স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৭

0
371

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

৭.

-সো,আজ নাতাশা আপুর বিয়ে এবং অনেকদিন পর তুলি আপুদের বাড়িতে আসার উপলক্ষে আমরা আজ সারারাত পার্টি করব।

আদিব একটি পেপারকে ফোল্ড করে মাইকের মতো বানিয়ে এনাউন্সমেন্ট করলো।শিমুল মুচকি হেঁসে আদিবকে বললো,

-নিশ্চয়ই, পার্টিতে পেট ভরবে না তাই না?এখন হালকা পাতলা কিছু খেয়েনি সবাই।

-ঠিক বলছো, শিমুল ভাইয়া। আমি নাতাশা আপু আর তুলি আপুকে ডেকে নিয়ে আসি।

রাদিব এক দৌঁড়ে রান্নাঘর গিয়ে নাতাশা আর তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আপু তোমরা তাড়াতাড়ি এসো। শিমুল ভাইয়া বলেছে তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে নিতে এরপর সারারাত পার্টি হবে।

কথাগুলো কোনোমতে বলে রাদিব আবারও একদৌঁড়ে চলে গেলো।নাতাশা আর তুলি মিলে রান্নাঘর থেকে প্লেট আর গ্লাস এনে ড্রইংরুমে ফ্লোরে বিছিয়ে রাখা মাদুরের উপর রেখে দিলো।নাতাশা শিমুল, আদিব এবং রাদিবকে ডাক দিতেই ওরা এসে পেতে রাখা মাদুরে বসে পড়লো।

রেস্টুরেন্ট থেকে আনা বিরিয়ানিগুলো সবাই বেশ তৃপ্তিসহকারে খেয়ে নিলো শুধু তুলি বাদে। কারণ, শিমুলের সামনে আজ চারবছর পর সামনাসামনি এই ভাবে খেতে বসেছে।

খাবার শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে ফেললো নাতাশা আর তুলি। এদিকে শিমুল, আদিব আর রাদিব বসে বসে কি নিয়ে আলাপ করছে?

নাতাশা আর তুলি এসে ড্রইংরুমের সোফায় বসে পড়লো। শিমুল একপলক তুলির দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।তুলির মনে হচ্ছিল শিমুল ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তাই তুলি শিমুলের দিকে তাকালো কিন্তু তুলি দেখলো শিমুল আদিবের সাথে কথা বলছে। তুলি শিমুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল এমন সময় তুলির নজর আঁটকে গেলো শিমুলের গলায় থাকা চেইনের মধ্যে।

তুলি হতভম্ব হয়ে গেলো কারণ আজ জিনিসটা শিমুলের গলায় আছে সেই জিনিসটা চারবছর আগে ওর কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু, এই ছিনিয়ে নেয়া জিনিসটা শিমুলের কাছে গেলো কি করে?

তুলি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এরপর ধীরপায়ে শিমুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।তুলিকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখে শিমুল ভড়কে যায়, নড়ে চড়ে বসে।

তুলি উপুড় হয়ে শিমুলের গলার চেইনটা হাতে নিয়ে শিমুলকে বললো,

-এইটা তুমি কোত্থেকে পেলে শিমুল ভাইয়া?

-এইটা আমার চেইন তুই জানিস না?
তুলির হাত থেকে চেইনটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো শিমুল।

-আমি কিন্তু একবারও চেইনের কথা বলিনি। আমি বলেছি চেইনে আঁটকে রাখা আংটির কথা।এই আংটিটা তো তুমি আমায় দিয়েছিলে?

-হ্যা, আমি দিয়েছিলাম কিন্তু তুই কি এই আংটিটা আগলে রাখতে পেরেছিস? যদি এতই আগলে রাখতি তবে এই আংটি অন্যজন আমার হাতে দিয়ে বললো কেন যে, তুলি এই আংটি কেন আলফাজ শেখ শিমুলের কোনো জিনিস রাখতে চায় না।

চিৎকার করে কথাগুলো বলে উঠলো শিমুল। শিমুলের আচমকা এমন চটে যাওয়া দেখে তুলিসহ উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।

নাতাশা এগিয়ে এসে শিমুলের কাঁধে হাত রেখে বললো,

-তোমাকে কে বলেছে তুলি তোমার কোনো জিনিস রাখতে চায় না? যে বলেছে সে পুরোটা মিথ্যা বলেছে। আ’ম শিউর।

-কে মিথ্যা বলবে, কণা? তুলির আপন বোন তুলির নামে মিথ্যা কথা বলবে আমার কাছে? কণার কি লাভ আমার কাছে তুলির নামে মিথ্যা কথা বলার?

শিমুলের মুখ থেকে কণার নাম শুনে নাতাশা আর তুলি অবাক হয়ে মুখ হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিমুল থুতনিতে হাত রেখে ড্রইংরুমের এপাশ-ওপাশ হাঁটছে।

নাতাশা কিছু বলার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে এমন সময় তুলি নাতাশার হাত চেপে ধরলো। নাতাশা ইশারায় তুলিকে বললো,

-আমার হাত ছাড় তুলি আজ যদি এই কথা ভাইয়াকে না বলি তবে ভাইয়া তোকে ভুল বুঝবে।

-কিন্তু, আমি চাই না শিমুল ভাইয়া সত্যিটা জানুক। উনি এই কথা জানলে আমার প্রতি উনার করুনা ছাড়া আর কিছুই হবে না।

নাতাশা জোড় করে তুলির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো এরপর তুলির হাত ধরে শিমুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শিমুলকে বললো,

-ভাইয়া, তুমি বললে না তুলি নাকি তোমার কোনো জিনিস নিজের কাছে রাখতে চায় না এবং এই আংটিও রাখেনি? তাই তো?

শিমুল কোনো জবাব না দিয়ে নাতাশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তুলি চোখের ইশারায় বারবার নাতাশাকে বারণ করছে কিন্তু আজ যেন তুলির কোনো কথা শুনতে রাজি নয় নাতাশা।

-তাহলে, বলো তো যার হাতের এমন অবস্থা সে কেমন করে তোমার দেয়া আংটি নিজের আঙ্গুলে পড়ে থাকবে?

নাতাশা কথাটি বলে তুলির বামহাত শিমুলের চোখের সামনে তুলে ধরলো। শিমুল দেখলো,তুলির বাম হাতের অনামিকা আর কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি নেই। বামহাতে মাত্র তিনটি আঙ্গুল অবশিষ্ট।

শিমুলের পুরো শরীর কাঁপছে।শিমুল যখন এই আংটিটা তুলির হাতে তুলে দেয় ঠিক তখনও তুলির হাতের পাঁচটি আঙ্গুল অক্ষত অবস্থায় ছিল কিন্তু এখন?

-কি করে হলো এমন?
গম্ভীর কন্ঠে কথাটি বলে উঠলো শিমুল।

-তুই আর কিছুই বলবি না নাতাশা। তোর আমার কসম লাগে, প্লিজ নাতাশা আর কিছু বলিস না।

তুলির মুখ থেকে এমন কথা শুনে নাতাশা আর শিমুল দুজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

তুলি নাতাশার হাত ছেড়ে দিলো এরপর একদৌঁড় ওর ঘরে চলে গেলো। শিমুল তুলির পিছনে যেতে চাইলে নাতাশা বাঁধা দেয়। নাতাশা আদিব আর রাদিবকে বললো পাশের ঘর গিয়ে শুয়ে পড়তে রাত হয়েছে অনেক।

আদিব আর রাদিব চলে যেতেই নাতাশা শিমুলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,

-ভাইয়া,আমি চাইলেও এখন তোমাকে সত্যি ঘটনা জানাতে পারবো না। কিন্তু, আমি চাই তুমি এই ঘটনা সত্যিটা জেনে যাও। আর এইটাও যেন জানতে পারো ঠিক কি কারণে কণা আপু এমন করছে তুলির সাথে।

এমন সময় নাতাশার মোবাইলে কল এলো, সায়মন কল করেছে। নাতাশা কল রিসিভ করে তুলির মায়ের ঘরে চলে গেলো কথা বলতে বলতে।

শিমুলের চোখের সামনে বারবার তুলির আঙ্গুল বিহিন হাত ভেসে উঠছে। শিমুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুলির ঘরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে কারণ এখন ওর তুলির সাথে কথা বলা প্রয়োজন। পরিবারের কেউই যেহেতু এতদিন ওকে সত্যি ঘটনা জানায়নি তবে আজ যে জানাবে এই কথার গ্যারান্টি কি?

শিমুল তুলির রুমের দরজায় কড়া নাড়তেই তুলি ওপাশ থেকে বলে উঠলো,

-দরজা খোলা আছে, চলে আয় নাতাশা।

শিমুল আস্তে করে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। তুলি ঠিক তখনও জানালার দিয়ে রাতের আকাশকে দেখছিল তাই এই ঘরে নাতাশা নয় বরং শিমুল এসেছে এই ব্যাপারটা তুলি টের পায়নি।

-তুলি?

শিমুলের মুখ থেকে নিজের নাম শুনে চমকে উঠে তুলি। জানালা থেকে মুখ সরিয়ে ঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখে শিমুল এসেছে ওর ঘরে। তুলি জানালার কাছ থেকে সরে এসে শিমুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-কিছু লাগবে?

-পুরো ঘটনা কিভাবে ঘটেছে আমি জানতে চাই তুলি?

-কিন্তু, আমি যে বলতে চাই না।

-কেন তুই বলতে চাইছিস না?

-আমি জানি না কিন্তু আমি তোমায় সত্যি ঘটনা বলতে পারব না।

-আমি এতকাল ভেবেছি তুই আমার দেয়া আংটিকে অগ্রাহ করে ফেরত দিয়েছিস কণাকে দিয়ে। কিন্তু আজ চারবছর ওর জানতে পারলাম তোর হাতের আঙ্গুল দু’টো নেই। তুলা রে বল না আমাকে তোর এত সুন্দর হাতের কে এমন অবস্থা করেছে? আমি তোর শিমুল ভাইয়া যে তোকে সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছি। আমি কখনো এমন কোনো কাজ করিনি যার জন্য হলেও তুই বিন্দুমাত্র কষ্ট পেয়েছিস। বল না তুলা কি হয়েছিল?

তুলির দুচোখ ভিজে উঠেছে আজ কতগুলো দিন পর তার শিমুল ভাইয়ের মুখ থেকে তুলা ডাক শুনতে পেয়েছে।

তুলি শিমুলের সামনে থেকে সরে গিয়ে খাটের উপরে বসলো। শিমুল তুলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কারণ শিমুল জানে তুলি কখনো শিমুলের অনুরোধকে অগ্রাহ করতে পারবে না।

-তুমি যেদিন এই আংটিটা আমায় দিলে সেদিন আমি আংটিটা না পড়ে বক্সে রেখে দিয়েছিলাম। এত দামি একটা জিনিস যদি আমি হারিয়ে ফেলি এই ভয়ে।

-আমি তো তোকে বলেছিলাম সবসময় এই আংটিটা পরে থাকতে। আর যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তাহলে বলে দিতে যে আমি এই আংটিটা তোকে দিয়েছি।

-তোমার কথা শোনায় আমার কাল হয়েছিল।তুমি চাকরিতে জয়েন করার পর হুট করে একদিন ফুপি কল দিয়ে বললো তোমাদের বাড়িতে যেতে। আমিও খুশি হয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে যাব বলে। আলমারী থেকে পার্সটা নিয়ে বের হয়ে যাব এমন সময় তোমার দেয়া আংটিটার কথা আমার মনে পড়ে। ড্রয়ার খুলে আংটির বক্স থেকে আংটিটা নিয়ে অনামিকা আঙুলে পড়ে নেই।এমনসময় কণা আপু এসে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে কে দিয়েছে এই আংটি? তখন আমি তোমার নাম বলি যে শিমুল ভাইয়া দিয়েছে। আপু তোমার নাম জানার পর কেমন চটে যায়!আমাকে ধমক দিয়ে বলে আংটি খুলে ওকে দিয়ে দিতে। আমি দিব না বলেছিলাম তাই আপু আমার সাথে জোরজবরদস্তি করে চেয়েছিল আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুলে নিতে।সেদিন আমার ঘরে দাদী ঘুমিয়েছিল তাই উনার সুপারি কাটার টেবিলের উপর পড়ে ছিল। আপু যখন দেখলো জোরজবরদস্তি করেও আংটি নিতে পারছে না তখন আমাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে দাদীর সুপারি কাটার দিয়ে আমার বামহাতের দুই আঙ্গুল কেটে নেয়।আমার গগনবিদারী চিৎকার শুনে মা আর দাদি ঘরে এসে আমার রক্তাক্ত হাত আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে কণা আপু। আমি এতটা নৃশংসতা মেনে নিতে পারিনি মূহুর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
দুদিন পর আমার যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করি। আমার বামহাতে ব্যান্ডেজ। সেদিন মা আমাকে বলে আমি যেন আমাদের পরিবারের কাউকে না জানাই যে আপু আমার হাতের দুই আঙ্গুল কেটে নিয়েছে।আজও কেউ জানে না কে আমার হাতের এমন অবস্থা করেছে শুধুমাত্র নাতাশা ছাড়া? আংটিটা সেদিনের পর থেকে আমার কাছে নেই। হসপিটাল থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পর অনেক খুঁজেছিলাম কিন্তু পায়নি। আজ চারবছর পর তোমার কাছে পেলাম।

মেকি হাসি দিয়ে কথাগুলো শেষ করলো তুলি। শিমুলের দুচোখ ভারি হয়ে উঠেছে তাই তুলির সামনে থেকে উঠে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলো।

তুলি ওর বামহাত চোখের সামনে মেলে ধরলো এরপর একপলক তাকিয়ে হাত নামিয়ে ফেললো।

#চলবে