স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৯

0
416

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

৯.

– বাবার পরে আমার জীবনে এমন একজন পুরুষ এসেছিল যার হাতে হাত রেখে নির্দ্বিধায় জীবনের বাকি পথ অতিক্রম করা যায়।সেই ছোটবেলা থেকে আমার জীবনের প্রত্যেকটি ধাপে আমি সেই মানুষটাকে আমার পাশে পেয়েছি। আমার পড়াশোনা,সমাজের কিছু কাপুরুষের খারাপ দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখা সবকিছু সেই পুরুষটা করে এসেছে একজন অভিভাবক হিসেবে।
আমি এতকাল অব্দি জেনে এসেছি সে শুধুই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু,পরে আমি জানতে পারলাম তার কেয়ারিংয়ের পিছনে শুধু আমার জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা ছিল। আর আমি এই এক সমুদ্র ভালোবাসাকে একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর শুভকামনা ভেবে এসেছি।

-কিশোরী মন কখনো সেই মানুষটাকে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে পেতে চায়নি?

-চেয়েছিল কিন্তু মা আর দাদীর বারণ পেয়ে সেই চাওয়া হারিয়ে যায় কালের গর্ভে।শিমুল ভাইয়ের একটু-আধটু কেয়ারিং, বকা, শাসন সব আমার মনে দাগ কেটেছে।নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করার আগে হটাৎ ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। বাবার হটাৎ মৃত্যু, এরপর আমার বড়ো আপুর কান্ড,সর্বশেষ ইশফাকের সাথে আমার বিয়ের মাধ্যমে শিমুল ভাইয়ার সাথে আমার একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

-এখন তো সেই মানুষটা তোমার স্বামী। ভাগ্য তোমাদের মিলিয়ে দিয়েছে তবে কেন তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো?

-তাকে স্বপ্নে চাওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই। কি নেই তার? ভালো চাকরি,গুড লুকিং,শার্প মাইন্ড। আর আমার কি আছে? না আছে লেখাপড়ার যোগ্যতা,বিধবা সাথে অকোজো হাত। চলে এসেছি আমি কারণ আমাকে নিয়ে চললে বরং উনাকে অপদস্ত হতে হবে।

-যদি কখনো সে তোমাকে খুঁজে পায় তখন তুমি কি করবে?

-তার কাছে ফিরে যাব কিন্তু সে কখনোই আমাকে খুঁজে পাবে না।

-এতটা আত্মবিশ্বাস ঠিক নয় তুলি কারণ সে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোক তোমাকে খুঁজে বের করা তার জন্য বাম হাতের খেলা।

সামনে বসে থাকা মেয়েটির কথা শুনে মুচকি হেঁসে ফেললো তুলি।

আজ চারদিন ধরে একটি এতিমখানায় অবস্থান করছে তুলি। তুলির শিক্ষকের সহায়তায় এই চাকরিটা পেয়েছে তুলি। এতিমখানার ম্যানেজারের মেয়ের সাথে বসে এতক্ষণ আলাপ করছিল তুলি।

-আমি আসছি তুলি গতকাল সময়মতো চলে এসো বাকি বাচ্চাদের সাথে নিয়ে।

-জি চলে আসবো।

মেয়েটি অফিস থেকে বের হয়ে গেলো তুলি অফিস রুম থেকে বের হয়ে বাচ্চাদের রুমে চলে গেলো। তুলির দায়িত্ব এখানকার বাচ্চাদের দেখাশোনা করা।

______________________

-কোনো খবর পেলি তুলির?

শিমুলের মুখের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো শিমুলের মা শিউলি।

-তোমার ভাইঝি তো আমাকে মেরে ফেলার জন্য পণ করে রেখেছে বুঝলে।নয়তো,এই শহরে যে জায়গায় ওর লাস্ট লোকেশন দেখাচ্ছে সেখানে গিয়ে দেখি বাস স্টপ। ও এই শহর থেকে বের হবার আগে হয়তো ওর মোবাইলের সিম খুলে ফেলে দিয়েছে এরপর নতুন সিম লাগিয়েছে। একটু সুযোগ রেখে যায়নি তোমার ভাইঝি। মা আর খাব না ভালো লাগছে না।

শিমুল একগ্লাস পানি খেয়ে উঠে চলে গেলো। শিউলি নিজের ছেলের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। কই ছেলেটাকে এখন সুখী দেখবে ভেবেছিল আর তুলি কি-না না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো!

ভাগ্যিস সেদিন নাতাশার হলুদ এবং বিয়ের অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। কারণ,শিমুল পরিবারের সবাইকে বারণ করে দিয়েছিল যে শিমুলের সাথে তুলির বিয়ে হয়েছে এই খবর যেন কারো কানে না পৌঁছায়।যদি একবার বিয়ের খবর জানতে পারে তবে বৌ কই? জিজ্ঞেস করে মাথা নষ্ট করে ফেলবে সাথে নাতাশার বিয়েতে ইফেক্ট পড়বে। নাতাশার বিয়ে তো খুব সুন্দর করে সম্পন্ন হয়েছে এখন তুলিকে খুঁজে পেলেই হলো শিমুলের মা আর কিছুই চায় না। উনার কাছে উনার সন্তানদের চেয়ে বড়ো আর কিছু নেই।

শিমুল যখন ঘরে এলো তখন ওর মোবাইল বেজে উঠলো। চার্জ থেকে মোবাইল বের করে রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে শিমুলের বন্ধু শাকিল বললো,

-কি রে দোস্ত আজ ১ তারিখ মনে আছে তোর? আমার বিয়েতে আসবি না? না-কি নাতাশার বিয়েতে যায়নি বলে তুই আমার বিয়েতে আসবি না?

-মনে হয় না আসতে পারব। এতদিন মানুষের নিখোঁজ হওয়া আত্মীয়কে খুঁজে বের করেছি আর আজ কয়েকদিন ধরে তুলিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।

-কেন তুলির আবার কি হলো?

-দোস্ত, তুলি আমাকে ছেড়ে এই শহরকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।

-আরে ব্যাটা এই আর নতুন কি তুলি সবসময় তোকে ছেড়ে চলে যায়। আছে কোথাও বেড়াতে গিয়েছে চলে আসবে।

-শাকিল, পুরো কথা শুনে এরপর কথা বলিস ফাজিল।আরে তুলির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। ও আমার স্ত্রী।

শিমুলের স্ত্রী তুলি এই কথা শুনে শাকিল অবাক হয়ে জানতে চাইলো কি ভাবে এই ঘটনা সম্ভব হয়েছে?শিমুল একে একে সব ঘটনা খুলে বললো। সবটা শুনে শাকিল বললো,

-ও চায় না তোরা ওকে খুঁজে পাস তাই এইভাবে সিম বদলে ফেলেছে। যে নিজ থেকে হারাতে চায় তাকে কি করে খুঁজে পাবি? আচ্ছা, তুলির ছবি দিতে পারবি আমায়?

-অবশ্যই, তুই খুঁজে বের করতে পারবি?

-আরে ব্যাটা আমরা বিভিন্ন এলাকার থানায় তুলির ছবি দিয়ে রাখলে অবশ্যই কেউ না কেউ ওর খোঁজ আমাদের জানাবে।

-আচ্ছা, তোর ওয়াট’স অ্যাপে আমি ছবি দিয়ে দিব। প্লিজ দোস্ত একটু চেষ্টা করিস।

-চেষ্টা করব মানে আমার বন্ধুর জীবনের প্রশ্ন। ভালো থাকিস দোস্ত আর চেষ্টা করিস আমার বিয়েতে আসার। আমি, রনি,সজিব,সাব্বির সবাই আমরা তোর অপেক্ষায় আছি। কবে থেকেই আমরা সবাই প্ল্যান করে রেখেছি কবে তোর সাথে দেখা করব?

-চেষ্টা করব। তুই একটু চেষ্টা করে দেখ তুলির কোনো খবর জানতে পারিস কি-না?

-ওকে, ভালো থাকিস আল্লাহ হাফেজ।

শিমুল কল কেটে দিলো এরপর ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার খুলে একটি ছবি বের করলো।
ছাইরঙা থ্রী-পিস পড়নে ঘোমটা দেয়া তুলি আর মেরুন শার্ট, কালো জীন্স পড়নে শিমুল। সেদিন একমূহর্তের জন্যেও হলেও হোক স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তুলি আর শিমুল পাশাপাশি বসে আছে ছিল। এই মুহূর্তটা হচ্ছে শিমুল আর তুলির বিয়ের পরের।

ছবিতে সেদিন তুলির মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে ও বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার প্ল্যান করেছে।

-তোকে ভালোবাসার পর থেকে আমি যতদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছি এইসব কিছু আমি সুদে-আসলে ফেরত নেব তোর থেকে। খালি তোকে একবার পেয়ে নেই এরপর তোকে আমার বুকের মাঝে চেপে রাখব তুলা।এই বুকের মায়ায় পড়ে তুই আর কোনোদিন কোথাও যেতে চাইবি না আমাকে ছেড়ে।

ছবিতে থাকা তুলির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে শিমুল।

এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো শিমুলের, শাকিল কল করেছে।

-হ্যালো?

-দোস্ত, মনে কর তুই তোর বৌকে পেয়ে গেছিস। সিলেটের বাসে উঠে রওনা হও, তোর বৌ এই সিলেট শহরে আছে।

শিমুল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পুরো শরীর কাঁপছে তুলিকে পাওয়া গেছে এই সংবাদটা পাওয়ার জন্য আজ চারদিন শিমুলের কান দু’টো যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল আর আজ সেই অপেক্ষার অবসান ঘটলো।

-তুই সত্যি বলছিস,শাকিল?

-আরে হ্যা ব্যাটা সত্যি বলছি তুই রওনা হও এখনি। তোর পরিবারের কারো সাথে বলবি না যে তুই তুলির খোঁজে সিলেট যাচ্ছিস নয়তো তুলির পরিবারের কেউ তুলির সাথে যোগাযোগ করে তুলিকে এ্যালার্ট করে দিতে পারে।

-ওকে ওকে বলব না। আমি রওনা দিচ্ছি।

শিমুল মোবাইল রেখে ল্যাগেজ গুছিয়ে ওর মা এবং বাবার থেকে অন্য কেসের কথা বলে বিদায় নিয়ে রওনা হলো সিলেটের উদ্দেশ্য।

#চলবে