সেদিন ছিল পূর্ণিমা পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
684

#সেদিন_ছিল_পূর্ণিমা
|পর্ব:-০৬| সমাপ্ত।

সাজু কেবিনের ভেতর গেল। একটু পরে অবন্তী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। সাজু তার দিকে তাকিয়ে বললো,

– আপনি ঠিক আছেন তো?

– হ্যাঁ ঠিক আছি।

সাজু বাইরে বের হলো, হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছে ডাক্তারি পোশাক পরা ক’জন পুলিশ ও দুজন আসামি। সাজু তাদের সামনে যেতেই পুলিশের মধ্যে থেকে একজন বললো,

– দৌড়ে একদম ছাদে চলে গিয়েছিল। সেখানেই ধরে ফেলেছি। যাইহোক, আমি দারোগা শাকিল।

– আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করেছেন।

একটু পরে নিচ থেকে উঠে এলো কিবরিয়া এবং আরো দুজন পুলিশ। তাদের সঙ্গে সোহাগ। সোহেল চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেবিনের দরজা ধরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে অবন্তী।

– আপনি এদের থানায় নিয়ে যান আমি একটু পরে আসছি। আর দুজন লোক দিয়ে যান, রাত শেষ হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকবে।

দারোগা শাকিল দুজন পুলিশকে রেখে বাকিদের নিয়ে চলে গেল। সাজু ও কিবরিয়া অবন্তীর কাছে এসে বসলো। অবন্তী বললো,

– কীভাবে কি হয়ে গেল বলেন তো?

– সাজু বললো, তামান্না আর কিবরিয়ার সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম আমি তখনই সোহাগকে দেখতে পাই৷ তার সঙ্গে আরো দুজন লোক ছিল, সোহাগের ছবি দেখেছি তাই চিনতে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু সে হয়তো ভাবেনি আমি চিনতে পারবো। তারপর নিজে থেকে বুদ্ধি করে হাসপাতাল খালি করার কাজটা করলাম। কিবরিয়া ও তামান্নাকে চলে যেতে বললাম। তখন ওরা বুঝতে পেরেছে হাসপাতালে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। সুতরাং আমাকে তারা চোখে চোখে রাখবে এটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।

কিবরিয়া হাসপাতাল থেকে বের হবার পরই আমি কেবিনে ঢুকে তাকে কল দিলাম। তারপর তাকে বললাম সরাসরি থানায় চলে যেতে হবে। ডাক্তার এর রূপ ধরে এলেই কাজটা সহজ হবে। তারা খুব দ্রুত অন্য হাসপাতাল থেকে ডাক্তারের পোশাক যোগাড় করেছে। এরপর হাসপাতালে একজন একজন করে এমনভাবে প্রবেশ করেছে কেউ সন্দেহ করেনি।
তখন আমি চলে গেলাম নিচে। আমার সঙ্গে সঙ্গে সোহাগও গেল এটা নামার সময় বুঝতে পারছি। কারণ আমাকে চোখে চোখে রেখে তারা নিয়ে যাবে আপনাকে। আমি তো জানি উপরে কি হতে পারে? তারপর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যখন সোহাগকে দেখতে পাই ততক্ষণে এরা সবাই ছাঁদে চলে গেছে। কারণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছাঁদের উপর লোকজন দেখা যাচ্ছিল। আর সেজন্যই আমি দ্রুত কেবিনে আসি কারণ এখানে অন্য কিছু যেন না হয়ে যায়।
অবশেষে এদের ধরা হয়েছে, কিন্তু এখনো আসল যারা তাদের ধরা বাকি। তাছাড়া টগরকেও উদ্ধার করতে হবে। সিরাজ নামের যে নেতার কথা টগর বলেছিল তাকে ধরতে হবে। সমস্যা হচ্ছে সাক্ষী।
এতকিছু হয়ে গেছে কিন্তু এদের বিরুদ্ধে মামলা করার মতো কিছু নেই।
যে ড্রাগসের জন্য এতো কাহিনি সেগুলো রয়েছে আরেকজনের হাতে। অবশ্য সেই ছেলে কিছুক্ষণ পরে চলে আসবে এখানে।

অবন্তী বললো,
– কোন ছেলে? যিনি আমার ব্যাগে থেকে প্যাকেট বের করে নিয়ে গেছে?

– হ্যাঁ। উনি ঘন্টা খানিক আগে কল দিয়েছিল। আপনার সঙ্গে বিকেলে কথা বলার সময় নাকি মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছিল। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তিনি এখানেই আসবেন।

সাজু আর কিবরিয়া দুজন মিলে সাহরি শেষ করে নিল। হোটেল থেকে কিনে আনা খাবার খেল। তারপর সাজু কিবরিয়াকে বললো,

– বন্ধু তুমি এখানে থাকো। আমি থানায় যাচ্ছি। ওদের কাছ থেকে আগে স্বীকারোক্তি নিতে হবে তারপর ওদের নিয়েই বাকিদের ধরতে হবে। আশা করি সকাল আটটার মধ্যে সবকিছু হয়ে যাবে। আমি কাজ শেষ হলেই চলে আসবো। যদি দেরি হয় তাহলে ডাক্তার এলে অবন্তীর কি কি পরীক্ষা করতে হবে তুমি খেয়াল রেখো। যো ছেলেটা আসবে তাকে থানায় পাঠিয়ে দিও।

সাজু উঠে দাঁড়ালো। অবন্তী বললো,

– আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।

– আরেকটা প্রশ্ন করি?

– করেন।

– সেদিন হাসপাতালে যে চারজন আপনাকে তুলে আনতে চেয়েছিল সেই চারজনের মধ্যে কেউ কি এই দুজনের মধ্যে ছিল?

– হ্যাঁ এরা দুজনেই ছিল সেদিন।

– ঠিক আছে, সাবধানে থাকবেন।

★★★

থানায় এসে দারোগা সাহেব ও সাজু ভাই একসঙ্গে বসে ওদের তিনজনকে প্রশ্ন করলেন। সচারাচর এরা স্বীকার করবে না এটাই ধারণা ছিল। কিন্তু একজন চুপ থাকলেও আরেকজন সবকিছু বলে দিলেন। দুজনকেই আলাদা করে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। সুতরাং দুজনেই ভাবছে সে হয়তো বলে দিয়েছে।

অবন্তীর স্বামী সোহাগ কাঁদছে। বেচারা কিছু টাকার লোভে এসেছিল। রাবেয়ার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে এরা সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিজের সাবেক স্ত্রীর কাছ থেকে একটা গোপন প্যাকেট বের করে দিলে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। সোহাগের ধারণা ছিল এটা কোনো ব্যাপার হবে না কারণ অবন্তী তাকে ভালোবাসে। তাই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কাজটা করার জন্য রাজি হয়ে যায়। তারপর অবন্তীর বাড়িতে যায় এবং অবশেষে ঢাকায় আসে৷ কৌশলে মিথ্যা কথা বলে তবুও কাজ হলো না। বেচারা!

সোহাগ ও আরেকজনকে থানায় রেখেই বাকি একজনকে নিয়ে রওনা দিল দারোগা শাকিল। টগরকে যেখানে রাখা হয়েছে আপাতত সেখানে যেতে হবে আগে।
ঘন্টা খানিক পরে তারা দক্ষিণ খানের একটা পুরনো বাড়িতে প্রবেশ করে। একটা গুদামঘর থেকে টগরকে উদ্ধার করা হয় কিন্তু সেখানে কর কাউকে পাওয়া গেল না।
তবে সিরাজ নামের সেই কথিত নেতাকে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিরাজ প্রথম প্রথম চিৎকার করলেও পরে যখন জানলো তার বাকি দুজন সবকিছু স্বীকার করেছে তখন চুপচাপ হয়ে গেল। সিরাজকে নিয়ে থানায় এসে দেখে গেল যে ছেলেটার কাছে সেই প্যাকেট এতদিন ছিল সেই ছেলে থানায় বসে অপেক্ষা করছে।

টগরের শরীর বেশি ভালো ছিল না। তবে দুর্বল শরীর নিয়েও সে সচ্ছল রইল। সকাল নয়টার দিকে টগরকে নিয়ে সাজু ভাই হাসপাতালে গেল।

অবন্তীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হলো। তারপর কিবরিয়া বললো,

– একটা ছেলে এসেছিল। তোমার জন্য একটা গিফট রেখে গেছে।

সাজু খানিকটা অবাক হয়ে গেল। কারণ গিফট বক্সের মধ্যে একটা গোলাপী রঙের চাদর। সাজু সেই চাদরের ভাজ খুলে দেখল এক পৃষ্ঠার লম্বা একটা চিঠি। কম্পিউটার টাইপ করার মতো সুন্দর ঝকঝকে হাতের লেখা। সাজু আরো একবার মুখ ফুটে বললো, ” রবিউল “!

সাজু ভাই,
আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
অবাক হবেন না সাজু ভাই, আশ্চর্যজনক দুটো কথা বলার জন্য এই চিরকুট। যদিও এতবড় কখনো চিরকুট হয় না, যেটা হয় সেটা চিঠি। আপনি তো জানেন পুলিশের হাত থেকে আমি পালিয়েছি আট মাস আগে। পালানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু দুটো কারণে আমি শেষ মুহূর্তে ইচ্ছে করেই পালিয়েছি।

(১) সাবরিনা আফরোজ।
গাজীপুরে যে হাসপাতালটা আমি করেছি সেই হাসপাতালের সবকিছু সাবরিনা দেখাশোনা করতো। মানে যাবতীয় লেনদেন সবকিছু তার কাছে ছিল। সাবরিনা বেঈমানী করেছে। শত্রুর ভয়ে কিংবা লোভে পড়ে সে আমার হাসপাতালের সব টাকা খালি করে দিয়েছে। আমার স্বপ্নের হসপিটাল এখন শূন্য। সাজু ভাই বেঈমান কখনো ছাড় দিতে নেই। বিশ্বাসঘাতকতা করা মানুষকে আমি কখনো ক্ষমা করি না। আমার হসপিটালের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সকল যন্ত্রপাতি সাবরিনা বিক্রি করে দিয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকুক তাকে আমি বের করবো ই সাজু ভাই।

(২) লতা চৌধুরী।
বড্ড অদ্ভুত দুনিয়া সাজু ভাই। যে লতা চৌধুরীর জন্য আমি এতকিছু করলাম। আপনাকেও কতো পরিশ্রম করতে হলো সেই সময়। অথচ আমি কোনভাবেই বুঝতে পারিনি এসবের পিছনে লতা চৌধুরীর বিশাল মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। যদি সেটা জানতে পারতাম তাহলে ওর স্বামীর মতো ওকেও ট্রেনে শেষ করতাম। আফসোস হচ্ছে সাজু ভাই। আর সেজন্যই জেলের মধ্যে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারিনি। এই দুজনের শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। লতা চৌধুরীর অনেক বড় একটা প্ল্যান আছে। কিন্তু সেটা কি আমি নিজেও জানি না।

আপনার কাছ থেকে আমার কিছু সাহায্যের দরকার হবে। সেজন্যই আপনাকে স্মরণ করলাম। ঠিক সময় মতো আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো। সাহায্য করবেন কি-না জানি না। তবে আমি চাইবো, বাকিটা আপনার বিবেচনা। আমার উদ্দেশ্য আপনি ঠিকই বুঝতে পারবেন। কারণ আমি জানি আপনি বুদ্ধিমান, খারাপ হবার পরে আমি আপনার মতো কাউকে সম্মান করিনি।
আল্লাহ হাফেজ।

ইতি,
রাফসান মাহমুদ/রবিউল ইসলাম।

★★★

০৮ দিন পর।

মহাখালী টার্মিনালে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে অবন্তী। সে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যাচ্ছে টগর। অবন্তী এখন সুস্থ, অপারেশন করা হয়েছে, যাবতীয় খর সাজু দিয়েছে। কদিন ধরে সাজুর মনোযোগ অন্য দিকে। সে রবিউলের বিষয় নিয়ে ভাবছে। লতা চৌধুরীর এতদিনে নিশ্চয়ই বাচ্চা হয়েছে। কিন্তু সেই মেয়ে কি এমন করেছে যার জন্য রবিউল এরকম কিছু বলতে পারে।

রবিউল যখন পালিয়েছে সেই ঘটনাও পুরোপুরি সে জানে না। হাসান ভাই সবকিছু জানে তাই তাকে জিজ্ঞেস করা দরকার। কিন্তু তিনি এখন ঢাকার বাইরে আছে।

|
|

বাস চলছে, মাগরিবের পরে বাস ছেড়েছে। জানালার পাশে বসে অবন্তী বললো,

– এর আগে আমি আমার স্বামীর সাথে রাতে বাসে ভ্রমণ করেছিলাম। আমরা নদীতে ফেরি পারাপারের সময় মাঝরাতে দুজন মিলে আকাশে জোৎস্না দেখেছি। সেদিন ছিল পূর্ণিমা, কি অপূর্ব দৃশ্য ছিল সেটা আজও চোখে ভাসে।

– টগর বললো, আপনি আপনার স্বামীকে খুব ভালোবাসেন তাই না?

অবন্তী জবাব দিল না। টগর চুপচাপ বসে রইল। আজ যদি পূর্ণিমা হতো তাহলে হয়তো তারা দুজন মিলে দেখতে পারতো। তখন হয়তো অনেকদিন পরে টগর বলতো ” জানো অবন্তী, তোমার সঙ্গে কাটানো সবসময় সুন্দর মুহূর্ত ছিল একসঙ্গে বাড়িতে যাওয়া। কারণ সেদিন ছিল পূর্ণিমা। ”

টগর কিছু বললো না। বাস চলছে আপন গতিতে। অবন্তীকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তাকে কালই ফিরে আসতে হবে। ইদের পরে অবন্তী যাবে চট্টগ্রামে। কারণ সিরাজ ও তার লোকদের খুব বেশি শাস্তি হবে না। অবন্তী এখানে এলে আবারও তার উপর বিপদ আসতে পারে। সাজু ভাই চট্টগ্রামে তার এক পরিচিত আঙ্কেলের ঠিকানা দিয়েছে অবন্তীকে। ইদের পরে যোগ করলে চাকরির ব্যবস্থা হবে।

★★★

রবিউলকে এই গল্পের মধ্যে পুরোপুরি রাখিনি। কারণ আমি চাই রবিউল যেখানে থাকব সেই গল্পের পুরোটা তার থাকবে। আর যেহেতু তার চাদর জড়ানো চিরকুট দিয়ে একটা অমিমাংশা ছিল তাই সেখান থেকেই সে ফিরবে। তাছাড়া তার ফাঁসির আদেশ হবার পরে কি কি ঘটেছে, কীভাবে সে পালিয়েছে এটাও লম্বা ইতিহাস। তাই আলাদা করে তাকে নিয়ে শুরু হবে।
এবার অপেক্ষা,
” চাদর জড়ানো চিরকুট “এর দ্বিতীয় খন্ড।
যেখানে অদ্ভুত লতা চৌধুরীর আবির্ভাব আবার দাদাজানের নতুন পরিচয়ে নির্বাচন করা।
সাবরিনার বিশ্বাসঘাতকতার কারণ।

— “সেদিন ছিল পূর্ণিমা” এখানেই সমাপ্ত —-

~~~ মো:- সাইফুল ইসলাম।