স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
189

#স্মৃতির_আড়ালে
#অন্তিম_পর্ব
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আমার ফা/সি কার্যকর হওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগেই নিহান আবার কেসটা রিওপেন করল। ওর কাছে থাকা সব প্রমাণ একত্রিত করল। যার মধ্যে কিছু টেপ রেকর্ডার, ভিডিও ফুটেজও ছিল। যা থেকে স্পষ্ট হয় সেদিন আমাকে বাড়ি থেকে বের করার পর আকাশ ও তার মা অনিতাকে প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ও রাজি না হওয়ার কারণে তাদের মাথায় রাগ চেপে যায়। দুই মা ছেলে মিলে চরম নির্মমতার পরিচয় দেয়। বালি*শ চাপা দিয়ে ওকে হ- ত্যা করে। তারপর কৌশলে আমার হাতের ছাপ ওয়ালা বালিশ দিয়ে আমাকে ফা সায়। এমনকি নিহানকে আটকে রেখে আমাকে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করে। তারা ভাবে নিজেরা নিরপরাধ সেজে থাকবে। তবে যার কাছে নিহানের মতো বন্ধু আছে তার তার কোন বিপদ হওয়া এতটা সহজ নয়৷ আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। নিহানের ছত্রছায়ায় চলল আমার জীবন।

দিন চলে যেতে লাগল। নিরপরাধ প্রমাণিত হবার পর আমি সাধারণ ভাবে ঘুরতে লাগলাম। নিজের স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করলাম আমি। তবে ইদানীং নিহানের অনেক পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করে চলেছি। ছেলেটার মধ্যে যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তার অন্যতন হচ্ছে ইদানীং ও আমার প্রতি একটু বেশিই কেয়ারিং হয়ে উঠেছে। ওর চোখে আমি আমার প্রতি অন্যরকম অনুভূতি লক্ষ্য করছি যা আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমার এতদিনের পুরোনো বন্ধু আমাকে আর আগের নজরে দেখছে না। ব্যাপারটা মোটেই খুশি হওয়ার মতো নয়। বরং আমার জন্য অনেক চিন্তার একটি বিষয়। আমি ভাবলাম একদিন নিহানের সাথে বসে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলব। তবে আমাকে কিছু বলয়ের হলো না। তার আগেই একদিন নিহানের মা নূর খাতুন আমার সাথে দেখা করলেন। উনি আমার সামনে বেশ থমথমে মুখ নিয়ে বললেন,“তুমি নিহানের জীবন থেকে সরে যাও।”

ওনার কথার কোন অর্থ বুঝতে না পেরে যখন আমি ওনাকে প্রশ্ন করলাম উনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন তখন উনি রেগে বললেন নিহান নাকি আমাকে ভালোবাসে। এমনকি উনি নিহানকে বিয়ের কথা বলায় নিহান বাকি বলেছে বিয়ে করলে আমাকেই করবে নাহলে করবে না।

ওনার কথা শুনে ভীষণ অবাক হলাম আমি। নিহানের মনে আমাকে নিয়ে এমন অনুভূতি থাকতে পারে তা মাথাতেও আসে নি। উনি আমাকে বললেন আমাকে নিজের বউ হিসেবে কখনো মানতে পারবেন না। আমার চরিত্র নিয়েও অনেক কথা তুললেন। শুনতে খা*রাপ লাগলেও ওনার বলা একটা কথাও মিথ্যা ছিল না। কোন মাই বা চাইবে আমার মতো একটা চরি*ত্রহীন মেয়েকে নিজের ছেলের বউ করতে। তাই উনিও চান নি। আমি ওনাকে কোন দোষ দেব না। আমি বরং ভাবতে লাগলাম কিভাবে সব সামলানো যাবে। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম কি করবো৷ সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি নিহানের সাথে দেখা করলাম। নিহানকে ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা বলতেই নিহান আমাকে বলল, সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম৷ তাই তো নিহানকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি ওর যোগ্য নই, ও যেন নিজের উপযুক্ত কাউকে বিয়ে করে কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা। আমি ওকে বোঝাতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরলাম। এদিকে নূর খাতুনও ক্রমাগত আমাকে চাপ দিতে লাগলেন। আমি সম্পূর্ণ দিশাহারা হয়ে রইলাম। কি করব, কি করব না এমন ভাবনা থেকে আমি একটা জরুরি সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি নিহানকে একদিন ডেকে বললাম ও যদি আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকে তাহলে যেন আমার দেখা মেয়েকে বিয়ে করে। নিহান আপত্তি জানাতেই আমি নিজের মিথ্যা ক্যান্সারের রিপোর্টটা দিলাম ওর দিকে(বলা বাহুল্য এই রিপোর্টটা আমি আমার এক পরিচিত ডাক্তারের থেকে টাকার বিনিময়ে বানিয়ে নিয়েছি) আমি রিপোর্ট কার্ডটা ওকে দিয়ে বললাম আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। আর এটাই আমার শেষ ইচ্ছা যেন ও আমার পছন্দসই মেয়েকে বিয়ে করে। আমার কথা শুনে নিহান বাচ্চাদের মতো কাঁদছিল। ওকে কাঁদতে দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগলেও আমার কিছু করার ছিল না। বুকে পাথর চেপে আমি ওর সামনে মিথ্যা অভিনয় করে যাচ্ছিলাম।

আমার অভিনয়ে বাধ্য হয়ে নিহান বিয়ে করল অন্য একটি মেয়েকে। মেয়েটির নাম ছিল নয়না। ভদ্র, সভ্য একটি মেয়ে। যার মন মানসিকতাও অনেক সুন্দর ছিল৷ সবথেকে বড় কথা ও আমার মতো নষ্ট ছিল না।

নয়না ও নিহানকে সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে দেখে আমায় অনেক ভালো লাগল৷ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নয়না আর নিহানের মেয়ে দুনিয়ায় এলো। এরমধ্যে আমি মরে যাওয়ার নাটক করে নিহান ও নয়নার জীবন থেকে দূরে সরে এসেছি। আমার স্মৃতি অমর করে রাখতে আমার সাথে মিলিয়ে নিহান ওর মেয়ের নাম রাখল আলিয়া।

———
আলিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। উৎফুল্ল হয়ে বলল,“তার মানে আমি মায়ের মেয়ে নই। আমি মায়ের বন্ধু নিহান আর তার স্ত্রীর মেয়ে। তাহলে আমি কিভাবে মায়ের কাছে এলাম?”

মেঘলা বলল,“তুই একটু ধৈর্য ধর। শেষ একটা পেজ বাকি আছে। আমি সেটা পড়ছি তাহলে সব হয়তোবা ক্লিয়ার হবে।”

মেঘলা আবারো ডায়েরিটা পড়তে শুরু করল।
——–
বেশি সুখ বোধহয় কারো কপালে সয়না। খুব সহজেই মানুষের গোছালো জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই ব্যাপারটার প্রমাণ আমি আবারো পেলাম। নিহান ও নয়না নিজেদের মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজারে ঘুরতে গেল। কিন্তু কেউ আর ফিরল না। দুজনেই একটি দূর্ঘটনায় মা*রা গেল। তবে সৌভাগ্যক্রমে তাদের মেয়ে আলিয়া বেঁচে রইল। নূর খাতুন এই মেয়েটির দায়িত্ব নিতে চাইল না। তাকে অনাথ আশ্রমে দিতে চাইল। এটা শুনে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আমার জীবনে নিহানের অবদান ভোলার মতো নয়। ও ছিল জন্যই আজ আমি বেঁচে আছি। তাই আমি সেই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম নিহানের মেয়ের দায়িত্ব আমিই নেব। আর তাই নিলাম। আলিয়াকে দত্তক নিয়ে ওকে নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করতে লাগলাম। নিজের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন আনলাম। জীবনে অনেক পা*প করলেও আমি এরপর একজন পরহেজগার বান্দা হওয়ার চেষ্টা করলাম। পর্দা করলাম, ইসলাম মেনে চললাম। আলিয়াকেও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করলাম। ওর কাছে তাই আমি একজন আদর্শ মা। কিন্তু স্মৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই কথাগুলো জেনেও কি ও আমায় আগের মতো সম্মান করবে? নিশ্চয়ই না। তবুও আমি চাই ও জানুক নিজের আসল পরিচয়। আমাকে ঘৃণা করার বিনিময়ে হলেও জানুক।

—-
আলিয়ার চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়তে লাগল। সে হঠাৎ করে মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“আমি মাকে ঘৃণা করিনা। কখনো করতে পারবো না। ঐ মানুষটা আমাকে এত সুন্দর জীবন দিয়েছে। তাকে আমি কিভাবে ঘৃণা করি। তবে হ্যাঁ, ওনার আগের যেই চরিত্র ছিল তার জন্য ওনাকে ক্ষমা করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি তো আমার জন্মের পর এক নতুন ওনাকে দেখেছি। জিনি সবসময় পর্দার মধ্যে থেকেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন, রোযা, যাকাত সব পালন করেছেন। মৃত্যুর আগে ওমরাহ, হজ্বেও গেছেন। গরীব দুঃখীদের সাহায্য করেছেন। আমি সেই পরিবর্তনশীল মানুষটাকে কিভাবে ঘৃণা করব?”

বলেই কাঁদতে লাগল আলিয়া।

The End…
পরিশিষ্টঃআলিয়া কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেঘলা আলিয়াকে বিছানাত শুইয়ে দিয়ে আহ্নিকার রেখে যাওয়া চিঠিটা পড়তে বসেছে। মেঘলার এখনো মনে আছে আহ্নিকা মৃত্যুর আগে তাকে আলাদা করে ডেকে এই চিঠিটা দিয়েছিল।

আহ্নিকার প্রতি মেঘলাও কম কৃতজ্ঞ নয়। সে তো একটা অনাথ আশ্রমে বেড়ে উঠেছে। যার মা-বাবা কেউ নেই। আহ্নিকা প্রতিদিন অনাথ আশ্রমে গিয়ে তার খোঁজ খবর নিত। আশ্রমের সবার জন্য ভালো মন্দ রান্না করে নিয়ে যেত। প্রতি ঈদে তাদের নতুন জামা দিত।

সব কথা মনে পড়তেই মেঘলার খারাপ লাগে। তার মনে পড়ে যায় আলিয়ার সাথে দেখা করার পূর্বে আহ্নিকা তাকে ডেকে কি বলেছিল সেই কথা। আহ্নিকা তাকে ডেকে বলেছিল, এটা আমার ডায়েরি। এখানকার শেষের কিছু পৃষ্ঠা ছিড়ে ফেলে তুমি এই নতুন লেখাগুলো ফেবিকল দিয়ে আটকে দাও।”

মেঘলা তখন কোন প্রশ্ন না করে তাই করে। এই চিঠির মধ্যে ডায়েরির আসল লেখাগুলো আছে। মেঘলা এই আসল লেখাগুলো বের করে পড়তে থাকে।

—–
নয়নার সাথে নিহানের বিয়ের আগেই সে জানতে পারল আমার অভিনয়ের কথা। আমার যে ক্যান্সার হয়নি সেটা জেনে ও রেগে গেল আবার খুশিও হলো। ভীষণ জেদ করতে লাগল আমায় বিয়ে করার জন্য। আকাশ মির্জার সাথে অনেক লড়াই করে আমার ডিভোর্সের ব্যবস্থাও করল। আমি নিহানের এই তীব্র ভালোবাসা আর ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ওর অযোগ্য জেনেও ওকে বিয়ে করেছি। তবে বিয়ের পর থেকেই আমি নিজেকে বদলে নিয়েছি। এই বদলে নেওয়ার পথিকৃৎ ছিল নিহান নিজেই। ও আমাকে নিজের কৃতকাজের জন্য তওবা করে ইসলাম মানতে পরামর্শ দিল। আমিও তাই করলাম। ধীরে ধীরে ইসলামের পথে আসলাম। জীবনে শান্তি ফিরে পেলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমি জানতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। ভীষণ খু্শি হলাম। নিহানও অনেক খু্শি ছিল আমাদের সন্তানের আগমনের কথা শুনে। এরমধ্যে একদিন হঠাৎ আমাদের জীবনে নতুন বিপর্যয় নেমে এলো। দুজনে মিলে হাসপাতালে গেলাম আমার চেকাপ করাতে। সেই হাসপাতালে হঠাৎ দুবৃত্তরা হা*মলা চালালো। জিম্মি করলো অনেককেই। তার মধ্যে আমি ও নিহানও ছিলাম। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম। নিজের জন্য নয় নিহান আর আমার অনাগত সন্তানের জন্য। অনেক বাতবিতণ্ডার পর পুলিশের সাথে চুক্তির মাধ্যমে ওরা কিছু জিম্মি করা মানুষকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়। কিন্তু সমস্যা হয় এখানেই। তারা হয় আমাকে মুক্তি দেবে আর নাহয় নিহানকে। আমি মনেপ্রাণে চাইছিলাম নিহান মুক্তি পাক কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।

নিহান আমার আর আমার সন্তানের জন্য নিজেকে সেক্রিফাইজ করে দেয়। আমি সেদিন নিহানকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করি। সেটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা। এরপর নিহানকে আমি দেখি নিথর দেহে।

—–
এটুকু লেখা পড়েই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে মেঘলা। সত্যিকারের ভালোবাসার পরিণতি কেন সবসময় এমন হয়?!

মেঘলার এখনো মনে পড়ে আহ্নিকার বলা শেষ কথা। তিনি বলেন,“আসল সত্যটা যেন সবসময় স্মৃতির আড়ালেই থাকে। আমি চাই না যে আমার মেয়ে জানুক সে এক দুঃশ্চরিত্রা মায়ের মেয়ে।

সমাপ্ত