স্মৃতির শহর পর্ব-০১

0
921

#স্মৃতির শহর
#পর্বঃ১
#তানিশা সুলতানা

ফুল সাজানো খাটে এক হাত ঘোমটা টেনে বসে হাজারো জল্পনা কল্পনা করছে রাইসা। কেমন হবে তার বর? খুব সুন্দর? না কি খুব বিশ্রী? কেমন হবে তার চরিত্র?
কিছুদিন আগেই রাইসার চাচাতো বোন রুপার বিয়ে হয়েছে। রুপার বর মদ খেয়ে রুপার সাথে ফাজলামো করেছে। অনেক মেরেছিলোও৷ রুপা না কি কিছু বুঝে না নেকা টাইপের এরকম বলে শশুড় বাড়ির সবার সামনে অপমান করেছিলো।
আজকে কি রাইসার বরও ওর সাথে এমনটা করবে? না কি এর থেকেও ভয়ংকর কিছু করবে?
ভেবেই হাত পা কাঁপছে রাইসার। লোকটাকে রাইকে সামনাসামনি কখনো দেখে নি৷ শুধু কয়েকবার ধমকের আওয়াজ শুনেছে দুর থেকে।

আঁচলে নিচে থাকা ফোনটা বারবার জ্বলে উঠছে। এই জ্বলে ওঠাই রাইদকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কেউ তাকে কল দিচ্ছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে স্কিনে তাকাতেই বুকের ভেতর ধক করে ওঠে রাইয়ের। স্কিনে বিহান নামটা জ্বলজ্বল করছে সাথে বিহানের হাসিমুখের ছবিটা।
খুব যত্ন করে নাম্বারটা সেভ করেছিলো রাই। এই ছবিটাও নিজে হাতে তুলেছিলো নাম্বারের সাথে সেভ করবে বলে।
মৃদু হাসে রাই। খুব যত্ন করে কলটা কেটে দেয়। ফোনটাও লুকিয়ে ফেলে তোষকের নিচে।

“তুমি আমার হয়েও আমার না
তুমি সত্যি হয়েও কল্পনা”

তাচ্ছিল্য সুরে বলে রাই।
চোখের কোনে চিকচিক করা পানি টুকু মুছে একটু হাসে।

পুরো রুমে এক বার চোখ বুলিয়ে নেয়,রাই। খুব বড় না রুমটা। একটা আলমারি খাট আর পড়ার টেবিল ছাড়া কিছুই নেই এই রুমে। বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে রুমটা। তাজা ফুলের গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। ফুল দেখলেই মন ভালো হয়ে যেতো রাইয়ের। কিন্তু আজকে মন ভালো হচ্ছে না। মনের মধ্যে জমে আছে পাহাড় সমান হাহাকার। এই অসময়ে অচেনা মানুষটার সাথে বিয়েটা না হলেও পারতো। জীবন নিয়ে রাইয়ের অনেক পরিকল্পনা আছে৷ সে সব কি এখন আর পূরণ হবে? কখনোই না?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রাই।
খাটের সাইডে বড় করে দেয়ালের সাথে টাঙানো আছে একটা ছবি। যেখানে নীল শার্ট পরে হাতে গিটার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুদর্শন এক যুবক। রাই বুঝে নেয় এটাই নিশ্চয় রাইয়ের বর হবে?
রাই ছবির দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটে। রাই কয়েক কদম ফেলে ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ছবিতে ঠিক যেভাবে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে রাইও ঠিক সেভাবেই দাঁড়ায়।
“এই যে মিস্টার হনুমান।
একদম আমাকে বকাঝকা করা যাবে না। আমি আপনাকে ভয় পায় না। আমাকে ঝাড়ি মারতে আসলে না আপনার হাতির সুরের মতো নাকটা এক ঘুসি মেরে ভেঙে দেবো।
চেনা আপনি আমায়।
আমার নাম রাইসা খান। হুমম বলে দিলাম।
আমাকে দেখে ছেলেরা ভয়ে দৌড়ে পালায়। একদম আমার ওপর হুকুমদারি করা যাবে না। মাইন্ড ইট
রাইসা ভাব দেখিয়ে বলে।
” সিরিয়াসলি
দরজার পাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠের শব্দে রাইসা ধরফরিয়ে ওঠে। বুকের ভেতর ধুকবুক করছে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়।
কি দরকার ছিলো এসব বলার? এখন কি হবে?
চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রাইসা বিরবির করছে।
“হু আর ইউ?
আমার রুমে কি করছেন? আর সাহস হয় কি করে আমাকে এসব বলার?
গর্জে উঠে বলতে বলতে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে লোকটা।
রাই মনে মনে দোয়া দুরুদ পরছে। ভয়ে থরথর করে হাত পা কাঁপছে। চোখে পানি টলমল করছে। চোখটা খুলে আবার বন্ধ করে ফেলে।
লোকটা একদম রাইয়ের মুখোমুখি বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ায়
” কিছু বলছি তো আমি?
বেশ শীতল সুরে বলে আদি।
রাই এবার একটু সাহস পায়। আস্তে আস্তে চোখ খুলে। চোখ খুলতেই এক জোড়া গভীর বাদমী মনিওয়ালা চোখে চোখ পরে যায়। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয় রাই। জীভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।
“আআআমি রাইসা। আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।
রিনরিনিয়ে বলে রাই। বুকের ধরফরানিটা কমছেই না। উল্টে বেরে যাচ্ছে।
” ওহহহহ
দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে রাইকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলে আদি।
আদির চাহনি দেখে রাই ভরকে যায়। এভাবে কেনো তাকাচ্ছে লোকটা? তাহলে কি উনিও রুপার বরের মতো? বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে রাইয়ের। বিহানের মুখটা খুব মনে পরছে।
“কোথায় তুমি? আমাকে বাঁচাতে আসবে না?
মনে মন বলে রাই।
আদি দুই পা এগিয়ে রায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়।
রাইয়ের মুখে হাত দিতে নেয়
রাই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে দুই হাত এক করে
” প্লিজ আমাকে ছোঁবেন না
মিনতি করে বলে রাই।
আদি দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে চর বসিয়ে দিতে মেয়েটার গালে।
নিজেকে স্বাভাবিক করে আদি চোখ খুলে। রাই এখানে ওভাবেই আছে।
আদি হাতের তালু দিয়ে রাইয়ের ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে দেয়।
রাই চমকে চোখ খুলে

” ইডিয়েট
দাঁতে দাঁত চেপে বলে আদি ওয়াশরুমে চলে যায়।
আদি চলে যেতেই রাই ছোট ছোট চোখ করে তাকায়।
“মাথা খারাপ না কি লোকটার?

খুব শব্দ করে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। রাই ভয় পেয়ে যায়। এভাবে দরজা আটকে দেওয়ার কি আছে? বুঝতে পারলো না রাই। মাথা খারাপ সবারই।

তারপর নিজের লাগেজটা খুঁজতে গিয়ে রাই হতাশ হয়। কোথাও নেই লাগেজটা। ওই খানেই তো ছিলো রাইয়ের সব জামাকাপড়। এখন রাই পড়বে কি?
মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাই।
মাথা খারাপ পরিবেশে এসে পরেছে। এদের কি কমনসেন্সের অভাব? একবার ভাবলো না মেয়েটা পরবে কি?
রাই বিরবির করছে আর পায়চারি করছে।
আদি ফ্রেশ হয়ে নিজের টাওয়ালটা আলমারিতে তুলে রেখে আলমারি তালা দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন দেখতে থাকে।
রাই কোমরে তৃহ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদির দিকে।
মানুষ কতোটা পাগল হলে ভেজা তোয়ালে আলমারিতে তালা দিয়ে রাখতে পারে?
এখানে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই।
এর থেকে তো রুপার বছরটাই ভালো ছিলো। অন্তত তোয়ালেটা তো দিয়েছিলো রুপা। তবে দিয়েছিলো না কি এটা রাই শিওর না। এটা জিজ্ঞেস করা হয় নি।

“এই যে শুনছেন
আদির পাশে দাঁড়িয়ে রিনরিনিয়ে ডাকে রাই।
” এই মেয়ে পবলেম কি তোমার?
চেঁচিয়ে বলে ওঠে আদি। রাই চমকে কয়েকপা পিছিয়ে যায়। পেছনে টেবিল ছিলো টেবিলে উস্টা খেয়ে বসে পরে।
“একদম ডিস্টার্ব করবা না আমাকে। তাহলে বেলকনির দিয়ে নিচে ফেলে দেবো। মাইন্ড ইট
মেঘের মতো গর্জন দিয়ে বলে আদি।
রাই দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদছে। কান্নার শব্দ পেলে যদি সত্যি সত্যি ফেলে দেয়। তখন?
আদি আবার আগের মতো নিজের কাজে মন দেয়।

রাই আস্তে আস্তে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ওঠে।
কি এমন বলে ছিলে রাই? যার জন্য এভাবে ধমক দিলো?
” এখান থেকে আমাকে পালাতে হবে। নাহলে এই হনুমানের ধমক খেতে খেতেই মরতে হবে আমাকে। থাকবো না আমি।
হেঁচকি তুলে বিরবির করে বলে রাই।

কোনোরকমে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে বেরিয়ে আসে রাই।
সাথে সাথে আবার ওয়াশরুমে ঢুকে পরে। গলগল করে বমি করে দেয়।
মাথাটাও ঝিমঝিম করছে কয়েকদিন যাবত। সকাল থেকেই বমি হচ্ছে। কাউকে বলে নি।
চোখ মুখ পানি দিয়ে আয়নার দিকে তাকায় রাই।
ভয় জেগে ওঠে মনের ভেতর।
“আমি কি প্রেগন্যান্ট?
প্রশ্নটা বারবার মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে।
” কি করবো এখন আমি?
ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে রাই। মাথার চুল খামচে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।

চলবে।