সেই তুমি পর্ব-০২

0
4217

#সেই তুমি
#-পর্ব-২
#-সানজিদা সন্ধি
ইতিমধ্যে মামনি খাবার নিয়ে রুমের সামনে এসেছে। কিন্তু আমি তো এখন দরজা খুলবোনা। প্রলয় হয়ে গেলেও না। মামনির ডাকাডাকি চলবে। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে রুমের সামনে থেকে চলে যাবে। নিজেও না খেয়ে থাকবে। চোখের জলে বালিশ ভেজাবে আর সারাক্ষণ ভাববে আমি কি করে এমন হলাম! হাহাহা এসব আমার জানা কথা! কিন্তু তারপরেও আমি তাকে নিয়ে ভাববোনা! একটুও ভাববোনা। ভীষণ কষ্ট দিবো তাকে। কষ্টে কষ্টে জর্জরিত করে ফেলবো! যেভাবে সে আমাকে কষ্ট দিয়েছিলো একটা সময়ে। কি ভেবেছিলো সে? আমি চুপচাপ মেনে নিয়েছিলাম বলে আমার কষ্ট হয়নি? আমি যন্ত্রণার আগুনে দগ্ধ হইনি? পরবর্তীতে ভালো আচরণ করেছিলাম বলে সব ভুলে গিয়েছি? মোটেও না। যন্ত্রণার স্বাদ প্রতিটা স্তরে তাকে উপভোগ করাবো বলে আমি ধৈর্য ধরে ছিলাম। আর বলাই বাহুল্য সেই দিনগুলো এসেছে মামনি! সেই দিনগুলো এসেছে! আর শুধু তুমিই নও যারা আমার অশ্রুপাতের কারণ হয়েছে সবাইকে যন্ত্রণার স্বাদ উপভোগ করাবো।দ্যাটস মাই প্রমিস! আর আহনাফ চৌধুরী কক্ষণো প্রমিস ব্রেক করে না মামনি! মামনির সমস্ত ডাকাডাকিকে উপেক্ষা করে আমি গিটারে মন দিলাম। নিজের অজান্তেই “আগার তুম সাথ হো” গানের মিউজিক বাজাতে লাগলাম। হুস ফিরতেই রাগে গা শিউরে উঠলো! পছন্দের গিটারটা মাটিতে আছাড় মেরে ফেলে দিলাম। তবে কি এখনো নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আসে নি আমার?রাগে দিকবেদিক হারিয়ে দেয়ালের সাথে ঘুষি দিলাম। রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে । ইচ্ছে করছে পুরো দুনিয়া ধ্বংস করে দেই। চিৎকার করে কেঁদে উঠি আর নিজেকে শেষ করে দেই। নিজেকে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে নিরব অশ্রু ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। গোধুলি লগ্নে ঘুম ভেঙে গেলো! সারাদিনের ঘটনাগুলো মনে করে রেগে যাওয়ার আগেই খাবার চাইতে গেলাম। মামনি কিছু খেতে দাও। ক্ষুধা লাগছে। তখন তো খেতে বললাম খেলিনা। এখন দেখ চেহারা কতখানি শুকিয়ে গিয়েছে! আহ মামনি স্টপ ইট! একবেলা না খেলে কেউ মরে যায় না। এখন চেয়েছি খেতে দাও! বাবা একটু পরেই তো আজান দিবে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা কর প্লিজ। মামনির চেহারার কেমন যেন ভয় দেখতে পেলাম একরকম। মামনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছে না কি তার সাথে রাগ করে খাবোনা এই বিষয়টাকে ভয় পাচ্ছে? যাইহোক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যেতেই পারে। খানিকক্ষণ পায়চারি করে ডাইনিং এ আসতেই বাবার সাথে দেখা হলো। সালাম দিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম। সেও আমার কারণে টেবিলে বসে বললো, দ্যাখ বাবা তুই হয়তো অবগত আছিস দুপুরে আমাদের বাসায় কয়েকজন গেস্ট এসেছিলেন। তারা যদিও তোর মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলো কিন্তু কালক্রমে তোর সাথে দেখা হয়ে যায়। আর এখন তুইও সবটা জানিস৷ তো সরাসরিই বলি। আমি আর তোর মা চাচ্ছিলাম তুই বিয়ে করে নে। এখন তো জবও করছিস। বাবা এখন এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। পরে কথা বলি এটা নিয়ে। কিন্তু বাবা শোন! তোমরা কি চাচ্ছো সরাসরি বলো। আমি বাড়ি থেকে চলে যাই? খুশি হবে তো? খাওয়ার প্লেটটা মেঝেতে ফেলে ঘরে চলে এলাম। সেই ৩ বছর আগে থেকে আমার পিছনে লেগেছে। সবকিছু জানার পরেও কেন মানসিক শান্তি দিচ্ছে না এরা আমায়। এত সাহস হয় কি করে। আহ্ আহনাফ কুল ডাউন! কুল ডাউন! গাড়ির চাবিটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। সারারাত আজ বাহিরেই কাটাবো। এই জানুয়ারিতে শীতের তীব্রতা যেন
অনেক বেশিই লাগছে। গাড়ির কাঁচ খোলা। বাতাস হু হু করে ঢুকছে৷ নাক, মুখে গলায় বাতাস ঢুকছে। গলার উপরিভাগ থেকে নাকের ভেতর অবধি কেমন যেন অনুভুত হচ্ছে নাকে বাতাস ঢোকার পরে। জানালার কাঁচগুলো তুলে দিলাম। গন্তব্য হয়তো জানা নয়তো অজানা। জারিফেরর বাসায় যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। গতমাসে ও দেশে ফিরেছে। যখন লেখাপড়ার উদ্দেশ্য দুজনে বিদেশে ছিলাম তখন ওর সাথে পরিচয় । আমি অবশ্য সেখানে একবছরের বেশি থাকিনি। জারিফের একটা বোন আছে। আমার সাথে ফোনে কথা বলেছিলো।গেলে তার সাথেও দেখা হয়ে যাবে। একবছরে মেয়েটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গিয়েছিলো নিজের অজান্তেই। যেটা আমি কখনোই চাইনা কারো প্রতি আমার মায়া জন্মাক। ড্রাইভিং করতে করতেই ব্লুটুথ কানেক্ট করে জারিফের কাছে ওর ফ্ল্যাটের লোকেশন জেনে নিলাম। হুট করে ঠিকানা চাইতে বেঁচারা বেশ ভরকে গেছে। গত একমাস বলে বলেও তার বাসায় যাওয়ার জন্য হ্যাঁ বলাতে পারে নি। আর আজ না বলতেই ঠিকানা চেয়েছি। অবশ্য আজ যে যাবো এটা আন্দাজ করতে পারছেনা। বেশ সারপ্রাইজড হবে সে। পুরনো দিনের কথা ভাবতে ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো আমার। জীবনের খারাপ সময়ে জারিফকে পাশে পেয়েছি। বন্ধু, ভাই,অভিভাবকের মতো আমাকে সামলেছে। বিপদে শক্ত করে হাত ধরেছে। ছেলেটার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। গাড়ি ঘুরিয়ে জারিফের বাসার দিকে রওনা দিলাম। সময় সত্যি কতো দ্রুত চলে যায়!
তিন বছর আগে, ক্যাম্পাসের সিনিয়র ড্যানির সাথে বড়সড় ঝামেলা লেগেছে আমার। ওর গ্রুপের সবাই এটাক করতে এসেছে আমাকে! আমি একা, ওরা সবাই। দেশে বাপের পাওয়ার, টাকাপয়সা কোনো কাজে আসবেনা এখন এটা ভালো মতোই বুঝতে পারছি। লাইফের সেকেন্ড টাইম আমার গায়ে কেউ হতে তুলবে এটা ভেবেই আমার মাথা কাজ করছে না! এমন সময় জারিফ কোথা থেকে এসে যেন ড্যানিকে রিকুয়েষ্ট করলো আমায় ছেড়ে দিতে। আর অদ্ভুতভাবে ড্যানিও কথা শুনেছে। ঝামেলা মিটমাট হয়ে যাওয়ার পরে জারিফকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমাকে কেন হেল্প করলে? আর সেই বা তোমার কথা শুনলো কেন? জারিফ আমার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে বললো এসব পরে হবে একদিন। সেই থেকে এখনো এই উত্তর জানতে চেয়েও পাইনি। কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো! অজানা থাকলে জানতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা জাগে।আর জেনে গেলে মনে হয় না জানাই ভালো ছিলো! সময়ের ব্যাবধানে গন্তব্যে চলে আসলাম। ফ্ল্যাটের সামনে কিছু চোখে পড়তেই নিয়ে নিলাম। লিফটে ঢুকে জাফনাকে দেখে বেশ চমকালাম। এই মেয়ে এখানে কি করছে? একদিনে দুবার দেখা এই পাজিটার সাথে । এতোক্ষণ ফোনে ডুবে ছিলো। আমার দিকে চোখ পড়তে সেও ভড়কে গেলো। হকচকিয়ে সালাম দিলো!সালাম নিলাম আমি। ভয়ে সে দূরে সরলো খানিক। তবে ওকে শাস্তি দেওয়ার আগে ওর সাথে ফ্রি হতে বললাম, ঢোলাঢালা টিশার্ট আর প্লাজুতে তোমাকে আলিফ লায়লার দৈত্যের মতো লাগছে। কথাটা বলে আনমনে হেসে উঠলাম। জাফনা আমার কথা শুনে অভিমানে মুখটা বাচ্চাদের মতো করে ফেললো! আহা সুন্দর লাগছে তো! স্যার আপনাকে হাসলে অনেক সুন্দর লাগে। হাসিমুখে থাকবেন সবসময়। আর সকালের জন্য সরি স্যার। বন্ধুদের ডেয়ার! না করতে পারিনি। মাফ করে দিয়েন। ইটস ওকে! ব্যাপার না! নেক্সট টাইম এসব যেন না দেখি। কথাটা বলেই মুচকি হাসি দিয়ে আমিও ফোনে ডুব দিলাম। জাফনা তোমার জন্য কি অপেক্ষা করছে তুমি নিজেও জানোনা। লিফট ৮ তম ফ্লোরে আসতেই জাফনা আর আমি দুজনেই বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই একমুহূর্তের জন্য আমার মাথায় আসলো,জাফনা কোনোভাবে জারিফের বোন নয়তো? শিট! লিফট থেকে বেরোনোর সময় জাফনা ইচ্ছে করেই আমাকে ল্যাং মেরে ফেলার চেষ্টা করলো। তারপর বলে উঠলো। উফ! এবারের চান্সটা মিস হলো মিস্টার আহনাফ চৌধুরী! কিন্তু নেক্সট টাইম হবে না। পাক্কা প্রমিস! আর আপনি কি ভেবেছেন? সকালের থাপ্পড় আমি ভুলে যাবো? আপনি জানেন আমি কে?ভুল করেছেন অনেক বড়। আমি দেখে নিবো আপনাকে।জাফনার কথায় মাথা দপদপ করে জ্বলে উঠলো! এই মেয়েকে তো আমি মেরেই ফেলবো আমি! কি করলো আর বললো সে একটু আগে? সাহস হয় কি করে? জাফনা তুমি তো শেষ! আমাকে পেছনে ফেলে জাফিরের ফ্ল্যাটে ঢুকলো সে। এটা দেখে মাথাটা একটু ঘুরেই উঠলো!
চলবে,,