স্মৃতির শহর পর্ব-০৭

0
469

#স্মৃতির শহর
#পর্বঃ৭
#তানিশা সুলতানা

রাই কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আসছিলো। দরজার কাছে এসেই জোরে স্বরে ধাক্কা খায় আদির সাথে। পরে যেতে নিলে আদি হাত ধরে ফেলে। রাই মাথা নিচু করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এখনো চোদ্দ দিয়ে টুপটুপ করে পানি গড়িয়েই যাচ্ছে।
আদি কপালে তিনটে ভাজ ফেলে তাকিয়ে আছে রাইয়ের দিকে। এই মেয়েটা সত্যিই অদ্ভুত। আগে তো এমন ছিলো না। এভাবে কোনো মেয়ে ধাক্কা খেলে নির্ঘাত ভয় পেয়ে যেতো চমকে উঠতো। কিন্তু ও একদম স্বাভাবিক। মনে হয় কিছুই হয় নি।
রাইয়ের চোখে পানি দেখে টনক নরে আদির। দরজা খুলে আগে আগে ভেতরে ঢুকে। রাই মাথা নিচু করে পেছনে পেছনে আসে।
“কাঁদছো কেনো?
দরজা লক করে রাইয়ের হাত ধরে বলে আদি।
রাই বা হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলার চেষ্টা করে।
“মুছে লাভ নেই। আমি দেখে নিয়েছি। এবার বলো?
কিছুটা গম্ভীর গলায় বলে আদি।
” এমনি
রাই রিনরিনিয়ে বলে।
“এমনি কেউ কাঁদে?
আদি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
” আমি কাঁদি।
কিছুটা শক্ত গলায় বলে রাই। আদি রেগে যায়। রাইয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে রাইয়ের নিচু হওয়া মাথাটা উঁচু করে তোলে।
“একদম আমার মুখের ওপর টাস টাস কথা বলার সাহস দেখাবা না। হাত পা ভেঙে রেখে দেবো।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে আদি।
রাই চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ওঠে।
” সরি
আদি চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে। তারপর রাইয়ের দুই গালে হাত দিয়ে রাই মুখের দিকে তাকায়। কেঁদে কেঁদে মুখটা লাল হয়ে গেছে। সারা মুখে পানি লেগে আছে। চোখের পাপড়ি গুলো ভিজে আছে। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে।
আদি খুব যত্ন সহকারে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। রাই এখনো চোখ বন্ধ করে আছে।
“বলো আমায়? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে।
খুব নরম গলায় বলে।
রাই মাথায় মানে কেউ কিছু বলে নি।
” তাহলে কি হয়েছে?
রাইয়ের সাহসটা হুট করেই বেরে যায়। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে আদির বুকে মাথা রেখে শার্ট খামচে ধরে।
হকচকিয়ে যায় আদি। রাই তো এরকম করার মেয়ে নয়। তাহলে কি আজ খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে?
রাইয়ের চোখের পানি আদির শার্ট ভেদ করে বুকে লাগছে। ঠান্ডা পানিতে বুকটা শিতল হয়ে যায়। মুচকি হাসে আদি।
” সারাজীবন এভাবেই আগলে রাখবো তোমায়। কথা দিলাম
রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে বলে আদি।
হঠাৎ আদির চোখ যায় রায়ের মাথার ঠিক মাঝ খানে কাটা দাগ। দাগটা খুব গভীর। ওই খানে চুলও নেই।
ভ্রু কুচকে তাকায় আদি। এই মুহুর্তে রাইকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা ভালো দেখায় না। তাই আদি চেপে যায়।

“আপনি তো আমায় এখানে রেখেছেন
বিহান যতদিন না আসে ততদিন কার জন্য। কিন্তু আপনি কি জানেন বিহান কখনোই আসবে না।
আদির বুক থেকে মাথা তুলে বলে রাই।
” তাই
কে বললো? আর ও আসলেই তুমি চলে যেতে না কি?
আদি বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলে।
রাই মাথা নিচু করে কাঁদছে।
“আমি জানি না। আমি কি করবো? পাগল পাগল লাগছে আমার। কোথায় যাবো আমি।
মাথার চুল খামচে ধরে ছটফট করতে করতে বলে রাই।
আদি রাইয়ের হাত ধরে
” রিলাক্স
এভাবে পাগলের মতো করছো কেনো?
হঠাৎ করেই আদি রাইয়ের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। মেয়েটা ছটফট করেই যাচ্ছে। নিজের চুল নিজে টানছে।
“শেষ একটা হেল্প করেন আমায়। বাচ্চাটা নষ্ট করে দিতে চাই আমি। একটু সাহায্য কর
রাইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই
আদি রাইয়ের হাত ছেড়ে দেয়। ঠাস করে রাইয়ের গালে থাপ্পড় দেয়। রাই থেমে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে গালে হাত দিয়ে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।
“নিজের ভুলের শাস্তি একদম ওই নিষ্পাপ শিশুকে দিতে চাইবে না। ওর কোনো হ্মতি আমি হতে দেবো না।
চিৎকার করে বলে আদি।
রাই বেশ ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে জরোসরো হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এতোটা রেগে কেনো গেলো? বাচ্চাটার সাথে তো ওনার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই? তাহলে?
“তুমি আমার বউ। তোমার বেবির দায়িত্ব আমি নেবো। তুমি চাইলেও না চাইলেও। আমি তোমার মতো বেইমান না। কথা দিয়ে কথা রাখতে জানি আমি।
একজনকে কথা দিয়ে অপেক্ষায় রাখবো ” আপনি আসবেন তো আমায় নিতে? আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য ” আর বছর না ঘুরতেই অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক। এটা তোমাকে দিয়ে সম্ভব।
আদিল চৌধুরী বরাবরই কথা রাখে। একজনকে অপেক্ষায় রেখে আরেকজনের সাথে সম্পর্ক করে না।

চিৎকার করে কথা গুলো বলে চলে যায় আদি। আপনাআপনি রাইয়ের কান্না থেমে যায়। কি বলে গেলো লোকটা? কিসের অপেক্ষা?

আবার আসে আদি।
“এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি দুধ গরম করে দিচ্ছি খেয়ে নেবে।
ধমক দিয়ে বলে আদি।
” রাহ্মস একটা
বিরবির করতে করতে চলে যায় রাই।
আদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

🥀🥀🥀
স্মৃতি ভালো হোক বা খারাপ তা সারাজীবন আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়।
খুব ভালোই যাচ্ছেলো দিন। দশ বছরের ছোট্ট রাইয়ের সব আবদারের ঝুঁড়ি ছিলো আদি। যখন তখন হুট করে চলে আসতো আদির বাড়িতে। এমনও অনেক রাত গেছে রাই আদির গলা জড়িয়ে ঘুমিয়েছে।
বয়স বাড়তে থাকে রাই। সাথে অনুভুতি গুলোও গাড়ো হতে থাকে। বাড়তে থাকে সৎ মায়ের অত্যাচার। অবশ্য রাই সেগুলো কখনোই পরোয়া করে নি। বাড়িতে থাকতোই কয়েক ঘন্টা
পনেরোতো পা দিতেই রাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। আবদার করে বসলো আদির বাবার কাছে
“আংকেল আমি আপনাদের বাড়িতে থাকতে চাই? রাখবেন আমায়।
আদির বাবা মুচকি হেসে পারমিশন দিয়ে দিয়েছিলো। বাবাকে বলে দিয়েছিলো প্রতিমাসে টাকা পাঠিয়ে দিতে।

দিনটা ছিলো ১৫ই আগস্ট। সেদিন লাগেজ নিয়ে রাই পারমানেন্টি চলে এসেছিলো আদির বাড়িতে। আদি অবশ্য এসব জানতো না।
আদির পাশের রুমই ছিলো অহির রুম। রাই আর অহি এক রুমে থাকতো।
রাই মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় আদিকে প্রপোজ করার।
আদির মায়ের থেকে জর্জেট নীল রংয়ের একটা শাড়ি নিয়ে ইউটিউব দেখে পরে নেয়। সাথে ম্যাচিং নিল কানের দুল কানের পিঠে গুঁজে নেয় টকটকে খয়েরী গোলাপ।
রাত তখন আনুমানিক এগারোটা। আদি পড়ালেখার পাশাপাশি ছোট খাটো একটা জব নেয়। যার জন্য ফিরতে রাত হয়।
নিজের রুম থেকে বেলি ফুলের তাজা ঘ্রাণ আসায় আদি দরজার বাইরে কিছুখন দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় অন্ধকার রুম। বেশ খানিকটা অবাক হয় আদি। এভাবে কখনোই রুমটা অন্ধকার থাকে না।
সুইচ দিতে গেলেই এক জোড়া নরম হাত বাঁধা দেয় আদিকে।
ছোঁয়াটা চিনতে খুব বেশি দেরি হয় না আদির।
” রাই তুমি এখানে এতো রাতে?
রাই আদির কথার উওর না দিয়ে আদিকে টেনে বেলকনিতে নিয়ে আসে। সেখানে লাইট জ্বলছে।
রাইয়ের দিকে তাকাতেই থমকে যায় আদি। এতো সুন্দর কেনো মেয়েটা?
ধপধবে সাদা পেটে নীল আবরণ। ঢোক গিলে আদি। রাইয়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
“শোনো আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে পারি না। সোজা সাপটা বলে দিচ্ছি।
আদির মুখো মুখি দাঁড়িয়ে বলে রাই।
আদি হাতে থাকা ফাইলের ব্যাগটা পাশে রেখে বেলকনিতে থাকা দোলনায় বসে পরে।
” বলো কি বলবে?
দুই গালে হাত দিয়ে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে আদি।
“ভালোবাসি তোমায়। তোমার সাথে থাকতে চাই। বিয়ে করতে চাই তোমায়।।
আদির পাশে বসে আদির কাঁধে মাথা রেখে বলে রাই।
আদি মুচকি হাসে। রাই যে ওকে ভালোবাসে এটা ও আগে থেকেই জানে। এবং নিজেও রাই নেশায় আসক্ত।
” আমিও ভালোবাসি।
রাইয়ের চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে আদি।
রাই খিলখিল করে হাসে।
কেমন নেশা নেশা লেগে যাচ্ছে আদির।
এতোটা না সাজলেও পারতো।
আদি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাইয়ের মুখের দিকে। রাই হাতে বেঁধে রাখা বেলি ফুলের মালা টার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে।
“রাই
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে আদি।
” হুমম বলো না
আদির দিকে তাকিয়ে বলে রাই।
“না মানে কিভাবে বলবো
তুমি যদি
আদির গলা শুকিয়ে আসছে।
রাই আদির হাতের ওপর হাত রাখে।
“আমাকে কিস করতে চাইলে একটা প্রমিজ করতে হবে।
মিষ্টি করে হেসে বলে রাই।
কি মেয়েরে বাবা না বলতেও বুঝে গেলো? বিন্দু মরিচে ঝাল বেশি। নাক টিপলে দুধ বের হয় আর সে এখন কিস করাও বোঝো।
মনে মনে বলে আদি। জোরে বললে রেগে বম হয়ে যাবে।
” কি প্রমিজ?
উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে আদি।
“আমার ঠোঁট ছোঁয়ায় ইচ্ছে থাকলে সিগারেটকে ঠোঁটে নেওয়া যাবে না। আর যাই হোক রাইসা সুলতানা পোরা ঠোঁটের স্বাদ নেবে না।
ভাব নিয়ে বলে রাই।
” বাহহহহ বা নাক টিপলে দুধ বের হয় আর সে এখন কিসও বোঝে?
আদি বলেই ফেলে।
রাই কোমরে হাত দিয়ে আদির দিকে তাকায়।
“বের করে দেখা না পারলে তোর চুল ছিঁড়বো
রেগে আদির চুল গুলো মুঠ করে ধরে বলে রাই।
আদি বাঁকা হেসে উন্নক্ত পেটে শীতল হাতটা রেখে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে নেয়।

🥀🥀🥀🥀
শব্দ করে হেসে ওঠে আদি। রাই পাশে বসেই দুধ খাচ্ছিলো। এই প্রথমবার হাসতে দেখলো লোকটাকে। যে কারণেই হাসুক লোকটার হাসি যেনো সারাজীবন থাকে। রাই মনে মনে বলে।
রাই নিজেও একটু হাসে। এক চুমুকে পুরো দুধটা শেষ করে ফেলে।
” শেষ
গ্লাস উপুর করে দেখিয়ে বলে রাই।
“গুড গার্ল
রাইয়ের চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে আদি।
রাই কিছু বলে না।
” আচ্ছা তোমার মাথার ওই কাটা দাগটা কিসের?
কেটে গেছিলো কি করে?
রাইয়ের হাসি হাসি মুখটা কালো হয়ে যায়। আপনাআপনি হাতটা চলে যায় মাথায়।
“জানি না কি হয়েছিলো। তবে এইটুকু মনে আছে। দুই বছর আগে আমি হাসপাতালে ছিলাম। খুব কষ্ট হতো। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা ছিলো। মাঝে মাঝে বাবা ছাড়া আর কাউকেই পাশে দেখতাম না। সারাক্ষণ একা থাকতাম। ডাক্তার অনেক ব্যাথা দিতো। কেউ হাতটা ধরে বলতো না এখুনি ঠিক হয়ে যাবে। একটু পানি খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। কখন নার্স আসবে আর আমার গালে একটু পানি দেবে।
দাদিমা বলেছে আমার মা মারা গেছে। মা বেঁচে থাকলে হয়ত তখন আমার সাথে থাকতো। আমার জীবনটা সুন্দর হতো। আমিও একটু সুখ পেতাম।
আমি সেই সব দিন মনে করতে চাই না।
রাইয়ের চোখের কোনে পানি চলে আসে।

দাদি বলেছে মানে? রাইয়ের মনে নেই ওর মা মারা গেছে? তাই বলি যে মেয়ে প্রতিদিন মায়ের কবর জড়িয়ে কান্না করতো সে কি করে একটা বার মায়ের কবরে না গিয়ে থাকে।

” জানেন যার মা নেই তার পৃথিবীতে কেউ নেই। বাবারা বরাবরই স্বার্থপর হয়। আমি কখনোই আমার সন্তানকে একা ফেলে চলে যাবো না। আমি সারাজীবন ওর সাথে থাকবো। যদি কখনো আমার মৃত্যু নিকটে চলে আসে তাহলে আমার আল্লাহর কাছে শেষ চাওয়া হবে আমার সাথে যেনল আমার সন্তানও পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। কারণ আমি যে কষ্ট পেয়েছি। আমি চাইনা আমার সন্তান সেই কষ্ট পাক।
রাই চোখের পানি মুছে নেয়।
আদি রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“তোমার মায়ের কবর দেখতে যাবে? তোমার মায়ের স্মৃতির শহরে যাবে? যেখানে মায়ের গন্ধ পাবে। মাকে অনুভব করতে পারবে? যাবে?
রাই খুশি হয়ে মাথা নারায়।
ও তো খুব করে চায় মা কে অনুভব করতে। মায়ের মুখটা মনে করতে। কিন্তু পারে না। মনেই পরে না মায়ের মুখটা।

চলবে