সে অবেলায় এসেছে পর্ব-০১

0
216

#সে অবেলায় এসেছে
#পর্ব -১
#ফিজা_সিদ্দিকী

আঁধারে ঢাকা নিঃস্তব্ধ কারাগার থেকে ভেসে আসা গোঙানির শব্দ অনুসরন করলো আলোক। সেল নম্বর 207। আট মাসের উঁচু পেট নিয়ে উবু হয়ে বসে আছে অল্পবয়সী এক মেয়ে। সেলের দেওয়ালে অসংখ্য আঁকিবুকির দাগ। যেনো কিছু হিসেব নিকেশের চিহ্ন রাখা দেওয়াল জুড়ে। আলোকের কপাল জুড়ে স্থান করে নিলো সূক্ষ চিন্তার ভাঁজ।

“আমার যা বলার আগেই বলে দিয়েছি। নতুন করে বলার মতো কিছু নেই।”

রাশভারী কণ্ঠস্বর শুনে খানিকটা বিচলিত হলেন আলোক শিকদার। ডিপার্টমেন্ট থেকে আজই তাকে পাঠানো হয়েছে এখানে। মূলত কয়েকটা কেস হাতে দেওয়া হয়েছে তার। এটা তার মধ্যে একটা।

“রুমানা অর্থী রাইট!”

আলোকের কথা শুনে বেশ মজা পেলো অর্থী। যেনো ভীষণ হাস্যকর কিছু শুনেছে সে।

“কয়েকদিন পর নিশ্চিহ্ন হবে যে নাম, তা নিয়ে কিসের এতো আয়োজন।”

“আপনার কি বাঁচতে ইচ্ছে করেনা?”

“নাহ”

কাঠকাঠ কণ্ঠের জবাবে আশাহত হলো আলোক। ক্যারিয়ারের প্রথম কেস যদি সমাধান করতে না পারে তবে টিকে থাকার লড়াই বড্ডো কঠিন হবে তার জন্যে। যেভাবেই হোক নিজের শেষ চেষ্টা করতে হবে তাকে।

“মিস অর্থী, আপনি কি আপনার সন্তানের কথা একবারও ভাবেন না? ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে অন্তত মুখ খুলুন। বাবা মা ছাড়া সদ্যোজাত সন্তান কিভাবে বড়ো হবে ভেবে দেখেছেন? রাস্তার ধারে কোনো আস্তাকুড়ে কিংবা ময়লার স্তুপে ফেলে আসবে আপনার সন্তানকে। কে নেবে ওর দায়িত্ত্ব? কিংবা ধরুন কোনো অনাথ আশ্রমে রেখে আসবে। এরপর? আপনি তো পিঠ বাঁচিয়ে পালিয়ে যাবেন। সন্তানকে ধোকা দিয়ে খুলে পড়বেন ফাঁসির দড়িতে। মুক্তি পাবেন। অথচ আপনার সন্তান প্রতি মুহূর্তে হাহাকার করবে। বাঁচার জন্য চিৎকার করবে। মাসুম বাচ্চার কান্না দেখে সহানুভূতি দেখিয়ে এক টুকরো রুটি সবাই দেবে। কিন্তু ভালোবাসা? যত্ন? আদর? মমতা? কে দেবে এগুলো? আপনার ভুলের জন্য নষ্ট হবে ওর জীবন। দু মুঠো ভাতের জন্য ছটফট করবে। মেনে নিতে পারবেন তো সেই দৃশ্য? তার চেয়ে বরং এক কাজ করুন জেনেবুঝে বাচ্চাটাকে নরকে ঠেলে না দিয়ে মে’রে ফেলুন। নিজের সাথে সাথে ওকেও মুক্তি দিন। জগৎ সংসারের জটিলতা থেকে মুক্ত করে দিন ওকে।”

লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলো আলোক। মেয়েটা বয়সে তার মতোই কিংবা ছোটো হবে সামান্য। চোখের তলায় জমে থাকা কালিমা অনেক অজানা গল্প লিখে রেখেছে। মলীন চেহারা এককালে ধবধবে ফর্সা সুশ্রী সৌন্দর্য্যের অধিকারী ছিলো। অযত্নে কোমর সমান চুলগুলো তেলচিটে হয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আলোক অর্থীকে। মেয়েটার মুখে বড্ডো মায়া। কোনো খুনীর প্রতি এতো সহানুভূতি তার আসেনি কখনও। তবে আজ হচ্ছে। কেনো যেনো মনের ভেতরের এক সত্তা তাকে ফিসফিসিয়ে বলছে রহস্যের বেড়াজাল অনেক গভীর। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো আলোক। নীরবতার মাঝে কাটলো বেশ কিছুটা সময়। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালো আলোক। কয়েক পা এগোতেই অর্থীর কথায় চমকে উঠলো। খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো চোখে মুখে।

অতীত 🥀

কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র। কয়েকমাসের জন্য কলেজ ছুটি। সাথে গরমের ছুটি যোগ হয়ে ছুটিটা তিন মাসে ঠেকেছে। আব্বু, আম্মু, ভাইয়ার একমাত্র চোখের মনি অর্থী। কখনো কিছুর অভাব বোধ করতে দেননি। ভীষণ স্বচ্ছল পরিবার না হলেও মধ্যবিত্ত পরিবারেও সুখের কমতি নেই কোথাও। এতগুলো মাস বাড়ীতে একা সময় কাটানোর জন্য টুকটাক সোশ্যাল মিডিয়া, ডেটিং অ্যাপ ঘাটাঘাটি করতো অর্থী । বেশ কিছু ছেলে প্রেমের প্রস্তাবও দিয়েছিলো। রাজি হয়নি অর্থী। তবে এবার একটু মজা করার ভীষণ শখ হলো অর্থীর। আসল উদ্দেশ্য ছুটির দিনগুলো কোনোভাবে পার করা।

নীলয় চৌধুরী। নামটা বেশ পছন্দ হয় অর্থীর। কয়েকদিন আগেই মেসেজ পাঠিয়েছিলো। সেও রিপ্লাই করলো। ডেটিং অ্যাপে সচরাচর নিজেদের পিক দেওয়াই থাকে। নীলয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিলো তার কথা। অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলতে পারতো নীলয়। মেসেজ থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয় ফোনালাপ। কথাবার্তার এক পর্যায়ে নীলয় দেখা করার প্রস্তাব রাখে। অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় দুজনের। মজা করতে গিয়ে সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলে অর্থী নিলয়কে। নীলয়ের কেয়ার, ভালোবাসা মিশ্রিত কথার মাঝে দিনে দিনে ডুবে যেতে থাকে অর্থী। সিংহভাগ সময় কাটতো নীলয়ের সাথে। একসাথে ঘোরাঘোরি করা, মুভি দেখা, পার্কে যাওয়া নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়। দেখতে দেখতে কেটে যায় এক বছর। সময়ের স্রোতের সাথে নীলয়ের মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখেনি অর্থী। না কখনও তাকে অনিচ্ছাকৃত ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে। মনের মাঝে বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় অর্থীর। সময়ের সাথে ভালোবাসা পাল্লা দিয়ে বাড়তেই থাকে। নীলয় প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। পরিবারে কেউ নেই। অনাথাশ্রমে তার বড়ো হয়ে ওঠা। স্যালারি অল্প হলেও দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।

“এরপর কি হলো অর্থী?”

আলোকের কথা শুনে মলিন দৃষ্টিতে তাকায় অর্থী। হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে তার বুক। অসহ্য লাগছে সবকিছু। এতোদিন বুকে চেপে রাখা পাথরটা সরাতে গিয়ে বড্ডো কসরত করতে হচ্ছে তাকে। নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ ঘোষণা করছে যেনো। নিস্তব্ধতার মাঝে দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছেনা।

******************

নীলয়কে কোনোভাবেই পছন্দ হয়না রামিজ সাহেবের। বাবার সাথে ভাইয়েরও একমত। এতদিন সবকিছু চাওয়ার আগে পেয়ে যাওয়া অর্থীর মাথায় চেপে বসে জেদ। নীলয়কে কোনোভাবে ছাড়তে রাজি নয় অর্থী। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে নীলয়ের সাথে বাড়ি ছাড়ে। কাজী অফিস থেকে কোর্ট ম্যারেজ করে। সাক্ষী হিসেবে থাকে নীলয়ের কয়েকজন বন্ধু।

পেরিয়ে যায় তিনটে মাস। নীলয়ের ভালোবাসায় অভাব জিনিসটা বুঝতে পারেনা অর্থী। তবে ইদানিং বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে নীলয়ের মাঝে। বেশ রাত করে বাড়ী ফেরে। অর্থীকে আগের মতো সময় দেয়না। কেমন যেনো দূরত্ব তৈরি করে চলার চেষ্টা করে।

“অর্থী নীলয় তো আপনাকে ভালোবাসতো। আপনিও তাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তবে তাকে মারলেন কেনো? আর আপনার বাবা, মা, ভাইয়া সবাইকেই বা মারলেন কেনো?”

হুট করেই একদিন পিছু নিয় নীলয়ের। সেদিন রবিবার ছিলো। নীলয়কে ফলো করতে করতে চলে যাই একটা বাড়িতে। ঘরে ছিলো দুটো রুম। যার মধ্যে একটা হিমঘর। শব্দহীনভাবে ধীর পায়ে ঢুকে পড়ি নীলয়ের পিছু পিছু। এরপর যা দেখি তার জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। সাতটা মেয়ের লা’শ। সবগুলো প্রায় নগ্ন অবস্হায়। নীলয় লোলুপ দৃষ্টিতে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো এক একটা দেহ। এরপর একটা মৃ’ত লাশের সাথেই।

এটুকু বলে থামলো অর্থী। বিস্ময়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে আলোকের। এতদিন ন্যাক্রোফিলিয়া রোগের ব্যাপারে সে শুনেছিলো। এই রোগে মৃতদেহের প্রতি আকর্ষণ থাকে রোগীর। তবে কখনও বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আসলেই এমন মানুষ আছে।

“ঘৃণায় রি রি করে ওঠে শরীর। শরীরের সমস্ত লোমকূপ খাড়া হয়ে যায়। সামনে চলতে থাকা দৃশ্য আর দেখা সম্ভব হয়না। নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ব’মি উঠে আসে। নীলয়ের আসল চেহারা এরপর থেকেই আস্তে আস্তে খোলাসা হয় আমার চোখের সামনে।”

অতীত 🌸

নীলয় টেনে হিঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে আসে অর্থীকে। পালানোর জন্য ছটফট করলে ইনজেকশন পুশ করে দেয় নীলয়। কিছুক্ষনের মাঝেই অবশ হয়ে আসে অর্থীর শরীর। হুঁশ থাকলেও শরীরের সমস্ত কার্যক্রম লোপ পেয়েছে। কথা বলার জন্য উন্মাধের মতো চেষ্টা করছে অর্থী। কিন্তু মুখ থেকে টু শব্দও বের হচ্ছেনা।

“অর্থী, আমার এক নারীর শরীর ভালো লাগেনা। নতুনত্ব দরকার হয়। তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি অর্থী। এজন্য তো কোনো মেয়ের দিকে ঘুরেও তাকাইনা। তোমাকে কোনোভাবে ধোঁকা দিতে চাইনা আমি। আমাকে প্লিজ ভুল বুঝোনা। আমি তো কারো ক্ষতি করিনি অর্থী। আর না তোমাকে ঠকিয়েছি। আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ।”

নীলয়ের কান্নায় পুরোনো ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠে অর্থীর মন। মন বলছে সবকিছু ভুলে নীলয়কে এসব থেকে বের করে আনতে। আবার মস্তিষ্ক বলছে, তোর রুচি এত খারাপ কিভাবে হলো অর্থী? এরকম নোংরা একটা ছেলের সাথে আবারো থাকার কথা ভাবতে ঘৃণা করছেনা তোর? শান্ত মাথায় মনকে প্রশ্রয় দেবে বলে ঠিক করলো অর্থী। এতোদিনের ভালোবাসার সম্পর্ক, দুজনের ছোটো সংসার ফেলে চলে যেতে কোনোভাবেই মন সায় দিলনা। যাওয়ার মতো কোনো জায়গাও তো তার নেই। বাড়িতে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে অর্থী। তার গলা শোনা মাত্রই ফোন কেটে দেয় সবাই। তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্ত করে অর্থী।

#চলবে?