স্মৃতির শহর পর্ব-০৬

0
456

#স্মৃতির শহর
#পর্বঃ৬
#তানিশা সুলতানা

বাড়ি ফিরে নিজের রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। মনটা ভীষণ খারাপ। মন খারাপের কারণটা অজানা রাইয়ের।

“ওই যে ম্যাডাম নুডলসটা খেয়ে নাও
ব্যস্ত ভঙ্গিতে বিছানায় নুডলসটা রাখতে রাখতে বলে আদি।
রাই চমকে ওঠে। চোখ ঘুরিয়ে আদির দিকে তাকায়।
” কথা কানে যাচ্ছে না? জলদি আসো।
নুডলস চামচে মোরাতে মোরাতে বলে আদি।
“একটু পরে খাবো।
রাই রিনরিনিয়ে মাথা নিচু করে বলে।
” থাপ্পড় খেতে না চাইলে তারাতাড়ি চলে আসো।
বেশ শক্ত গলায় বলে আদি। রাই ধীর পায়ে আদির পাশে এসে দাঁড়ায়।
“বসার জন্য পালকীর ব্যবস্থা করতে হবে?
রাই দাঁত কটমট করতে করতে বসে।
” হা করো।
রাই বড়বড় চোখ করে তাকায় আদির দিকে।
“খেতে বললাম না
ধমক দিয়ে বলে আদি।
রাই ভয়ে থমথমে খেয়ে যায়। চটজলদি হা করে রাই।
” গুড
কয়েকবার খাওয়ার পরে রাই কাশি দেয়। আদি পানি এগিয়ে দেয়। রাই খেয়ে নেয়।
“আপনি খাবেন না?
রাই বলে। আদির চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। মনে মনে এই সময়টার অপেক্ষায়ই যেনো ছিলো। একটু নরেচরে বসে আদি।
” আমার হাত ব্যাথা। মুখ অব্দি হাত উঠবে না। তুমি খেয়ে নাও
দুখি দুখি মুখ করে বলে আদি।
“আমি খাইয়ে দেই?
মাথা নিচু করে চোখ খিঁচে বন্ধ করে বলে রাই। মনে হচ্ছে এখুনি চর পরবে দুই গালে। রাই দুই গালে হাত দেয়।
আদি মুচকি হাসে রাইয়ের অগোচরে।
” কি হলো খায়িয়ে দাও
আদি হা করে বলে। রাই ধপ করে চোখ খুলে। খায়িয়ে দেয় আদিকে। কেমন একটা জড়তা কাজ করছে রায়ের ভেতরে। তবে এই লোকটা রায়ের জন্য এতোকিছু করছে এইটুকু তো রাই করতেই পারে।
“শোনো আমার পারমিশন ছাড়া এক পা রুমে বাইরে রাখবা তো পা কেটে হাতে ধরিয়ে দেবো বলে দিলাম।
ধমক দিয়ে বলে আদি।
রাই নাক ফুলায়। ভালো ভাবে বলা যেতো না? সব সময় একটা লাটসাহেবি ভাব। রাইয়ের যদি একটু সাহস থাকতো না তাহলে এক ঘুসি দিয়ে নাক ফাটিয়ে দিতো।
” মাথায় ঢুকেছে?
মাথায় চাটি মেরে দাঁত কটমট করে বলে আদি।
রাই কাঁদো কাঁদো ফেস করে মাথায় হাত বুলায়।
“হনুমান একটা
দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করপ বলে।

🥀🥀🥀
আদি ভার্সিটিতে চলে গেছে। রাইকে যেতে না করেছে। শরীরের অবস্থা ভালো না। বমি করতে করতে বেহাল দশা। আদিও যেতো না কিন্তু জরুরি কিছু কাজ পরে গেছে। সাথে কিছু বাজারও করতে হবে। এক কাজে দুই কাজ হয়ে যাবে ভেবে যায় আদি।
রাই গোছল সেরে গোলাপি একটা থ্রি পিছ পরে নেয়। এটা আদি হাসপাতাল থেকে ফেরার পথেই কিনেছে রাইয়ের জন্য। অনেক গুলো জামা কিনে দিয়েছে।

চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে একটু হাঁটতে বের হয়। এখানে আসার পর থেকে চারপাশটা দেখায়ই হয় নি। কারো সাথে পরিচয় হয় নি। আদিও বাসায় নেই এই সুযোগেই রাই বেরিয়ে পরে।

দরজা খুলে দরজা লক করে যেই না পা বাড়াবে
“এই মেয়ে শুনো
একটা মধ্য বয়সি মহিলা ডাকে। রাই থেমে যায়। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে মহিলার দিকে এগিয়ে যায়।
” বলুন আন্টি
“নাম কি তোমার? এখানে নতুন?
রাইয়ের হাত ধরে বলে মহিলাটি।
” আমার নাম রাইসা সুলতানা। এখানে কালকেই এসেছি।
“আমি এখানে পৌরসু এসেছি। আসলে ছেলে এখানে নিয়ে এসেছে। ওর না কি বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছে না। পরিবেশ পাল্টানোর জন্য এসেছি। কিছুদিন থাকবো।
মহিলাটি এক গাল হেসে বলে।
” আমি মেবি এখানে পার্মানেন্টলি থাকবো। আসলে উনি এ বিষয়ে কিছু বলে নি।
মাথা নিচু করে বলে রাই।
“তুমি বিবাহিত?
মহিলা টির কথায় চমকে ওঠে রাই। কি বলা উচিৎ এখন? হাত দিয়ে ওড়না গিট্টু দিতে থাকে।
মহিলাটি হয়ত বোঝে।
” এসো না আমার বাড়িতে। আমি খুব ভালো চা করতে পারি। তোমাকে খাওয়াবো। আমার ছেলে তো সব সময় মা চা দাও মা চা দাও বলে চেঁচায়।
তাহলে ভাবো কতো ভালো চা বানায় আমি?
রাইয়ের হাত ধরে এক প্রকার টেনে নিয়ে যায় মহিলাটি।
রাই কিছু বলার সুযোগ পায় না।।

রাইদের ফ্লাইটের থেকে এটা অনেকটা ছোট। কিন্তু বেশ পরিপাটি। দুটো রুম এখানে। মহিলাটি রাইকে বসতে বলে চলে যায় চা বানাতে। চা খেতে খেতে না কি অনেক কথা বলবে।
রাইয়ের বিরক্ত লাগছে। বাসায় সারাক্ষণ বসে থাকতে হয় বলে একটু হাঁটতে বের হচ্ছিলো। এখানে এসে আবার সেই বসতেই হবে। বিরক্তিকর।

“আমার আমাকে চা দিও
কোনার একটা রুম থেকে কোনো একটা ছেলে বলে। রায়ের ভেতরটা মোচর দিয়ে ওঠে। চোখ দুটো টলমল করে। মুখে এক চিলতে হাসি ফোঁটে।
” বিহান
অস্ফুরণ কন্ঠে বলে।
ধিরে পায়ে এগিয়ে যায় ওই রুম টার দিকে।
দরজায় দুই বার কড়া নারে।
“মা তুমি আবার পারমিশন নিচ্ছো কবে থেকে?
এক গাল হেসে বলে বিহান। রাই শুধু কথা ভাজে হাসিটা বুঝতে পারে।
বুকে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে।
বিহান উপুড় হয়ে শুয়ে ফোন দেখছিলো।

” মা জানো একটা চাকরির অফার পেয়েছি। এবার সবটা ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে আমি ইয়া বড় একটা গাড়ি গিফট করবো দেখে নিও।
মিষ্টি হেসে বলে বিহান।
রাইয়ের চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পরছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে।
“ও মা কথা বলছো না কেনো?
বিহান পেছনে ঘুরে রাইকে দেখে চমকে ওঠে। এক লাফে উঠে বসে। চোখ ডলে আবার তাকায়। রাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
” তুমি এখানে?
বিহান কপালে দুটো ভাজ ফেলে বলে।
রাই বিহানের দুই গালে হাত রাখে। অসম্ভব রকম ঠোঁট কাঁপছে। হাত দুটোও কাঁপছে।
“তোমাকে কতো খুঁজেছি আমি জানো? কোথায় হারিয়ে গেছিলে বলো?
” আচ্ছা জান, তুমি না বলতা তুমি আমাকে ভালোবাসো? তাহলে যাকে ভালোবাসো তার সাথে কথা না বলে, তাকে দেখে এতোদিন কি করে থাকতে পারলে?
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে রাই।
বিহান রাইয়ের হাতের ওপর নিজের হাতটা রাখে।
এই মেয়েটার প্রতি কোথাও না কোথাও বিহানের দুর্বলতা আছে। নাহলে কেনো ওর মুখের দিকে তাকালে বুক ধুকপুক করে?
“কেনো পালিয়ে এলে? কি ভেবেছিলে? আমি আমার বাচ্চার অজুহাত দিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে ফোর্স করবো?
তাচ্ছিল্য হাসে রাই।
” আমি তো কখনো আমার বাবার কাছেই মাথা নিচু করি নি। হাত পেতে কখনো কিছু চায় নি। আর তুমি তো আমাকে ব্যবহার করেছো এটা জেনেও আমি তোমাকে জোর করবো ভাবলে কি করে?
বিহানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয় রাই।
চোখের পানি মুছে নেয়।
“হায় রে মানুষ,,,,
এতোটা স্বার্থপর কি করে হতে পারে? বিবেকে বাঁধলো না?
আমি তো তোমাকে খুঁজছিলাম এটা জানতে কেনো করলে আমার সাথে এমনটা? কেনো? সারাক্ষণ ভালোবাসি ভালোবাসি বলে পাগল করে দিতে। তাহলে যাকে ভালোবাসো তার জীবনটা কি করে নষ্ট করলে তুমি? কি করে তাকে অপবিত্র বানিয়ে দিলে?
থেমে একটু দম নিয়ে আবার বলে রাই।
“আমি জানি সেদিন তুমি ইচ্ছে করে আমার জুসে ডিংক মিশিয়ে দিয়েছিলে। আর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে গেছিলে। তবুও চুপ করে ছিলাম কারণ
তখন সিনক্রিয়েট করে না পারতাম আমার সম্মান ফেরাতে আর না পারতাম আমার সাথে হওয়া অন্যায় টাকে মুছে ফেলতে।
রাই একবার ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে।
” ভালো করলে না বিহান। খুব খারাপ করেছো তুমি। আমি যতটা না কষ্ট পেলাম তার দ্বীগুন কষ্ট তুমি পাবে অভিশাপ দিলাম তোমায়।
আমার কষ্ট একদিন ঠিক দুর হবে কিন্তু তুমি কখনোই ভালো থাকতে পারবে না।

রাই উঠে দাঁড়ায়।
“আর হ্যাঁ কখনো ভুলেও আমার বাচ্চাটার ওপর অধিকার দেখাতে যাবে না৷ নাহলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো। আমার বাচ্চাটা শুধুই আমার।

বেরিয়ে যেতে নেয় বিহানের রুম থেকে। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো বিহানের মা। সবটা শুনে নিয়েছেন উনি। ওনার চোখের কোনেও পানি চিকচিক করছে।
“সরি আন্টি। কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দেবেন।
বলেই চলে যায় রাই

বিহান নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাই ওকে একটা কথা বলার সুযোগ দিলো না। আর সুযোগ দিলেই বা ও কি বলতো? বলার মতো কোনো কথা না কি?
তবে আজকে রাইয়ের মুখটা দেখে বুকের বা পাশে চিনচিন করছে বিহানের।
এমনটা না করলেও পারতো রাইয়ের সাথে। অন্তত একলা থাকার দিয়ে বলতে পারতো। আমার জীবনে একটা সময় রাই নামের কেউ ছিলো।
কিন্তু এখন তো নামটা উচ্চারণ করতেও বিহানের কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে।
” আদিকে ঠকাতে গিয়ে নিজেই পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। কি করে ফেললাম?
মাথার চুল খামচে ধরে হাঁটু মুরে বসপ পরে বিহান। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতল ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। এক দিক দিয়ে মেয়েরাই ভালো অন্তত কষ্ট হলে শান্তি মতো একটু কান্না তো করতে পারে।

চলবে