স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-৩৮+৩৯

0
1830

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
|পর্ব-৩৮|

বিকট আওয়াজে পিটপিট করে চোখ খুলতেই সামনে পড়ে অতিরিক্ত আলো! যার ফলস্বরূপ ঠিকভাবে চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে পড়েছে। মাথার কার্নিশে বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তরল জাতীয় কিছু। তা যে রক্ত নিশ্চিত! ক্ষনিক সময় পর আলোর তীব্রতা কমতেই ঝাপটে চোখ খুলে সামনে ফিরে তাকাই!

চোখ যেনো পলক ফেলা বন্ধ করে দিলো। মস্তিষ্ক থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে সামনে! আয়াফ ভাইয়া?

অস্ফুটস্বরে বললাম,

-‘ আ..আয়াফ ভা..ভাইয়া আপনি?’

আয়াফ ভাইয়া হাসলো। পৈশাচিক হাসি! যেই হাসিতে লুকিয়ে আছে বহু রহস্য। আয়াফ ভাইয়ার ডান হাতে একটা রড। বুঝতে বাকি নেই সেই সময়টাতে তিনিই আমায় এই রড দিয়ে সজোরে মাথায় আঘাত করেছেন। কারণ রোডের এক কোনায় রক্ত লেগে শুকিয়ে আছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই।

আয়াফ ভাইয়া উচ্চ স্বরে বলল,

-‘ ফাইনালি দোল! ফাইনালি…! তোকে পূর্বের কড়া সিকিউরিটি থেকে বাহির করে নিয়ে এসেছি। নিয়ে এসেছি নিজের রাজ্যে! হাহ্! এবার দেখি পূর্ব কিভাবে এসে তোকে নিয়ে যায়। শালা *** একটা!

পূর্বকে গালি দেয়াতে মাথা রগচটা ভাবটা উঠে এলো। ব্যাথা নিয়েই কাট কাট কন্ঠে বলি,

-‘ কাপুরুষ কোথাকার! পারলে পূর্বের সামনে দিয়ে আমায় নিয়ে আসতি! কেনো এনেছিস এখানে? কি চাই?

আয়াফ ভাই রেগে গেলো কিছুটা। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে হাতের রড দিয়ে পায়ে সজোরে আঘাত করে। চিৎকার দিয়ে ওপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে কান্না থামানোর তুমুল চেষ্টা চালাই!
আয়াফ ভাই বলল,

-‘ একদম তুই তুই করবিনা। জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। পূর্বের কাছে থেকে থেকে সাহস বেড়েছে তাইনা? তোর সাহস মেটাবো আমি ***!

পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত ঝড়ছে! ব্যাথায় ছটফট করছে হৃদপিণ্ড। ব্যাথাটা ভেতরে আঁকড়ে ধরে শক্ত কন্ঠে বলি,

-‘ আমাকে আঘাত করার শাস্তি আপনাকে দিতে হবে। এই যে রক্তক্ষরিত করেছেন, তার প্রতেকটা ফোঁটার মূল্য দিতে হবে! পূর্ব আপনাকে তিলে তিলে শেষ করবে। আমারই ভুল! আপনাকে সেদিন মেরে ফেলতে দেয়া উচিত ছিলো! ওপ্স! তোর মতো কাপুরুষ কে ‘আপনি ‘ বলে সম্মোধন করছি কেনো?ছিহ! ‘

আয়াফ তেড়ে এসে চুলের মুঠি শক্ত করে ধরলো। তিক্ত মাখা কন্ঠে বলল,

-‘ দেখ জাষ্ট ভালোবাসি বলে তোকে এখনল বাঁচিয়ে রেখেছি। ভাবিস না যে তারজন্য তোকে ছেড়ে দিবো।এই যে, এতক্ষণ আমায় যা যা বললি! তুই তুকারি করলি না? তারজন্য তিলে তিলে কষ্ট দিবো তোকে। ‘

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেই। কেমন কটমট আওয়াজ হয়! খেয়াল হয় চুলে শক্ত করে ধরে রাখা আয়াফের হাত নরম হয়ে আসছে। আয়াফ বাজখাঁই কন্ঠে বলল,

-‘ কে রে? দরজার ওপাশে কে? এদিকে আয়!’

দরজা সটান হয়ে খুলে যায়। চোখদুটো আমার চকচক করে উঠলো। পূর্ব কি এসেছেন? আমায় বাঁচাতে? কিন্তু পরক্ষণে মনে হয় এটা কোনো ফিল্ম না। পূর্ব আমার খোঁজ এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে পাবেন?এখন তো তার মিটিং এ থাকার কথা। সকাল এখন!
বাসা থেকে বেড়িয়ে যাই ভাইয়া চলে যাওয়ার পর। কিছুদূর নির্জন এক পার্কে গিয়ে বসতেই মাথায় তীব্র গতিতে আঘাত পাই! তারপর মনে নেই। কিছু মনে নেই! চোখ খুলে আয়াফ ভাইয়াকে দেখি।

আয়াফ ভাই পিছু ঘুরলেন। সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ হলো। গুলির আওয়াজ। একসঙ্গে কয়েকটা গুলি এসে লাগে আয়াফ ভাইয়ার বুকে। তৎক্ষনাৎ মাটিতে মুখ থুবরে পড়ে যায় সে! নিশ্চিত হলাম মারা গিয়েছে। এতো গুলি বুকে গিয়ে লাগার পর বেঁচে থাকা অসম্ভব! তবে তাকে গুলি কে করলো?

দরজার দিকে দৃষ্টি দেই। তড়িৎ গতীতে রুমটায় ঢুকে কালো পোশাকধারী কয়েকজন লোক। দুই মিনিট পার হতে তাদের মাঝখান দিয়ে প্রবেশ করে অন্য একজন! কিছুটা সামনে এগিয়ে আসার পর আলোর প্রতিফলন হয় তার মুখে। ভেসে উঠলো কালো মাস্ক দিয়ে আবরীত চেহারা! চোখদুটো দেখা মাত্রই বুঝতে কষ্ট হলো না কে ইনি?
ইনি তো…..,

শুষ্ক ঠোঁটযুগল জিভ দিয়ে ভিজিয়ে পূর্ব লম্বা খানেক পা ফেলে মিটিং রুম থেকে বের হয়ে যায়। মাত্রই মিটিং শেষ হলো। মিটিং এ উপস্থিত সবাই পূর্বের সাথে কিছু কুশল বিনিময় করতে চেয়ে ছিলোন কিন্তু পূর্ব সেই সুযোগটি দেয়নি। মিথ্যা বলে কাটিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে আসে।

নিজের বিলাসবহুল, চাকচিক্যতার ছোয়া অফিস কক্ষে গিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম! চিন্তার লেশ সর্বমুখে বিরাজমান! অস্থিরতার ঢেউ তুলেছে হৃদপিণ্ড। পূর্বের এই অস্থিরতা কেনো হচ্ছে জানা নেই। সে চিন্তিত, দোলাকে নিয়ে! অজানা এক ভয় ঝেকে ধরেছে তাকে। মন বারংবার প্রশ্ন করছে, ‘তার দোলপরী ঠিক আছে তো?’

পূর্ব চট জলদি ফোন বের করে। অমনি বেশ কড়া একটা শব্দ কানে আসে তার। দরজার দিকে অস্থিরতার দৃষ্টি মেলে দেয় সে! এই আওয়াজটা হয় মূলত যখন পূর্বের কেবিনে কেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে প্রবেশ করে, নয়তো পাসওয়ার্ড! পাসওয়ার্ড, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ হয়ে গেলেই এই বিকট আওয়াজটা হয়!

পূর্ব দেখে অরণ্য আসছে। চিন্তার ছাপ তারও মুখে। অরণ্য চিন্তিত কন্ঠে বলল,

-‘ আর ইউ ওকে পূর্ব? এতোটা চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোকে? মিটিং রুম থেকেও এক প্রকার ছুটে বের হয়ে আসলি! এভ্রিথিং ইজ ওকে?’

পূর্ব হাতের ফোনটা সামনে থাকা কাঁচের টেবিলটায় রাখে। অস্থিরতা মিশ্রিত কন্ঠে সে বলল,

-‘ ডোন্ট নো! কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে আমার অগোচরে খুব বড় কিছু হয়ে গিয়েছে। ভয় লাগছে! ‘

অরন্য খানিক সন্দিহান কন্ঠে বলল,

-‘ ভয়টা কি দোলাকে নিয়ে?’

ঘাড় বাকিয়ে ‘হ্যা ‘ বলল পূর্ব!
ফোস করে শ্বাস ছাড়ে অরন্য। অতঃপর ঠোঁট বাকিয়ে বলল,

-‘ তোর তো প্রতিনিয়তই দোলাকে নিয়ে টেনশন, ভয় কাজ করে! এ আর নতুন কি?’

-‘ না অরণ্য, আজকে আমার একটু বেশিই উদ্ভট লাগছে। ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। ‘

অরণ্য পূর্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে পূর্বকে। নাহ! আজ আগের দিনগুলোর থেকে পূর্বকে একটু বেশিই অস্থির আর উদভ্রান্তকর লাগছে। অরণ্য বলল,

-‘ ফোন দে দোলাকে! ‘

পূর্ব চটপট ফোন হাতে নেয়। দোলার নাম্বারে কল করতে নিতেই ফোন স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সায়ানের নামটি! সায়ান কল করেছে। বুকে ধ্বক ধ্বক আওয়াজ টা পূর্বের যেনো বেড়ে যায়।
ফোন রিসিভ করতেই অপাশ থেকে কারো কাঁদো কন্ঠ কানে আসে পূর্বের। সায়ান বলল,

-‘ পূর্ব, পূর্ব আমার বোন, দোলকে কেও কিডন্যাপ করেছে পূর্ব! ওকে আমার কাছে এনে দে ভাই। ‘

বলতে বলতেই হু হু করে কেঁদে দেয় সায়ান। পূর্বের হাত থেকে ফোন পড়ে যায় মাটিতে। স্থির রূপে পাথরতা অবলম্বন করেছে সে! অরণ্য হতভম্ব। দৌড়ে এসে পূর্বের পাশে দাঁড়ায়! অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ পূর্ব কি হয়েছে? ফোন দিলো কে?কি বলেছে?’

পূর্ব থমথমে কন্ঠে বলল,

-‘ দোলকে কেও কিডন্যাপ করেছে। আই থিংক ঐ জঙ্গি গোষ্ঠীর কেও হবে। ‘

নিস্তব্ধ অরণ্য!

আমার সামনে বসে আছে অহনের বিয়ের দিন সেই ধাক্কা খাওয়া লোকটা! পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে সে। লোকটার নাম অদ্রিন। অদ্ভুতুরে চাহনি দিয়ে সে আমার পানে তাকিয়ে। মাস্ক পড়া নেই এখন। তার চেহারা দেখে সু- পরিচিত মনে হচ্ছে। যেনো এর আগেও কতবার দেখেছি তাকে!

আমি ভীত! ভয়ে তটস্থ আমি। তবে বাহিরে তা প্রকাশ করলাম না। দূর্বল ভেবে তারা আমায় কাবু করতে পারে।

আমি শীতল কন্ঠে বলি,

-‘ আপনি? আপনি এখানে কেনো? কি চাই? আপনাকে কি পূর্ব আমায় নিয়ে যেতে বলেছে। ও কোথায়? ‘

অদ্রিন বিদ্রুপ হাসি দেয়। তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলল,

-‘ পূর্ব পাঠাতে যাবে কেন? আমরা নিজ থেকে এসেছি তোমায় নিতে?’

আমি কাঁপাটে কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

-‘ ক…কোথায়?’

-‘যেখানল এত বছর ধরে নিয়ে যাওয়ার প্লান ছিলো।টেনশন নট, তুমি একা যাবেনা। তোমার পুরো ফ্যামিলি যাবে সেখানে! এনিওয়ে আমার পরিচয় টা দেই? আমি অদ্রিন আয়মান। *** জঙ্গি গোষ্ঠীর একজন। ‘

এই ‘জঙ্গি ‘ শব্দটা শুনেই মনে উথাল-পাতাল ঢেউ শুরু হয়। নিজের ভয়টাকে যতটুকু সম্ভব দমন করার প্রয়াস চালাই। অদ্রিন ফের বলল,

-‘ তোমাকে নিয়ে যেতে ওর্ডার করেছে ওপর থেকে। তাই সেই বাংলাদেশ থেকে তোমার পিছু ঘুরছি! এন্ড ফাইনালি এই আয়াফ নামক গাধাটা আমাদের তোমাকে ধরতে সুবিধা করে দেয়। পূর্বের সিকিউরিটি সম্পর্কে জানতো ও। সুযোগ বুঝে তোমায় তুলে নিয়ে আসে আর আমরাও এর পিছু পিছু চলে আসি। ব্যাটা একটা গাধা, চারিদিকে ঠিকমতো খেয়াল না করে মেয়ে কিডন্যাপ করতে আসে। হোয়াটএভার আমাদেরই ভালো হলো! ‘

অদ্রিন ফের বিদ্রুপ হাসে। একজন কে হাতের ইশারা করে বলল আয়াফের লাশটা সরাতে। কথা অনুযায়ী লোকটা তার কাজ শুরু করে! আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকে সামনে তাকাই। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলি,

-‘ আমাকে উঠিয়ে নেয়ার নির্দেশ কেনো দেয়া হয়েছে আপনার ওপর? আমি কি করেছি? আর আমার পরিবারই বা কি করেছে? কেনো আমাদের সুস্থ – স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে দিচ্ছেন না। ‘

অদ্রিনের চেহারা নিমিষেই হিংস্ররূপ ধারণ করলো। তেতে যাওয়া কন্ঠে সে বলল,

-‘ তুই, তোর পরিবার, তোর দাদারা আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু! বাংলাদেশ এর সাথে শত্রুতার আগে, তোদের বংশের সাথে আমাদের শত্রুতা! ধ্বংস করে দিয়েছিলো তোর পরিবার আমাদের কে।’

অবাক চাহনিতে তাকিয়ে আমি। উদ্যিগ্ন হয়ে বলি,

-‘ মানে? কি করেছে আমার ফ্যামিলি? ‘

-‘ বলতে বাধ্য নই! চুপ থাক, নয়তো জিভ টেনে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।’

মৌনতা রূপে তাকিয়ে থাকি। পালানোর রাস্তা খুঁজতে হবে আমায়। আমি এদের জালে পা দিতে পারবো না কখনো। হটাৎ অদ্রিন আমার হাতের দিকে চেয়ে বলল,

-‘ আরে এই হায়াত, এই মেয়ের হাতের বাঁধন খুলে দে। বস জানতে পারলে মেরে ফেলবে আমাদের! ‘

অদ্রিনের কথায় হায়াত নামক লোকটি বলল,

-‘ স্যার যদি পালিয়ে যায়? নয়তো কোনো কিছু করে?’

-‘ কিছু করবে না। এরা মেয়েজাতী! ভিতুর বাচ্চা এরা। যা খোল! ‘

আশার সঞ্চয় হয় আমার মন নিভৃতে! হায়াত লোকটা এগিয়ে এসে দুই পা আর হাতের বাঁধন খুলে বসা থেকে উঠতে নিবে তখনই আমি তার হাতে খামচি মেরে রিভলবার নিয়ে নেই। হিতাহিত জ্ঞান ফেলে গুলি করে দেই হায়াতের পায়ে। অদ্রিন দাড়িয়ে যায়। সাথে বাকি লোকগুলো হুড়মুড়িয়ে আসতে নিলে আমি কোনো ভাবান্তর ছাড়া অভিজ্ঞ মানুষদের মতো এক একজনের বুকে গুলি করে দেই! খেয়াল হয় অদ্রিনের চোখে ভয় আর অবিশ্বাস্যের ছাপ! মানতে পারছে না হয়তো আমার এই রূপ! আমি তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলি,

-‘ মেয়ে জাতি চাইলে সব পারে! ছেলেদের নাকে দড়ি পড়িয়ে ঘুরাতেও পারে সাথে গুলি করা তো সামান্য ব্যাপার! ‘

অদ্রিনের দিকে রিভলবার তাক করে ট্রিগারে প্রেস করতে নিলেই ও কাঁপা কন্ঠে হাত উঁচু করে বলল,

-‘ দেখো দোলা, আমাকে যদি শুট করো তাহলে তুমি তোমার দাদুর সাথে আর কখনোই দেখা করতে পারবে না।’

দাদুর কথা শুনে আমি স্তব্ধ! কি বলছে এসব অদ্রিন।দাদু তো মারা গেছেন। আমি কটমট চোখে চেয়ে বলি,

-‘ ফাজলামো হচ্ছে? দাদু মারা গেছে আজ অনেক বছর। ‘

-‘ তিনি মারা যাননি দোলা। তিনি লুকিয়ে আছেন। আমাদের জঙ্গি গোষ্ঠীর লিডার টিম অন্যতম সদস্য তোমার দাদু জায়িন আকবর। ‘

নিস্তব্ধ রূপে তাকিয়ে আছি অদ্রিনের দিকে। এটা কি সত্যি? আদও সম্ভব?

চলবে…..

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
|পর্ব-৩৯|

[বোনাস পার্ট]

বাকরুদ্ধ হয়ে সামনে দাদুকে দেখছি। বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্টমান তার সর্বমুখে! বয়সের কারণে হাতের চামড়া ঝুলে পড়ে কুঁচকে গেছে খানিকটা। তবুও অনেকটা শক্ত লাগছে তাকে দেখে!

দাদুকে দেখে আকস্মিক জ্ঞান লোপ পায়। কাদা দিয়ে এঁটে সেঁটে মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ি। নীরবে কেঁদে চলেছি! আজ চোখের পানি থামতেই চাইছে না। দাদু ছিলেন আমার বাবার পর সবচেয়ে ভরসা যোগ্য এবং ভালোবাসার একজন মানুষ। এক কথায় আমার আদর্শ তিনি। আর তিনি কিনা জঙ্গিবাদে লিপ্ত? তার রক্তে দিয়ে গড়া মানুষদেরই ক্ষতি করতে চাইছেন? ব্যাপারটা মেনে নিতে প্রচন্ড রকমের কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু দাদুর এমন করার কারণটা কি?

আস্তে ধীরে হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াই। পা যুগল কাঁপছে ! আপনজন এর থেকে পাওয়া ধোকা গুলো একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে ভেঙ্গে দিতে এক সেকেন্ড ও নেয়না।

দাদুর চারিপাশে কালো সুট কোর্ট পড়া ২০ জনের মতো গার্ড। আমার পিছে অদ্রিন। মাথা উঁচু করে তিক্ত দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। অদ্রিনের সেই মূর্হতটার কথা শুনতে বিশ্বাড হচ্ছিলো না। কিন্তু যখন ও একটা ছবি দেখায় তখন আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। দাদুকে এক পলক দেখার জন্য এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো মন! অদ্রিনের কথা অনুসারে এই জায়গায় আসা! শুরুতে পরিত্যাক্ত ভবন দেখলেও মাটির নিচে যেতে অব্দি এটা একটা রাজপ্রাসাদ। মাটির নিচে তৈরি করা বাড়িটা!

দাদুর সামনে দাঁড়াই। তার চক্ষুযুগল লাল। আমি আলত কন্ঠে বলি,

-‘ দ..দাদু? ক..কেনো করলে এসব? ক..কি কারণে?’

গালে পাঁচ আঙ্গুলের স্পর্শ পেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে যাই। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে তার দিকে। দাদু আমায় থাপ্পড় মেরেছেন? যিনি আমার হাতে একটু আঁচড় লাগলেও পাগল হয়ে চার পাঁচজন ডাক্তার বাসায় ডেকে আনতেন, আজ তিনি আমায় আঘাত করেছেন?

দাদু হুংকার দিয়ে বলল,

-‘ এই মেয়েকে বন্দি করে রাখো। খাবার দাবার কিছু দিবেনা। রুমে আলোও যাতে না থাকে, খেয়াল রাখবে। ‘

দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাকালীন হুট করে দুজন মেয়ে এসে আমার হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে যেতে থাকে। আমি স্তব্ধ। এতোটা শক ব্রেন নিতে পারছে না। দাদু কেনো করলো এমনটা? এসব দেখার আগে মৃত্যু গ্রহণ করাটা শ্রেয় ছিলো!

পূর্ব পাগলপ্রায়! পুলিশ লাগিয়ে কাজ হচ্ছেনা। দোলাকে এমনভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা বলার মতো না। কোনো রকম এর প্রমান রাখেনি। দোলাকে প্রথমে আয়াফ কিডন্যাপ করেছে তা জানতে পেরেছে পূর্ব! অতঃপর আয়াফের মৃত্যু দেহকে ছুড়ি দিয়ে এক আঘাতে দু টুকরো করে ফেলেছে! কেও বাঁধা দেয়নি। দিয়ে লাভ নেই বলে!

গোয়েন্দা সংস্থায় বসে নিজের টিমের সাথে কথা বলায় যখন ব্যাস্ত সে তখনি ফোনে ম্যাসেজের টোন এর শব্দ হয়। কথা বলা থামিয়ে ম্যাসেজটা দেখে থমকে যায়। চোখদুটো আজ অশ্রুপূর্ন! টিমের সবাই অবাক চোখে দেখছে পূর্বকে। একজন জুনিয়র অফিসার কৌতূহল দমন করতে না পেরে সে ফরাসি ভাষায় উৎসাহ নিয়ে বলল,

-‘ স্যার আপনি কি কাঁদছেন? আপনার শরীরে বুলোট লাগলেও কখনো চোখে পানি দেখিনি। আজ হটাৎ? এনিথিং সিরিয়াস স্যার?’

পূর্ব চোখ বন্ধ করে পানিটুকু আড়াল করার চেষ্টা চালায়। পরিশেষে চট জলদি চোখ খুলে বলল,

-‘ সবাই রেডি হও! জঙ্গিদের আস্তানার খোঁজ পেয়ে গিয়েছি। রিভলবার আর কিছু এসিড নাও সঙ্গে। ‘

সবাই দাঁড়িয়ে ‘ইয়েস স্যার’ বলে চলে যায়!
পাশে দাড়িয়ে ছিলো অভ্র, অরণ্য, সায়ান! তারা এগিয়ে আসলো। সায়ান বলল,

-‘ দোলের খোঁজ পেয়েছিস পূর্ব? ‘

পূর্ব মাথা নাড়িয়ে ‘ হ্যা ‘ বলি। তিনজনের চোখ চকচক করছে। অভ্র বলল,

-‘ কিভাবে পেলি?এই জঙ্গিরা খুব ধূর্ত ছিলো। ‘

-‘ দাদু বলেছে! জায়িন আকবর, তিনি নাকি ওদের লিডার প্যানেলের একজন। আমায় যেতে বলেছে। ‘
ধরা কন্ঠে বলল পূর্ব!

তিনজন এর অবাকের সিমানা আকাশ ছুই ছুই! সায়ান চেঁচিয়ে বলল,

-‘ পূর্ব আর ইউ ম্যাড? দাদু মারা গিয়েছে অনেক বছর। মৃত্য মানুষ ব্যাক আসে কিভাবে? তাও জঙ্গিরূপে? ‘

তাল মিলিয়ে অভ্র বলল,

-‘ এক্সাক্টলি! পাগল তুই পূর্ব? কিসব বলছিস? দোলার চিন্তায় মাথা তোর পুরো গেছে। ‘

পূর্ব কাঁপা হাতে ওর ফোনটা এগিয়ে দেয়। সে নিজেও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। কি হচ্ছে এসব? আরো কি কি কঠিন সত্যির মুখোমুখি হতে হবে তার?

সায়ান ফোন হাতে নিয়ে দেখলো একটা ম্যাসেজ ওপেন করা। অভ্র বলল যা লিখা আছে জোরে পড়তে! সায়ান পড়া শুরু করলো,

-‘ পূর্ব আমি জায়িন আকবর! তোমার দাদু। দোলার জীবন হুমকির মুখে আছে। জলদি টেক্সটে দেয়া অনুযায়ী ঠিকানায় আসো। আমি বেঁচে আছি কিভাবে জিজ্ঞেস করো না আপাতত। জোহানকে জিজ্ঞেস করিও! আপাতত জলদি আসো। এই জঙ্গি গোষ্ঠীর লিডার প্যানেল এর একজন সদস্য আমি তাই কিছু করতে পারছিনা। ‘

স্তব্ধ সবাই! বাক্যহীন হয়ে মাটিতে বসে পড়ে তিনজন। পূর্ব শক্ত হয়ে টেবিলের ওপর দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

অন্ধকারের মাঝে ফেলে রেখে যায় দুজন মেয়ে আমায়! ভীত চোখে চারপাশে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াই। কিন্তু ঠিকমতো দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছিলো না। আয়াফ পায়ে রড দিয়ে আঘাত পর ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। আমার মন নিভৃতে এখনো দাদুর জন্য অগাধ বিশ্বাস জমে রয়েছে। বারংবার মনে হচ্ছে কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে! কিছু তো একটা আছে যা আমার অজানা। পুরো বাংলাদেশ এবং আমার পরিবার এর অজানা। নাহলে এই জঙ্গি গোষ্ঠী কি কারণে বাংলাদেশ এবং আমার পরিবার এর ক্ষতি করতে চায় সেটা ধরে ফেলতো সবাই!

অন্ধকার রুমটায় হাতড়ে হাতড়ে একপাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ি। কেমন শো শো আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েকটা গাড়ি একসাথে আসার শব্দ! কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করতেই কানে ভেসে আসে গোলাগুলির শব্দ! কারো আর্তনাদ, কারো চিৎকার আর কারো বা হুঁশিয়ারি হয়ে যাওয়ার জোরালো কন্ঠস্বর! বুক কেঁপে উঠলো! ভয় ঢুকেছে মনে। কি হচ্ছে বাহিরে?

আমি কিছুটা চেঁচিয়ে বলি,

-‘ কেও আছেন? প্লিজ দরজাটা খুলে দিন। আমার অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসছে। দাদু?প্লিজ দরজাটা একটু খুলে দাও! ‘

অন্ধকার যেনো তীব্র ভাবে আমায় গ্রাস করেছে। ফোবিয়া আছে এই অন্ধকারে আমার।

দরজার কাছটায় গুলির আওয়াজ শুনে হতভম্ব হয়ে যাই। চিৎকার দিয়ে উঠলো কেও। দরজা খুলে যায় তার দুই মিনিট পর। আধার পেরিয়ে বাহির থেকে আসা আলোক রশ্মি থেকে স্পষ্টরূপে দেখতে পাই পূর্বকে! একহাতে রিভলবার। তাকে দেখা মাত্রই ব্যাথাময় পা নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে জরীয়ে ধরি। পূর্ব আমায় শক্ত করে জরীয়ে ধরে উঁচু করে তোলেন! তিনি আমার থেকে অনেক লম্বা! ঘাড়ে মুখ গুজে লম্বা শ্বাস টেনে কাঁধে তার ওষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়া দিতে থাকেন অনবরত। আমি ঠোঁট চেপে ফুপিয়ে কেঁদে দেই। এতোটা সময় পর আকাঙ্খিত মানুষটা সামনে আসাতে কান্নাটা বাঁধা মানতে চাচ্ছে না।

পূর্ব আমায় নিচে নামিয়ে দুইগালে হাত রেখে ধরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘ ঠিক আছিস তো? কোথায় আঘাত লেগেছে? ‘

বলতে বলতে তিনি আমার হাত, ঘাড় চেক করতে থাকেন। মাথার কাছটায় এসে থমকে যান। তার একহাত সামনে এনে দেখেন রক্তে ভরপুর! নিশ্চিত মাথার আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আলত হেসে বুকে মাথা এলিয়ে দেই তার। ক্লান্ত চেখদুটো বন্ধ হয়ে আসে! নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। চারিপাশের কোলাহল কানে আসা বন্ধ হয়ে যায়! চোখদুটো বন্ধ হওয়ার আগে পূর্বের ক্রন্দনরত হতবিহ্বল মুখশ্রীটাতে একটা চুমু খাওয়ার তীব্র বাসনা জেগেছিলো মনে! তবে তা পূর্ণ হলোনা।

জ্ঞান ফেরার পর চারিপাশে তাকিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করি হসপিটালে।ব্যাকুল চোখদুটো পাশে তাকাতেই তার কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটির দেখা পেয়ে যায়। পূর্বের চোখদুটো লাল টগবগে! একহাত ধরে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি চক্ষুজোড়া খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে হয়ে আমার কাছে এসে বললেন,

-‘ দোলপরী মাথায় ব্যাথা করছে? পায়ে ব্যাথাটা আছে? বেশি অনুভূত হচ্ছে? ডক্টর কে ডাকবো? যন্ত্রণা কি একটুও কমেনি। ‘
শেষের কথাটি তিনি করুন কন্ঠে বললেন।

আমি ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে তাকে বলি,

-‘ আমি ঠিক আছি! ব্যাথা করছে না তেমন। আপনি বসুন। ‘

পূর্ব বসলেন না। আমার বেডে উঠে গিয়ে গালে হাত দিয়ে কপালে শব্দ করে দু- তিনটে চুমু খেলেন! গালে চুমু খেয়ে আমার ওষ্ঠদ্বয় করে নেন নিজের আয়ত্তে! কিছু বলার জন্য হাস ফাঁস করা আমি তার এহেন কান্ডে চুপ হয়ে যাই।
দুই তিন মিনিট পর তিনি সরে আসতেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেই। অতঃপর দাদুর কথা মনে আসাতে সবকিছু সাইডে ফেলে কিছু জিজ্ঞেস করবো তখনি তিনি ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বললেন,

-‘ ঘুমিয়ে পড়! কথা বলিস না এখন। ক্লান্ত তুই ব্রেনের রেষ্ট প্রয়োজন।’

তার শক্ত কন্ঠ শুনে থতমত খেয়ে যাই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ি তৎক্ষনাৎ!

চলবে….