স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৩

0
130

#স্মৃতির_আড়ালে
#৩য়_পর্ব
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিহানের বাড়িতে এসে ওর বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম আমি। নিহান আমার দিকে শান্তভাবে তাকালো। সামান্য রেগে বলল,“আমার বিছানাটা এভাবে দখল করে নিলি! লোকে শুনলে কি বলবে যে অন্যের বিয়ে করা বউ তার বাসর রাতের দিন আমার খাটে এসে শুয়ে পড়েছে।”

আমি হেসে বললাম,“তোর সবকিছুর উপরেই তো আমার একছত্র অধিকার আছে। আমরা সেই ছোটবেলার বন্ধু বলে কথা। আর রইল কথা বাসর ঘরের। সে তো আমাদের বাসর ঘরেও আকাশের প্রাক্তন বউ এসে শুয়ে পড়েছিল।”

“সত্যি নাকি?”

“তা নাহলে আর বলছি কি। বাদ দে। তোকে একটা মজার কথা বলি।”

“বল।”

“ঐ মির্জা বাড়িতে একদিন থেকেই আমি ওখানকার সম্পর্কে অনেক গোপন তথ্য জানতে পেরেছি।”

“কি জানতে পেরেছিস?”

“ঐ আকাশ মির্জার বাবা আব্দুল মির্জাই তো তো বায়োলজিকাল ফাদার তাই না?”

আমার কথাটা যে নিহানের পছন্দ হলো না সেটা তার মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল। একটা রাগ লক্ষ করলাম ওর চেহারায়। আমি ওর রাগকে পাত্তা না দিয়ে বললাম,“ঐ মির্জা বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে আরো অনেক কথাই শুনেছি বাড়ির বহু আগের কাজের মেয়ে জরিনার থেকে। ঐ মির্জা বাড়ির সব ছেলেদেরই কালো অতীত আছে। একেকটা নারীলোভী আর ভন্ড, সমাজের সবাইকে নিজেদের ভালো চেহারা দেখায় আর ভিতরে ভিতরে….”

“এসব কথা বাদ দে না। আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না তুই ঐ ফ্যামিলিতে বিয়ে করতে গেলি কেন? তোর জন্য কি কোন ভালো ছেলে ছিল না? আমাকে বলতি আমি তোর জন্য ভালো ছেলে এনে দিতাম।”

“আমি তো ভালো মেয়ে নই ব্রো। তাহলে একটা ভালো ছেলেকে কিভাবে নিজের সাথে জড়াতে চাইব বল? তাই তো মনে হলো ঐ আকাশ মির্জাই একেবারে আমার জন্য পার্ফেক্ট ম্যাচ।”

নিহান আর কিছু না বলে পাশের ঘরে চলে গেলো। আমিও ওর বিছানায় শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।

…..
সকালে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে বসলাম। বিশাল একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়ালাম। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম কিচেনের দিকে। নিহান রান্না করছিল। ছেলেটা বেশ রান্নাও করে। আমি ওর পাশে গিয়ে বললাম…

………………………………………………
“কি হলো? থামলি কেন আলিয়া?”

আলিয়া মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল,“এরপর ডায়েরির কিছু পেজ গায়েব।”

“তাহলে একটা কাজ কর। পরের পেজ যেখানে আছে সেখান থেকে পড়তে শুরু কর।”

আলিয়া আবার পড়তে শুরু করে।

………
এভাবে যে হঠাৎ খু*নের কেসে ফেঁসে যাব সেটা আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। তাও না আবার কাকে? আকাশ মির্জার প্রাক্তন স্ত্রী অমিতাকে! যেই মেয়েটাকে বাসর ঘরের সেই অপ্রীতিকর ঘটনার পর আর কখনো দেখিই নি তার খু*নের দায় কিনা আমার উপর এসে বর্তালো। দেশের আইন ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস যেটুকু ছিল সেটুকুও আর রইল না।

যদিও আমি এখন পুলিশ কাস্টাডিতে নেই। নিহানের সহায়তায় আত্মগোপনে আছি রাঙামাটির একটি প্রত্যন্ত এলাকায়। নিহান বলেছে ও সত্যটা উদঘাটন করার চেষ্টা করবে। তারপরই আমাকে ফিরিয়ে আনবে। আমিও ওর কথা মেনে নিয়েছি।

রাঙামাটিতে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিচয়ে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি আমি। এখানকার পরিবেশ যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর এখানকার মানুষের ব্যবহার। বর্তমানে এক উপজাতি এলাকার পাশেই রয়েছি আমি। এদিকটায় চাকমা উপজাতির বাস। গ্রামটা বেশ শুনশান এলাকায়। এখানে অব্দি আমার খোঁজ করা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি নিজে থেকে ধরা দেব।

গ্রামটির নাম তিয়ায়াই। যার অর্থ “সূর্যের ভূমি।” এই গ্রামের সকল মানুষদের দেখি প্রতিদিন ভোরে সূর্যের উদয়কালে বিশেষ এক প্রার্থনায় সমবেত হতে। যতদূর শুনলাম এখানকার লোকেরা সূর্যদেবতার আরাধনা করে।

এখানে বেশ বাহারী খাবারও পাওয়া যায়। এখানকার মানুষেরা কৃষিকাজ করে। এছাড়া শিকার করেও খায়। গ্রাম পাশেই একটি বিশাল হৃদ বিদ্যমান। সেখান থেকেও অনেকে মাছ ধরে খায়।

এতসব সুবিধার মধ্যে কিছু অসুবিধাও আছে এখানে। যার অন্যতম হলো এখানে সারাদিন খুঁজলেও আপনি নেটওয়ার্ক পাবেন না, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবও রয়েছে। এত সবকিছুর পরেও এই গ্রামের যেই বিষয়টা আমায় মুগ্ধ করে সেটা হলো “তেহাইয়ো” আনুমানিক ২৫ কি ২৬ বছরের তাগড়া যুবক। এই গ্রামের গ্রামপ্রধানের একমাত্র ছেলে। দেখতে বেশ ফর্সা, লম্বা, চাকমা হওয়ার কারণে গোলগাল চেহারা। যেমনটা হয় আরকি। ওর প্রতি কেন জানি আমি আলাদা একটা আকর্ষণ অনুভব করি ইদানীং। ছেলেটা আসলেই অনেক আকর্ষণীয়। ছেলেদের প্রতি এই আকর্ষণ যদিও নতুন কিছু না। প্রথমবার কোন পুরুষের গভীর স্পর্শে মাতোয়ারা হওয়ার পর থেকেই…

পড়তে পড়তে ডায়েরিটাই ছু*ড়ে দিল আলিয়া। রাগে নিজের মাথার চুল ছি*ড়তে ইচ্ছা করছে। মেঘলা এসে বসলো আলিয়ার পাশে। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। আলিয়া মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,“সবাই বলে না আমাকে অনেকটা চাকমাদের মতো দেখতে। তাহলে আমি কি আমার মা আর ঐ তেহাইয়ো নামক লোকটার নোং*রামীর ফসল মেঘলা?”

“চুপ কর আলিয়া চুপ কর। এসব কেন ভাবছিস তুই? এমন তো নাও হতে পারে।”

“আমি আর কিছু জানতে চাই না। আমার জানতে হবে না নিজের পিতৃপরিচয়। কিন্তু আমার পক্ষে আর সি ডায়েরি পড়া সম্ভব নয়। নিজের পূজনীয় মায়ের অতীতের এসব বিশ্রী কাহিনি আমি আর জানতে চাই না। যতটুকু সম্মান তার জন্য বাকি ছিল সেটাও নাহলে আর আস্ত থাকবে না।”

মেঘলা ডায়েরিটা তুলে নিলো। আলিয়াকে শান্ত হবার আহ্বান জানিয়ে বলল,“তোকে পড়তে হবে না। আমি তোকে বাকি কাহিনি পড়ে শোনাচ্ছি। তুই মনযোগ দিয়ে শোন।”

……………………..
রাঙামাটিতে এসেছি এক মাস হলো। এর মধ্যে তেহাইয়োর সাথে কোনদিন সেভাবে কথা হয়নি। একদিন আমি নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে পরিচয় করে নিলাম। ওর সাথে কথা বলে বেশ ভালোও লাগল। ছেলেটা বেশ নম্র ভদ্র। আমার আবার এমন নম্র ভদ্র ছেলে পছন্দ নয়। ভালো ছেলেদের ঠিক হ*জম করতে পারি না। আমার পছন্দ ঠিক আমারই মতো কোন প্লেবয় ছেলে। আমি যেমন প্লেগার্ল তেমনি এক প্লেবয়ের সাথেই তো আমাকে মানায় তাই না? হা হা হা।

দিনগুলো বেশ ভালোই যেতে লাগল।কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না সুখ হলো শৈবালের নীড়। সুখ বা ভালো মুহুর্ত সত্যিই ভীষণ ক্ষণস্থায়ী। তাই তো শেষরক্ষা হলো না। পুলিশ শেষপর্যন্ত আমার খবর পেয়েই গেলো। বর্তমানে তারা গোটা গ্রামটা ঘিরে রেখেছে। আমার আর পালানোর কোন পথ নেই। হয়তো এখন আমাকে স্যারেন্ডার করতেই হবে। আমি জানি, আমি একজন মহাপাপী। তবে মানুষ হ*ত্যার মতো জঘন্য আমি করিনি। যেই কাজটা করিনি তার জন্য শাস্তি পাবো না এটুকু ভরসা আমার আছে। বাকিটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম।”

এটুকু পড়েই থামল মেঘলা। আলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,“দেখলি তুই শুধু শুধুই এত কিছু ভেবে নিচ্ছিলি। ঐ তেহাইয়োর সাথে তোর মায়ের কিছুই হয়নি।”

আলিয়া বেশ অধৈর্য হয়ে বলল,“পরের পৃষ্ঠায় যা তাড়াতাড়ি। আমি এরপরের ঘটনাগুলো জানতে চাই।”

“ঠিক আছে পড়ছি।”

ডায়েরির পাতা উল্টিয়ে পরবর্তী পাতায় চোখ রাখল মেঘলা। প্রস্তুতি নিল পড়া শুরু করার।

To be continue…