সেই তুমি পর্ব-০৬

0
3313

#-সেই তুমি
#-পর্ব-৬
#-সানজিদা সন্ধি
ক্লাস শেষে বাসায় এসে সারা ঘর জুড়ে পায়চারি করতে লাগলো জাফনা। সকালের বিষয়টা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছেনা সে। খাবার টেবিলেও তাকে অন্যমনস্ক দেখা গেলো। বিকেল বেলা টিউশন থাকায় মনটাকে কোনো রকম শান্ত করে রেডি হয়ে নিলো সে। টিউশন বা স্কুল কলেজের যাওয়ার জন্য কার ব্যবহার খুব একটা পছন্দ নয় জাফনার। কলেজ লাইফের সমস্ত আনন্দ উপভোগ করার জন্য সে চলেও আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতোই৷ খুব একটা লাক্সারিয়াস লাইফ লিড পছন্দ নয় তার৷

বাসা থেকে বেরিয়ে টিউশনের জন্য অটোতে উঠে রওনা দিলো জাফনা। তার পাশেই একজন মধ্যবয়স্ক লোক বসেছে। সকালের বিষয় নিয়ে ডিস্টার্বড থাকায় অন্যদিকে খেয়াল ছিলোনা তার। কিছুক্ষণ পরে জাফনার একটু অস্বস্তি হতে শুরু করলো। পাশে বসা লোকটা ক্রমাগত তার দিকে চেপে আসছে। জাফনা একটু সরে গিয়ে দেখলো সরার মতো আর কোনো যায়গা নেই। দম ধরে বসে থাকতে থাকতে তাকিয়ে বুঝতে পারলো লোকটা দুইহাত একসাথে ভাজ করে আঙ্গুল দিয়ে জাফনার প্রাইভেট পার্টসে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে৷ মুহুর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। বাবার বয়সী লোক বলে কিছু বলতেও অস্বস্তি হচ্ছে । একটু অপেক্ষা করে ভাবলো কিছু না বলেই সামনে কোথাও নেমে যাবে। সেই প্রিপ্রারেশন নেওয়ার সময়ই মুহুর্তেই তার মন ঘুরে গেলো৷ এখন সে চুপচাপ চলে গেলে লোকটা আরো সাহস পাবে এমন করার। কে জানে পাবলিক পরিবহন সহ বাস্তব জীবনে কত মেয়েকে অস্বস্তির মুখে ফেলেছে। বাবার বয়সী তো কি হয়েছে? জানোয়ার সবসময় জানোয়ারই হয়৷ একটু ভেবে সে উঁচু গলায় বলে উঠলো,” আঙ্কেল! আপনি এদিকে এতো চেপে এসেছেন কেন? আমার অসুবিধা হচ্ছে। আর হাত সংযত করুন। আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছেন কেন? মেয়ের বয়সী মেয়েদের সাথে ভদ্র আচরণের চেষ্টা করবেন!” জাফনার কন্ঠস্বর সারা অটোতে অন্যরকমের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অটোর সামনে বসা ছেলেদুটো আর তার সামনের সিটে বসা একজন ছেলে আর মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, কী হয়েছে আপু? কোনো সমস্যা? জাফনা সবটা পরিস্কার ভাবে বলতেই সবাই লোকটাকে ধমকে উঠলো! সবার সামনে লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে জাফনার কাছে ক্ষমা চেয়ে লোকটা সামনে নেমে গেলো!
জাফনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! মানুষের চিন্তাভাবনার বড্ড উন্নতি প্রয়োজন।

আহনাফ বাসায় এসে অদিতির কথা ভেবে একদফা ভাঙচুর করে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় শুয়ে পড়লো৷ ঘর থেকে আসা বিকট শব্দে আতিয়া চৌধুরী অশান্ত হয়ে পড়লেন। ভয়ে ভয়ে আহনাফের ঘরের সামনে গিয়েই দেখলেন আহনাফ বিছানায় শুয়ে আছে আর তার সারাঘর ছোটখাটো একটা ধ্বংস স্তুপের ন্যায় পড়ে আছে। আল্লাহর নাম করে আহনাফকে ডাকতেই সে তার হাত থাকা ডায়েরিটা ছুড়ে মারলো৷ দূর্ভাগ্যবশত আতিয়া চৌধুরীর নাকে লেগে রক্ত পড়তে লাগলো। যন্ত্রণায় হুস হারা হয়ে ডায়েরিটা হাতে নিয়েই চলে গেলেন তিনি। এদিকে আহনাফ পুরনো দিনের স্মৃতি ভেবেই উন্মাদের ন্যায় করতে লাগলো৷

নাকে স্যাভলন লাগানোর পরে আতিয়ার ডায়েরির কথা মনে পড়লো৷ ডায়েরি হাতে নিয়ে খোলার পরে প্রথম পেজে অদিতির আঁকা ছবি দেখে প্রচন্ড ঘামতে শুরু করলেন তিনি। অজানা আশংকা বুকে দানা বাঁধতে লাগলো৷ মুহুর্তেই যেন সবকিছু অন্ধকার মনে হতে লাগলো তার কাছে। আজ কোনো কারণে অদিতির কথা মনে পড়েনি তো আহনাফের? তাহলে তো অঘটন ঘটবেই।

জাহিনের কল পেয়ে হুস ফিরলো আহনাফের। সালাম দিয়ে আহনাফকে ফোনের মধ্যেই ফ্লাইং করলো জাহিন। আর ধন্যবাদ দিতে লাগলো অসংখ্য বার। জাহিনের কল পেয়ে আহনাফের অশান্ত মনটা মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেলো। আর থ্যাংক্স দেবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই জাহিন বলে উঠলো চকলেট আর পায়েলের জন্য। জারিফদের বাসায় যাওয়ার দিন ওদের বাসার সামনে থাকা একটা সুপার শপ থেকে জিনিসগুলো নিয়ে যায়৷ আর জারিফের রুমে রেখে জারিফকে টেক্সট করে সে এগুলো যেন জাহিনকে দিতেই জাহিনের খুশির সীমা দেখে কে! ফোন দিয়েই নিজের খুশিগুলো শেয়ার করছে সে। জারিফও আহনাফের সঙ্গে এতটা ফ্রি নয়। অনেকক্ষণ ধরে কথা শেষ করে হাতের দিকে তাকাতেই ডায়েরির কথা মনে পড়লো আহনাফের। আর সেটা দিয়ে মামনিকে আঘাত করার কথাও। তাড়াহুড়ো করে যেতে গিয়ে মেঝেতে থাকা কাঁচ ফুটে যায় তার পায়ে। কিন্তু নিজের দিকে তাকানোর সময় নেই এখন তার। ডায়েরিটা মামনি কৌতুহল বশত পড়ে ফেললে সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। কিন্তু মামনির ঘরে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো আহনাফ। মামনির টেবিলের উপর ডায়েরিটা রাখা। আর মাথার কাছে ডক্টর। ডক্টরকে দেখে খানিকটা ভড়কে গেলো সে। সে কি কোনোভাবে মামনিকে বেশি আঘাত করে ফেলেছে? যদি সেটাই হয় তবে বেশ হয়েছে। শেষ হয়ে যাক তার মাথা। ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে ডক্টরকে আহনাফ জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে মামনির? ডক্টর বললো কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে প্রেশার হাই হয়ে গিয়েছে তার। হাইপারটেনশন আর প্রেশারের ঔষধ দিয়ে ডক্টর চলে গেলেন আর বেশি চিন্তা করতে নিষেধ করলেন।

ডায়েরিটা হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় পায়ে ব্যাথা অনুভব করতেই কিছুটা থমকে দাঁড়িলো আহনাফ। কিন্তু আবার চলতে লাগলো। আহনাফকে খোঁড়াতে দেখে আতিয়া বেগম চেঁচিয়ে তাকে থামতে বললেন। বিরক্ত হলেও থামলো আহনাফ। আতিয়া উঠে দৌড়ে আহনাফকে বিছানায় বসিয়ে তার পা চেক করতে লাগলেন। আতিয়া পায়ে হাত দেওয়ায় অস্বস্তি হতে লাগলো আহনাফের কিন্তু কিছু না বলে উঠে যেতে চাইলে আতিয়া থামিয়ে দিলেন। পা থেকে একটু আগে ক্রমাগত রক্ত বের হচ্ছিলো বোঝা যাচ্ছে। এখন রক্ত জমাট বেঁধে আছে। রক্ত দেখে আতিয়া চৌধুরী আঁতকে উঠলেন। ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে ক্ষত পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। ব্যান্ডেজ শেষ হওয়ার পরপরই আহনাফ পাগলের মতো হাসতে হাসতে আতিয়া চৌধুরীকে বলে উঠলো, এতটুকুতেই কাবু হয়ে গেলে মামনি? একদিন এরচেয়েও বেশি ক্ষত নিয়ে পড়ে ছিলাম। তখন তো পাশে থাকোনি। এখন আর তোমার মায়াকান্নার কোনো প্রয়োজন নেই। দূরে থাকো আমার থেকে। আহনাফ কথাগুলো বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আতিয়া চৌধুরী ধপ করে মেঝেতে বসে থাকলেন। আর ভাবতে লাগলেন সেদিন তিনি যা করেছিলেন সেটা কি আসলেই উচিত হয়েছিলো? মন আর মস্তিকের যুদ্ধতে নিস্তেজ হয়ে ঠান্ডা মেঝেতেই বসে থাকলেন তিনি। নোনাজলে ভিজে গেছে তার কপোল। বা পাশের চোখের জল শুকিয়ে আবার নতুন করে পড়ছে। আর ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন তিনি।

আহনাফ ঘরে এসে ডায়েরিটা পরম যত্নে রেখে দিয়ে নিজের ঘর গুছাতে শুরু করলো। নিজের ঘরে কাউকে আসতেই দিতে চায়না সে। আর ঘর গুছানোর অধিকার দেওয়া তো অনেক দূরের কথা। এমনিতেই সে ভীষণ গুছানো স্বভাবের ছেলে। অগোছালো ভাব একদমই পছন্দ নয় তার৷ আর অগোছালো কিছু দেখলে মেজাজ বিগড়োয় তার। ঘর গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো সে। এখন আর ভালো লাগছে না কিছু। মাথাও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছি৷ এককাপ কফির ভীষণ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে যেই উঠতে যাবে অমনিই দেখলো আতিয়া চৌধুরী কফির কাপ হাতে রুমে এসেছে। হুট করে একটা কথা আহনাফের মাথায় চলে আসে তার মামনি কি সত্যিই ভালোবাসে তাকে? না কি ছুটকির মতো তাকে ব্যবহার করার আশায় খাতির করছে? কিন্তু আহনাফ তো আর ছুটকি নয়। আহনাফ আগুনের ফুলকি। তার কাছে আসার চেষ্টা পুড়িয়ে দিবে সবাইকে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপে মন দিলো আহনাফ। খেলাতো সবে শুরু হয়েছে। শেষ হতে অনেক দেরী।

জাফনা কোচিং শেষে বাড়িতে এসেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ফ্রেশ না হয়েই। ক্লান্তিতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। অতো গোছগাছ থাকা জাফনার হয়ে ওঠে না। পড়ার টেবিলটা এলোমেলো। একেক বই একেক যায়গায়। কোনো হিসেবে নেই। প্রসাধনী পন্যগুলো একমাসও টেকে কি না সন্দেহ। রাবার ব্যান্ড, ক্লিপ কাকড়া সারাঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এসব নিয়ে মা সুফিয়া খানের উঠতে বসতে বকা খায় সে। কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন করার নাম গন্ধই নেই তার। ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখে ছটফট করতে লাগলো সে। তার মনে হচ্ছে সব যেন চোখের সামনেই ঘটছে। ঘুম থেকে ধরফড়িয়ে উঠে বড় বড় নিঃশ্বাস নিলো। ঘামে চপচপ করছে পুরো শরীর।

চলবে,,,,