে ও। মাঝখানের এই নীরবতাটুকুর সুযোগে তিন্নির মাথার নিউরনগুলো “Newton’s cradle” র মতো যেন ছোটাছুটি লাগিয়ে দিল! সত্যি! কি কান্নাটাই না কেঁদেছিল তিন্নি কাল দুপুরে! আর আজ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আবার ও অভিমন্যুর পাশে! না চাইতেও গাল লাল আসলো তিন্নির। নাহ! অস্বস্তিকর নীরবতাটা ভাঙতেই হবে, না হলে এমনই সব ভুলভাল ভাবনা ঘুরবে মাথায়! কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে মনের ভেতর অনেক হাতড়ে কথা খুঁজে বার করলো তিন্নি — আপনার জ্যাকেটটা সেদিন থেকে আমার কাছেই রয়ে গেছে।

চাপা হাসির একটা শব্দ হলো অভিমন্যুর গলায় – “জানি। নো প্রব্লেম।“

দুজনেই আর কোনো কথা খুঁজে পেল না! কিছুক্ষন পর অভিমন্যু গলা ঝেড়ে বললো — অনেক বকবক করলেন……এবার একটু চোখ বন্ধ করুন, আর ঘন্টা খানেক পরই পৌঁছে যাবো।

— কোথায় যাচ্ছি আমরা?

— Not disclosable to civilian ম্যাডাম। তবে ভরসা রাখুন, আমি থাকতে আপনার কোনো ক্ষতি হতে দেব না।

কি ছিল অভিমন্যুর স্বরে, কয়েক সেকেন্ডস তিন্নি অপলক তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে। অভিমন্যুও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল না! আচমকা আবার যেন শরীরটা অবশ হয়ে এলো তিন্নির। চলন্ত গাড়ির মধ্যে ধীরে ধীরে অদৃশ্য একটা ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরী হচ্ছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো ও! আজ দুপুরে মেঘার বলা কথাটা তিন্নির মাথায় ঝলক মারলো যেন, “কিস করেছিস?”

ধুর! আর ভাবতে পারছে না ও! কথা না বাড়িয়ে অভিমন্যুর চওড়া কাঁধের ওপর অবসন্ন শরীরে মাথা এলিয়ে দিলো তিন্নি, আড়চোখে দেখলো ওর ঠান্ডা নরম হাতদুটো আবারো অভিমন্যুর কড়াপড়া শক্ত মুঠিতে সযত্নে বন্দী হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে পা অবধি একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ বয়ে গেল যেন। তিন্নি আরএকবার কেঁপে উঠতেই অভিমন্যু খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো — কি হল? শীত করছে?

কোনো জবাব না দিয়ে ক্লান্ত চোখদুটো বন্ধ করে নিল তিন্নি।
.
.
.

তন্দ্রা মতো এসে গিয়েছিলো তিন্নির, ট্রাক থামতে অভিমন্যুর আলতো ছোঁয়ায় সোজা হয়ে উঠে বসলো। স্পষ্ট চোখে ওর দিকে তাকালো অভিমন্যু– “এসে গেছি। মুখ বন্ধ রাখবেন। আমি না বলা অবধি কোনো কথা বলবেন না, ঠিক আছে? আর এখানে কিন্তু মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না, জ্যামার লাগানো আছে।“

— “বললাম যে ফোনটা আগেই ওই গাড়িতে ফেলে এসেছি? “ নিচু গলায় জবাব দিলো তিন্নি। তখনো ঘোর কাটে নি ওর।

হেসে ফেললো অভিমন্যু — ওহ হ্যাঁ! সুন্দর!!! আসুন তবে, আর কি!

ঘাড় হেলাল তিন্নি ! আর কি কি বাকি আছে ওর অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হতে?

এক এক করে আর্মির সেনারা ট্রাক থেকে নেমে গেলে সবার শেষে অভিমন্যু নামলো, তারপর কোলে করে তিন্নিকে নামাতে যেতেই আপত্তি জানালো তিন্নি – না না! ঠিক আছে! আমি পারবো!

–না, পারবেন না!
অতি অনায়াসে বিনা দ্বিধায় আরএকবার তিন্নিকে কোলে তুলে নিলো অভিমন্যু।

**************************__****************************

ঝড়, বৃষ্টি, সব ট্যুরিস্টদের একসাথে ফেরার ট্রাফিকে গ্যাংটক ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে সাতটা বেজে গেলো। হোটেলের সামনে সায়করা একে একে সবাই নামতে মেঘার খেয়াল হলো — ওই? সীমন্তিনী কই?

–সীমন্তিনী কই মানে? তোদের গাড়িতে ছিল না? সায়ক চেঁচিয়ে উঠলো

পিয়াসা বললো – না, ও তো বাবামন্দির থেকে বেরোনোর পর যখন আবার আমরা দাঁড়ালাম, তোদের গাড়িতে চলে গেল।

— আমাদের গাড়িতে তো আসে নি? কি করিস তোরা পিয়াসা?

ঠোঁট ওল্টালো পিয়াসা – আমাকে তো তাই বলে গেলো মনে হলো! গাড়িতে উঠতে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলো!

মেঘা চেঁচিয়ে উঠলো — “মনে হলো ” মানে টা কি? তুই ঠিক করে শুনিস নি?

আমতা আমতা করে পিয়াসা বললো — আমার কানে হেডফোন ছিল, গান শুনছিলাম।

— তোরা কি করিস রে? একটা জলজ্যান্ত মেয়ে গাড়িতে উঠলো কিনা তোদের খেয়াল নেই?
দুহাতে নিজের মাথার চুল ছিড়তে বাকি রাখলো সায়ক!
— “কি করবো এবার? ওর বাড়ির লোক আমায় খুন করে ফেলবে রে! পুলিশ কেস হয়ে যাবে।“

মেঘা তখন তিন্নির নাম্বার ডায়াল করতে লাগলো! পিড়িং পিড়িং শব্দে ফোন বাজলো সায়কের পকেটে – তিন্নির ফোন সায়কের পকেটে, সেই নাথুলাতে তিন্নির থেকে ফোনটা নিয়েছিল সায়ক, ফেরত দেওয়া হয় নি!

টেনশনে মেঘা কেঁদে ফেলবে এবার! চেঁচিয়ে উঠলো – সীমন্তিনীর ফোনটাও আমাদের কাছে! ও তো চেষ্টা করেও আমাদের সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারে নি! কি হবে? পুলিশ বলবে আমরা ইচ্ছে করে ছেড়ে এসছি ওকে! আমাদের সবার নামে আ্যটেম্প্ট টু মার্ডার কেস হয়ে যাবে এবার!

নির্মাল্য এগিয়ে এলো, ওদেরকে শান্ত করতে বললো — চেঁচামেচি করে কি হবে এখন, আগে চল নিয়ারেস্ট থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করি!

— আর পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে?

–অন্য আর কি উপায় আছে তোরাই বল?

এদিকে হোটেলের রিসেপশন থেকে ছুটতে ছুটতে একজন হোটেল স্টাফ বেরিয়ে এলো – স্যার আপনাদের সাথে সীমন্তিনী আচারিয়া বলে কোনো মেয়ে ছিল?

–হ্যাঁ কেন? সায়ক এগিয়ে এলো

— নাথুলা বেস ক্যাম্প থেকে ফোন এসেছে – ইন্ডিয়ান আর্মি ম্যাডামকে রেসকিউ করেছেন নিউ বাবামন্দিরের কাছ থেকে। ধস পড়ে রাস্তা বন্ধ, কাল সকালে রাস্তা খুললে ম্যাডামকে ওনারা হোটেলে পৌঁছে দেবেন।

সবার মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো – আর্মি বেস ক্যাম্পে সীমন্তিনী? একা? আর কি মেয়েটা আস্তো থাকবে?

**************************__****************************

মিলিটারির ওপেন ক্যাম্প। অনেকটা জায়গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বন্ধুর রুক্ষ মাটির ওপর এপাশ ওপাশ ইঁট, বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার বানানো, পর পর সারি দিয়ে মিলিটারি ট্রাক, জীপ্ দাঁড়িয়ে আছে, তার ই সাথে রয়েছে অনেকগুলো তাঁবু, জংলা সবুজ রঙা! অভিমন্যু কথা বলছে ওর সিনিয়র অফিসারের সাথে, একটু দূরে দাঁড়িয়েও অভিমন্যু আর কর্নেল শ্রীবিষ্ণু রঙ্গনাথামের পুরো কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলো থাকা নোংরা কম্বল গায়ে জড়িয়ে জবুথবু তিন্নি! কর্নেল বেশ রেগেই গেছেন বলে মনে হচ্ছে।

–হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান? ডু ইউ নো হার পার্সোনাললি?

–নো স্যার বাট আই মেট হার ইন দ্য ট্রেন ওয়ান্স।

–হোয়াট ইফ ইটস এ ট্র্যাপ অভিমন্যু? হোয়াট ইফ দিস ইজ এ হানি ট্র্যাপ? উই ডোন্ট ইভেন নো হু শি রীয়্যালী ইজ!

–ডিড আই হ্যাভ এনি আদার অপশন স্যার? দ্য রোডস আর ব্লকড।

একটু দূরত্বে থেকে সবকথাই কানে আসছিল তিন্নির, কয়েক পা এগিয়ে এলো – “স্যার ক্যান আই সে সামথিং?”

অভিমন্যু ফিরলো ওর দিকে — আপনি যান ম্যাডাম, আমাকে ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে দিন।

মাঝে মাঝে পরিস্থিতি বিশেষে তিন্নির শান্ত, দুর্বল “বেচারা” চেহারাটার খোলস ছেড়ে একটা খোলা তলোয়ার বেরিয়ে আসে, খু-ব অল্প সময়ের জন্য…..কিন্তু, আসে। কর্নেল আর অভিমন্যুর কথা শুনতে শুনতে আজও সেই তরবারি ছিটকে এলো। অভিমন্যুকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি কর্নেল স্যারের দিকে ফিরলো তিন্নি – “আপনি আমায় গুগল করে দেখতে পারেন।“

–এক্সকিউজ মি?? কর্নেল রঙ্গনাথামের ভুঁরু কুঁচকে উঠলো।

— ইয়েস স্যার, মাই নেম ইজ সীমন্তিনী আচারিয়া, আই রাঙ্কড ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড এক্সামস, আই গেস ইউ ক্যান ফাইন্ড মাই নেম এন্ড ফটো ইন ওল্ড নিউজ আর্টিকেলস। আই ক্যান অলসো গিভ ইউ মাই ওয়ার্ক সুপারভাইজার্স নেম এন্ড লিঙ্কডিন আই.ডি…. ইউ ক্যান কল হিম এন্ড গেট মী ভেরিফায়েড দ্যাট আই ডু ওয়ার্ক ইন দ্যাট অর্গানাইজেশন।

তিন্নির স্পষ্ট অ্যাকসেন্ট, আর ব্যক্তিত্ব দেখে কর্নেল রঙ্গনাথামের মুখের রাগ রাগ ভাব উধাও হয়ে গিয়ে স্মিত হাসিতে ভরে উঠলো। অভিমন্যুর দিকে ফিরে হাত উলটে হেসে বললেন — ওয়েল ইন দ্যাট কেস…. শি ইজ অল ইওরস অভিমন্যু।

কর্নেল স্যার যে অর্থেই বলুন না কেন তিন্নির মন আবার ফড়িংয়ের মত নেচে উঠলো! “রীয়েল্যী? আ্যম আই ? অল অভিমন্যু’স?”

নিজের মনকে কষে এক ধমক লাগালো তিন্নি! কোথায় এই সিচ্যুয়েশনে কান্নাকাটি করে চিন্তায় আকুল হবে ও ….. তা নয়, অভিমন্যুকে দেখেই ওর দিল “গার্ডেন গার্ডেন” হয়ে যাচ্ছে! কতদিন চেনে ওরা একে অপরকে? দুইদিন মিলিয়ে সাকুল্যে তিন চার ঘন্টা হবে হয়তো! তাতেই এই? মুখ টিপে নিজেকে সংযত করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো তিন্নি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে।

অভিমন্যুর সাথে কর্নেল আরো কিছু কথাবার্তা সেরে চলে যেতে অভিমন্যু তিন্নির দিকে ফিরলো। গলায় হাসি মাখিয়ে কৃত্রিম ভয়ের সুরে বললো – বাপরে! আপনি তো নমস্য ব্যক্তি দেখছি। স্টেটবোর্ড এক্সামের টপার?

অভিমন্যু কি প্রশংসা করছে না বক্রোক্তি! তিন্নি ঠিক বুঝতে পারলো না! কাদামাটিতে জুতো ঘষতে ঘষতে অস্বচ্ছন্দভাবে বললো —- টপার নই!! সেভেন্থ রাঙ্ক করেছিলাম উচ্চমাধ্যমিকে।

—- তাই বা ক’জন হয়? কিন্তু আপনাকে দেখে তো ঠিক মনে হয় না?

স্পষ্ট চোখে সরাসরি তাকালো তিন্নি —- কি মনে হয় আমাকে দেখে?

একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেলো অভিমন্যু, তারপর বললো – “আমার ধারণা ছিল টপাররা সব রিসার্চার নয়তো সায়েন্টিস্ট হয়, কেউ আর দেশে থাকে না।“

—- সব টপারের লাক সমান হয় না অভিমন্যু। সব টপার দেশ ছেড়ে পালায় না, আপনি একাই দেশভক্ত নন।

আবছা গলায় বললেও তিন্নির হঠাৎ কাটা কাটা স্বরে থমকে গেলো অভিমন্যু, তারপর নিচু গলায় বললো — সরি আপনাকে ইনসাল্ট করতে চাই নি।

— আমার নামটাও আপনি জানতে চান নি!

এতক্ষন ধরে বুকে জমে থাকা চাপা অভিমানের জমাট শব্দগুলো ছিটকে বেরিয়ে আসতেই মনটা দমে গেল তিন্নির! গত দেড় দুই ঘন্টা বা দেড় দুই দিন, ঘুম ঘুম মিষ্টি একটা স্বপ্নের ঘোরে ছিলো ও, এক ধাক্কায় মাটিতে থুবড়ে পড়লো যেন। ভুলেই গিয়েছিল তিন্নি, গত দুইদিন ধরে থেকে একা একাই যে দিবাস্বপ্ন দেখে যাচ্ছে ও, সবই যে একতরফা! বাস্তব তো তার থেকে বহু যোজন দুরে। অভিমন্যুর কাছে তিন্নি তো তেমন গুরুত্বপুর্ণ কেউ নয়, সেইজন্যই হয়তো ওর নামটুকু অবধি জানার প্রয়োজনবোধ করে নি সে! এমনকি এতোটা সময় এক গাড়িতে পাশাপাশি বসেও না?! ভেতর থেকে অযৌক্তিক চাপা কান্না ফুঁসে বেরোতে চাইলেও মুখ চিপে রইলো তিন্নি, আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছে করছিলো না ওর।

কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অভিমন্যু বললো — আসুন, যাওয়া যাক।

কথা না বাড়িয়ে পথ দেখিয়ে হাঁটতে লাগলো আগে আগে। বালির ওপরেই কাঁটা গুল্মলতা ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক, খানিকটা ব্যবধানে পরপর অনেকগুলি ইঁটের স্তুপ পেরিয়ে অভিমন্যুর পেছন পেছন একটা টেন্টে এলো ওরা, ভেতরে ঢুকে অভিমন্যু নিজের এক সেট স্পোর্টসওয়ার টি শার্ট আর পাজামা বার করে দিলো, কেজো হাসি হেসে বললো — “এক্সট্রেমলি সরি! এর বেশি আপনাকে কিছু দিতে পারবো না! এটা আমার টেন্ট, নিশ্চিন্তে এখানে রাত কাটান, কাল সকালে দেখা হবে।
একটু থেমে তিন্নির দিকে আর এক পলক তাকিয়ে বললো — খাওয়ার জল এই বোতলে আছে, আর একটু রাত হলে হাবিলদার এসে আপনাকে ডিনার দিয়ে যাবে। বাইরে বেরোনোর দরকার নেই।”

— আর আপনি? আপনি কোথায় থাকবেন?

–আমি আজ নাইট ডিউটি নিয়ে নেবো, শোওয়ার দরকার পড়বে না, কাল সকালে আপনাকে গ্যাংটকে পৌঁছে দিয়ে আমার ছুটি।

ততক্ষনে রাগ কমে গেছে তিন্নির, সেই জায়গাটায় ঢুকে আসছে একটু একটু অপরাধবোধ! ছিমছাম তাঁবুর ভেতরটা দেখতে দেখতে ধীর গলায় বললো
— খুব অসুবিধায় ফেললাম না আপনাকে?

হাসলো অভিমন্যু — আর্মির ডিউটি ম্যাডাম, কিছু করার নেই! চললাম, রাতে টেন্ট থেকে বেরোবেন না।

অভিমন্যু যাবে বলে সবে পিছন ঘুরেছে। কিন্তু ততক্ষনে তিন্নির খোলা তরবারি আবার ওর “বেচারা” খাপে ঢুকে গেছে। বাইরের শোঁ শোঁ হাওয়ার আওয়াজ, তাঁবুর চারপাশে ভারী বুটের শব্দ, অত্যাধুনিক রাইফেল আর বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সেনা আসা যাওয়ার রাস্তায় সারি সারি ট্রাক, কামান আর পুরো ক্যাম্পে ও একা একটা মেয়ে! চোখের সামনে দৃশ্যটা ভেসে উঠতেই অজানা একটা ভয়ে কুঁকড়ে গেল তিন্নি! এখানে এতগুলো অচেনা লোকের মধ্যে ওর একমাত্র ভরসা অভিমন্যু! সারাটা রাস্তা অভিমন্যুর পাশে বসে থেকে যে ভয়টা একবারের জন্যও ওর মনে উঁকি মারে নি, অভিমন্যুকে চলে যেতে দেখে সেই ভয়টাই নখ দাঁত বার করে আছড়ে পড়লো যেন তিন্নির ওপর! কাতর একটা আর্তি ছিটকে এলো তিন্নির মুখ থেকে – অভিমন্যু? একটু দাঁড়াবেন? প্লিজ?

টেন্ট থেকে বেরোতে বেরোতে থমকে গেলো অভিমন্যু – বলুন?

—- “আমার……..আমি…….. আসলে আমি কখনো এরকম কোনো পরিস্থিতিতে পড়ি নি! এরকম একটা পরিবেশ, আপনি প্লিজ একটু থাকবেন আমার সাথে…….. যদি কাজ না থাকে?” আমতা আমতা করে বলেই ফেললো তিন্নি।

অভিমন্যু বোধহয় এটা এক্সপেক্ট করে নি! একমুখ প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষন, তারপর তিন্নির রক্তশূন্য মুখ আর কাঁপা গলার স্বরে মাথায় স্ট্রাইক করলো ব্যাপারটা। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো –”ভয় করছে”?

তাঁবুর মিটমিটে হ্যাজাকের আলোয় তিন্নির কাজলকালো চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো, ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে ঘাড় নাড়লো অল্প। ক্ষনিকের জন্য নীরব থেকে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে শেষে অভিমন্যু বললো — ওকে, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন! আমি একটু পর আপনার ডিনার নিয়ে আসছি!একসাথে খাওয়া যাবে। অলরাইট?

কৃতজ্ঞতায় গলা ভারী হয়ে এলো তিন্নির, চোখও। অস্ফুটে ঠোঁটগুলো নড়ে উঠলো ওর – থ্যাংক ইউ।

এতো আস্তে কথা, তাও শুনতে পেলো অভিমন্যু, আর্মির আরেকগুন বোধহয়! নরম গলায় বললো
– “মাই প্লেজার ম্যাডাম।“

টেন্টের সাদা পর্দা সরিয়ে ভারী জুতোর শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলো অভিমন্যু।

চলবে