সে আমার শরৎফুল পর্ব-৮+৯

0
114

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৮

#আরশিয়া_জান্নাত

ঘুম থেকে উঠার পর চারদিকের শোরগোল দেখে তৃণা বেশ অবাক হলো। আশেপাশের কিছু মহিলা এসেছেন। তৃণাদের বাসায় কোনো অনুষ্ঠান হলে উনারা এসে সাহায্য করেন। কেউ মশলা বাটেন, কেউ ঘরদোর পরিষ্কার করেন, কেউ রান্নার যোগাড়যন্ত্র করেন। মোট কথা হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে এনারা যোগ দেন তার মায়ের সাথে। তৃণার জানামতে আজ কোনো অনুষ্ঠান নয়। তবে কিসের এতো আয়োজন? হাতমুখ ধুয়ে বিছানা গুছিয়ে কম্বলের নীচ থেকে শালটা বের করে গাঁয়ে পেচালো। কম্বলের ভিতর শাল বা সোয়েটার রাখার সুবিধা হলো এতে এসব গরম থাকে। পড়তে অসুবিধা হয় না। তৃণা রুম থেকে বের হয়ে সোজা মায়ের কাছে গেল। তাহমিনা বেগম চুলোয় গরুর গোশত বসিয়ে অপর চুলায় পোলাওয়ের চাল ভাজছেন। তৃণাকে দেখে বললেন, হটপটে পরোটা আর ডিম আছে, ফ্লাক্সে চা আছে। গরম পানি এখান থেকে নিয়ে যা। চটজলদি নাস্তা খেয়ে নে।

মা বাসায় কেউ আসবে?

হ্যাঁ তোর রফিক আঙ্কেল আসবে তার কিছু আত্মীয় নিয়ে।

হঠাৎ আত্মীয় নিয়ে!

হুম। কেন আসতে পারেনা? কেমন বোকা বোকা প্রশ্ন তোর!

তৃণা সন্দিহান দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। পরে কি ভেবে ডাইনিং এ গিয়ে নাস্তা করতে বসলো। ফোনটা বের করে বড় ভাই ওয়াসিকে নক করলো, দাদাভাই বাসায় কি হচ্ছে জানিস কিছু?

ওয়াসি লাইনেই ছিল। সাথে সাথে রিপ্লাই করলো, স্টেশন আছি, সরাসরি এসে বলি?

এবার আরেক দফায় চমকালো তৃণা। ওর দাদাভাই পর্যন্ত আসছে। তবে কি তৃণার সন্দেহ ঠিক? ওকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসছে? কিন্তু এরকম তো হবেনা। ওকে অন্তত জানাবে নিশ্চয়ই। নাকি রূপার সাথে থেকে থেকে তার মাইন্ড ডিটেক্টিভ হয়ে গেছে। রূপাকে দেখতে এলে যা হতো তার সাথে ম্যাচ করে মাইন্ড এই সিগন্যাল দিচ্ছে!

নাস্তা খেয়ে তামজিদের রুমে উঁকি দিতে দেখে তামজিদ নেই। জানুয়ারিতেও আজকাল স্কুলে ক্লাস থাকে। অথচ তৃণা ক্লাস করতো ফেব্রুয়ারিতে। এর আগে ভর্তিটা কোনোরকম হলেও বই পেতে পেতে ফেব্রুয়ারি হতো। এখন ১লা জানুয়ারিতেই বই উৎসব পালিত হয় নতুন বই দিয়ে। যাক গে ঐসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই আপাতত সে রুমে গিয়ে কম্বল মুড়িয়ে বই পড়বে। এতো ঠান্ডা ইয়া আল্লাহ!

তৃণা এই তৃণা দরজা খোল।

খোলাই আছে, আসো।

তাহমিনা রুমে ঢুকে বলল গরম পানি করে এনেছি গোসল করে নে।

অসম্ভব আম্মু। এই ঠান্ডায় আমি গোসল করে শহীদ হবো নাকি!

গরম পানি এনেছি তো। শীত লাগবেনা।

গরম পানি দিয়ে গোসল করলে শীত আরো বেশি লাগে। আমি আজকে গোসল করবোনা।

একদম নাটক করবিনা। ২দিন ধরে গোসল করিস না। আজকে গরম পানি করে দিয়েছি তাও করবি না! খেচ্চর মেয়ে একটা। উঠ বলছি।

মা আমি সারাদিন বাসায় থাকি, ধূলোময়লায় যাই না। আর ফ্রিজে থাকা মানুষের শরীরে ঘাম হয়না। খেচ্চর বলো কেন? শুকে দেখো এখনো ফ্রেশ। কেউ বুঝবেই না ২দিন গোসল করিনি। তুমি অযথাই আমাকে খেচ্চর বলছো।

আমি অতো কথা শুনতে চাই না। চুলে শ্যাম্পু করে গোসল করে নে।

ইয়া আল্লাহ এই নির্দয় মহিলা আজ আমায় জানে মেরে ফেলবে। শ্যাম্পু করলে আমি নির্ঘাত জ্যাক হয়ে যাবো মা। তুমি কেন এই জুলুম করছো?

তৃণা! যা বলছি চুপচাপ কর নয়তো মার খাবি।

আমি ২৩+ তরুণী, আমাকে তুমি মারবে জাস্ট বিকজ অফ গোসলে না করছি বলে! নিউজপেপার থেকে শুরু করে ফেসবুকে তোলপাড় করা হেডলাইন হবে। মায়ের হাতে মেয়ে খুন,,,,

পাশে থাকা ফুলির মা হেহে করে হেসে ফেললেন। তাহমিনা বকা দিয়ে বললেন, ফুলির মা পানিটা বাথরুমে রেখে যাও। আজ এই মেয়ের একদিন কি আমার একদিন।

আম্মাজান আজকে তো এমনিও একদিনই! এখন সেটা তোমার হোক বা আমার।

আমি এতো কথা শুনতে চাই না। বাসায় মেহমান আসবে, আর তুই দূর্গন্ধ ছড়িয়ে বেড়াবি তা তো হবেনা। গোসল কর।

আম্মু আমি বুঝি না তুমি আমার গোসলের পেছনে পড়লে কেন? প্রয়োজন হলে জামা চেইঞ্জ করে পারফিউম মেরে যাবো তোমার মেহমানদের সামনে। তাও গোসল করবো না।প্লিজ আম্মা বহুত ঠান্ডা। আমি সত্যিই মরে যাবো।

আচ্ছা আমার কথা শুনবি না তাই তো? আমি এখন গিয়ে সবাইকে বলছি তুই ২সপ্তাহ গোসল করছিস না। প্রয়োজনে লাইভে যাবো। তোর সব বন্ধুরা দেখবে। তখন দেখিস কি হয়।

তৃণা ভ্রু কুঁচকে বলল, ২দিনকে ২সপ্তাহ বানিয়ে দিলে! কপটতা করা অন্যায় আম্মা।

কেউ তো যাচাই করতে আসবে না দিন কত। মা যখন বলছে এটাই সত্যি।দাঁড়া রূপাকে কল করি। বাকি অর্ধেক মাইকিং ওয় করে দিবে।

আচ্ছা আচ্ছা বাদ দাও আমি যাচ্ছি গোসলে। তবুও ঐ ফকিন্নিরে বইলো না। তুমি মা হয়ে ২সপ্তাহ বানাইছো ও ২মাস বানাতে দেরি করবেনা।

তাহমিনা ডেভিলমার্কা হাসি দিয়ে চলে গেলেন। তৃণা কাঁদো কাঁদো মুখ করে শ্যাম্পুর বোতল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো, আল্লাহ এই যাত্রায় বাঁচাই দিও।

ও আল্লাগো ও আম্মাগো এতো ঠান্ডা আমি মইরা গেলাম গো,,,,

রুমি স্কুল শেষে বাসায় ফিরতেই রুমানা বললেন, রুমি জামা পাল্টে এদিকে আয়।

মায়ের থমথমে মুখ রুমির ভীষণ ভয় লাগে। এমনিতেই সে ছোট থেকেই মা-কে ভয় পায়। তার উপর এখন তার মা আরো বেশি গম্ভীর হয়ে গেছেন। তাই মায়ের প্রতি তার ভয়টা আরো বেশি বেড়েছে। রুমি স্কুলের পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে মায়ের কাছে গেল। তাহমিনা কিছু খাবার সামনে দিয়ে বললেন, এগুলো খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। তারপর রান্নায় বসবো। তুই রান্না করবি।

কিন্তু মা আমি রান্না করতে পারি না।

পারিস না তো কি হয়েছে? শিখবি। তারপর পারবি।

হঠাৎ রান্না শিখতে হচ্ছে কেন!

তাহমিনা শীতল দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। রুমি ভয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো। তাহমিনা আপন মনে বলতে লাগলো, তোর বাবা হুট করে চলে গেছেন, আমরা কেউ আশা করি নি। জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যু হবেই। এই সহজ সত্যিটা আমরা ভুলে বসে থাকি। এমনভাবে জীবনযাপন করি যেন আমাদের হাতে অফুরন্ত সময় আছে। আমি যে বহুবছর বাঁচবো তার নিশ্চয়তা নেই। আমি চাই আমিও এমন হুট করে মরলেও যেন অন্তত তুই রান্না করে খেতে পারিস। আমাদের কেউ নেই এটা তো দেখেছিস এবার! তোর বোন‌ নিজের সংসার ফেলে নিশ্চয়ই তোদের জন্য রান্না করতে রোজ আসবে না! তাই আমি থাকতে থাকতে সব শিখে নে। এতে লাভ ব্যতিত ক্ষতি হবে না।

রুমি কোনো কথা বললো না চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে অবিরাম ধারায়। ওর মা এতো নিষ্ঠুর কথা এমন শান্ত গলায় কিভাবে বলছে? বাবাকে হারিয়ে মনটা এমনিই ছোট হয়ে আছে। তার উপর মাকে হারানোর কথা কল্পনা করাও অসম্ভব। এই পৃথিবীতে তাদের আর কে আছে? যাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছে, যাদের কেন্দ্র করে তারা ৩ ভাইবোন বেড়ে উঠেছে, তাদের থেকে কেন্দ্রচ্যুত হয়ে টিকে থাকা কি এতো সহজ? অন্তত রুমির কাছে তো এটা অনেক কঠিন। কান্নার তীব্রতায় রুমির শরীর কেঁপে উঠে তবুও একটুও শব্দ বের হয় না। তাহমিনা সেটা দেখেও না দেখার মতো করেই রইলেন। কুটে রাখা তরকারি রান্নাঘরে নিয়ে চুলা জ্বালালেন, রুমিকে বললেন, উঠে এসো। দেখো কিভাবে করি আমি।

রুমি চোখ মুছে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তেলে পেঁয়াজ দিয়ে তার মা রান্না করতে শুরু করলো। রুমিও চুপচাপ তা দেখতে লাগলো।

তৃণা বেডের উপর শাড়ি গয়না দেখে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল আজ তাকে দেখতে আসছে। তার বান্ধবী রুবিনা, সাথী এসে বলল, চাচীআম্মা আমাদের পাঠালেন তোকে তৈরি করে দিতে। উঠ শাড়ি পড়বি।

ঘটনা কি বলতো ছেলেপক্ষ আসছে নাকি আমাকে দেখতে?

তুই জানিস না?

নাহ! আমাকে তো কিছু বলেনি।

পাড়ার সবাই জানে তুইই জানিস না! অবাক কান্ড।

সাথী বলল, জানবে কিভাবে সারাক্ষণ তো ভাল্লুকের মতো দরজা জানালা বন্ধ করে কম্বোলের নীচে পড়ে থাকিস।

তৃণা তেঁতে বলল, ভাল্লুককে যেন তুই কম্বোল সাপ্লাই করিস! আমাকে তুই ভাল্লুক বললি কিভাবে!

রুবিনা বলল, তোরা থামবি! তৃণা উঠ তাড়াতাড়ি। রেডি করাতে সময় লাগবে তো।

ঢং করবি না। আমি এরকম মানবো না। আমাকে না জানিয়ে ছেলেপক্ষকে আসতে বলা। আজ আমি লঙ্কাতান্ডব বাঁধাবো। আমি কি কচি খুকি নাকি? আমাকে না বলে এতোকিছু ঘটানো। একটু পর না বলে বসে আজই আমার বিয়ে! নাহ নাহ আমি ভুলেও তাদের সামনে যাবো না।

সাথী ফিসফিস করে বলল, তৃণা তোর পছন্দের কেউ আছে? এমন রেগে যাচ্ছিস কেন? বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে করবি না! আজ বিয়ে হলেও কি? ছেলে ডাক্তার, ভালো বংশের। দেখতেও ভালো। অমত করার কি আছে?

তৃণা যেন ধাক্কা খেল ভীষণ। আসলেই কি অমত করার কিছু নেই? ও কি কাউকে পছন্দ করে! এমন তো নয় ওর প্রেমিক আছে। তবুও মন কেন অস্থির লাগছে? কেন মনে হচ্ছে এটা ঠিক না। সে বিয়ে করতে পারবে না এখন। কিছুতেই না।
কার জন্য এমন মনে হচ্ছে? অন্য ৫টা মেয়ের মতো সে কেন মেনে নিতে পারছেনা পাত্রপক্ষ দেখতে আসা স্বাভাবিক!

কলের পুতুলের মতো শাড়ি পড়ে সেজেগুজে তৈরি হলো পাত্রপক্ষের জন্য। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিরব বিতর্ক চলছে মন আর মস্তিষ্কের মাঝে। সেখানে একটা আবছা অবয়ব, যার নাম অস্পষ্ট নয়, চেহারা অপরিষ্কার নয়। তবে তার নাম নেওয়ার পূর্ণ অধিকার কি আছে? নির্ভরযোগ্য অস্তিত্ব আছে? নেই। এই অস্পষ্ট অনুভূতির উপর ভিত্তি করে তৃণা তার আপনজনদের কষ্ট দিতে পারবে না। তাই ব্যর্থ হয়ে তৃণা তার বাবা-মায়ের ইচ্ছেমতোন এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলো।

চলবে,,,

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৯

#আরশিয়া_জান্নাত

দুপুরের শেষ প্রান্তে রফিক সাহেব তার আত্মীয় তথা পাত্রপক্ষ নিয়ে হাজির হলেন। দু’হাত বোঝাই করে ফল মিষ্টি নিয়ে ১৫/২০ জন উপস্থিত হলেন। সবাইকে বসার ঘরে বসতে দিয়ে তৃণার বাবা ওয়াজেদ আলমগীর বললেন, ভাইসাহেব আপনারা দুপুরের খাবার টা আগে সেরে নিন?

রফিক সাহেব বললেন, দুপুরের আয়োজন করতে গেলে কেন? আমরা খেয়েদেয়েই এসেছি।
দিনে দিনে চলে যাবে বলেই আগে এসেছি।

নাহ নাহ ওসব শুনবো না, দু’কদম হাঁটলেই সব হজম হয়ে যায়।

পাত্রের মা বললেন, ভাইজান অস্থির হবেন না। আমরা সত্যিই খাওয়া দাওয়া করেই এসেছি। এখন ভদ্রতার খাতিরে খেতে বসলে অপচয় ব্যতিত কিছুই হবেনা।

সবার কথায় অবশেষে তিনি সেটা রহিত করলেন। শরবত আর বাহারী নাস্তায় তাদের আপ্যায়নে মন দিলেন। তখন অবদি ছেলে আসেনি। বড়োরাই একে অপরের সাথে মত বিনিময়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিশোরী বয়সী মেয়েরা ইতোমধ্যেই অন্য ঘরগুলোয় আনাগোনা শুরু করে দিয়েছে।ছোটরা ছোটাছুটি করছে। এই হৈ হৈ রবের মাঝে একমাত্র তৃণার রুমটাই নিরব হয়ে আছে। তৃণা তৈরি হয়ে চুপ করে বসে আছে। সাথী আর রুবিনা তার মাকে সাহায্য করতে চলে গেছে। তৃণাও সুযোগে দরজা আটকে বসেছে। তৃণার ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে হলে ফিরতে। কিন্তু ভার্সিটি খুলতে আরো দিন দশেক বাকি। তবুও সমস্যা হতো না, তানজিনার বাসায় উঠা যেত। তৃণাদের ওখানে একটা অলিখিত নিয়ম আছে। সেখানে বেশিরভাগ সময় দেখতে এসেই আকদ হয়ে যায়। আর তৃণা মনের কোথাও না কোথাও এই ভয়টাই পাচ্ছে। ও এখনি বিয়ে করতে চায় না। তবে না চাওয়ার সলিড কারণ ও দেখাতে পারছেনা।পড়াশোনার অজুহাত দেওয়া যাবেনা। সাথীদের থেকে যতটুকু শুনেছে ছেলেপক্ষ বিয়ের পরো পড়াবে বলেছে। ডাক্তার পাত্র পেয়ে তার বাবা মায়ের যেযন আপত্তি থাকবেনা, রফিক আঙ্কেলের বন্ধুর মেয়ে হওয়ায় তাকেও রিজেক্ট করার প্রশ্ন আসেনা। রফিক আঙ্কেল তৃণার বাবার ভীষণ কাছের মানুষ। তিনি যখন এই সমন্ধ এনেছেন বলা যায় ৮০% পজিটিভ। তৃণা হিসেব নিকেশ কষে আরো বেশি হতাশ হয়ে পড়ছে। ওর বারবার মনে হচ্ছে কোনো একটা মিরাক্যাল ঘটুক এই বিয়েটা না হোক।

হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়লো। তৃণার মা বললেন, তৃণা দরজা খোল।

তৃণা দরজা খুলতেই হুরহুর করে কয়েকজন মহিলা তার রুমে ঢুকে পড়লো। এতে সে ভীষণ বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না।
একজন বলল, বাহ ছবিতে যেমন দেখেছি মেয়ে তো দেখতে এর চেয়ে বেশি সুন্দর। আমাদের মৃদুলের সাথে বেশ মানাবে কি বলো ভাবি?

একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে তৃণার চিবুক তুলে বেশ মন দিয়ে তাকিয়ে বললেন, মাশাআল্লাহ!

একেকজন একেক প্রশ্ন শেষে চলে যেতেই ভদ্রমহিলা তৃণার পাশে বসলেন। ধীর অথচ স্পষ্ট গলায় বললেন, আমার ছেলে ভীষণ অগোছালো ধরণের। পড়াশোনার বাইরে কোনো বিশেষ গুণ নেই। নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখতে পারেনা। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে খাওয়া ঘুমের রুটিনের বারোটা বাজিয়েছে। এই এতো এতো বদ গুণের মাঝে ওর ১টাই ভালো গুণ আছে। সেটা হলো ও মানুষকে অনেক বেশি ভালোবাসে। মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আমি পাত্রের মা হিসেবে এমন একটা মেয়ে চাই যে আমার এই আলভোলা ছেলেটার দায়িত্ব নিবে, যত্নে গুছিয়ে নিবে। আমার সংসারে আর কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। আমার মেয়ে নেই, আমি ঘরে মেয়ে নিতে চাই।

তৃণা চুপচাপ শুনলো কিছু বললো না। তিনি রুম থেকে বের হবার আগে তৃণার হাতে জোর করে খাম ধরিয়ে বললেন, তোমাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।আল্লাহ ভাগ্যে রাখলে তোমাকেই আমি মেয়ে করতে চাই।

বেশ খানিক পরে তৃণার ডাক পড়লো। কাঁপা হাতে ট্রে নিয়ে ড্রইং রুম অবদি যাওয়া তার কাছে এভারেস্ট চড়ার চেয়ে কঠিন বোধ হলো। ওয়াসি হেসে বললো, কিরে পেত্নি এইরকম মৃগি রুগীর মতো ওনাদের সামনে যাবি নাকি! স্ট্রং হয়ে যা।
তৃণা চোখ গরম করে ভাইয়ের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল, দাদাভাই এর শোধ আমি তুলবো দেখো!

সবাইকে সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই সবার চোখ তৃণার দিকেই নিবদ্ধ হলো। তৃণার বাবা উঠে এসে মেয়েকে বললেন, ট্রে টা টেবিলে রাখতে। রফিক সাহেব বললেন, তৃণা মামণি এদিকে এসে বসো। তৃণা এগিয়ে গিয়ে সোফার এককোণে বসলো। এতোজনের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় নার্ভাসনেসে এই শীতেও তার হাতের তালু ঘেমে উঠলো। বেচারি ঠাওর করতে পারলো না মৃদুল নামক পুরুষ কোনটা!

হঠাৎ একজন বলে উঠলো, আমরা বড়রা তো দেখলাম, এখন ওদের আলাদা কথা বলতে দিলে ভালো হয়। কি বলেন?

হ্যাঁ অবশ্যই। তৃণা মা তুই বরং মৃদুলকে নিয়ে ছাদে যা। আলাপচারিতা সেরে নে। রুবিনা, ওদের নিয়ে যাও তো।

তৃণার পিছুপিছু মৃদুল উঠে এলো। তৃণা ছাদের কার্ণিশ ঘেষে দাঁড়ালো। মাঠটার দিকে চেয়ে বুকটা কেমন ভার হয়ে উঠলো। এই মাঠের সাথে ইরহামের কোনো যোগসূত্র নেই, তবুও মাঠ দেখলেই আজকাল তার কথা মনে পড়ে।তৃণা টের পায় তীব্রভাবেই টের পায় ইরহাম তার মনের একটা নির্দিষ্ট জায়গা দখল করে রেখেছে। তবে সেটা পাকাপোক্ত হয়েছে কি না জানেনা। কারো গলার শব্দে চৈতন্য ফেরে তার। পাশে তাকিয়ে দেখে মাঝারি গড়নের একজন পুরুষ। গোলগাল চেহারা, লালচে ফর্সা গায়ের রং। চুলগুলো ছোট করেই কাটা, চোখেমুখে ক্লান্তির রেশ। যেন সবেই ওটি সেরে এসেছে।

আপনার সম্পর্কে এই কয়েকদিন অনেক কিছু শুনেছি। ভেবেছি সবাই বাড়িয়ে বলছে।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবাই কমই বলেছে। আপনি আসলেই হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের নায়িকার মতো অনিন্দ্য সুন্দরী।

আপনি উপন্যাস ও পড়েন নাকি!

স্কুল লাইফে উনার উপন্যাসের ভুত চেপেছিল। ঐ সময়েই উনার ৩০+ বই পড়েছি।

ওহ!

আপনার প্রিয় লেখক/কবি কে?

শরৎচন্দ্র।

বাবাহ! কঠিন সাহিত্য পড়েন দেখি! আমি আবার বাংলা ব্যাকরণ কম বুঝি।

হুম বুঝলাম।

মিস তৃণা আপনি কথা কম বলেন নাকি এখন বলছেন না! আমার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন কি নেই?

একটা প্রশ্ন করি জবাব দিন দেখি।

কি প্রশ্ন বলুন?

আপনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বা আপনার পেশা বাদ দিয়ে এমন একটা কারণ দেখান যেটা দেখে আপনাকে বিয়ে করতে চাইবো। অর্থাৎ আমি আপনাকে কেন বিয়ে করবো? ব্যাখ্যা করুন

মৃদুল কিছুক্ষণ নিরব রইলো। তারপর বললো,
আসলে এই প্রশ্নের উত্তরটা গুছিয়ে ভাবতে পারছি না। তবে এইটুকু বলতে পারি আমি একজন সাপোর্টিভ মানুষ। অপরকে উৎসাহিত করা, মেন্টালি সাপোর্ট করার প্রবণতা আমার আছে। আমি আমার লাইফ পার্টনারের প্রতি লয়্যাল হবো।

ওহ ভালো!

মিস তৃণা আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি এই আলাপে আগ্রহী নন। আপনার কি পছন্দের কেউ আছে কিংবা অন্য কোনো ইস্যু! আপনি চাইলে আমাকে বলতে পারেন।

তৃণা হেসে বললো, কৃষ্ণপক্ষ বইটা পড়েছেন ডক্টর সাহেব?

মৃদুল চমকালো ভীষণ। দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললো, আমি কি এই বিয়ে ভেঙে দিবো তৃণা? আমার পরিবারের সবাই একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে। আমি সেটা বন্ধ করে দিবো?

আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আপনি কি আমাকে সময় দিতে পারবেন? এখনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না।

আচ্ছা ঠিকাছে। আপনি সময় নিন।

ধন্যবাদ।

মৃদুল মুচকি হেসে নীচে চলে গেল। তৃণা ঝাপসা চোখে আকাশে চাইলো।

ভাইয়া আসবো?

আয়।

কি করছিস?

এমনিই বসে আছি, কি বলবি বল।

ভাইয়া আমি কোচিং এ পড়বো না। অন্য একটা কোচিং ঠিক করে দে।

কেন কি হয়েছে?

রুমি ফ্লোরে পায়ের আঙুল‌ দিয়ে নখ খোঁচাতে লাগলো। ইরহাম বোনের দিকে চেয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। তারপর শান্তস্বরে বলল, ওখানে তোকে কেউ বিরক্ত করে?

নাহ, বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে তো, তাছাড়া রোজ এতোখানি পথ একা যেতে ভালো লাগেনা। আগে তো বাবা ছিল উনি দিয়ে আসতেন, ওখানে বসে চা খেতেন। একসঙ্গে ফিরতাম।

রুমি, আমাদের সবাইকে নিজের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। এই সামান্য দূরত্বেই যদি এমন ভাবনা রাখিস, সামনে কলেজ/ভার্সিটি যাবি কিভাবে?

অতোদূর মা পড়তেও দিবেনা। দেখবে মেট্রিক দিতেই বিয়ের জন্য তোড়জোড় করবে।

বলেছে নাকি?

নাহ, তবে ভাবভঙ্গি সেটাই বলে।

আসলে বাবার শোকে এমন হয়ে গেছে। এমনিতেই মা গম্ভীর স্বভাবের। বাবাকে হারিয়ে সেটা আরো বেড়েছে। তুই ওসব ভাবিস না। ভাইয়া তোকে পড়াবো। তোর যতদিন মন চায় পড়বি।

রুমি চলে যেতেই ইরহাম তার পাড়ার বন্ধুদের কল দিলো। কোচিং এর আশেপাশে খবর নিতে বলে চেয়ারে হেলান দিলো। পৃথিবীটা শেয়াল নেকড়েতে ভরে গেছে। এখানে টিকে থাকা খুব কঠিন!

চলবে,,,