সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-১৩+১৪

0
143

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ১৩
গরমের ছুটি থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকেই হটাৎ করেই সোমার ছোড়দার হোস্টেলে আনাগোনা কিছুটা হলেও বেড়ে গেলো, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সে বোনের সঙ্গে দেখা করতে আসতে লাগলো। এমন সময় এক শনিবারে কাকার সঙ্গে বড়দির আশ্রম থেকে ফেরার পথে সুকান্ত অদ্বিতীয়া কে হোস্টেলের সামনের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। মাঠের পাশ দিয়ে আসতে আসতে একটা বড়ো গাছের নিচে সে সোমা কে তার দাদার সঙ্গে কথা বলতে দেখলো, অদ্বিতীয়া কে দেখেই সোমা হাত নাড়লো,

এদিকে আয়! ছোড়দা তোকে কিছু বলবে!

অদ্বিতীয়া বিস্মিত হলো, সোমার দাদা তার সঙ্গে কথা বলতে চায়! ধীরে ধীরে সে সামনে এসে দাঁড়ালো, সোমা তাকে দেখেই পিছু হটল,

আমি হোস্টেলে যাচ্ছি, তুই কথা বলে চলে আসিস!

অদ্বিতীয়া বাধা দেওয়ার আগেই সে ছুটে চলে গেলো, জীবনে প্রথম বার অনাত্মীয় কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো অদ্বিতীয়ার। সে চোখ তুলে তাকানোর মত অবস্থাতেই থাকলো না,

তোমার নামটা খুব সুন্দর! কে রেখেছে?

কোনরকমে গলা দিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ বার করলো অদ্বিতীয়া,

ছোট কা!

ও! তোমার ছোট কার সঙ্গেই আমরা আগের বার ফিরেছিলাম না?

কোনো কথা না বলে ঘাড় নাড়লো অদ্বিতীয়া, সুমন বেশি দেরি করলো না, হাতের চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

আমার তোমাকে ভালো লাগে! এটা পড়ে দেখো!

জীবনে প্রথম কারো কাছ থেকে চিঠি পেলো অদ্বিতীয়া, চিঠি টা নেবার আগেই দাদুর মুখটা সামনে ভেসে উঠলো তার, মাথা নিচু রেখেই মাথা নাড়লো,

আমি নেবো না! আসছি!

হতবাক সুমন কে দাঁড় করিয়ে রেখে অদ্বিতীয়া হোস্টেলের দিকে প্রায় ছুটতে লাগলো, সোমা মুখে বললেও ফিরে যায়নি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো, বন্ধু কে ছুটে যেতে দেখে দাদার কাছে ফিরে এলো,

কি বললো?

নেবে না!

সুমনের হতাশ গলা সোমা কেও হতাশ করলো,

তোকে বলেছিলাম না! ওরা অনেক বড়লোক! প্রচুর পয়সা আছে ওদের!

তাতে কি! বড়লোক বলে কি ভালো লাগতে পারে না! তুই চিঠিটা নিয়ে যা! খুলবি না কিন্তু! সময় বুঝে দিয়ে দিস, বলিস আমি সামনের শনিবার এসে উত্তর নেবো!

বোনের হাতে চিঠি ধরিয়ে দিয়ে সুমন চলে যাওয়ার পরে সোমা হোস্টেলে ফিরে এলো, অদ্বিতীয়া তখনও কাঁপছিলো। সোমা বন্ধুর দিকে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

আরে! একটা চিঠি নিলেই কি প্রেম হয়ে যায় নাকি! পড়ে তো দ্যাখ! উত্তর দিতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই!

এ এক অমোঘ আকর্ষণ, দাদুর মুখটা ভেসে উঠলেও হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলো অদ্বিতীয়া। জীবনের প্রথম প্রেমপত্র! এর আগে কেউ ওকে ভালবাসি এই শব্দ টা বলেনি কখনো! অদ্বিতীয়া এক সাংঘাতিক দোলাচলে ভুগতে লাগলো! একবার দাদু একবার সুমন কার মুখের গুরুত্ব ওর কাছে এই মুহূর্তে বেশি তা কিছুতেই স্থির করে উঠতে পারছিলো না। শেষ পর্যন্ত খানিকটা নিজের ইচ্ছায়, খানিকটা সোমার জোরাজুরিতে চিঠি লিখে উত্তর না দিলেও সুমনের সঙ্গে দেখা করলো অদ্বিতীয়া।

ঘটনাটা ঘটলো মাত্র মাস দুয়েক পরেই, ইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রমা বাড়িতে পড়ে গিয়ে পা ভাঙলেন, তাঁকে অপারেশনের জন্যে কলকাতার বড় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। রমার ভাই এবং ভাই বউ বাইরে থাকতো, তাদের রমা কে বাড়ি ছাড়া করে সম্পত্তি দখল নেওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো, তারা দিদি কে বিপদের সময় দেখবে এরকম অবাস্তব আশা কেউই করতো না। সুকান্ত রমা কে ভালবাসতেন, কিন্তু প্রতাপ সান্যালের বিরোধিতা করার সাহস জোগাড় করতে না পারায় তাঁরা দুজনেই শেষ পর্যন্ত অবিবাহিতই থেকে গেলেও যোগাযোগ বন্ধ হয় নি। প্রতাপ সান্যাল সব খবরই রাখতেন, তাতে তাঁর কিছু এসে যেতো না, শুধু বাড়ির বউ করায় আপত্তি ছিলো।

এক্ষেত্রেও সুকান্তই এগিয়ে এলেন, রমার চিকিৎসার দায়িত্ব তিনি সম্পূর্ন নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন, তাঁর ব্যবস্থাপনায় কলকাতায় রমার অপারেশন হলো। রমা কে নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব ওখানের আরো দুজন বাসিন্দার কাঁধে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন, আসার আগে আগামী দু তিনটে শনিবার যে তিনি ভাই ঝির সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারবেন না, সেখবর অদ্বিতীয়া কে জানিয়ে গেলেন। অদ্বিতীয়া তাতে আদৌ দুঃখিত হলো না, বরং ছোট কা না আসায় তার সুমনের সঙ্গে দেখা করার আরো বেশি সুবিধা হলো।

কিন্তু বিধি বাম! প্রেম জমে ওঠার আগেই সে পরের সপ্তাহে বড়ো দিদিদের নজরে পড়ে গেলো। খবর খুব দ্রুত ছড়ায়, বন্ধুর দাদা যে শুধু মাত্র বন্ধুর জন্যেই নয় তার বন্ধুর জন্যে আসে এখবর সুপারের কানে পৌঁছে গেলো। অদ্বিতীয়ার ভাগ্য জন্ম থেকেই তার প্রতি বিরূপ ছিলো, এই ঘটনা যখন ঘটলো তখন রমা সেখানে উপস্থিত নেই, তাঁর বদলে দায়িত্বে থাকা শিক্ষিকা সুকান্ত শনিবারে না আসায় তাঁদের বাড়ির নম্বরে ফোন করলেন।

প্রতাপ সান্যাল সেই ফোন ধরলেন, শিক্ষিকার কাছে অভিযোগ শুনে তৎক্ষণাৎ সুকান্তর সাথে কোনো আলোচনা না করেই ড্রাইভারের হাতে সুপার কে চিঠি লিখে নাতনি কে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন। অদ্বিতীয়া ইতিমধ্যেই বড়ো কোনো শাস্তির জন্যেই অপেক্ষা করেছিলো, ড্রাইভার কে দেখে আরো বেশি করে শঙ্কিত হলো, সোমার মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেই সে গাড়িতে উঠে বসলো।

সে যখন বাড়িতে ঢুকলো তখন সরযূ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাকে ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেই চিৎকার করে বললেন,

রক্ত! রক্ত! রক্তের দোষ যাবে কোথায়! যতোই বনেদী রক্ত মিশুক না কেনো আসলে তো ওই বেশ্যার রক্তই! তখনি বলেছিলাম ওই মেয়ে কে ঘরে তুলো না! তা আমার কথা কেউ কানে নিলে তো! নাতনি নাতনি করে কতো আদিখ্যেতা! দিলো তো নাতনি মুখে ঝামা ঘষে!! জন্মেই যে কেনো গলায় নুন দিয়ে মেরে ফেলতে পারলাম না, তাহলে আজ আর এদিন দেখতে হতো না! সব ওই হতভাগী মায়ার জন্যে! আর এট্টু আগে যদি মরতো বেটি তাহলে এটাকেও বিদায় করতাম! তা সেতো হবার ছিলো না, কপালে আসলে এই দিন দেখাটাই বাকি ছিলো! বংশের মান সম্মান তো ডুবিয়েছিস, যা এবার বাকি টুকু সেরে ফ্যাল, গলায় ঝুলে পড় ওই ছোটো লোকের!!

অদ্বিতীয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, নিজের অপমানের থেকেও তার কাছে বেশি কষ্টের ছিলো তার মৃতা মা কে বেশ্যা বলা। সরযূ থামার আগেই দোতলার বারান্দায় থমথমে মুখে সান্যাল মশাই বেরিয়ে এলেন, কড়া চোখে নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

তোমার ঠাকুমা এতদিন এসব কথা বলে এলেও আমি আমার বংশের রক্ত, বনেদিয়ানার ওপরে ভরসা রেখেছিলাম। আশা করেছিলাম তুমি কোন বাড়ির মেয়ে সেটা তোমার মনে থাকবে! আজ তোমার জন্যে একজন সামান্য স্কুল টিচার আমাকে এতো কথা শোনাতে পারলো। তোমার আর ওইখানে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই! কিন্তু আমার বংশের মেয়ে কে তো আমি অস্বীকার করতে পারবো না, তাই বিয়ে দিতে গেলেও আমার বাড়ির মেয়ের কিছু পড়াশোনার দরকার আছে! এখানে থেকে বাকি টুকু শেষ করো তুমি!

অদ্বিতীয়া বিস্ময়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তার যে হোস্টেলে ফিরে যাওয়াই বন্ধ হয়ে যেতে পারে সেটা তার এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় নি! তাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সরযূ রীতিমত বিরক্ত হলেন,

সাহস দেখো মেয়ের! কিরকম তাকিয়ে রয়েছে! ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না যেনো! একফোঁটা জল নেই চোখে! এতো কথা বললুম তাতে কি তার কিছু এসে গেলো! আমাদের এরকম কথা কেউ বললে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তাম! একটুও লজ্জা শরম নেই গো!

প্রতাপ সান্যাল একদৃষ্টিতে নাতনির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঘরে ঢুকে গেলেন, সরযূ দোতলার সিঁড়ির দিকে স্বামীর সঙ্গে আরো কিছু গোপন শলা পরামর্শ করার চেষ্টায় এগোলেন, অদ্বিতীয়া ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রান্না ঘর থেকে বামুনের খুন্তি নাড়ার আওয়াজ আসছিলো কিন্তু এতোদূর থেকে আসা সত্বেও কেউ তাকে খাবার কথা বললো না, কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পরে সে দোতলায় নিজের ঘরে উঠে এলো, এতক্ষনের শক্ত করে চেপে রাখা কান্না নিজের ঘরে এসে তার দু চোখ দিয়ে বইতে লাগলো, সে বিছানার ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে তার কখনো না দেখা মায়ের জন্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

প্রতাপ সান্যাল থমথমে মুখে খাটে বসেছিলেন, সরযূ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন, এক গেলাস ঠান্ডা জল কুঁজো থেকে গড়িয়ে স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

মাথা ঠাণ্ডা করো! অপাত্রে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই! বরং একে কি করে বিদায় করবে সেকথা ঠান্ডা মাথায় ভাবো! ওই মায়ের রক্ত তার গায়ে আছে সেকথা ভুললে চলবে না, সেই জন্যেই তখন বলেছিলাম অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসতে। সে তুমি শুনলে না, বংশ, বংশ করে তোমার দরদ উথলে উঠলো একবারে! আরে মেয়ের আবার কিসের বংশ, ছেলে হলে তাও কথা ছিলো!

সান্যাল মশাই ঘাড় নাড়লেন,

ভুল তো গিন্নী হয়েছেই! সবচেয়ে বড়ো ভুল কোথায় জানো? নার্সিং হোমেই মেরে ফেলা উচিত ছিলো!! না বাড়িতে আসতো না আজ আমাকে ওই দু পয়সার নিচু জাতের টিচারের মুখে এতো বড় বড় কথা শুনতে হতো! প্রতাপ সান্যালের ভয়ে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়! তাবড় তাবড় জজ সাহেবরা আমাকে দেখলে হাত জড়ো করে! আর সেই প্রতাপ সান্যাল আজ ফোনে এতো অপমানিত হলো এই মেয়ের জন্যে!

সরযূ মাথা নাড়লেন, আফসোসের গলায় চাপা স্বরে বললেন,

কম চেষ্টা তো করিনি গো! পারলুম কোথায়! সেই সরালুম ওই মায়া কে, কিন্তু এট্টু দেরি হয়ে গেলো! যদি আরেকটু আগে সরাতে পারতুম, তাহলে কবে এ মেয়েকে আঁতুড় ঘরেই নুন দিয়ে মেরে ফেলতুম! কিন্তু হতভাগী সারাক্ষন নজরে রাখতো!

প্রতাপ সান্যাল বিরক্ত দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন,

কোন কাজটা আজ পর্যন্ত নিজে নিজে পেরেছো! বউয়ের পেটেই তো মারার ব্যবস্থা করছিলে, সেটাও তো পারোনি! মায়া কে সরাতেও তো আমাকেই লাগলো!

সেও তো ওই মায়ার জন্যেই! না হলে ওই দুধ খেলে পেটের নাড়িও বাইরে বেরিয়ে আসে, বাচ্ছা তো কোন ছার! মরার আগেও হতচ্ছাড়ি আমার সর্বনাশ করে যেতে ছাড়ে নি গো! সব ওই বউয়ের কাছে উগরে গেছে!! তারপরেও তো কম চেষ্টা করলুম নে! রতন কে বললুম, হরিসভায় যাবার আগে দরজাখান খুলেও গেলুম! তা তিনি আসল কাজ হাসিল না করে অন্য কাজে মেতে উঠলেন! আর তোমার ঐ সব্বনাশি বউ বলা নেই কওয়া নেই মাথায় গাছের গুঁড়ি মেরে বসলো! আর তুমিও তার এবাড়িতে পা দেওয়া বন্ধ করে দিলে!

গিন্নীর কথায় প্রতাপ সান্যাল মুচকি হাসলেন,

সবই যদি তুমি বুঝতে গিন্নী তবে তুমিই ওই কালো কোট পড়ে মামলা লড়তে, আর আমায় লাগতো না! রতনের সব ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছি, তোমার ছেলে কে পুলিশে যেতেও দিইনি! সব কিছুই তো ঠিকই ছিলো শুধু বৌমা ওখানে এসে যাবে সেটা ভাবি নি!

সরযূ গলায় বিরক্তি এনে বললেন,

শুধু এসে পড়লো!!এসে মেয়ে কে উদ্ধার করে একেবারে বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছাড়লো! নিজে গেলি, সঙ্গে করে আমার ছেলেটা কে বশ করে নিয়ে গেলি তা যা, কিন্তু মেয়েটাকেও বাড়ি থেকে বার করে দিলি! ও বউ কে আমার সন্দেহ হয়! যা ধুরন্ধর মেয়ে, ও সব বোঝে! মায়ার মরার খবরও ও ঠিক আশার কাছ থেকে পেয়েছে, আমাকে পরে কোনো সুযোগে ধরবে বলে এখন চুপ করে আছে! আশা কেও আমার এট্টুও বিশ্বাস নেই! টাকার লোভে ঠিক সব কিছু বউ কে বলে দিয়েছে!!

প্রতাপ সান্যালের মুখ গম্ভীর হলো,

বউ তোমার মুখ খুলবে না আমি জানি! কিন্তু আশার ওপরে ভরসা করা সত্যিই ভুল হয়েছে, এতদিনে কার কার কাছে গল্প করেছে কে জানে! তুমিই তখন ওর ব্যবস্থা করতে দাও নি!

ও যে এতো শয়তান, বউয়ের সঙ্গে হাত মেলাবে জানবো কি করে! আগেও তো ওকে দিয়ে কতো কাজ করিয়েছি, কখনো তো মুখ খোলেনি! আর ভেবেছিলুম মায়া কে সরাতে পারলে তারপর ঐ মেয়ে কে সরাতে আশাকে লাগবে, কিন্তু পরে বুঝলুম সে আর হবার নয়! বউ তাকে কড়া নজরদারি তেই রেখেছে, যদিও খুব বেশি ভালোবাসে বলে তো কখনো মনে হয়নি তখন!! সেরকম মনে হলে আর দেরি না করে সরিয়ে দাও আশা কে না হয়! হ্যাঁ গো, রতন আবার মুখ খুলবে না তো?

প্রতাপ সান্যাল হাসলেন,

যাতে না খোলে সেই জন্যেই তো ওর মা কে নিয়ে এসে এখানে রাখা!!

সান্যাল দম্পতির এই গোপন আলোচনা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একজন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই শুনলো, সে রতনের মা বিমলা। শেষ কথাটা শোনার পরে তার বুকের মধ্যে ভয়ে হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগলো, সে দ্রুত সামনে থেকে সরে গেলো।

সুকান্ত যখন বাড়ি ফিরলেন তখন বেশ রাত, ছেলে বাড়িতে ঢোকা মাত্র সরযূ তাকে রসিয়ে রসিয়ে অদ্বিতীয়ার গুনপনা শোনালেন, এই মেয়ে যে তাঁদের বনেদী বংশের উপযুক্ত নয় সেকথা বার বার করে বলতে লাগলেন। সারাদিন পরে বাড়ি ফিরেই এসব কথায় সুকান্ত অত্যন্ত বিরক্ত হলেন, তাঁর এতো চেষ্টার পরেও ভাই ঝির এই অধঃপতনে তিনিও যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলেন, সোজাসুজি জামা কাপড় না ছেড়েই দোতলায় উঠে এলেন। তিনি যখন ঘরে ঢুকলেন তখন ঘর অন্ধকার, সারাদিনের ক্লান্তির পরে অভুক্ত অদ্বিতীয়া কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, কাকার চিৎকারে চমকে উঠে বসলো,

পিয়া!! তুমি এতো নিচে নেমে গেছো!! ওদের বাড়ি তুমি দেখে এসেছো নিজের চোখে, তারপরেও তুমি ওই ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করেছো!!

আর কখনো হবে না ছোট কা! আমি দাদুকে কখনো দুঃখ দেবো না! আমি আর ওর সঙ্গে কখনো কথা বলবো না!! প্লিজ আমাকে হোস্টেলে ফিরে যেতে দাও!!

অদ্বিতীয়া হাত জোড় করে নিচু গলায় কাঁদতে কাঁদতে বললো, সুকান্ত থমকে গেলেন, সাময়িক রাগের ঘোর কাটার পরে লক্ষ্য করলেন ভাই ঝির মুখ শুকিয়ে গেছে। নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞেস করলেন,

খেয়েছো?

অদ্বিতীয়া চুপ করে থাকলো, সুকান্ত সবই বুঝলেন, ভাই ঝি কে বললেন,

রান্না ঘরে চলো, আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি, বাকি কথা পরে হবে!!

কাকার কল্যাণে অবশেষে খাবার জুটলো অদ্বিতীয়ার, সুকান্ত বাবার সঙ্গেও কথা বললেন, আর কোনোদিনও এরকম হবে না, হলে তিনি নিজে পিয়া কে বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসবেন এই কথা দেওয়ার পরে প্রতাপ সান্যাল রাজি হলেন। পরের দিন কাকার সঙ্গে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে রওনা হবার আগে প্রতাপ বাবু নাতনির মুখোমুখি হলেন, কড়া গলায় নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন,

ভবিষ্যতে যদি ঐ ছেলের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখার কথা শুনি, তাহলে ঐ ছেলের কি ব্যবস্থা করবো সে আমিই জানি!! তোমার কাকার ওপরে আমার কোনো ভরসা আর নেই, এবার থেকে তুমি আমার নজরে থাকবে!!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ১৪
ভাই ঝি কে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে সুকান্ত ফিরে চলে গেলেন, অদ্বিতীয়া আর সুমনের সঙ্গে দেখা করলো না, সোমা কে বললো,

তোর দাদা কে বলে দিস আমি দাদুভাই কে দুঃখ দিতে পারবো না! আমি এরকম করেছি জেনে দাদুভাই দুঃখ পেয়েছেন, আমাদের বংশের সম্মান নষ্ট হয়েছে!

বোনের কাছ থেকে পরের শনিবারই সুমন সে খবর পেয়ে গেলো, কিন্তু তার প্রতি শনিবার আসা বন্ধ হলো না। রীতিমত নাছোড়বান্দা সুমন কে দেখে অদ্বিতীয়া মনে মনে দাদুর বলা কথার জন্যে ভয় পেতে লাগলো। দাদু কে সে চিনতো, তিনি সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে জানলে কি কি করতে পারেন সেই চিন্তায় ভয়ে তার বুক শুকিয়ে গেলো। অবশেষে কিছুতেই সুমনের আসা বন্ধ করতে না পেরে সে সব সত্যি কথা বন্ধু কে বলে ফেললো,

আমার দাদু খুব রাগী মানুষ, তোর দাদা এখনো এখানে আসছে জানতে পারলে আমাকে হোস্টেল থেকে চলে যেতে হবে। আমি ওখানে ফিরে যেতে চাই না, ঠাম্মা কে আমার ভালো লাগে না! প্লিজ তুই তোর দাদা কে আসতে বারণ করে দে!

পরের শনিবার সুমন আবার এলো, দাদার সঙ্গে কথোপকথনের পরে সোমা অদ্বিতীয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো,

ছোড়দা আর কখনো আসবে না বলেছে! শুধু চলে যাওয়ার আগে তোর সঙ্গে শেষ বারের মতো কথা বলতে চায়, প্লিজ চল একবার!!

মনের মধ্যে ভাঙচুর চলছিলো অদ্বিতীয়ার, জীবনে প্রথম বার কেউ তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলো। সুমনের সঙ্গে কথা বলতে না যাওয়ার মতো মনের জোর তার মধ্যে ছিলো না। অবশেষে মনের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ করে হেরে গেলো অদ্বিতীয়া, সোমার সাহায্যে সে আবার সুমনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। সুমন এবারে মাঠের অনেকটা বাইরে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছিলো যেখান থেকে হোস্টেল দেখা যাওয়া সম্ভব ছিলো না, অদ্বিতীয়া কে বোনের সঙ্গে হেঁটে আসতে দেখে সে আরো খানিকটা দূরে একটা গাছের আড়ালে সরে গেলো।

তুমি যা চাও তাই হবে, আমি আর আসবো না! কিন্তু তার মানে এই নয় আমি তোমাকে ভুলে যাবো! আমি চাকরি পেলেই তোমার সঙ্গে দেখা করবো আবার, তখন তোমার দাদু আর কিছু করতে পারবে না। তুমি আমার জন্যে ওয়েট করবে তো?

অদ্বিতীয়া ঘাড় নাড়লো,

প্লিজ তুমি আর যোগাযোগ রেখোনা! তুমি চাকরি পেলেও আমার দাদু মেনে নেবেন না!

সুমন উত্তেজিত হলো, রাগের গলায় বললো,

দাদু মেনে নেবার কে? তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা সেটা বলো? ওসব দাদুর ভয় আমি পাইনা!

ভয় পাওয়ার কথা এটা নয়, কথা টা ভালোবাসার। আমি দাদু কে যতো টা না ভয় পাই, তার থেকেও বেশি আমার ওঁর জন্যে কষ্ট হয়। উনি আমাকে খুব ভালোবাসেন! উনি যদি জানেন আমি আমাদের বাড়ির কথা না ভেবে, আমাদের বংশের সম্মানের কথা না ভেবে তোমার সঙ্গে মেলামেশা করছি আবার, তাহলে দাদুভাই কষ্ট পাবেন।

আমি যদি কোনোদিনও অনেক বড়লোক হতে পারি তোমাদের মতো, তাহলে তোমার দাদুর সম্মান নষ্ট হবে না তো? তখন উনি মেনে নেবেন আমাদের কে?

খানিকটা বিদ্রুপের গলায় বললো সুমন, অদ্বিতীয়া চুপ করে থাকলো কিছুক্ষন, তারপরে একটু নিচু গলায় বললো,

তুমি বনেদী আর বড়োলোকের ফারাক বোঝোনা, আর সেটা তোমাকে আমি কখনো বোঝাতে পারবো না!! তুমি হয়ত বড়লোক হবে একদিন, কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও বনেদী হতে পারবে না! ওটা পয়সা দিয়ে কেনা যায়না! আমাদের বাড়ির মেয়েরা কখনো প্রেম করে বিয়ে করে না, তাতে বনেদী বাড়ির সম্মান নষ্ট হয়!

তাহলে এরপর? শুধু বনেদী নই এটাই আমার অপরাধ? এই তো! সব কিছু তো চেষ্টা করলে করতে পারা যায়, কিন্তু বনেদী চেষ্টা করলেও হওয়া যায় না, তোমার মুখেই শুনলাম! তারমানে তোমাদের মতো বাড়ির মেয়েদের কে ভালোবাসতে নেই?

অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

না নেই! সেটা আমি জানতাম বলেই তোমার চিঠি তখন নিতে চাই নি!! কিন্তু তারপরেও আমি নিয়ে ফেললাম! ভুল আমারই হয়েছে, আমার তোমার সঙ্গে দেখা করা উচিত হয় নি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি!! আর আমি এখন এসব নিয়ে কোনো কিছু ভাবতেও চাই না! আর কখনো তুমি এসোনা!

সুমন কে দাঁড় করিয়ে রেখে অদ্বিতীয়া হাঁটতে থাকলো, খুব পেছনে ফিরে শেষ বারের মতো একবার দেখতে ইচ্ছে করছিলো সুমন কে, কিন্তু ও ঘুরলো না! পেছন থেকে সুমন চিৎকার করলো,

আমি অপেক্ষা করবো!! আবার তোমার সঙ্গে কথা হবে!! আজ না হলেও কাল!! আমি তোমার দাদু কে পরোয়া করি না!

নিজেকে শক্ত করলো অদ্বিতীয়া ঠাম্মার কথা গুলো শুধু মনে হচ্ছিলো, বেশ্যা মায়ের রক্ত! নাহ! কোনো বেশ্যার রক্ত ওর শরীরে নেই! বনেদী সান্যাল দের রক্ত আছে ওর শরীরে, ওকে সেটা প্রমাণ করতেই হবে। অনেক বড়ো হতে হবে ওকে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, যাতে ওর মা কে আর কোনোদিনও কেউ বেশ্যা না বলতে পারে সেটা কাজে করে দেখাবে ও।

পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে প্রথম প্রেম ভাঙতে বাধ্য হওয়া মেয়েটি আরো নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে লাগলো। সারাদিন সে নিজেকে পড়াশোনার মধ্যে ডুবিয়ে দিলো, তার বংশ মর্যাদায় যেনো কেউ দাগ লাগাতে না পারে সেই চেষ্টাই সব সময় করতে লাগলো।

দিন এগিয়ে চলেছিলো, রমা ইতিমধ্যেই সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন, তাঁর যত্নে তৈরি করা আশ্রমের সদস্য সংখ্যাও বাড়ছিলো ক্রমশ। সুকান্ত এবং রমার সঙ্গে ক্রমশই অদ্বিতীয়াও জড়িয়ে পড়ছিলো। দাদার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় একটু হলেও সোমা ক্ষুব্ধ হয়েছিলো। অদ্বিতীয়ার সে বাদে অন্য কোনো বন্ধু ছিলো না, তাই সে সবসময় সোমা কে মানিয়ে নিয়েই চলার চেষ্টা করতো। সোমা জানতো তার বন্ধু যথেষ্ট অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, সুকান্ত প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার হাতে শখে টিফিন কিনে খাবার পয়সা দিয়ে যেতেন, অদ্বিতীয়া কিছু কিনে না খেলেও সোমা সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতো। অদ্বিতীয়া আপত্তি করতো না, সোমা কে খাওয়াতে পেরে সে খুশিই হতো, যাতে সোমা তার প্রতি প্রসন্ন থাকে তার তরফ থেকে সব রকমের চেষ্টা থাকতো।

সোমা খুব স্বার্থপর মেয়ে ছিলো, বড়লোক বাড়ির মেয়ে অদ্বিতীয়া তার কাছে তুরুপের তাস ছিলো, যেনো তেনো প্রকারেন তাকে নিজের দাদার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে তার উৎসাহই দাদার থেকে বেশি ছিলো প্রথমে। সুমন অন্য ধরনের ছেলে ছিলো, ফুটবল ছিলো তার জীবন, খেলাধুলা, ক্লাব, বন্ধু বান্ধব, পাড়ার রক্ত দান শিবির, এসবই তার জীবন ছিলো। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে সুমন প্রথম দিকে বোনের বন্ধু কে নিয়ে অতোটা ভাবে নি, বোন কে হোস্টেল থেকে নিয়ে অদ্বিতীয়ার গাড়িতে ফেরার সময় তাকে দেখে তার এতটাই ভালো লাগলো, যে ফুটবলের বাইরেও যে জীবনে অন্য কিছু আছে সেটা সে প্রথম বার অনুভব করলো।

বোনের মুখে তার বন্ধুর অসম্ভব প্রশংসা তাকে আরো বেশি করে তার দিকে আকর্ষিত করলো। সে বরাবরের জেদী ছেলে, তার ফুটবল খেলার নেশা ছাড়ানোর জন্যে তার বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন এককালে। সে যখন সন্ধ্যে পেরিয়ে খেলে বাড়িতে ঢুকতো তখন তার বাবা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন, কিন্তু সেই লাঠি তার পিঠে অজস্র বার ভাঙা হয়ে গেলেও ফুটবল ছেলের জীবন থেকে সরানো তার বাবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সেই জেদের বহিঃপ্রকাশ এক্ষেত্রে আবার ঘটলো, সুমন ফিরে গেলো, বোন কে দেওয়া কথামতো আর কখনো হোস্টেলে গেলো না, কিন্তু অদ্বিতীয়া কে সে মন থেকে সরাতে চেষ্টাও করলো না। সে অপেক্ষা করতে লাগলো আবার কোনোদিনও অদ্বিতীয়ার মুখোমুখি হবার, তার সঙ্গে আবার কথা বলার, নতুন করে সম্পর্ক শুরু করার।

দেখতে দেখতে মাধ্যমিক শেষ হয়ে গেলো, পরীক্ষার পরের তিন মাসের ছুটির সুযোগে হোস্টেল খালি হয়ে গেলেও অদ্বিতীয়া বাড়ি যেতে চাইলো না। সুকান্ত অবাক হলেন,

বাড়ি যাবি না! কেনো? হোস্টেল তো খালি হয়ে যাবে, বন্ধুরা বাড়ি চলে যাবে, তুই একা থাকবি কেনো?

অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

আমার বড়দির সঙ্গে কথা হয়ে গেছে ছোট কা, আমি একা হোস্টেলে থাকবো না, আমি ওনার কাছে থাকবো। আমার বাড়িতে একা একা ভালো লাগে না।

সুকান্ত রমার সঙ্গে কথা বললেন, তার থাকাতে রমার কোনো অসুবিধে নেই সেটা জানার পরে তিনি ভাই ঝি কে রমার দায়িত্বে রেখে কলকাতা ফিরে গেলেন। পরীক্ষার পরে নাতনি বাড়ি ফিরে আসবে এমন ধারণাই প্রতাপ সান্যালের ছিলো, তাকে ছেলের সঙ্গে না ফিরতে দেখে তিনি আশ্চর্য্য হলেন,

তুমি ওখানে রেখে ওকে চলে এলে! এই বুদ্ধি, বিবেচনা নিয়ে তুমি কিভাবে যে ওকালতি করো আমি বুঝে উঠতে পারিনা!

সুকান্ত অবাক হলেন,

ও একজনের দায়িত্বে আছে বাবা! ওকে তো হোস্টেলে একা ফেলে রেখে আসিনি! দিন দুয়েকের মধ্যেই সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ও রমার কাছে চলে যাবে। আর শুধু টেন আর টুয়েলভ চলে যাচ্ছে, হোস্টেল তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না!!

স্বামী কোনো কথা বলার আগেই এবার সরযূ এগিয়ে এলেন,

ওই টাতেই তো আরো ভয়!! ও মেয়ে নিজে যা পারে নি, এবার একে দিয়ে তাই করিয়ে নেবে! কম চেষ্টা তো করে নি এবাড়িতে ঢুকতে! নেহাত রুখে দাঁড়িয়েছিলুম তখন তাই পারে নি! তাবলে মনে কি সে কম বিষ পুষে রেখেছে!! এই সুযোগে এ মেয়ের মাথাখানা খাবে এক্কেরে!

রমার প্রতি সরযূর আগের মনোভাব সুকান্তর অজানা ছিলো না। ইদানিং তাঁরও বয়স হচ্ছিলো, প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছর আগের তরুণী রমার সম্পর্কে একই রকম মনোভাব যে তিনি এই বয়সে এসেও ধরে রেখেছেন এটা বোঝার পর সুকান্ত ধৈর্য্য হারালেন,

আশ্চর্য্য! সে এই বাড়ির বউ হতে পারে নি বলেই পিয়া কে ইচ্ছাকৃত ভাবে বাজে ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ করে দেবে! তুমি পারও বটে! আর কতো কাল! এসব ছেড়ে এবার একটু ঠাকুর দেবতায় মন দাও, শেষ জীবনে কাজে আসবে! তোমার হাতে কি থাকবে শেষ পর্যন্ত, ভেবেছো কখনো? বড়ো বউ, ছেলে কে তো বিদায় করলে, পিয়া যে তোমার জন্যেই বাড়ি আসতে চায় না সেটা বোঝো? সারা জীবন যে সংসার সংসার করলে, সংসার তোমাকে কি দিলো শেষ পর্যন্ত? হিসেব করেছো কখনো? শেষ বয়সে মুখে জল দেবার মতোও তো কেও থাকবে না!

স্ত্রী কে ছেলের কাছে অপমানিত হতে দেখে এবার প্রতাপ সান্যাল এগিয়ে এলেন,

প্রশ্ন টা ওই মেয়েটার নয়! প্রশ্ন টা তার কাজকর্মের! ওই যে কিছু অনাথ বাচ্ছা ওখানে সে রেখেছে, তারা কোথা থেকে এসেছে, কোন ঘরের, কি তাদের রক্ত, কিছুই তো জানা নেই! তাদের নিয়ে সে থাকছে, তুমি সেখানে যাচ্ছ সেসব নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই! একটা স্বল্প পরিচিত মেয়ে কিভাবে তার জীবন কাটাবে সেটা তার নিজস্ব বিষয়, আমি কিছু বলতে যাবো না! কিন্তু আমি অবশ্যই আমার বংশের মেয়ের ভালোর ব্যাপারে কথা বলবো। আমি তোমার মায়ের মতো বলছি না যে সে ইচ্ছাকৃত ভাবে পিয়া কে এগিয়ে দেবে, কিন্তু পরিবেশ? পরিবেশের যে মানুষের জীবন গঠনে বড়ো ভূমিকা থাকে সেটা অস্বীকার করতে পারো তুমি? ওই নাম গোত্রহীন কিছু অনাথ বাচ্ছার সঙ্গে থেকে সে কোন পরিবেশে মানুষ হবে, সেটা বলো? কি শিখবে সে! তুমি কলকাতার কোনো হোস্টেলে তাকে রাখতে পারতে? আমি তো তাকে হোস্টেলে পাঠানোয় কোনো আপত্তি করিনি, কিন্তু কি পরিবেশে নিয়ে গিয়ে তুমি রাখলে তাকে! গিয়েই সে এক বাজে ছেলের খপ্পরে পড়ে গেলো!! না, আমি তিন মাস তার ওই পরিবেশে থাকা কিছুতেই মেনে নেবো না!! এখানে যদি তোমার মায়ের জন্যে থাকতে তার ভালো না লাগে, তবে তাকে তার বাবা, মায়ের কাছে রেখে এসো!! কিন্তু ওখানে সে কিছুতেই থাকবে না!!

অগত্যা সুকান্ত আবার পরের দিন সকালেই ভাই ঝি কে নিয়ে আসতে রওনা হলেন, যাবার আগে তিনি বাবা কে বৌদি কে জানিয়ে দেবার জন্যে বলে গেলেন। কোর্টে নবীনের সঙ্গে দেখা হবার পরে প্রতাপ সান্যাল তাকে দিয়ে বৌমার কাছে খবর পাঠালেন যে অদ্বিতীয়া আগামী তিন মাস সরলার কাছেই থাকবে।

স্বামী কোর্ট থেকে ফেরার পরে সরযূ তাঁর ঘরে গেলেন, একটু চিন্তার গলায় বললেন,

হ্যাঁ গো!! তাকে ওখানে পাঠানো কি ঠিক হলো? এমনিতেই সে তো ছেলেটাকে বশ করেই ফেলেছে, এবার আবার মেয়েটার মাথাটাও না খায়!! তিন মাস কম কথা নয়!! একে সে মেয়ে আমাকে সহ্য করতেই পারে না, তার মধ্যে ওইখানে ওই বউয়ের কাছে রাখা!!

প্রতাপ বাবু মাথা নাড়লেন,

সে নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না গিন্নী, মায়ে ঝিয়ে ওখানে কি করছে সে খবর আমি নবীনের কাছে পেয়ে যাবো। আর এতদিন তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে শুধু স্বামীকে নিয়ে কাটালো, এবার একটু মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে দেখাক।

সরযূও চিন্তিত হলেন,

এদিকে মেয়ে কে পোছে না, এদিকে তো মেয়ে কে বাঁচাতে সব ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বুঝিনা বাপু কিছু!! একবার তার মা কে ভিখিরি বলেছিলুম বলে সে বউ এগিয়ে এসে আমার ছেলেকেই ভিখিরি বলে দিলো! আরে বুঝলি না যে তুই তোর সোয়ামি কেই ভিখিরি বললি!!

প্রতাপ সান্যাল চোখ বন্ধ করে আরাম কেদারায় মাথা ঠ্যাকালেন, নিচু গলায় বললেন,

এই কথাগুলো আমারও মাথায় আছে সরযূ!! আমিও দেখতে চাই যে সে সত্যি তার সতীনের মেয়ের দায়িত্ব নিতে চায় না নাকি এখানে আমাদের দেখিয়েই সেটা এড়িয়ে চলতে চায়। তুমি ওসব লতা পাতা, শিকড় বাকড়ে বিশ্বাস করতে পারো, আমি করি না!! সে কি দিয়ে আমার ওই ছেলেকে চুপ করিয়ে দিয়েছে সেটা আমি জানতে চাই!! একটা কথা ভুললে চলবে না বউ তোমার বনেদী ঘরের মেয়ে, তার বুদ্ধিকে ছোটো করে দেখলে হবে না!! এতদিন সব খবর জেনেও সে মুখ বন্ধ রেখেছে নিজের স্বার্থেই, ভবিষ্যতেও রাখবে আমি জানি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাকে নজরের আড়ালে রাখা উচিত!! সবাই নিজেকে চালাক ভাবে গিন্নী, তুমি, আমিও ভাবি, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তবে নিজেকে চালাক ভাবলেও অন্য কে বোকা ভাবার মতো ভুল যেনো আমরা কখনো না করি। সে এখান থেকে সরে যেতে চেয়েছে, যেতে দিয়েছি, কিন্তু নজর এক মুহূর্তের জন্যও সরাবো না, সে আমার নজরেই থাকবে!!
ক্রমশ