স্মৃতির শহর পর্ব-০৮

0
450

#স্মৃতির শহর
#পর্বঃ৮
#তানিশা সুলতানা

পড়ন্ত বিকেলে লাল পেরে গোলাপি শাড়ি পরে বাড়ির সামনে বাগানে বসে আছে রাই। মনটা খুব ভালো।
অপেক্ষা করছে আদির জন্য। অবশ্য অপেক্ষা করতে ভালোই লাগছে।
বিকেলের ফুরফুরে বাতাসটা মনটা ছুঁয়ে যাচ্ছে। চুল গুলো খোপা করে তাতে বেলি ফুলের মালা দিয়েছে। আদি ফুল আর শাড়িটা কিছুখন আগেই এনে দিয়েছে। খুব রোমান্টিক হাসবেন্ড হতো আদি। যদি রাইয়ের সাথে বিয়েটা মন থেকে হতো। যদি কোনো ঝামেলা না থাকতো।
ইন ফিউচার যখন রাই আদির ডিভোর্স হয়ে যাবে তখন আদি যাকে বিয়ে করবে সে খড়গ লাকী হবে। এমন হাসবেন্ড ভাগ্য করে পাওয়া যায়।
অনমনে হাসে রাই। বিহান আর ওর রিলেশনটা ঠিকঠাক থাকলে আজকে অন্য রকম হতো জীবনটা।

বিহান নিজের রুমের জানালার দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাইয়ের দিকে। আগে কখনো শাড়িতে দেখে নি রাইকে। আজকেই প্রথম দেখছে। মেয়েটা সত্যিই নজর কারা সুন্দরী আর মায়াবী।
এই মেয়েটার সাথেই বিহান জঘন্য কাজটি করে ফেলেছে।
ভাবতেই নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে বিহানের।
কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে বিহান রাইয়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। পাশে তাকিয়ে মাকে দেখতে পায়।

“অলওয়েজ আদি আমার থেকে ভালো রেজাল্ট করে। সব সময় ফাস্ট। আমার ভালো লাগার জিনিস গুলো আমার আগেই ও নিয়ে নিতো। খুব হিংসে হয় ওকে আমার। আমি তো ওর থেকে বেটার কিছু ডিজার্ভ করি। প্রথম দেখায় রাইদকে ভালো লেগে যায়। বেপারটা আদির কাছে শেয়ার করব ভাবি তখনই জানতে পারি রাই অহির বেষ্টফ্রেন্ড। আদির সাথে সম্পর্ক খুব ভালো। আমি যখন ভাবলাম রাইকে প্রপোজ করবো তার আগেই আদি প্রপোজ করে বসলো। রিলেশনশিপ এ গেলো। সয্য করতে পারছিলাম না। মেনে নিতে পারছিলাম না। জেদ হলো রাইকে ওর থেকে কেরে নেবো।
রাইদকে ও ডিজার্ভই করে না।
আদি বিদেশে যাওয়ার পরে ছলে বলে রাইয়ের কাছে ঘেসার চেষ্টা করতাম পারতাম না। সারাক্ষণ আদির কথা ছিলো মেয়েটার মুখে। আদির সাথে ঝগড়া লাগলে আমাকে এসে রিকোয়েস্ট করতো আদির সাথে কথা বলিয়ে দিতে। কতোটা খারাপ লাগতো আমার?
অপেক্ষা করতে লাগলাম রাইকে নিজের করে পাওয়ার। একবার ভাবলাম জোর করবো মেয়েটার সাথে। কিন্তু বিবেক বাঁধা দিলো।
তারপর যখন জানতে পারলাম রাইয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছে স্মৃতি শক্তি হারিয়ে গেছে। খুব খুশি হয়েছিলাম। এক টুকরো আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালাম।
হাসপাতালে রাই একা একা থাকতো। তখন সুযোগ বুঝে রাইকে সময় দিতাম। হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতাম।
রাই সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে বন্ধুত্ব করে বসলাম। আস্তে আস্তে ভালোবাসতে শুরু করলো ও আমায়।
তারপর আদির বাড়ি ফেরার কথা শুনে ভয় জেগে বসলো মনে। রাইকে বিয়ের প্রপোজাল দিলাম। বললো সময় প্রয়োজন। কিন্তু আমি তো জানতাম। আদি কখনোই রাইকে আমার হতে দেবে না।
অহির বার্থডেতে সুযোগ পেয়ে গেলাম। ভেবে নিলাম রাইকে পুরোপুরি রাইকে আমার করে নেবো। যাতে চাইলেও রাই আমায় ছাড়তে না পারে। করলামও তাই।
কিন্তু দেখো মা কি হয়ে গেলো?
আবারও হেরে গেলাম আদির কাছে।
মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলে বিহান।
” ভেবেছিলাম আমি ইগনোর করলে এটিটিউট দেখালে রাই অসহায়ের মতো আমার হাতে পায়ে ধরবে। আমার পেছনে ছুটবে। আর আমি সেটা আদিকে দেখাবো আর মজা নেবো। এখন আদি আমার সাথে মজা নিচ্ছে।
সয্য করতে পারছি না আমি।
দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বিহান।
“এখনো সুযোগ আছে বিহান।
বিহান ফট করে মায়ের (তানিশা সুলতানা) দিকে তাকায়। চোখ দুটো চকচক করে ওঠে।
” কি সুযোগ মা?
“রাইয়ের পেটে তোর সন্তান। এই সন্তানের জোরেই রাইকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
” কিন্তু মা
“কোনো কিন্তু না। তুই রাইকে ফোর্স করবি। বাকিটা আমি বুঝে নেবো।
মাকে জড়িয়ে ধরে হাসে বিহান।
এই একটা মানুষ যে সব সময় বিহানকে সাপোর্ট করে যে কোনো পরিস্থিতিতে।
(তানিশা সুলতানা)

দশ মিনিট অপেক্ষা করার পরেও আদি আসছে না বলে রাই এবার বিরক্ত হয়।
উঠে দাঁড়ায়। মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়।
বাড়ির দিকে ঘুরতেই চমকে ওঠে রাই।
ওর সামনে বিহান দাঁড়িয়ে আছে। রাই ভেতরে কষ্ট পেলেও মুখে হাসি টানে। নিজের দুর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ করতে নেই।
” আপনি এখানে ভাইয়া? কিছু বলবেন?
মাথার ঘোমটাটা আরও একটু টেনে নিয়ে এক গাল হেসে বলে রাই।
বিহানও হাসে। নিজের কষ্ট বুঝতে দেবে না বলেই যে এতো চওড়া হাসি সেটা বিহান ভালো করেই জানে।
“বলার তো অনেক কথাই আছে। পরে বলবো।
এখন বলো আমার চ্যাম্প কেমন আছে? চেকআপে করিয়েছে?
রাইয়ের পেটের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে বিহান।

আদি দরজা লক করে বাগানের দিকে এগিয়ে আসতেই রাইয়ের হাসি মুখটা চোখে পরে। সামনে বিহান দাঁড়ানো।
বিহানকে দেখে দাঁত কেলাচ্ছে কেনো মাথায় ঢুকছে না আদির।
রাগে হাত মুঠ করে নেয়। কপালের রগ ফুটে উঠেছে। মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে রাইয়ের।
“সরি ভাইয়া আপনার চ্যাম্প কে জানি না?
কিন্তু আমার বেবি ভালো আছে। ওর পাপা মাম্মা আছে তো ওর সাথে। আর আমার বর চেকআপ করাতে নিয়ে গেছিলো। খুব খেয়াল রাখে আমার। দায়িত্ব থেকে একদমই পালিয়ে বেড়ায় না উনি।
মুখে হাসির রেখা টেনে বলে রাই। বিহান চোয়াল শক্ত করে ফেলে।
আদির মুখে এতোখনে হাসি ফোটে।
বিহান তাচ্ছিল্য হাসে।
” ভালোই তো কথা শিখে গেছো।
তবে তুমি কি জানো? তোমার শরীরে যে আছে তার মধ্যে আমারই রক্ত বইছে। এটা অস্বীকার করতে পারো না।
বিহানের কথার ধরনে রাগ হয় রাইয়ের। এবার মুখ থেকে হাসি সরে যায়।
“আমি কখনোই সত্যি অস্বীকার করি না। তবে আপনি রক্তে সম্পর্ক দেখিয়ে কি প্রুফ চাইছেন? না কি বলার চেষ্টা করছে আবার আপনার সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার? আরেকবার আপনাকে বিশ্বাস করতে?

বিহান কিছু বলার আগেই হনহনিয়ে আদি চলে আসে ওদের সামনে।
” রাই চলো
আদি হাতটা বারিয়ে দিয়ে বলে।
রাই বিহানের দিকে এক পলক তাকিয়ে আদির হাতে হাত রাখে।
“বিহান তুই এখানে?
বিহান আদির দিকে দাঁতে দাঁত চেপে তাকায়। আদি সেটা দেখে বাঁকা হাসে।
” সরি দোস্ত তোর সাথে সময় কাটাতাম।কিন্তু বইয়ের আবদার তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে। পরে এক সময় সময় দেবো তোকে।
বিহানের পিঠ চাপকে বলে আদি।
তারপর রাইয়ের হাত ধরে চলে যায়।
বিহান তাকিয়ে থাকে। এটাই দেখার বাকি ছিলো।

🥀🥀🥀
গাড়িতে বসার আগেই আরেক দরফা বমি করে নেয় রাই। এবারের বমিটা হয়েছে সিগারেটের গন্ধে।
আদি রাইয়ের এক হাত ধরে হাঁট ছিলো আরেক হাত দিয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো।
রাই না করতে চাই ছিলো। কিন্তু সাহস পায় না। ফলে এখন বমি করলো।
আদি রাইকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। ছিটে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে রাই।
“খুব বেশি খারাপ লাগছে? নাহলে যাবো না?
রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে আদি।
” সিগারেটের গন্ধ সয্য হয় না আমার।
রিনরিনিয়ে বলে রাই।
আদি এক ঝটকায় রাইয়ের থেকে দুরে সরে যায়।
গাড়ি থেকে নেমে ভালো করে কুলি করে নেয়।
আগেই বোঝা উচিত ছিলো। এভাবে সিগারট না খেলেও পারতো।

একদম ধীরে ধীরে গাড়ি ডাইভ করছে আদি। রাইয়ের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। রাই এক মনে চিপস খাচ্ছে আর আড় চোখে আদির দিকে তাকাচ্ছে।

🥀🥀🥀
দিনটা ছিলো রায়ের ষোলতম জন্মদিন। সারাবছর কেউ খোঁজ না নিলেও নিয়ম করে জন্মদিনের দিন সবাই কিছু না কিছু উপহার দিতো রাইকে।
এসএসসি পরিহ্মা চলছে। এক্সাম দিয়ে বাসায় আসার পরে সবাই রাইকে গিফট দেয়। পার্সেলে পাঠিয়েছে। রাইয়ের সৎ মাও সেদিন রাইকে গিফট দিয়েছিলো৷ একটা স্বর্নের চেইন। আর বাবা দিয়েছিলো মায়ের সাথে রাইয়ের একটা ছবি। মানুষ সমান বড় করে সেটা রাইয়ের দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছিলো। খুব ভালো লেগেছিলো রাইয়ের। বাবা আর সৎ মায়ের একটা ভালো গুন ছিলো। সেটা হলো প্রতিমাসে নিয়ম করে হাত খরচের টাকা দিতো। আর মা জামাকাপড় কিনে দিতো। আর জন্মদিনের দিন ভালো ভালো রান্না করে খাওয়াতো।

রাইয়ের মনটা খুব খারাপ ছিলো। কেনোনা আদি কোনো কিছুই গিফট দেয় নি। আবার উইশও করে নি। মোট কথা সারাদিন কথাই বলে নি।
সন্ধার পরে রাই লুকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
দৌড়াতে থাকে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। আদিদের বাড়িটা খুব বেশি দুরে না। তাই একা যাওয়ার সাহস করেছে।
হঠাৎ একটা বাইকের সাথে ধাক্কা খায় রাই।
ভীষণ রাগ হয়।
“কালা না কি আপনি? চোখ কি পকেটে রেখে ঘুরেন?
হাত ছাড়া দিতে দিতে বলে রাই।
বিহান হেলমেট খুলে রাইয়ের দিকে তাকায়। সেই দিনই ছিলো বিহানের সাথে রাইয়ের প্রথম দেখা।
” সরি মিস

বিহান কানে হাত দিয়ে বলে।
রাই আরো হ্মেপে যায়। আশ্চর্য বাইক দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরি বলছে। সরি বললেই কি রাইয়ের হাতের ছিলে যাওয়া জায়গাটা সেরে যাবে?
বিহানের হাত থেকে হেলমেটটা নিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় ফেলে দেয় রাই। বিহান কপাল কুচকে তাকায়।
“সরি মিস্টার
রাইও বিহনের মতো কানে হাত দিয়ে বলে।
তারপর দাঁত কেলিয়ে চলে যায়।
বিহানও হেসে ফেলে।
” ধানী লঙ্কা।

আদি এখনো বাসায় ফেরে নি। রাই আদির খাটের ওপর গোল হয়ে বসে আছে৷ কেউ জানে না রাই এখানে এসেছে। চুপিচুপি আদির রুমের জানালা দিয়ে রুমে ঢুকেছে।
এখন বিরক্ত লাগছে। কতোখন বসে থাকা যায়।
ঘড়ির কাটায় রাত এগারোটা। এতো দেরি কেনো করছে? কোন মেয়ের সাথে ডেটিং এ গেছে?
রাগে আদির সুন্দর করে গোটানো বিছানাটা এলোমেলো করে ফেলে রাই।

কলিং বেল বাজার শব্দে রাই বুঝে যায় আদি এসেছে। রাগটা আরো বেরে যায়। গাল ফুলিয়ে বসে।

“হ্যাপি বার্থডে জান
দরজা খুলতে খুলতে বলে আদি।
আপনাআপনি রাইয়ের দুই ঠোঁটের মাঝ খানে ফাঁকা হয়ে যায়। উনি কি করে জানলো রাই এখানে আছে? রুমটাতো অন্ধকার। তাহলে?
আদির দরজা লাগিয়ে দেয়।
“তুমি আমার থেকে একশত হাত দুরে থাকলেও তোমার অস্তিত্ব টের পায় আমি। আর এখন তো মাএ পাঁচ হাত দুরে আছো।
তাছাড়া আরো একটা বিষয় আছে। আজকে মহারানীর বার্থডে তার রাজা মশাই তাকে ইউশ করে নি। তার তো এখানে আসতেই হতো।
এম আই রাইট?
সুইচ টিপে রাইয়ের দিকে না তাকিয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলে আদি।
রাই আবার আগের মতো গাল ফুলিয়ে বসে।
“প্রথমে ভেবেছিলাম সবার আগে তোমাকে ইউশ করবো। তারপর মত চেন্জ করলাম। সবাই তো আগে ইউশ করার জন্য দল বেঁধে থাকবে। লাস্টে তো কেউ থাকবে না। আমি নাহয় সবার পরেই ইউশ করলাম।
রাইয়ের পাশে এসে বসে বলে আদি।
“আপনার থেকে গিফট পাওয়ার জন্য আমি বসে নেই।
বলেই দাঁত দিয়ে জীভ কাটে রাই।
আদি শব্দ করে হেসে ফেলে।
” গিফট দেবো কখন বললাম?
রাই আদির বুকে থাপ্পড় দেয়। আদি হেসে রাইকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
“লাগবে না আপনার গিফট?
অভিমানের সুরে বলে রাই।
” আর ইউ শিওর?
রাইয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বলে আদি।
রাই উওর দেয় না।
আদি পকেট থেকে একটা বক্স বের করে। রাইকে সোজা করে বসায়।
বক্স খুলে সেখান থাকা আংটিটা নেয়।
“আজ থেকে ঠিক তিন বছর পরে তোমায় বিয়ে করবো। অপেক্ষা করবে আমার জন্য? হবে আমার বউ?
রাই মিষ্টি হাতটা এগিয়ে দেয়।
” আমি চাইলে এখন তোমায় বিয়ে করতে পারতাম। কিন্তু তাতে আমাদের ক্যারিয়ারের হ্মতি হবে। ফিউচার ব্রাইট হবে না। ভালো একটা জব করতে হবে। তোমাকেও তো বড় হতে হবে তাই না?
“হুমমমমম
” যাই পরিস্থিতি হোক না কেনো কখনো ছেড়ে যেয়ো না আমায়।
“কখনো ছেড়ে যাবো না৷ কথা দিলাম। অপেক্ষা করবো আপনার জন্য। আপনি ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করবো না। আমি আপনারই। শুধুই আপনার।
আদিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে রাই।

চলবে