স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০২

0
144

#স্মৃতির_আড়ালে
#২য়_পর্ব
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আমাকে যখন আকাশ মির্জা মধ্যরাতে বাড়ি থেকে বের করে দিলো তখন আমি অসহায় হয়ে পড়ে রইলাম রাস্তায়। ভীষণ ক্রোধে আমার মাথা ধরে আসছিল। ইচ্ছা করছিল সবকিছু শেষ করে দেই। তবে আমি নিজেকে শীঘ্রই সামলে নিলাম।

এত অপমানের পর এখন নির্লজ্জের মতো মির্জা বাড়িতে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি ঠিক করলাম নিজের বাড়িতেই ফিরব। বাড়িতে ফেরার কথা ভাবতেই হঠাৎ আমার মনে এলো তুহিনা চৌধুরীর কথা। উনি আমার সৎমা। বর্তমানে আমার বাড়ি ওনারই অধীনে। খুব ছোটবেলায় আমার মা মা’রা যায়। তারপরই আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আনেন তুহিনা চৌধুরীকে। তুহিনা চৌধুরী আমাদের বাড়িতে আসার পর বদলে যায় আমার জীবন। আমার খুব করে মনে আছে সেই সময় আমি ১৪ বছর বয়সে পা রেখেছিলাম। সবে বয়োঃসন্ধিকালে পা রেখেছিলাম। অনেকটাই অবুঝ ছিলাম। উনি আসার পরেই মায়ের অভাব ভীষণ করে বোধ করতে লাগলাম। বাবাও দিন দিন কেমন জানি অচেনা হতে লাগলেন। একসময় তুহিনা চৌধুরী একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দিলেন। ব্যস, কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়ে গেল। বাবা আমার দিকে যেটুকু খেয়াল রাখত সেটাও আর রাখল না। শুধুমাত্র আমার খরচ চালিয়েই দায় সারত। এসব দেখে ধীরে ধীরে জীবনের প্রতি আমার মন বিষিয়ে ওঠে। আমিও ধীরে ধীরে অন্ধকার জগতে পা রাখি। এত অবহেলা, অনাদরে আমার ভেতরের ভালো আমিটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই আমি নেশার জগতে পা রাখি। সঙ্গে ছেলে সঙ্গ তো আছেই।

নিজের জীবনের অন্ধকার অধ্যায় নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমি টের পেলাম রাত বাড়ছে। এই অবস্থায় একটা মেয়ের এভাবে রাতে একা থাকা নিরাপদ নয়। তাই আমি নিজের সেলফোন বের করলাম। কাঙখিত নাম্বারটি ডায়েল করে কল লাগালাম। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরই রিসিভ হলো৷ বিপরীত দিক থেকে শুনতে পেলাম একজনের ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বর। হাই তুলে ও বলল,“হ্যালো, কে বলছেন?””

“আমি তোর যম বলছি। তাড়াতাড়ি তোর গাড়ি নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়িতে চলে আয়।”

ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে নিহান। ডেস্কের উপর থেকে নিজের চশমাটা তুলে পড়ে নেয়। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলে,“আহ্নিকা তুই! এত রাতে কেন ফোন করেছিস? এখন তো তোর বাসর হওয়ার কথা। আবার কোন বিপদ হলো নাকি?”

“বিপদের আর বাকি আছে কি? তুই আয় তো। ফোনে এত কথা বলা সম্ভব না।”

“আচ্ছা, তুই ওখানেই থাক আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছে যাব।”

“আর শোন আসার সময় আমার জন্য এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি আর একটা কোক নিয়ে আছিস। খুব খিদে পেয়েছে। পেটে যেন ইঁদূর দৌড়াচ্ছে।”

“আচ্ছা।”

আমি ফোনটা কে*টে দিলাম। তারপর এদিক ওদিক তাকালাম। এখন চলছে নভেম্বর মাস। ইতিমধ্যেই অল্প অল্প শীত পড়তে শুরু করে দিয়েছে। মধ্যরাত তাই শীত যেন একটু বেশিই। শীতে কাপতে লাগলাম আমি। গায়ে ভারী কোন পোশাকও নেই।

……
এটুকু পড়েই ডায়েরির পাতা বন্ধ করল আলিয়া। তাকালো নিজের সমীপে বসে থাকা মেঘলার দিকে। মেঘলা খুব আগ্রহ নিয়ে বলে উঠল,“আরে এই নিহানই তোর মায়ের সেই বেস্ট ফ্রেন্ড না? যে সবসময় তোর মায়ের পাশে ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকত?”

আলিয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,“হ্যাঁ, ইনিই সেই।”

“তুই ডায়েরিটা পড়া বন্ধ করলি কেন? পড়তে থাক। আমার তো তোর মায়ের গল্পটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে।”

“আমার একটুও ভালো লাগছে না মেঘলা এসব পড়তে। আমার মায়ের চরিত্র এমন ছিল? আমার ভাবতেও খারাপ লাগছে। উনি কিনা আরেকজনের সংসার ভেঙে ছিলেন!”

“তুই এই হীন্যমনতায় ভুগিস না আলিয়া। উনি যা করেছেন তার দায় তো সম্পূর্ণ ওনার উপর বর্তায়। তুই তো কোন অন্যায় করিস নি!”

“আমি কিছু বুঝতে পারছি না। যেই মাকে ছোটবেলা থেকে আমি নিজের আদর্শ মেনে এসেছি আজ কিনা তার সম্পর্কে এসব জানতে হচ্ছে!”

মেঘলা আলিয়ার কাধে হাত রেখে শান্তনা দিয়ে বলে,“কষ্ট পাস না রে! এরকম কত কিছুই তো থাকে আমাদের স্মৃতির আড়ালে। যা হয়তো অনেকের কাছেই অপ্রকাশিত। তুই পড়া কন্টিনিউ কর।”

“আমার পক্ষে আর পড়া সম্ভব নয় মেঘলা।”

“আলিয়া! বি ব্রেভ। এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে না। তোর মনে আছে আহ্নিকা আন্টি মৃত্যুর আগে তোকে কি বলেছিল? উনি তোকে বলেছিলেন যতই খারাপ লাগুক না কেন তুই যেন কোনভাবেই এই ডায়েরিটা পড়া বন্ধ না করিস। তোর মনে জমে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর এই ডায়েরিতে আছে। এমনকি তোর পিতৃপরিচয়ও!”

মেঘলার কথায় আলিয়া প্রভাবিত হয়৷ সে নিজেকে শক্ত করে সিদ্ধান্ত নেয় পুনরায় ডায়েরিটা পড়বে। এমন ভাবনা থেকেই আবার ডায়েরিটা খুলে পড়তে শুরু করে।

……..
পাক্কা বিশ মিনিট আমাকে নিহানের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। মশার কা*মড়ে আর কনকনে শীতে ইতিমধ্যেই আমার অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে। নিহান যখনই আমার সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নামল আমি তৎক্ষণাৎ নিজের সব চাপা ক্ষোভ উগড়ে দিলাম ওর উপর। খিটখিদে গলায় বললাম,“এতক্ষণ লাগে তোর আসতে! এখান থেকে তো তোর বাড়ি বেশিদূরও নয়। এত দেরি হলো কেন? তোকে যে খাবার আনতে বলেছিলাম এনেছিস?”

নিহান আমার দিকে তাকিয়ে ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলল,“তোর জন্য খাবার গরম করতে গিয়েই তো দেরি হলো। এত রাতে তো আর কেউ রেস্টুরেন্ট খুলে রাখেনি আমার জন্য। তাই বাধ্য হয়ে আমার ফ্রিজে থাকা বিরিয়ানি গরম করে আনলাম আর সৌভাগ্যবশত একটা কোকের বোতলও পেলাম ফ্রিজে।”

“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি দে। আমার খুব খিদে পেয়েছে।”

নিহান আমার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিতেই আমি নিয়ে খেতে শুরু করলাম। সত্যি ভীষণ খিদে পেয়েছিল। আমাকে গপগপ করে খেতে দেখে নিহান মিটিমিটি হাসতে লাগল। আমি ভ্রু পাকিয়ে শুধালাম,“কিরে এভাবে হ্যাবলার মতো হাসছিস কেন?”

“না কিছু না। তুই আমায় আগে বল তো এত রাতে তুই বাইরে কি করছিস?”

আমি একে একে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই নিহানকে খুলে বললাম। সব শুনে নিহানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। আমি তাকিয়ে দেখলাম রাগে ওর হাতের শিরা উপশিরা সব ফুলে উঠেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টায় আছে ও সেটাও বেশ বুঝলাম। নিহান আমায় বলল,“তুই খাওয়া শেষ করে চল আমার সাথে। ঐ আকাশ মির্জা এবং তার মাকে আমি উচিৎ শিক্ষা দেব।”

“আরে ভাই চিল। এত মাথা গরম করলে চলে নাকি? আমি তো আজ হোক, কাল হোক মির্জা বাড়িতে ফিরবোই। তবে এভাবে না। ওরা যেভাবে অপদস্ত করে আমাকে বের করে দিয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ সম্মান দিয়ে আমায় ফিরিয়ে নেবে। দেখে নিস।”

নিহান আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি ইশারা করে ওকে থামিয়ে দিলাম। এরপর ওর গাড়িতে বসে পড়লাম। ওর নাম ধরে ডেকে বললাম,“জলদি এসে ড্রাইভ কর। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

“কোথায় যাবি এখন তুই?”

“তোর বাড়িতে।”

“কি!!”

“কেন কোন অসুবিধা আছে?”

“না নেই।”

আমি মৃদু হাসলাম। জানতাম নিহান আমার মুখের উপর না বলতে পারবে না। সেই স্কুল লাইফ থেকেই আমরা একে অপরের বেস্ট ফ্রেন্ড। আমাদের সম্পর্ক এত মজবুত যে আমাদের দেখে কেউ কেউ ভাবত যে আমরা রিলেশন করি। কিন্তু সত্যি বলতে আমার জীবনে নিহাই একমাত্র ছেলে যার সাথে আমি রিলেশনে যাইনি। ক্লাসের কোন ছেলেই বাকি রাখিনি। কিন্তু নিহান সবসময় আমার বন্ধু হয়েই ছিল। একজন প্রকৃত বন্ধু। যে সবসময় আমার পাশে থেকেছে। তাই তো আমি চোখ বন্ধ করে ওকে ভরসা করি। ও কিন্তু অনেক মেধাবী। সবসময় ক্লাসে টপার ছিল। ওর চোখের চশমা তো সেই টপারের পরিচয়ই বহন করছে। হাহা। বর্তমানে ও নিজের একটা বিজনেস ফার্ম গড়ে তুলেছে। বেশ পরিশ্রমী ও। নিজের বন্ধু জন্য এত প্রশংসা করছি না। আসলেই ও বেস্ট।

To be continue…