সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-১১+১২

0
159

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ১১
অদ্বিতীয়ার আপত্তি থাকা সত্বেও প্রতি শনিবারই সুকান্ত অদ্বিতীয়ার কাছে উপস্থিত হতে লাগলেন। মানুষ ভালোবাসার দাস, কিশোরী মনের ক্ষোভ যত তাড়াতাড়ি তৈরি হয়, ভালোবাসার পরশে মিটেও যায় দ্রুত। ক্রমশই সে অনুভব করছিলো যে তাকে দেখতে আসার সঙ্গে বড়দির অনাথ আশ্রমের দেখাশোনার কোনো বিরোধ হতে পারে না।

তোমাকে এখানে এলেই কি আশ্রমে যেতে হবে ছোট কা? একবারও কি তুমি শুধু আমার জন্যে আসতে পারোনা?

ভাই ঝির প্রশ্ন সুকান্ত কে আসল ঘটনা বুঝতে সাহায্য করলো, সুকান্ত হাসলেন,

তোর জন্যে তো তাও আমি আছি! ওদের কেউ নেই! যাবি একবার আমার সঙ্গে?

অদ্বিতীয়া সম্মত হলো, কাকার সঙ্গে গিয়ে আশ্রমের কর্ম কান্ড দেখে আসার পরে সে মনে মনে তার হিংসার জন্যে লজ্জিত হলো। বড়দি তাকে দেখে খুশি হলেন, বললেন,

কাকা তো সপ্তাহে একবার মাত্র আসেন, কতো কাজ থাকে, এদের দেখা শোনা কি চাট্টিখানি কথা! তুমি তো আসতেই পারো প্রতিদিন বিকেলে, ইচ্ছে হলে সোমা কেও আনতে পারো! আমি সুপার কে বলে দেবো, আমাদের বয়স হচ্ছে, তোমরা এগিয়ে আসবে তবে তো এ আশ্রম এগোবে!

শিশু গুলিকে দেখে কেনো যেনো নিজের সঙ্গে খানিকটা হলেও সাদৃশ্য পেলো অদ্বিতীয়া, এদের কেউ নেই, ওর তো সবাই থেকেও কেও নেই! মনের মধ্যে ওদের জন্যে অন্য রকম একটা ভালো লাগা তৈরি হলো। সদা গম্ভীর বড়দিকেও যেনো অন্য ভাবে চিনলো সে, সেও আসতে চায় জানিয়ে হোস্টেলে ফিরলো অদ্বিতীয়া। রাতে সোমা কে ছাদে গল্প করতে করতে বললো,

আমি যাবো বলেছি ওখানে তুই যাবি তো?

সোমা মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক আওয়াজ করলো,

ধুস! আমার ওসব পোষায় না! তবে যাবো তোর সঙ্গে না হয়! এই সুযোগে একটু বাইরে তো বেরোনো যাবে! তবে ও আশ্রম বেশিদিন থাকবে না, বড়দি মরে গেলেই উঠে যাবে! সুমিতা দি বলছিলো বাড়িটা বড়দি মরে গেলেই ওর ভাই বিক্রি করে দেবে, বড়দি বেঁচে আছে তাই পারছে না!

সে এখন দেরি আছে! বড়দি কি এতো তাড়াতাড়ি মরে যাবে নাকি!!

বিরক্তির গলায় বললো অদ্বিতীয়া, এরপর থেকেই প্রায় দিনই বিকেলে ওখানে যেতে শুরু করলো সে, সোমাও তার সঙ্গী হলো তবে আশ্রমের ব্যাপারে তার কোনো উৎসাহ ছিলো না, সে শুধু হোস্টেল থেকে বেরোনোর সুযোগ পেয়ে তার সদ্ব্যবহার করছিলো। দেখতে দেখতে বছর শেষ হলো, নতুন ক্লাসে বেশ ভালো রেজাল্ট করে উঠলো অদ্বিতীয়া। সোমা মোটামুটি রেজাল্ট করলেও সে তাই নিয়েই খুশি ছিলো, হোস্টেলের দিনগুলো আগের থেকে অনেক দ্রুত কাটছিলো তাদের।

হোস্টেলে দেরি করে ফিরে ধরা পড়ার পর থেকেই সুপার সোমা কে কড়া নজরে রাখছিলেন, ফলে তরুণের আসা অনেকটাই কমে গিয়েছিলো, তারই প্রভাব তার রেজাল্টে পড়েছিলো, মোটামুটি ভালো ভাবেই উৎরে গিয়েছিলো সোমা। তরুণের আসা কমে যাওয়াতে অদ্বিতীয়া মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিলো, ক্রমশ দুই কিশোরীর মধ্যে বন্ধুত্ব দানা বাঁধতে লেগেছিলো।

দিন এগোনোর সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমশ সান্যাল বাড়ির রাশ সরলার হাতে চলে যাচ্ছিল, সরযূ সবই লক্ষ্য করছিলেন, স্বামীর কাছে সুরাহার আশায় দরবার ও করছিলেন নিয়মিতই, কিন্তু প্রতাপ সান্যালের হাতেও এই সূক্ষ্ম সাংসারিক বুদ্ধি কে রোখার মতো কোনো অস্ত্র ছিল না।

তাবিজ, কবজ, বশ এসবে বিশ্বাস না থাকলেও রতিকান্ত র সুবুদ্ধি উদয় হবার কারণ জানতে সরযূর মতো প্রতাপ সান্যাল নিজেও যথেষ্টই উৎসাহিত ছিলেন। তাঁর উকিলি বুদ্ধি কে হাতিয়ার করে এ তথ্য জানার বিভিন্ন উপায় তিনি চালিয়ে গেলেও প্রকৃত সত্য কিছুতেই উদঘাটন হচ্ছিলো না। তাঁর গিন্নী তাঁকে ক্রমাগত বিরক্ত করে চলেছিলেন, এইরকম সময়ে একদিন একখানা ঘটনা ঘটলো।

কলকাতায় বসোবাস করলেও গ্রামে সান্যাল দের পৈতৃক ভিটে সহ জমিজমা ছিলো অনেকটাই। পাশেই বসোবাসকারি এক পরিবার বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে সেসব জমি জমার দেখাশোনা করে আসছিলো। মাঝে মাঝে কলকাতায় এসে তারা জমির ফসলের দাম, গাছের আম, শীতের সময় পাটালি গুড় এসব দিয়ে যেতো।

গোপন সূত্রে প্রতাপ সান্যাল খবর পেলেন যে সেই পরিবারটি ক্রমশই সম্পত্তি বেশ কিছু বছর ধরে দেখাশোনা করার সুযোগে ভিটে এবং জমি দুই ই দখল করে নেওয়ার সুযোগ খুঁজছে। যে এই খবরটি সান্যাল মশাইয়ের কানে পৌঁছালো সেই নবীন নিজেও সেই গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলো এবং সান্যাল দের জমি জমা নিজেই কিনে নিতে উৎসুক ছিলো।

প্রতাপ সান্যাল নিজেও সেসব জমি জমা রাখতে একটুও উৎসাহী ছিলেন না, কলকাতায় বসে ওকালতি করে ওসব জিনিস রক্ষা করা তাঁর মতো ব্যস্ত লোকের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তিনিও লোকটির প্রস্তাবে রাজি হলেন, কিন্তু সমস্যা ছিলো একটাই সেসব জমির বিলি ব্যবস্থা করতে গেলে সেখানে অন্তত মাস দুয়েক থেকে আগে জমি নিজের দখলে আনার প্রয়োজন ছিলো, ব্যস্ত সান্যাল মশাইয়ের পক্ষে যা কিছুতেই সম্ভব ছিলো না।

এই রকম পরিস্থিতিতে একদিন রবিবারের দুপুরে খেতে বসে এই প্রসঙ্গে ছোটো ছেলে সুকান্তর সঙ্গে আলোচনা করছিলেন প্রতাপ সান্যাল। পাশেই রতিকান্ত বসে খেলেও বড়ো ছেলে কে বরাবরই খরচের খাতায় ধরে রাখা সান্যাল মশাই এর কাছে তার কোনো গুরুত্ব ছিলো না। সরযূ জলচৌকী তে বসে তদারকি করতে করতে তাঁদের কথোপকথন শুনছিলেন, বামুন পরিবেশন করছিলো আর সরলা রোজকার মতোই রান্নাঘরে বসে খাবার গুছিয়ে থালায় তুলে রাখছিলো।

সুকান্ত নিজেও যথেষ্টই ব্যস্ত উকিল, তাছাড়া রমার অনাথ আশ্রম, ভাই ঝির দেখাশোনা সব কিছু মিলিয়ে তাঁর পক্ষে কিছুতেই মাস দুয়েক কলকাতা ছেড়ে গ্রামে গিয়ে পড়ে থাকা সম্ভব ছিলো না। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে তিনি চিন্তিত হলেও করণীয় কি তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না, এমন সময় সরযূ পাশ থেকে বলে উঠলেন,

চিন্তা কিসের! আমার রতি আছে তো! পারবি না বাবা এট্টু কদিন থেকে জমিগুলো উদ্ধার করতে?

রতিকান্ত চমকে তাকালো, বাকিরাও অবাক হলো, রতিকান্ত জমি জমা উদ্ধার করতে পারে এ ভরসা তাদের কারো ছিলো না, রতিকান্ত র বোধহয় নিজেরও নিজের ওপরে আস্থা ছিলো না। কিন্তু সরযূ ছাড়লেন না, রীতিমত ছেলের কাছে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন,

যা বাবা! দুটো মাসের তো ব্যাপার! অতো টা জমি বাড়ি চলে যাবে বাপ? পৈতৃক ভিটে দখলে রাখতে পারবো না? বাড়িতে এতো বড়ো ছেলে থাকতে ও জমি দখল হয়ে যাবে? রাখতে পারলে তো তোরই থাকবে বাবা, ও নিয়ে তো আর আমরা স্বর্গে যাবো নে!

সুকান্ত আপত্তি জানালেন,

কি বলছো মা তুমি! দাদা ওসব একা পারে নাকি! আজ পর্যন্ত জমি বাড়ি কি জিনিষ ও জানে? কোনোদিনও কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামায় নি, সে হটাৎ করে প্রায় দখল হয়ে যাওয়া জমি নিজের দখলে আনবে ওখানে বসে থেকে?

সরযূ রেগে গেলেন,

ব্যাটা ছেলে! শিখতে কতক্ষন লাগে! ও ঠিক পারবে! আর একা যাবে কেনো? সেরম হলে না হয় রতন কে সঙ্গে করে পাঠিয়ে দেবো, সে চালাক চতুর ছেলে ওসব কাজ ভালোই পারে!

সুকান্ত বিস্মিত হলেন,

রতন দা! আবার ওকে এ বাড়িতে ঢোকাবে? তুমি কি পাগল হলে মা?

সরযূ প্রায় তেড়ে উঠলেন,

কেনো? কি এমন ভুল কথা বললাম! এ বাড়িতে তো ঢোকাচ্ছি না, সে সঙ্গে যাবে আবার কাজ মিটে গেলে নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে! এখানে ঢোকার কথা আসছে কেনো!

প্রতাপ সান্যাল চুপ করে মা ছেলের কথোপকথন শুনছিলেন, গিন্নীর বুদ্ধির তারিফ না করে তিনি পারছিলেন না। এই সুযোগে যে গিন্নী এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন।

রতিকান্ত কে বউয়ের থেকে আলাদা করা আর রতন কে নতুন করে সান্যাল বাড়িতে ঢোকার রাস্তা খুলে দেওয়া এক কাজে দুই কাজ হাসিল করতে চাইছিলেন সরযূ। বশ কাটাতে ছেলে কে বউয়ের থেকে আলাদা করা ছাড়া এই মুহূর্তে তিনি আর কোনো পন্থা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। জমি উদ্ধার হোক বা না হোক রতন সঙ্গে থাকলে রতিকান্ত র যে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না তা তিনি জানতেন।

সরযূ প্রায় জেদ ধরে বসে থাকলেন, গিন্নীর কথায় প্রতাপ সান্যাল শেষ পর্যন্ত সুকান্তর আপত্তি সত্ত্বেও রতিকান্ত কে রতন কে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকার কথায় রাজি হয়ে গেলেন। সরলা রান্নাঘরে বসে বসে সবটাই শুনলো, রতনের ওপরে তার একটুও আস্থা ছিলো না, সে সঙ্গে থাকা যে রতিকান্তের পক্ষে বিপদের হতে পারে সে কথা তার জানা ছিলো।

আলাপ আলোচনা চলতে লাগলো, সরযূ উৎফুল্ল ছিলেন, বউয়ের থেকে ছেলে কে আলাদা করতে পারার এতো বড়ো সুযোগ হাতের মুঠোয় এসে যাওয়ায় তাঁর মুখে খুশির ছাপ স্পষ্ট হচ্ছিলো। গ্রামের বাড়ি খুব বেশি বসবাস যোগ্য ছিলো না, সেখানে বাস করার আগে বাগানের জঙ্গল, ঘরদোর পরিষ্কার করার প্রয়োজন ছিলো। একদিন বিকেলে সরযূ বামুন কে দিয়ে রতন কে বাড়িতে ডেকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন, সে আগে গিয়ে বাড়ি বাসযোগ্য করবে তার পরে রতিকান্ত সেখানে পৌঁছাবে।

রতন কে বাড়িতে ডাকার কথায় সরলা আপত্তি জানালো, শ্বশুরের ঘরে গিয়ে বললো,

বাবা, মা কথা দিয়েছিলেন রতন দা কে এবাড়িতে ডাকবেন না, তিনি কথার খেলাপ করছেন!!

সরযূ বিরক্ত হলেন স্বামী কিছু বলার আগেই বললেন,

তা আমার রতি ওই পোড়ো বাড়িতে গিয়ে উঠবে নাকি! সাপ খোপের আস্তানা হয়ে আছে ওখানে! আগে রতন গিয়ে পোস্কার করুক!

সরলা শাশুড়ির কথার কোনো উত্তর দিলো না, শাশুড়ির উপস্থিতি সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে শ্বশুর মশাই কে বললো,

ওখানে আগে থেকে বলে গেলে চলবে না বাবা! গাঁয়ের লোকজন কে জানেন না, ও বাড়িতে থাকতে লোক আসছে জানাজানি হলে গাঁয়ে ঢোকার আগেই বিদায় করবে! আর রতন দার ভরসায় আপনি আপনার ছেলে কে ছাড়ছেন, সে বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে কি করেছিলো সে সবাই জানে! যদি সত্যি জমি উদ্ধার করতে চান তাহলে সরাসরি কোনো খবর না দিয়ে বাড়িতে তালা খুলে ঢুকে পড়তে হবে, সে ওদের দ্বারা হবে না!

প্রতাপ সান্যাল উকিল মানুষ, এক্ষেত্রে বউয়ের পরামর্শ তাঁর যুক্তিযুক্ত মনে হলো, রতন আর রতিকান্ত দুই মাতালের পক্ষে যে গ্রামে গিয়ে সম্পত্তি উদ্ধার করা সম্ভব নয় এ তিনি মনে মনেই জানতেন। অতোটা জমি হাতছাড়া করার ইচ্ছে তাঁর একেবারেই ছিলো না, পারলে বউই পারবে এটা তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাই সরাসরি বউ কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

তাহলে ঐ জঙ্গলে ভর্তি নোংরা বাড়িতে কে গিয়ে ঢুকে তালা খুলে পরিষ্কার করবে? ওরা ওসব পারবে না, তুমি যদি পারো তাহলে সঙ্গে যাও, আমার আপত্তি নেই। দরকার হলে আমি ওখানে নবীন কে বলে দিচ্ছি, ও একটা মেয়ে জোগাড় করে দেবে না হয়, তোমার হাতে হাতে করে দেবে।

সরলা মাথা নাড়লো,

না বাবা নবীন দা কেও জানানোর দরকার নেই! খবর কিভাবে ছড়ায় তা কে জানে! আমি বরং আমার বাপের বাড়ির গাঁ থেকে একটা মেয়ে কে নিয়ে নিচ্ছি, আর রতন দা কে আমার লাগবে না, ওনাকে খবর দেওয়ার দরকার নেই!

প্রতাপ সান্যাল রাজি হয়ে গেলেন, শ্বশুরের মত নিয়ে আগামী দিন পাঁচেকের মধ্যেই রওনা হবার কথা বলে সরলা নিজের ঘরে চলে যাওয়ার পরে সরযূ কোমরে হাত দিয়ে স্বামীর সামনে দাঁড়ালেন।

ব্যাপার খানা কি? বউ কি তোমাকেও বশ করলো নাকি? অতো কষ্টে এট্টু সুযোগ পেয়েছিলুম, তা তুমি সে আশায় জল ঢেলে দিলে! এখন ওই বউ এবার আমার রতির পিছু পিছু ওখানেও ধাওয়া করবে গো!

প্রতাপ সান্যাল মুচকি হাসলেন, খাটে হেলান দিয়ে আয়েস করে বসে গিন্নীর উদ্দেশ্যে বললেন,

তোমারই উপকার করলুম গিন্নী, সে তুমি বুঝলে না!! তুমি এ বাড়ির গিন্নী হতে চেয়েছিলে, এবার বউ কে বিদায় করে গিন্নী হও না যতো খুশি, কে তোমায় বারণ করেছে! একা যদি সামলাতে না পারো, বয়স তো হয়েছে, তা এই সুযোগে তোমায় সাহায্য করার জন্যে বৌদি কেও কাছে এনে রাখো না হয়, আর রতনের খাবার বামুন কে দিয়ে ও বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। বাড়ি এখন তোমার, বউ কবে ফিরবে তার এখন ঠিক নেই কিছু, ততদিনে সংসার আবার তোমারই হবে। আর যদি জমি উদ্ধার করতে পারে তা সে উপরি পাওনা। যে দিক দিয়েই ভাবো না কেনো লাভ তোমারই!

কথাটা মনে ধরলো সরযূর, তবু তিনি খুঁত খুঁত করতে লাগলেন,

একদম একা ছেড়ে দেবে! ওখানে কি হচ্ছে কিছু খবর পাবো না! রতন টা কেও সঙ্গে নিতে চাইলো না, উল্টে বাপের বাড়ির কাজের লোক কে নিয়ে যাচ্ছে!

প্রতাপ সান্যাল মাথা নাড়লেন,

ও তুমি চিন্তা করো না, নবীনের কাছে আমি সব খবর পেয়ে যাবো! আর ফিরে আসবে যখন তখন আর ও কাজের মেয়ে কে এ বাড়িতে ঢুকতে দেবো না!

সরযূ শান্তি পেলেন, তাঁর সংসার তার মুঠোয় ফিরে আসার সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে উপরি পাওনা ছিল ভাই বউয়ের বাড়িতে ঢোকা। তার থেকেও বেশি আনন্দের খবর ছিলো এই যে তাঁর স্বামী তাঁরই আছেন, বউয়ের বশ হন নি!!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ১২
সরলা নির্দিষ্ট দিনে রতিকান্ত কে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলো, যাবার পথে তার গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় তারই বয়সী একজন শক্ত সমর্থ বিধবা মহিলা কে গাড়িতে তার সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। সরযূ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, এতদিন পরে তাঁর হাতের মুঠো থেকে প্রায় বেরিয়ে যাওয়া সংসার আবার হাতের মুঠোয় ফিরে এলো।

বউ বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাপের বাড়িতে উপস্থিত হলেন, ভাই বউ একটু দোনোমনো করছিলো তার শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে ননদের বাড়িতে গিয়ে থাকার কথায়, কিন্তু সরযূ তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, বুঝিয়ে বললেন,

কলসীর জল গড়িয়ে খেলে শেষ হতে কতক্ষন বৌদি! তোমার ছেলে আর নিজে কিছু করে খাবে ভেবেছো? আমারই এতো সম্পত্তি খায় কে? ছোটো ছেলে তো বিয়েই করলো না, বড়ো ছেলের আবার বিয়ে দিলুম তা কপাল দেখো, সে বউ তো বাঁজা! তা সেই বাঁজা বউ নিয়েই ছেলের আদিখ্যেতা কত! আর রইলো বাকি ওই মেয়ে! তা মুখে তোমার নন্দাই যাই বলুক ও মেয়ে কে ফুটো কড়িও উনি ঠ্যাকাবেন নে! তাহলে রইলো আমার রতন! সেও যদি এসব না দেখে তো দেখবে কে? ওই তো সান্যালদের গুষ্টি! সব সম্পত্তির লোভে হামলে পড়ে সব সময়! তাদের একজনের হাতেও একটি নয়াও যেতে দেবো নে!

রতনের মা আশ্বস্ত হলো, সত্যিই রতনের এই জমি বেচে সংসার চালানো তার কোনোদিনও পছন্দ ছিলো না। কলসীর জল সত্যিই গড়িয়ে খেলে একদিন শেষ হয়! শেষ বয়সে তাই ননদের কাছেই বাকি জীবনটা থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করলো সে, সরযূ খুশি হলেন খালি বাড়িতে একা তাঁর ভালও লাগছিলো না।

সরলা আর রতিকান্ত যখন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালো তখন সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে, হটাৎ করে সান্যাল দের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়ানোয় গ্রামের লোকজন কৌতূহলী হলো, দু একজন উঁকি ঝুঁকি মারলেও কেউ কোনো প্রশ্ন করলো না। খানিকটা বিনা বাধাতেই তারা বাড়িতে প্রবেশ করলো। পরের দিন সকাল হতেই খানিকটা দূরে বসোবাসকারী সেই পরিবারটির কর্তা সুবল তার সঙ্গে বউ বাণী কে নিয়ে দেখা করতে এলো, তাদের আসার উদ্দ্যেশ্য সরলার অজানা ছিলো না। রতিকান্ত তার নিজের মতোই এখানেও দোতলায় একটি ঘর দখল করে থাকছিলো, বাড়িতে কারো আসা যাওয়ায় তার কিছু এলো গেলো না।

সরলা বাণী কে না চিনলেও কলকাতায় যাতায়াতের সুবাদে সুবল কে খুব ভালো করেই চিনতো, সে তাদের যথেষ্টই যত্নআত্তি সহকারে বৈঠকখানায় নিয়ে এসে বসালো। সুবল ঘোড়েল লোক, দু একটি কথার পরে ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য জানতে চাইলো, সরলা কোনো জটিলতায় গেলো না, সরাসরি বললো,

আমি গ্রামের মানুষ, কলকাতায় মন টেকে না, তাই এখানের বাড়িখানা একটু সারিয়ে সুরিয়ে মাঝে মাঝে এসে থাকবো ভেবেছিলাম, তা বাবা কে বলতে উনি রাজি হয়ে গেলেন!

বাণী হাসলো,

তা খুব ভালো করেছো দিদি! পৈতৃক ভিটে কেউ তালা বন্ধ করে রাখে! এখানের জল হাওয়া ভালো, মাঝে মাঝে এসে থাকলে ভালোই লাগবে!

সরলাও হাসলো,

তোমাদের ভরসাতেই এলাম কিন্তু, মাঝে মাঝেই জ্বালাতন করবো!

বাণী মাথা নাড়লো, সুবল একটু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করলো,

তবে যে শুনলাম নবীন বাগদি নাকি আপনাদের জমি, বাড়ি কিনতে চায় বৌদি? সান্যাল মশাইয়ের সঙ্গে নাকি কথা হয়েছে?

সরলা দ্রুত মাথা নাড়লো, তাড়াতাড়ি বললো,

না ভাই এরকম তো কিছু আমি জানি না! তবে এইটুকু বলতে পারি যে আমি এখানে থাকতে এসেছি, বাড়ি বেচতে আসিনি!

সুবল একটু তাকিয়ে থেকে বললো,

সে আপনাদের বাড়ি আপনারা থাকবেন তাতে আমাদের কিই বা বলার আছে! তবে এই জমি, বাড়ি আমার বাপ, ঠাকুদ্দার আমল থেকে আমরাই দেখে শুনে রেখে আসছি বৌদি, তাই আমাকে না জানিয়ে কিছু করবেন না কিন্তু!

সরলা ঘাড় কাত করলো,

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এ বাড়ি, জমি কিছুই আমি বেচবো না!

সুবল আর বাণী বেরিয়ে যাওয়ার পরে কমলা এগিয়ে এলো, সে এতক্ষন ধরে সম্পূর্ন কথপোকথন শুনছিল, সরলার দিকে তাকিয়ে একটু অবাক গলায় বললো,

তবে যে বলেছিলে দু মাসের ব্যাপার!!

সরলা খানিকক্ষন উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো,

কমলা দি! মনে হচ্ছে সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি, কতদিন পরে একটু প্রাণ খুলে শ্বাস নিচ্ছি জানো! আমার সত্যি আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই! আমি শ্বশুরমশাই এর সঙ্গে কথা বলবো!

দু একদিনের মধ্যেই পরিশ্রমী সরলা তার সহযোগী কমলার সাহায্যে বাড়ি কে বাসযোগ্য করে তুললো। প্রয়োজনীয় জিনিস যেটুকু দরকার ছিলো তা নবীনের সহায়তায় জোগাড় করে রীতিমত সংসার গুছিয়ে বসলো সরলা। সুবলও প্রায় প্রতিদিনই এসে খোঁজখবর নিয়ে যেতে লাগলো, ক্রমশই সরলা তার আস্থা অর্জন করে নিতে থাকলো।

সারা জীবন ভাই বউদের সংসারে জোর করে নিজেকে গিন্নি দেখাতে চাওয়া সরলা এই প্রথম সত্যিকারের গিন্নি হলো। কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে যতই হোক মাথার ওপরে সরযূ সব সময়ই ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করতেন, এখানে সেরকম কেউ ছিলো না, প্রথম থেকেই সরলাই এ বাড়ির গিন্নী ছিলো। এই প্রথম সত্যি নিজের একটা সংসার পেলো সরলা, যে সংসারে তার ওপরে গিন্নীপনা দেখানোর মতো কেউ ছিলো না, মন প্রাণ দিয়ে সেই সংসার কে আঁকড়ে ধরলো সে।

আসলে সরলা কত্রী নয় একজন সুখী সংসারের গৃহবধূ হতে চেয়েছিলো, তাই সরযূ তাকে কলকাতা থেকে গ্রামে পাঠিয়ে জব্দ করতে পেরেছেন ভেবে খুশি থাকলেও তা সত্যি ছিলো না। সরলা শাশুড়ির হাতে তাঁর সংসার ছেড়ে দিয়ে এসে এখানে স্বামী কে নিয়ে নিজের ছোট্ট সংসারের সূচনা করলো, এবং কিছুদিনের মধ্যেই এক্ষুনি কাউকে জানতে না দিয়ে মনে মনে আর কখনো কলকাতায় ফিরে না যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললো।

বেশ কিছুদিন নতুন ক্লাস চলার পরে ভাই ঝি কে গরমের ছুটিতে বাড়ি আনতে গেলেন সুকান্ত। হোস্টেলে যাবার প্রায় মাস সাতেক পরে বাড়িতে আসার সুযোগ পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছিলো অদ্বিতীয়ার, আসার আগের রাতে সে আর সোমা দুজনেই উত্তেজনায় ঘুমাতে পারলো না। সোমার উত্তেজনার অবশ্য অন্য কারণ ছিলো, আগামী এক মাস প্রতিদিন তরুণের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ পেয়ে সে উত্তেজিত ছিলো।

পরের দিন মামলা মোকদ্দমার পর্ব শেষ করে সুকান্ত যখন তাকে নিতে এলেন তখন বেলা গড়িয়ে গেছে, ইতিমধ্যেই বাবা আসতে না পারায় সোমার ছোড়দা তাকে নিতে এসে গিয়েছিলো দুপুরের দিকে। দুজনে একসঙ্গে বেরোবে এরকম ইচ্ছে থাকলেও সোমার দাদার তাড়া ছিলো, তার ফুটবল ম্যাচ আছে, বোন কে বাড়িতে পৌঁছেই সে খেলতে বেরিয়ে পড়বে। তাড়া থাকায় সোমার কথামতো তার মুখে উন্নত মানের ভাষা শোনার সুযোগ অদ্বিতীয়ার হলো না, তাছাড়া কেউ তাকে কলেজ পড়ুয়া ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে কি হতে পারে সেকথা ভেবেও সে ছোড়দা র সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলো না। সোমা তার দাদার সঙ্গে চলে গেলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, অদ্বিতীয়া কাকার জন্যে একাই বসে রইলো।

কাকার সঙ্গে অদ্বিতীয়া যখন গাড়িতে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো তখন বিকেল শেষ হয়ে এসেছে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে বাসের জন্যে করুন মুখে বসে থাকা সোমা আর তার দাদা কে রাস্তার ধারে দেখতে পেলো।

ছোট কা! ও আমার বন্ধু! কলকাতায় ফিরবে, ওকে গাড়িতে তুলে নিই?

সুকান্ত আপত্তি জানালেন না, গাড়ি তাদের গা ঘেঁসে দাঁড়াতেই সোমা চমকে তাকালো, অদ্বিতীয়া তাকে গাড়ির দরজা খুলে ডাকলো,

চলে আয়! তোকে ছোট কা বাড়িতে পৌঁছে দেবে!

সারাটা রাস্তা পেছনের সিটে বসে দুই বন্ধু আনন্দে মশগুল হয়ে কাটালো, সুকান্ত পাশের সিটে বসা তরুণ টির সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যেতে লাগলেন।

নাম কি তোমার?

সুমন, সুমন ব্যানার্জী।

কি করো?

ফুটবল খেলি,

এমন উত্তরে সুকান্ত চমকালেন, একটু অবাক গলায় বললেন,

ফুটবল খেলো! সেতো ভালো! কিন্তু পড়াশুনা করো তো?

সুমন ঘাড় নাড়লো,

করি, কলেজে পড়ছি, সেকেন্ড ইয়ার। কিন্তু করতে ভালো লাগে না, বাবা ছাড়ে না তাই!

এবার অদ্বিতীয়াও একটু অবাক হয়ে তাকালো, পড়াশুনা করতে অনেকেই ভালোবাসে না, কিন্তু এরকম বিরক্তি নিয়ে সেকথা ঘোষণা করতে এর আগে কাউকে দেখেনি ও। এই উত্তরের পরে সুকান্ত আর আলাপচারিতা খুব বেশি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে গাড়ি চালানোর দিকে মনোনিবেশ করলেন, কলকাতায় ঢুকে এদের রাস্তায় কোথাও নামিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিলো তাঁর, কিন্তু ভাই ঝির বন্ধু কে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে আসার আবদারে তিনি তাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রাজি হলেন।

যদিও সুমন বাড়ি পর্যন্ত গেলো না, বোনের জন্যে তার ঠিক সময়ে মাঠে পৌঁছানো হয়নি, খেলা শেষ হয়ে গেলেও সে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় খবর নেবার জন্যে সে বেশ কিছুটা আগেই বন্ধুদের আড্ডায় নেমে গেলো। বাড়ির দরজায় গাড়ি দেখে সোমার বাড়ির লোকজন বেরিয়ে এলো, অদ্বিতীয়ার বংশ পরিচয় তাদের জানা হয়ে গিয়েছিলো মেয়ের কাছ থেকে, তাই তারা তাদের বাড়িতে আসার জন্যে সুকান্ত কে জোর করতে লাগলো। সুকান্ত কিছুতেই নামলেন না, সারাদিনের ধকলে তিনি ক্লান্ত আছেন বলে এড়িয়ে গেলেন। অদ্বিতীয়ার নামার খুব ইচ্ছা থাকলেও ছোট কার দেরির কথা ভেবে সেও আর নামতে চাইলো না, তবে খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির যতো টুকু দেখা যাচ্ছিলো তাতেই তাদের সংসারিক অবস্থা বোঝা যাচ্ছিলো। সোমার সঙ্গে যে তাদের বাড়ির আকাশ পাতাল তফাৎ এটুকু বুঝতেই পারছিলো অদ্বিতীয়া, সোমা রা যে একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার সেটা তাদের বাড়ির চেহারায় স্পষ্ট হচ্ছিলো।

বাড়ি পৌঁছানোর পর তাকে অভ্যর্থনা জানানোর মতো কেউ ছিলো না, অদ্বিতীয়ার কোনো আশাও ছিলো না সে ব্যাপারে, তার একমাত্র ভালোবাসার মানুষ সুকান্ত তার সঙ্গেই ছিলেন। রাস্তায় আসতে আসতেই বাড়িতে বাবা এবং নতুন মা না থাকার কথা জানতে পেরেছিল অদ্বিতীয়া, তাই এতদিন পরে হোস্টেলের ওই হৈ চৈ এর পরিবেশ ছেড়ে খালি বাড়িতে ঢুকে একটুও ভালো লাগলো না তার।

প্রতাপ সান্যালের নাতনির প্রতি টান না থাকলেও বিরূপতা ছিলো না। বংশ, রক্তের গৌরবে গৌরবান্বিত প্রতাপ বাবুর কাছে অদ্বিতীয়ার মায়ের পরিচয় গৌণ ছিলো, সে তাঁর বংশের মেয়ে, এই পরিচয় টুকুর ওপরে নির্ভর করেই দাদু নাতনির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। সান্যাল বাড়ির এখনকার মোটামুটি সুস্থ পরিবেশের পক্ষে অন্তরায় ছিলেন সরযূ দেবী, তিনি তাঁর বউয়ের ওপরের রাগ, এই মুহূর্তে যে কোনো উপায়েই অদ্বিতীয়ার ওপরে দেখতে ব্যস্ত ছিলেন। কথায় কথায় যেকোনো প্রসঙ্গেই তার মৃতা মা কে টেনে নিয়ে আসতেন তিনি।

দিন দশেক বাড়িতে ঠিক মতো কাটানোর পরে একদিন সকাল থেকে অদ্বিতীয়ার শরীর খারাপ হলো, কিন্তু সান্যাল বাড়িতে এমন কেউ ছিলো না যে তার খোঁজ নেয়। রাতে বাড়ি ফিরে সুকান্ত ভাই ঝির খবর নিতে গিয়ে তার অবস্থা দেখে ডাক্তার কে ফোন করে ডেকে নিয়ে এলেন, ডাক্তার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিলেন।

তার শরীরে এতটাই রক্তাল্পতা দেখা দিলো যে তাকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়লো। প্রতাপ সান্যাল যে নাতনি কে খুব বেশি ভালবাসতেন তা নয়, তবে বংশ, রক্ত, আভিজাত্য ইত্যাদিতে বিশ্বাসী তিনি তাঁর বংশের মেয়ের জন্যে সু চিকিৎসার অভাব রাখলেন না। তখন কলকাতা শহরে যে গুটি কয়েক নামকরা নার্সিং হোম ছিলো তারই একটিতে তাকে ভর্তি করানো হলো।

বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে তার রক্তের গ্রুপ জানা গেলো ও নেগেটিভ। সে শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলো ঠিকই, কিন্তু বাড়ির কারোর সঙ্গে তার গ্রুপের মিল না পাওয়া যাওয়া তাকে আরো বেশি করে ঠাকুমার চক্ষুশুল করে তুললো। কথায় কথায় তার শরীরে অজাত, কুজাতের রক্ত বলে বারবার মায়ের প্রসঙ্গ টেনে আনতে লাগলেন তিনি।

কে জানে বাবা কোন ঘর থেকে এসেছিলো মা! এরম রক্ত হয় বলেও তো কখনো বাপের জন্মে শুনিনি ম্যা গো!

শিশু বয়সে বলা ঠাকুমার কথাগুলো খুব বেশি মনে না থাকলেও, এবারের বক্তব্য কিশোরী মেয়েটির মনে যথেষ্টই দাগ কাটলো। সে তার একমাত্র ভালোবাসার জায়গা কাকার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, অভিমানী গলায় ঠাকুমার বক্তব্যের সারমর্ম জানতে চাইলো। সুকান্ত কথা ঘুরিয়ে দিলেন, হাসির ছলে বললেন,

অজাত, কুজাত কি রে! এতো রাজ রক্ত!! কটা লোকের হয় বলতো? এখন তুই এর মর্ম বুঝবি না, যখন বড়ো হবি তখন জানবি তুই কতো দামী রক্তের মালিক! তোকে রক্তের প্রয়োজনে লোকে বাড়ি বয়ে এসে ডেকে নিয়ে যাবে!!

প্রতাপ সান্যাল সেই সময়েই ওখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, নাতনি আর ছোটো ছেলের কথপোকথন শুনে ঘরে ঢুকে এলেন। নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন,

এটা তোমার কাকা কিন্তু ঠিক বলেছে! বনেদী ঘরের মেয়ের রক্ত কিন্তু এরকম রাজ রক্তই হওয়া উচিত! বুঝলে দিদিভাই! তোমার ঠাম্মা যাই বলুক রক্ত তোমার যে এক্কেবারে বনেদীই সে আমি এখন আরো বেশি করে বুঝলাম! আমার বংশের একদম উপযুক্ত বংশধর তুমি! নিজেকে কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছো? এই রূপ, এই রঙ এসব তুমি বনেদী রক্ত ছাড়া পেতে কোথায়?

অদ্বিতীয়া খুশি হলো, দাদুর কাছ থেকে এই প্রশংসা বাক্য তার মনের কষ্ট এক লহমায় দূর করে দিলো। তার রক্ত কেনো এতো দামী তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছোট কার কাছ থেকে পাওয়ার পরে তার অভিমান কমলেও কিশোরী মেয়েটি কিন্তু ঠাকুমার ব্যবহার ভুলতে পারলো না। বাবা তার কাছে অনেক দূরের মানুষ ছিলো, এই ঘটনার পরে ঠাকুমাকেও সে মন থেকে সরিয়ে ফেললো। কিশোরী মনের আবেগ বড়ো সাংঘাতিক, এই বয়সে যে ভালোলাগা, মন্দলাগাগুলো শুরু হয় সেগুলোর রেশ সারাজীবন থেকে যায়। হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার সময় সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে গেলো, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আর সে বাড়ি আসবে না।
ক্রমশ