সে আমার শরৎফুল পর্ব-৬+৭

0
120

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৬

#আরশিয়া_জান্নাত

“মানুষ যদিও সৃষ্টির সেরা জীব, তবে তাদের কর্মকান্ড নিকৃষ্ট!”

ইরহাম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তৃণার দিকে তাকালো।
তৃণা পেপারটা সরিয়ে কোচে হেলান দিলো। মনটা ভীষণ বিষন্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ইরহাম কিছুক্ষণ সময় দিয়ে বললো, হঠাৎ এই কথা বললেন কেন?

তৃণা তার দিকে চেয়ে বলল, আপনার কি মনে হয় আমি ভুল বলছি?

ভুল বলেছেন এই কথা বলার মতো জোর নেই, কেননা চারদিকে এমনসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে নিকৃষ্ট বলাই যায়। তবে আমি জানতে ইচ্ছুক এখন কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বললেন,,

জানেন আমি যখন সেন্টমার্টিন গিয়েছি একটা বিশেষ জলজ প্রাণির খোঁজ পাচ্ছিলাম না। অথচ আমাদের আগের ব্যাচও কিছু দেখেছিল। শুধু তাই নয়, সুন্দরবনে গিয়েও এমন অনেক প্রাণির খোঁজ পাইনি যা হয়তো ক’মাস আগেও ছিল। এসব দেখলে আমার ভীষণ রাগ হয়। একটা প্রতিবেদন পড়েছিলাম। “বোকা ডোডো পাখি”-র সম্পর্কে। শুধুমাত্র মানুষের পদার্পনে একটা প্রজাতি ১০০ বছরের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেল! এ থেকে কি বোঝা যায় না মানুষ যেখানেই যায় ধ্বংস বয়ে আনে,,,

এটা সত্যি।

সাপের কথাই বলি, সাপ দেখলেই মানুষ মেরে ফেলে। এখন সেটা বিষাক্ত হোক বা না হোক। অথচ এই সাপও কিন্তু জীব বৈচিত্র্যতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ প্রাণি। বনবিড়াল বা একটু ভিন্ন কোনো প্রাণি দেখলেই আমরা হত্যা করে ফেলি, কুকুর বিড়ালকেও ছাড় দেই না। ওরা তাও পায়ের ধারে থেকে থেকে লাথি উষ্ঠা খেয়েও কিভাবে যেন টিকে গেছে। নিরীহ কিছুই এই পৃথিবীতে টিকতে পারেনা।

সহমত।

যাক বাদ দিন, আমি এসব নিতে পারিনা আসলে। তাই ইমোশনাল হয়ে পড়ি। ডোন্ট মাইন্ড।

ইটস ওকে।

ইরহাম পেপার টা হাতে নিয়ে দেখলো, থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজির তোপে অনেকগুলো পাখির দেহাবশেষ রাস্তায় পড়ে আছে। মানুষের বিনোদন কিছু কিছু প্রাণির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এটা যেন এর জ্বলন্ত প্রমাণ। ইরহাম বুঝে পায়না কি দরকার এমন আনন্দের যা অন্যের জীবন কেড়ে নিবে? আতশবাজিতে সাময়িক চোখের আনন্দ ব্যতিত কোনোকিছুই হাসিল হয়না। অথচ লোকে কত টাকা খরচা করে এই জিনিসটা কিনে।

তৃণা চা আর স্যান্ডুইচ অর্ডার করলো। ক্ষিদায় তার পেট চো চো করছে যদিও সে ভরপেট নাস্তা করেই বেরিয়েছে। কিন্তু ট্রেনে চড়লেই তার ক্ষিদে বাড়ে। ওর মতে ট্রেনের ঝাকুনিতে খাবার দ্রুত হজম হয়। ইরহাম ওকে নাস্তা খাওয়ার স্পেস দিতে উঠে যাচ্ছিল, ওমনি তৃণা বললো উঠবেন না বসুন।

আমি একটু ওয়াশরুমে,,

বাহানা দিয়ে লাভ নেই। নাস্তা করে তারপর যাবেন।

নাহ ঠিকাছে তৃণা। আপনি খেয়ে নিন।

আমাকে আপনার এতো খাদক মনে হয়? আমি ৪টা স্যান্ডুইচ একা খাবো!? মানছি আমি একটু পরপর এটা ওটা খাচ্ছি তবে তার মানে এইটা না কিন্তু।

আমি সেটা কখন বললাম?

বলেননি তবে বুঝিয়েছেন।

আমি সত্যিই তেমন কিছু বুঝাইনি।

বিশ্বাস করবো, যদি আপনি আমার সাথে খাবার শেয়ার করেন। প্লিজ!

ইরহাম টিপ্পনী কেটে বলল, আমার ওয়েট কম বলেই কি সবসময় এই আপ্যায়ন?

হাহাহা। সত্যি বলি চিকন মানুষ দেখলে আমার ইচ্ছে করে নিজ হাতে ভাত মেখে গালে তুলে দেই! আমার যে বান্ধবিরা ডায়েট ডায়েট করে মরে ওদেরকে তো সুযোগ পেলে গামলাভর্তি ভাত খাইয়ে দম নেই। জীবন তো একটাই, খাওয়ার জন্যই তো এতো কিছু। এখানে এতো বিধিনিষেধ মেনে চলা যায়!

আপনার কথা শুনে বিশ্বাস হয়না আপনি খাদ্যরসিক!।দেখতে তো যথেষ্ট ফিট!

আমি আমার মায়ের ভান পেয়েছি, ইচ্ছেমতো খাবো কিন্তু ওজন বাড়বেনা। হিহিহি

হাহা,, লাকি মানুষ।

আমার সব ফ্রেন্ডরা এটা বলে।

খাওয়া শেষে তৃণা বললো, আপনি কোথাও যাওয়ার থাকলে ঘুরে আসেন। আমি জেগে থাকতে থাকতে,,

কেন?

আমার ঘুম আসতেছে। সবসময় জার্নিতে ঘুম আসলেও তাকিয়ে থাকতে হয়। সিকিউরিটি কনসার্নে। আজ যেহেতু পাহারাদার আছে ঘুমাতে ভয় নেই। কি বলেন?

ভেরি স্মার্ট! এজন্যই একসঙ্গে আসতে চেয়েছেন।

নাহ নাহ তেমন নয়। তবে ২০% উদ্দেশ্য এটাই।

বাকি ৮০% কি?

বাকি ৮০% কি সেটা তো ভেবে দেখিনি,,

ইরহাম অন্যদিকে ফিরে হাসলো। তৃণা জানলার দিকে মনোনিবেশ করলো।

আকাশে আজ সুয্যিমামার বিশেষ কতৃর্ত্ব নেই। কেমন মেঘলা দিনের মতো‌ নরম আলোর ছটা ছড়িয়ে আছে। তেজি ভাবটা নেই। তৃণা বেশ আরাম করে শাল পেঁচিয়ে কোচে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। টুপি, শালের মাঝে ওর ছোট্ট মুখটা বাদে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। তাও নাক অবধি ঢাকা। ইরহাম ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো। কেমন আদুরে বাচ্চার মতো ঘুমাচ্ছে মেয়েটা! স্বল্প পরিচয়ে তাকে কেমন ভরসা করে বসেছে। ইরহাম এরমধ্যে আসা ফেরিওয়ালা থেকে ট্রেনের বিখ্যাত পটেটো চিপস, ম্যাংগো জুস আর কিছু চকোলেট কিনে নিয়েছে। ঘুম ভাঙলে নিশ্চয়ই তৃণার খিদে পাবে। তাই আগে থেকেই যোগান রাখা।

তৃণার ঘুম ভাঙে একদম লাকসাম জংশনে ট্রেন থামার পর। আড়মোড়া ভেঙে বলে, কোথায় আছি?

লাকসাম।

ওহ আচ্ছা। মাথা থেকে টুপি সরিয়ে চুলগুলো ঝেড়ে ক্লিপ দিয়ে বাধল, চোখে মুখে পানি দিয়ে রুমাল দিয়ে মুছতে লাগলো। ইরহাম তখন সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পেপারে মুখ গুজে ছিল। তৃণা শাল ভাজ করে মাথায় উড়না দিলো। পরিপাটি হয়ে বলল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি বহু বছর পর এতো শান্তিময় একটা জার্নি করছি! আহ শরীরটা একদম চাঙা হয়ে গেছে।

ইরহাম সামনে থাকা নেট থেকে খাবারগুলো তার দিকে বাড়িয়ে বলল, নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে? নিন সামান্য স্ন্যাক্স গ্রহণ করুন।

টাইমিং জোস! আরেকটা ধন্যবাদ।

তাই না?

হুম।

আচ্ছা শুনুন, আন্টিদের নিয়ে আমাদের বাসায় আসবেন? বেড়িয়ে যাবেন!

আম্মা আসলে কোথাও যান না।

তাহলে বোনদের নিয়ে?

দেখি,,

আচ্ছা।

তৃণা?

হুম?

কাউকে এতো সহজে ভরসা করবে না।

ভুল মানুষকে ভরসা করিনি।

এতো কনফিডেন্ট?

জ্বি!

যদি ভুল প্রমাণ হয়?

বিশেষ‌ ক্ষতি হবে?

হবে না?

উমমম নাহ! ক্ষতি হবার মতো স্কোপ তো দেই নি।

তবুও বলবো সবাইকে সুযোগ দিবেন না সফরসঙ্গী হবার,,,

এটা কি পরোয়ানা জারি নাকি কেবলি সতর্কীকরণ?

কোনটা বললে খুশি হবেন?

পাল্টা প্রশ্ন কেন?

থাক বাদ দিন।

তৃণা ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। ইরহাম আর কথা বাড়ালো না।

স্টেশন থেকে রিকশায় তুলে দিয়ে ইরহাম বলল, এই বইগুলো আপনার জন্য। পড়ে রিভিউ দিবেন কিন্তু।

অসংখ্য ধন্যবাদ।

এতো ধন্যবাদ দিতে হয়না। বাসায় পৌঁছে টেক্সট করবেন,,

তারপর রিকশাওয়ালাকে বলল, মামা সাবধানে নিয়ে যাবেন।

তৃণা হেসে বিদায় জানালো। প্যাকেট খুলে দেখলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ৩টি বই বৃষ্টির ঘ্রাণ, ঘুণপোকা~কাগজের বৌ, মানবজমিন।

“বাহ! তার রুচি আছে বলতে হয়!! কিন্তু আমি যে কিছু গিফট করলাম না। কি গিফট করা যায়??”

বাড়ি ফিরে তৃণার দিন বেশ ভালোই কাটছে। শীতের অলসতায় সে থোরাই কম্বল ছেড়ে বেরোয়। পারলে কম্বল মুড়িয়েই সবখানে যায়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই ঠান্ডু মৌসামে তাকে না চাইতেও ওয়াশরুমে যেতে হয়। শীত আসলে এই একটাই অশান্তি। এছাড়া সবই শান্তি,,,, ছিটে পিঠা আর গরুর গোশত নিয়ে তৃণার মা এসে খাটের কিনারায় বসলেন। তৃণা কম্বল পেঁচিয়েই উঠে বসলে। আদুরে গলায় বলল, আমি হাত ভরাতে পারবোনা মা, আবার ঠান্ডা পানি ধরতে হবে। তুমি বরং খাইয়ে দাও,,

হ্যাঁ রে হলে থাকলেও এমন করিস নাকি বাড়িতে আমাকে জ্বালাতে এসব করিস?

আমি তোমার একটা মাত্র মেয়ে, আমি জ্বালাবো না তো কে জ্বালাবে? তাছাড়া সারাবছর তো থাকি না,,,

ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে করে খাটাও আর কি। শ্বশুরবাড়ি গেলে যেন শীত আসবে না, তখন ঘরের সব করতে হবে, ঠান্ডা মারিয়ে বাচ্চাদের কাপড়ও ধুতে হবে।কি করবি তখন?

জামাইকে বলবো ওয়াশিং মেশিন আর গাইজার ইনস্টল করতে। তাহলেই হলো।

আহাগো সোনাগো, পরের ছেলে এতো মান্যি করতে যাবে কেন? যদি উল্টোটা হয়?

হবে না মা হবেনা। সে আমায় মাথায় তুলেই রাখবে।

তৃণার গালে খাবার তুলে দিতে দিতে উৎসুক কন্ঠে বললেন,ইশ যেন ভবিষ্যৎ দেখে রেখেছে। হ্যাঁ রে কেউ আছে নাকি এমন? ভালোবাসিস কাউকে?

তৃণা খাবার মুখে রেখেই বলল, থাকলে যেন এক পায়ে রাজি হতে?

হতাম না কেন? ভালো পরিবারের ছেলে হলে আলবাৎ হতাম।

এহহ ঐসব তোমাদের বাবা-মায়ের চালাকি। আমি জানিনা ভাবছো? আদর করে বলবে মা তো বান্ধবীর মতোই। বল না কাকে ভালোবাসিস। এরপর বলে দিলেই বোম্ব ব্লাস্ট। ঠুসস ম্যাকাও,,

ছিঃ তাজু এই ভাবিস মা কে? আমি কি এরকম?

কাউকে বিশ্বাস নেই মা। মায়েদের ফাঁদ আরো বেশি কঠিন,,,,

বদ মেয়ে, আমি তোকে গর্ভে ধরেছি আর তুই কি না আমাকেই বিশ্বাস করিস না।

তৃণা চোখ টিপে বলল, মায়ের বেস্টফ্রেন্ড যে পিতামশাই ভুলে গেলে চলে? হিহিহি

তৃণার মা রেগে উঠে গেলেন। তৃণা বলল, ও মা আরেকটু খাইয়ে যাও না। মজা লাগছে তো।

নিজে উঠে গিয়ে খা, মা ডাকবি না আর আমায়। ফাজিল।

তৃণা হোহো করে হাসতে হাসতে বলল, ক্ষেপেছে রে মাতারাণী ক্ষেপেছে।

চলবে,,,

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৭

#আরশিয়া_জান্নাত

আপুনী কি করিস?

এমনি বসে আছি। আয় ভেতরে।

তামজিদ ভেতরে এসে চেয়ারে বসলো। তৃণা বইখাতা সরিয়ে বলল, কিরে কিছু বলবি?

নাহ। তোর সঙ্গে গল্প করতে এলাম।

আচ্ছা।

আপুনী তোর ক্যাম্পাসে ঘোরার অনেক শখ আমার। আমি অনেকগুলো ব্লগ দেখেছি। কি সুন্দর!

হ্যাঁ অনেক সুন্দর। তুই মেয়ে হলে তোকে নিয়ে যেতাম সাথে করে, ক’টা দিন থাকতে পারতি।

হুম। আচ্ছা আপুনী তোর ছেলে ফ্রেন্ড নাই? তাদের হলে থাকা যেত!

উমম আছে কিছু তবে অতো সখ্যতা নেই। আমি দেখি ব্যবস্থা করতে পারলে তোকে নিবো।

আচ্ছা। জানিস সুপারমার্কেটে একটা দারুণ রেস্টুরেন্ট হয়েছে। ফাস্টফুড খেতে যাবি?

টাকা কে দিবে? আমার কাছে কিন্তু নাই।

আমি দিবো। আমি টিফিনের খরচ জমিয়েছি তোর সাথে ঐখানে খেতে যাবো বলে।

ছোটু, তোর কোনো ফ্রেন্ড নেই?

তামজিদ মাথা নাড়িয়ে বলল, ক্লাসমেট আছে।

তৃণা হেসে বলল, তুই ইন্ট্রোভার্ট আমি জানি। আমার সাথে যতো মন খোলা রাখিস আর কারো সাথে রাখিস না এও জানি। তবুও বলবো বন্ধু রাখিস। দু একটা হলেও।

আমার বন্ধু তুই। এটাই এনাফ।

তৃণা স্নেহের দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালো। বয়সে ছেলেটা ওর ৬বছরের ছোট। ছোট থেকেই ওর পাশঘেষা হয়ে থাকে। তৃণা বলল, চল এখনি বের হই। তোর সাথে আজ ঘুরবো।

তামজিদের মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো।

আচ্ছা তুই রেডি হ, আমি অপেক্ষা করছি।

তামজিদ চলে যেতেই তৃণা আলমিরা থেকে কাপড় বের করে রেডি হতে লাগলো।

নিজের শহরের ব্যাপারই আলাদা। অন্য যতো বড় শহরেই যাওয়া হোক না কেন মন পড়ে থাকে এই ছোট্ট শহরটায়। এই শহরের ছোটছোট গলিপথে, রিকশা/অটো চলে। লোকাল বাস/লেগুনার প্রকোপ নেই। ভোরের দিকে সবচেয়ে বেশি স্নিগ্ধ লাগে। এখানে চট্টগ্রামের মতো ভোরের দিকে গার্মেন্টসকর্মী বা চাকরিজীবিদের ভিড় থাকেনা পথে। ঐ সময়ে কিছু পথচারী কিংবা প্রাইভেটে যাওয়া শিক্ষার্থী চোখে পড়লেও সবটা সুনশান ই থাকে। তবে এখন অনেকটাই জাকজমক হয়েছে। মোড়ে মোড়ে দোকানপাটের পসরা বেড়েছে। রেস্টুরেন্ট হয়েছে। অথচ একটাসময় ছিল যখন হাতে গণা কিছু রেস্টুরেন্ট ছিল এই ছোট্ট শহরটায়। সেখানেই ভিড় জমাতো সবাই।লাচ্চি আর টোস্টের স্বাদ এখনো যেন জিভে লেগে আছে!
তৃণা তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রথমে সুপারমার্কেট গেল। সেখানে টুকটাক কেনাকাটা শেষে ফাস্টফুডে ঢুকে দুই ভাইবোন জম্পেশ আড্ডা দিলো। খাওয়া শেষে রাস্তায় নেমে বলল, ছোটু চল হাঁটি,,

তামজিদ যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। সে সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বলল, আপুনী অন্নদা স্কুলের ওদিকে চল, তোর পছন্দের ফুচকাওয়ালা মামাটা এখনো আছে।

হেঁটে হেঁটে আগের দিনের মতোই চারদিক দেখে দেখে নানান গল্প করতে করতে তারা ফুচকা স্টলে গিয়ে থামে। দিনটা আজ দুই ভাবোনের দারুণ কেটেছে!

ইরহাম ব্যাংক থেকে তার জমানো বেশ কিছু টাকা তুলে বাবার কিছু ঋণ শোধ করেছে।এই টাকাগুলো সে জমিয়েছিল তার বাবা-মায়ের হজের উদ্দেশ্যে। পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়া প্রায় ২/৩ অংশ খরচ করতে হলো। ইরহামের মা রুমানা বেগম এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছেন। তবে চোখেমুখে আনন্দ যেন হারিয়ে গেছে। ইরহাম সকালে উঠেই আনন্দবাজার গিয়ে তাজা মাছ আর সবজি কিনে এনেছে। ওখানে সরাসরি তিতাস নদী থেকে মাছ তুলে বিক্রি করা হয়। সেই তাজা মাছ আনতে তার বাবা সবসময় আগে আগে বাজারে যেতেন। বড় সিলভার কার্পটা দেখে রুমানা বেগমের মুখ আরো মলিন হয়ে গেল। এই মাছটা তার স্বামীর অনেক প্রিয় ছিল। লোকটাম মাছ নিয়ে বেশি আবেগ ছিল। গরু মুরগি নিয়ে আগ্রহ নেই।যখন যেখানে যে মাছ পেতেন নিয়ে আসতেন ব্যাগ বোঝাই করে। সেই মাছ কুটতে কুটতে বটি সামনে রেখেই কত ঘুমিয়ে পড়েছে রুমানা হিসাবের বাইরে। তখন তার মনে হতো এই স্বামীর যন্ত্রণায় সে মরে যাবে। অথচ দেখো আজ সে নেই বলেই যেন সে মরতে বসেছে! মানুষ থাকে না কথা থেকে যায়।

ইরহাম?

জ্বি আম্মা।

রুমি কোথায়?

স্কুলে গেছে।

তুই এই মাছ কেন আনলি? এখন কে কুটবে এই বড় মাছ?

আম্মা, আমি কুটে দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

তুই মাছ কুটতে পারিস?

হ্যাঁ

বড় মাছ আনলে ওদেরকে বলবি কেটে দিতে। বাড়িতে আনবি না।

কিন্তু মা তুমিই তো বলো ওরা কেটে দিলে সব ফেলে দেয়। তুমি যে মজা করে মাছের তেল রাধো ওটা রাঁধতে পারো না,,,

ওসব তোর বাবার পছন্দের ছিল বলে রাঁধতাম। তোরা কেউ তো খাস না। তাই এখন আর সমস্যা নেই।

ইরহাম আর কথা বাড়ালো না। আনাড়ি হাতে মাছ কুটতে বটি নিয়ে বসে গেল। রুমানা ছেলের ধৈর্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটা সবসময় এমন করে। যা পারবেনা তাও করে দিবে। তবুও মুখ ফুটে বলবেনা পারছি না। মেনে নেওয়া মানিয়ে নেওয়ার গুণটা ওর মধ্যে এলো কোত্থেকে? হয়তো বাপের উপর গেছে বলেই। তার বাবাও ছিল এমন। যতো বকো চেচামেচি করো লোকটা হেসে উড়িয়ে দিতেন। যদি বলতেন শুধু লাল মরিচ ডলে ভাত খাও আর কিছু রাধিনি, সে আপন মনে পেয়াজ মরিচ লবণ ডলে ভাত মাখিয়ে খেতে বসে যেতেন। একটাবার রেগে বলতেন না,কেন রাধোনি?
অনেক সময় নিজেই রান্না করে ফেলতেন।

হয়েছে আর করতে হবেনা। রাখ।

আমি পারবো মা, তুমি একটু অপেক্ষা করো।

রুমানা দেখল দেখতে অগোছালো মনে হলেও সে ঠিকই এতো বড় মাছটা কেটেকুটে ঠিক করে ফেলেছে। বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বলল, মা হয়েছে না? বলেছি না আমি পারি!

রুমানা ছেলের হাসির দিকে তাকিয়ে বললেন, আর কি কি পারিস তুই? এসব শিখলিই বা কবে?

তোমার থেকেই শিখেছি। তুমি যখন কুটনা কাটতে বসতে আমি তাকিয়ে থাকতাম। হলে যখন মাঝেমধ্যে খাবারে বিতৃষ্ণা আসে আমরা রুমমেটরা মিলে রান্না করি। তখন আমিই সব করি।

বাহ! আমার ছেলের দেখি অনেক গুণ! মাশাআল্লাহ।

মা বিরিয়ানি খাবে? আমি অনেক ভালো আখনি বিরিয়ানি করতে পারি। তুমি বললে এবার করবো,,,

আচ্ছা করিস।

ইরহা সব পরিষ্কার করে হাত ধুতে চলে গেল। রুমানা মাছগুলো ধুয়ে রান্না বসালো।

একটা সমন্ধ এসেছে, ছেলে ডাক্তার। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে। ৩ভাই কোনো বোন নেই। ছেলে সবার বড়। মা-বাবা দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত। বংশমর্যাদা ভালোই। রফিক ভাই আছে না? উনার কেমন আত্মীয়। বলছিল একটা ভদ্র শিক্ষিত মেয়ে খুঁজতেছে। উনিই তৃণার কথা তুলল। তুমি কি বলো?

মেয়ে যখন হয়েছে বিয়েতো দিতেই হবে। ভালো পাত্র পেলে আপত্তি করবো কেন? খোঁজখবর নাও যদি ভালো মনে হয় বাসায় আসতে বলো, তৃণা যখন এখানেই আছে এরমধ্যে এসে দেখে যাক। দেখা সাক্ষাতে তো ক্ষতি নাই। দুই পক্ষের পছন্দ হলেই পরেনা বিয়ে!

হুম। তবুও ওরে জিজ্ঞাসা করিও ওর পছন্দের কেউ আছে কি না। সমন্ধ তো কম আসে না। আমিতো সবাইরে চাপা দিয়ে রাখি। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে, আর কত বাদ দিবো!

তুমি অতো ভাবিও না। ওদেরকে আসতে বলো। বাকিটা আমি দেখবো।

আচ্ছা তাহলে এ কয়দিনের মধ্যেই আসতে বলি?

হুম।

তুমি যোগাড়যন্ত্র করো। আপ্যায়নে যেন খামতি না থাকে।

ঐসব তোমারে ভাবতে হবেনা। লিস্ট দিবো বাজার পাঠাই দিও।

আচ্ছা।

ছাদে বসে চা পান করতে করতে হঠাৎ মনে হলো আসার পর একদিনো ইরহামের সাথে কথা বলা হয় নি। একবার কি কল করবে? যদিও ইরহামের সাথে বিনা প্রয়োজনে কলে কথা হয়না তেমন। তবে আজ কেন জানি কথা বলতে মন চাইছে। ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বার ডায়াল করে কানে তুললো, দু’টো রিং বাজতেই ইরহাম কল রিসিভ করলো। ভরাট কন্ঠে বলল, আস্সালামু আলাইকুম, কেমন আছেন?

ওয়ালাইকুমুস্সালাম। জ্বি ভালো আপনি কেমন আছেন?

এই তো ভালোই।

বাসায় সবাই ভালো আছেন?

জ্বি, আপনার?

ভালোই।

হঠাৎ খোঁজ নিতে ফোন করলেন বুঝি!

হুম, ভাবলাম বেচারার কাছে হয়তো নাম্বারটা সেইভ নেই যে কল করে খোঁজ নিবে। তাই আমিই কল দিলাম।

হাহাহা, সুযোগের সদ্ব্যবহার কেউ আপনার থেকে শিখুক। পিঞ্চ কাটতে ছাড়লেন না!

কি জানি! সত্যিটা প্রকাশ করলে লোকে যদি এই অপবাদ দেয় কি বলার আছে?

তেমন নয় আসলে, বাসায় আছেন, ফোন করার বিধিনিষেধ আছে কি না তা তো জানি না। তাই কল করা হয়নি।

কেন আপনার প্রেমিকার ফ্যামিলি বুঝি খুব রক্ষণশীল? বাসায় গেলে কল করতে পারেন না?

ভেরি স্মার্ট! ইনডিরেক্টলি লাভ এফেয়ার আছে কি না যাচাই করছেন!

জিজ্ঞাসা করতে নিষেধাজ্ঞা আছে?

নাহ, তবে সরাসরি তো জিজ্ঞাসা করেন নি।

আপনার গফ নেই এটা ভাবা কি আমার বোকামী হবে না?

তাহলে কি ধরে নিবো আপনারো কেউ আছে?

এমন মনে হবে কেন?

যেই যুক্তিতে আপনার মনে হচ্ছে।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক হ্যান্ডসাম ছেলে, যে কি না কোচিং সেন্টারেও পড়ায়। তার গফ নেই মানা যায়? নিব্বিদেরর কনফেস ই তো থাকার কথা শ’খানেক।।

যদি বলি কেউ নেই বিশ্বাস করবেন?

অবাক হবো। তবে অবিশ্বাস করবো না।

তাই না?

হুম।

তবে আমি জানি আপনার কেউ নেই।

কে বলেছে নেই?

বলতে হবে কেন?আমি জানি।

এতো কনফিডেন্টলি বলছেন কিভাবে? আমিতো এই বিষয়ে আগে কিছু বলিনি।

ইরহাম মাথা চুলকে বলল, আপনার সঙ্গে আমি দুইটা জার্নি করেছি। এটা কি এনাফ না জানার জন্য আপনি পিওর সিঙ্গেল? জার্নির সময় আর যাই হোক কোনো ছেলে এতোটা কেয়ারলেস হবেনা যে তার গফকে ফোন করে আপডেট নিবে না। আপনার পরিবার ব্যতিত কাউকেই কল করতে দেখিনি এই সময়টায়।

আপনি দারুণ পর্যবেক্ষক তো! দেখে তো বোঝা যায় না এতো কিছু নোটিস করেন?

বুঝে ফেললে কেউ আর নোটিস করার স্কোপ রাখবে?

তাও ঠিক!

কি করছেন?

ছাদে বসে আছি। আপনি?

মাঠে আছি।

আচ্ছা রাখছি, পরে কথা হবে।

ঠিকাছে, সাবধানে থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।

আল্লাহ হাফেজ।

ফোন‌ রেখে তৃণা তাদের বাড়ির পাশের মাঠটার দিকে তাকিয়ে। ইশ যদি ইরহাম এই মাঠটায় থাকতো মন্দ হতো না!

চলবে,,,