সেই তুমি পর্ব-০১

0
6370

#-সেই তুমি
#- সানজিদা সন্ধি
#-পর্ব-১

এক্সকিউজ মি মিস্টার! আই লাভ ইউ! পিচ্চি একটা মেয়ের মুখে কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি। মেয়েটা কি চেনে আমাকে? জানে আমি কে? দেখে তো মনে হচ্ছে ইন্টার ফার্স্ট অর সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আর আমাকে তো চেনার কথা নয়। এই প্রতিষ্ঠানে আমি নতুন। না কি লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট? হচ্ছেটা কি এসব? বছরের প্রথম দিনে এরকম একটা ধাক্কা। উফ অসহ্যকর।আমার বিরক্তি রাগে পরিনত হতে বেশি সময় লাগলো না মেয়েটির সাহস দেখে।ঘাড়ে হাত দিয়েছে। কতবড় বেয়াদব মেয়ে। রাগে আমার কান গরম হয়ে গেলো। বুঝলাম চোখমুখও লাল হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা হট,জোস বলে কিছু শব্দ উচ্চারণ করলো। আর রাগ সংবরণ করতে না পেরে একটা থাপ্পড় দিয়ে উঠলাম। এতোক্ষনে মেয়েটার নেমপ্লেটে আমার চোখ গেলো। তার নাম জাফনা। নামটা দেখে একটু অবাক হলাম। বেশ আনকমন একটা নাম। জাফনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এটা দেখে বিরক্তি আরো বাড়লো।রাগের সময় কেউ ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদলে ভীষণ বিরক্ত লাগে আমার। জাফনা “সরি ভাইয়া,এটা ডেয়ার ছিলো” বলে চলে গেলো। দূর থেকে দুজন মেয়ে দাড়িয়ে পুরো বিষয়টা লক্ষ্য করলো।বছরের প্রথম দিন এক বিষাক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু হলো।আর ছেলেমেয়েও হয়েছে এমন ডেয়ারের নামে যতোসব উশৃঙ্খলতা। ১০ টা বাজতে আর কিছুক্ষণ বাকি। নতুন টিচারদের মিটিং আজ।প্রিন্সিপাল স্যার আমায় অডিটোরিয়ামে যেতে বলেছিলেন। একেই বাসা থেকে বের হতে লেট হয়েছিলো তারউপর এই বাজে ইন্সিডেন্ট। ভাঙা মেজাজ নিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুকলাম। মিটিং ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। দেরী করে ঢোকার পরে স্যারের সাথে চোখাচোখি হওয়ায় স্যারের চোখ রাঙানোতে নিজের প্রতি তিক্ততা যেন আরো বাড়লো। তাড়াতাড়ি একটা স্থানে বসে ভাবতে লাগলাম।কলেজের টিচার হিসেবে জয়েন তো করলাম ইচ্ছের বিরুদ্ধে। তবে এর ফল কি ভালো হবে?ভাবনার রেশ কাটতেই বুঝতে পারলাম প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে মঞ্চে ডাকলেন। অস্বস্তিতে মাথা নিচু হয়ে গেলো আমার। আবারও স্বজনপ্রীতি নামক যাতাকলে পিষে মরতে হবে। প্রিন্সিপাল কর্নেল আবির চৌধুরী আমার পিতা। আর আমি তার একমাত্র পুত্র সন্তান আহনাফ চৌধুরী। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি। প্রাচ্যুর্যের মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। অত্যাধিক জেদী,আর অহংকারী আমি। নিজেই নিজের দূর্নাম করতে পারি। এই গুণটা ভালোই আছে আমার। যেখানেই যাই বাবার ছায়া পিছু ছাড়ে না আমার । একা সংগ্রাম করে কিছু করতে দেয় না। তাই কি আর করার তার অনুরোধে তার চোখের সামনে থাকতে কলেজে জয়েন করা। বাকি টিচারদের সামনে শুধুমাত্র সহকারী শিক্ষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে না দিয়ে তার ছেলের ট্যাগটা লাগানোয় মেজাজ অত্যাধিক খারাপ হয়ে গেলো। ইনটলারেবল। বাবার কথার রাগটা একটু প্রশমিত হলো। আহনাফ তুমি এখন বড় হচ্ছো বাবা! নিজের রাগটা তো সংবরণ করতে শেখো। নয়তো ভবিষ্যতে ভালো হবেনা। বাবা এটা নিয়ে আমরা বাসায় গিয়ে আলোচনা করছি। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই একটা মেয়ের দিকে তাকানোর সাথেই আমার চোখ থেমে গেলো। এটাতো মালিয়াত। আমার ক্লাসমেট ছিলো। এখানে কি করছে সে? আমাকে বেশি ভাবতে হলোনা। সে নিজেই কাছে এসে বললো,” আহনাফ কেমন আছো? আমরা এখন একে-অপরের সহযোগী, এখন নিশ্চয়ই তুমি আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করবে না!” আমি মুচকি হেসে বললাম সেটাতো সময় আর তোমার ব্যাবহারের উপর নির্ভর করবে মালিয়াত। আর দেখছি আগের মতোই হ্যাবলা রয়েছো। একটু আপডেট হও। নয়তো ফিউচারে কাউকে পাবে না। উফ অসহ্যকর দিন। স্টুডেন্টদের সাথে প্রথমদিন আজ। ক্লাসে ঢুকে জাফনার দিকে চোখ গেলো। যা ভেবেছিলাম তাই। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার এর মেয়ে। আমার ভাবতে অবাক লাগছে এই বয়সে লেখাপড়া বাদ দিয়ে এসব সাহস দেখাচ্ছে এরা। ইডিয়ট একেকটা। আমার হাতে পড়েছে এবার মজা তো বুঝাবেই। তার জন্য দিনের শুরুটা বাজে হয়েছে। শাস্তি তো পাবেই বাছা। পরিচয় পর্বে জানতে পারলাম তার পুরো নাম সুহাইলা মুবাররাক জাফনা। আর পাশে থাকা দুটো মেয়ের একজন অরিন আরেকজন সাবা। এই তিনটাকে তো দেখে নেওয়ার কথা আছে। মাথাটা হুট করে চক্কর দেওয়ায় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সোজা বাসায় চলে এলাম। বাড়িতে এসেই মেজাজ আরেকধাপ খারাপের পথে। বারংবার নিষেধ করা স্বত্তেও আমাকে দেখতে আসার জন্য পাত্রীপক্ষকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে। কতবার বলেছি মামনিকে আমি বিয়ে করবোনা। তাও এরকম করছে। রাগে কান গরম হয়ে গেলেও হাসিমুখে সবার সামনে কথা বলে ঘরে ঢুকলাম। জীবনে একটা কাজ ভীষণ কষ্টকর। আর সেটা হচ্ছে রাগ কন্ট্রোল করে হাসিমুখে চুপচাপ থাকা। যাইহোক সবকিছুর উর্ধ্বে মা বাবার সম্মান। এমন পরিস্থিতিতে অদিতিকে ভীষণ মিস করছি। না! না! আমি তাকে কেন মিস করতে যাবো? আমি তো শুধু তাকে ঘৃণা করি। ভীষণ ঘৃণা করি। ফ্রেশ হয়ে এসে গিটারে সুর তুললাম। আজ সময়টা এভাবেই কাটবে। আচ্ছা! ছেলে মানুষ কেন কথায় কথায় কাঁদতে পারে না? তারা কেন পারে না চিৎকার করে সবাইকে জানাতে তাদের বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে? যাহ! ছেলেমানুষের আমার ছেলেমানুষী মানায় না কি? তাদের তো হতে হয় শক্ত, পাষাণ। আগুনের মতো আগ্রাসী। যাতে সব দুঃখ গিলে নিতে পারে। তবে রাতে একা চুপচাপ বালিশ ভেজাতে তো কোনো সমস্যা নেই। এতসব ভাবনার মধ্যে মামনি দরজার নক না করে ভেতরে আসলো! শান্ত মেজাজটা মুহুর্তেই অশান্ত হয়ে গেলো! মামনি তোমাকে না কতবার নিষেধ করেছি দরজায় নক না করে ভেতরে আসবে না। তারপরও তোমার সাহস হয় কি করে? মামনি আমার কৎাকে তোয়াক্কা না করে বলতে লাগলো! বাহ্ রে! আমার ছেলের ঘরে আসতে আমার আবার পারমিশন লাগবে না কি? বেশ বড় হয়ে গিয়েছিস মনে হচ্ছে? ভুলে যাসনা কিন্তু তুই আমার কাছে এখনো ছোটই আছিস! বাবা মায়ের কাছে সন্তানেরা সবসময় ছোটই থাকে। কিন্তু মামনি প্রাইভেসি বলে একটা ওয়ার্ড আছে তো না কি? তোর আবার প্রাইভেসি! হাসালি গাড়ু ময়েজ! মামনি জাস্ট আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও ভালো মতো। অন্যথায় ফলাফল খুব খারাপ হবে। আরে গাড়ু ময়েজ তুই রাগিসনা তো। কথাটা বলেই মায়ের কি হাসি! ইশ! এই হাসিটাই তো জান্নাত! কিন্তু তাকেই আমি অবহেলা করছি। অবহেলা করছি তো বেশ করছি। এই মহিলা এসব পাওয়ারই যোগ্য। আর রাগ করতে পারলাম না তার সাথে। তবে এই রাগ করতে না পারার রাগটা তো আমি অন্য কারো উপর ঝাড়বোই। নয়তো আমার শান্তি নেই। বিছানায় বসে মনযোগ দিয়ে মামনির কথা শুনতে লাগলাম। ফের অসহ্যকর এক টপিক! আমি কবে বিয়ে করছি। যে মেয়েটা দেখেছে সে অনেক লক্ষ্মীমন্ত। কিন্তু আমি তো তার উপর শোধ না নেওয়া অবধি বিয়ে করবোনা!যারা আমাকে কাঁদিয়েছে তাদের প্রত্যেককে কাঁদতে হবে। ভীষণ কাঁদতে হবে। আর তাদেরকে কাঁদাতে না পারলে আমিও আহনাফ চৌধুরি নই। মামনির উপর আরেকবার বাজে আচরণ করতে ইচ্ছে করলোনা৷ তাই তাকে খাবার আনতে বলে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। আর তার ছবির সামনে বসে বিড়বিড় করতে লাগালাম! তুমি নারী জাতীর কলঙ্ক ডার্লিং!তোমাকে এমন ফল ভোগ করতে হবে যা তুমি জীবনেও ভুলবে না! অবশ্য তোমার জীবন থাকবে কি না এটা নিয়েই আমি যথেষ্ট সন্দিহান। হাহাহা! নাহ এবার আমার গিটারের সুরে মন দেওয়া উচিত! “সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে!” গিটারে সুর তুলতে তুলতে জাফনার কথা মনে পড়লো!বাচ্চা মেয়েটা!কতো সুন্দর করে কাঁদে!কান্নাও আবার,সুন্দর হয় না কি? কে জানে?কাম অন আহনাফ! এগুলো কি হচ্ছে তোর সাথে? কেন হচ্ছে? যাইহোক না কেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাসনা। সামনে তোর অনেক কাজ বাকি। গিটারের প্রবল ঝড়ে হারিয়ে গেলাম এক জগতে। অনেক কাজ বাকি আমার।
চলবে,