স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব-০৯

0
365

#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯

আজ অনেকদিন পর রিফাত তার বাবার দেওয়া সেই কাজটা শেষ করতে পেরেছে। বিয়ের আগের সময় হলে কাজটা অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত কিন্তু এখন প্রীতির চিন্তায় কাজটা এতো দেরিতে শেষ হলো। প্রায় পনেরো দিন পর সে তার বাসায় ফিরে যাচ্ছে। মূলত বাসায় ফেরার চাইতে প্রীতিকে অনেকদিন পর দেখবে বলে বেশি খুশি লাগছে। সে জানে না এখনো ওই বাসায় সবার কী অবস্থা। ঢাকা যাওয়ার জন্য রাতে বাসটাতে উঠার ফলে সকালেই ঢাকা পৌঁছে যেতে পেরেছে।
রিফাত বাস থেকে নেমে চারদিকে একবার চোখ বুলালো। না, তাদের বাসার কাওকে দেখা যাচ্ছে না, কেউ নিতে আসেনি রিফাতকে । আজ রিফাত বাসায় ফিরবে এটা সে বাবাকে খবর দিয়েছিলো কিন্তু বাবা আসেনি। রিফাতের একটু মন খারাপ হলো। আগে রিফাত বাসা থেকে দুইদিন কোথাও বাইরে থাকলে বাবা-মা পাগলামি শুরু করে দিতো, কাজের জন্য ঢাকার বাইরে গেলে দুইদিনের দিন ফিরে আসতে হতো বাবা-মায়ের পাগলামির জন্য, বাবা স্টেশনে এসে রিফাতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত, রিফাত বাস থেকে নামতেই এসে জড়িয়ে ধরতো। অথচ আজ! এতদিন পরে আসছে তাও কেউ নিতে আসলো না। রিফাত বুঝলো বাবা-মায়ের মনে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে হয়ত। কিন্তু নিমিষেই প্রীতির কথা ভাবতে গিয়ে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে বাবা-মা’য়ের সামনে মুনের থেকে ক্ষমা চাইবে রিফাত। অন্তত মুন কোনোদিন ক্ষমা না করে পারবে না। মেয়েটির সাথে একটু বেশিই অন্যায় হয়ে গিয়েছে, মুন ক্ষমা করে দিলে বাবা-মা’ও রিফাতের কাছ থেকে আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না, এতে রিফাত নিশ্চিত। সে আর কিছু না ভেবে বাস থেকে নেমে পড়ল। এরপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

—————–
সকালে মুন চোখ খোলার আগেই পানির গর্জন কানে এল। মুন আর শুয়ে থাকতে পারলো না। চিলেকোঠার মই বেয়ে নিচে নেমে এলো। দরজার বাইরে প্রচন্ড আওয়াজ। ছোট্ট রান্না-ঘরটাতে মধ্যবয়স্ক চাচাটি কিছু বানাতে ব্যস্ত। মুন কৌতূহল-বশত বাইরে এতো আওয়াজের কারণ জিজ্ঞেস করতে চাচার পাশে এগিয়ে গেল।

-‘চাচা, কীসের আওয়াজ এটা?’

-‘মনে হচ্ছে খালের পানি,’ বলে চাচা রান্নাঘরের ছোট্ট কাঁচের জানালাটা খুলতেই কয়েকগুন বেড়ে গেল ভীতিকর শব্দটা।

-‘এ যে প্রচুর বৃষ্টি!’ চাচা জানালাটি খুলে মুনের উদ্দেশ্যে আবারো বলে উঠল।

জানালা খোলার সাথে সাথে বৃষ্টির আওয়াজ তীব্র হলো। মুন আওয়াজের জন্য কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দেখল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার অনেক। মেঘে পুরো দিনের আলোটা আড়াল করে রেখেছে।

-‘চাচা, এতো বৃষ্টির মধ্যে খালের পানি উঠে যাবে না তো?’ বৃষ্টির জোর দেখে মুন চাচার উদ্দেশ্যে বলল।

চাচা কফির পানি চুলার দিকে এগিয়ে নিতে নিতে বলল,’চিন্তা নেই। খালের পানি এতো উপরে উঠবে না ; উপরের নিচের মতো জায়গাটা ছাপিয়ে নিচে নেমে যাবে পানিগুলো।’ বলতে বলতে জানালাটি বন্ধ করে দিলো।
জানালা বন্ধ করার সাথে সাথে আওয়াজটার তীব্রতা কমে গেল।
মুনের হঠাৎ দেশের ইচ্ছেটা তীব্রভাবে জেগে উঠল। এমন একটা স্বপ্নের মতো জায়গায় তার এই ইচ্ছেটা পূরণ করতে না পারলে তার আফসোস থেকে যাবে। সে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে এক দৌড়ে সামনে এগিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাইরে। বরফ-শীতল বৃষ্টির পানি মুনের সারা গা মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল। কিন্তু মুন সেদিকে পরোয়া না করে আরও দু’পা এগিয়ে ক্রিকের দিকে তাকালো। ক্রিকের পানি মুনের ঠিক পায়ের কাছে উঠে এসেছে, প্রচন্ড গর্জন ছেড়ে সামনের দিকে স্রোত-আকারে ছুটছে পানিগুলো, পাক খাচ্ছে। সেই আপন মনে বক বক করা ক্রিকের পানির এমন রুদ্ধ-মূর্তি কল্পনাইও আনতে পারেনি মুন।
মুন দু’হাত মেলে চারদিকে ঘুরতে লাগল। আজকে ডাক দেওয়ার মতো কেউ নেই, এতদিন মায়ের জন্য দেশে এমন ইচ্ছেটা ভালোভাবে পূর্ণ করতে পারেনি আর আজ! এমন সুন্দর একটা দিন তার জীবনে আসবে তা সে কল্পনায়ও আনেনি।

সামনের ঘরের কাঁচের জানালাটির ধারে বসে আদ্রিন প্রকৃতির এই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যটি পেইন্টিং করছিলো। হঠাৎ এরই মাঝে কোনো এক সাদা পরীর দু’হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গেল। সে তার পেইন্টিং’য়ে প্রকৃতির দৃশ্যর মাঝে পরীটিকেও স্থান দিল। অনেক্ষন যাবৎ জানালা দিয়ে সে সেদিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে রইল। এরপর কিছু বুঝে উঠতেই সে পেইন্টিং শেষ করে সেটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে চাচাকে ডাক দিল। চাচা আসতেই আদ্রিন মুনকে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলার আদেশ দিল। চাচা গিয়ে মুনকে ডাকতেই মুন কী বলল সেটা আদ্রিন বুঝতে পারেনি ঘর থেকে কিন্তু চাচার হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে ফিরে আসতে দেখে আদ্রিনের মাথায় রাগ চড়ে বসল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে মুনের পাশে দাঁড়ালো। আদ্রিনের কোনো কালেই বৃষ্টি পছন্দ ছিল না, সে বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ করে না কিন্তু তাই বলে অন্যের পছন্দের জিনিসে আদ্রিন বারণ করবে – সেটা কোনোদিন করেনি। কিন্তু আজ এই মেয়ের এতো বেশি বৃষ্টিতে ভেজা আদ্রিনের সীমা লঙ্গনের মতো লাগছে। হয়ত এই মেয়ে নিজের বাসায় মা-বাবার জন্য শখটা পূরণ করতে পারেনি বলে এখানে পূরণ করছে। আদ্রিনের মাথা ব্যথা বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে নয় ; মেয়েটির শখটা অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে যা আদ্রিনের জন্য বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুন চোখ বন্ধ করেই বৃষ্টি উপভোগ করছিলো যার ফলে পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে সেটা সে খেয়াল করতে পারেনি।
-‘এই মেয়ে! ঘরে যাও।’ আদ্রিন ইংরেজিতেই বলে উঠল।

হঠাৎ কারো গম্ভীর কণ্ঠস্বরে মুনের পিলে চমকে উঠল। সে এতক্ষন নিজেকে অনেক স্বাধীন মনে করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কল্পনার রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিল কিন্তু মাঝখানে এই ইংরেজ ব্যাটা এসে তার শখের মধ্যে পানি ঢেলে দিবে তা তার ভাবনার বাইরে ছিল।
মুন চোখ খুলে আদ্রিনের দিকে এক ফলক তাকিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই ইংরেজ ব্যাটার জন্য তার এতো সুন্দর কল্পনাতে ব্যাঘাট ঘটছে তাই সে আদ্রিনের প্রশ্নে কোনো জবাব না দিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে আগের মতো প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করল।
মুনের এমন গা-ছাড়া ভাব দেখে আদ্রিন রেগে মুনের হাত শক্ত করে ধরে এক টানে ঘরের ভেতর নিয়ে এল।

মুন চোখ লাল করে আদ্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। আদ্রিন না দেখার ভান করে মুনকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ব্যাগ গুছাতে মনোনিবেশ করল।

এতক্ষনে বৃষ্টির ঘনত্ব কমে এসেছে। আদ্রিন পুরোপুরি ব্যাগ গুছিয়ে চাচাকে ডেকে সে চলে যাওয়ার কথা বলল। মুন তা শুনেও যেন শুনলো না। তার কেন জানি আদ্রিনের উপর ভীষণ-ভাবে অভিমান জন্মেছে। বলা হয়, অভিমান শুধু আপনজনদেরই উপর জন্মে কিন্তু মুনের কেন জানি এই একরাতের পরিচয়ে এই মানুষটার উপর অভিমান এসেছে তা সে ভাবতে পারছে না। অথচ মানুষটার সাথে ভালোভাবে এক বাক্য কথাও এখনো বিনিময় হয়নি।

আদ্রিন ব্যাগ গুছিয়ে মুনকে পেরিয়ে বের হতে নিতেই চাচা এসে মুনের কথা জানাতেই সে আড়চোখে এক ফলক মুনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,’গাড়িতে পেছনের সিট্ পড়ে আছে, যার ইচ্ছে উঠতে পারে, চাইলে শহর পর্যন্ত যেতে পারে।’

মুন বুঝতে পারলো কথাগুলো তারই উদ্দেশ্যে ছিল। এই ইংরেজ ব্যাটা ছাড়া সে কোনোমতেই নিজের বাসায় যেতে পারবে না তা ভেবে অভিমান এক পাশে রেখে ওভাবেই ভেজা শরীরে গাড়িতে উঠে পড়ল মুন।
গাড়িতে উঠতেই আদ্রিন গাড়ি না ছেড়ে নিজের ব্যাগে কী যেন একটা খুঁজে বের করে সেটা গাড়ির পেছন সিটে বসা মুনের দিকে ছুড়ে মারলো।
মুন হাতে নিয়ে দেখতে পেলো একটা বড়ো টাওয়াল। মুন সেটা না নিয়ে ওভাবেই রেখে দিল। তার এখন ভীষণ রাগ পাচ্ছে মানুষটার উপর, মুনকে পশুর মতোই করছে সব।

-‘আমার গাড়ি ভেজালে ভুলেও নিবো না। গাড়ি থেকেই ফেলে দিবো বলে দিলাম। আমার সিট্ যাতে না ভিজে।’ আদ্রিন ড্রাইভিং সিটে বসে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল।

মুন বুঝতে পারলো এই ব্যাটা যা বলে তা অক্ষরে অক্ষর পালন করে। এমনও হতে পারে, অর্ধেক পথে গিয়ে সিট্ ভেজা দেখে মুনকে গাড়ি থেকে ফেলে চলে যাবে। তাই মুন আর না পারতে টাওয়ালটা টেনে নিতেই আদ্রিন গাড়ি ছেড়ে দিল।

গাড়ির মধ্যে কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি ওদের। শহরে আসতেই আদ্রিন গাড়িটা এক পাশে থামিয়ে মুনকে নেমে যেতে বলল। মুন গাড়ি থেকে নামতেই আদ্রিন মুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল। মুনের হঠাৎ করে ভীষণভাবে কান্না পেলো। মানুষটা এমন কেন। মুন এক আকাশ পরিমান অভিমান আর কান্না-মাখা চোখে আদ্রিনের গাড়িটা যাওয়ার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইল। দেখতে দেখতে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আর কী দেখা হবে মানুষটার সাথে!

#চলবে ইন শা আল্লাহ