স্রোতধারা
দশম_পর্ব
~মিহি
স্রোত দরজা খুলছে না দু’ঘণ্টা ধরে। বাসার কাজের মহিলাটি বেশ কয়েকবার ডেকেও কোনো সাড়াশব্দ পায়নি। সৌহার্দ্যরা বাড়ি আসার পরপরই সে স্রোতের কথাটা তাদের জানায়। শাহরীন চৌধুরীর গলা শুকিয়ে আসলো। সৌহার্দ্য পাগলের মতো দৌড় দিল স্রোতের ঘরের দিকে। কোনো কিছু না ভেবেই সজোরে কয়েকবার আঘাত করলো দরজায়। স্রোতের কোনো সাড়াশব্দ নেই। সৌহার্দ্য দেরি না করে দরজা ভেঙে ফেলল। দরজা ভাঙতেই ভেতরে যা দেখল তার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিল না। স্রোত ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গালে অয়েন্টমেন্ট লাগাচ্ছে। সৌহার্দ্য সরাসরি স্রোতের গালে থাপ্পড় লাগাল। হুট করে এমন আক্রমণে স্রোত কয়েক পা পিছিয়ে গেল। সৌহার্দ্যের চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে রাগ। দরজায় শাহরীন চৌধুরী ও সায়ান চৌধুরী দাঁড়িয়ে। দুজনকেই চোখের ইশারায় সরে যেতে বলল। স্রোতকে বসালো সৌহার্দ্য। স্রোত দাঁড়ি শেভ করেছে, চুলও আগের তুলনায় ছোট। একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে স্রোতকে। সৌহার্দ্য কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
“স্রোত, তুই এতটা ইম্যাচিউর কবে থেকে হলি? তোর থেকে এসব বাচ্চামি আমি কখনোই এক্সপেক্ট করিনি।”
“অনেক কিছুই তো হয় এক্সপেক্টেশনের বাইরে, ভাইয়া। আমিও কখনো নিজের এমন অবস্থা এক্সপেক্ট করিনি। তোমরা কেউ বুঝতেছো না আমার অবস্থা। আমি ধারাকে ছাড়া বাঁচবো না এই সিম্পল জিনিসটা তোমরা মানতে পারতেছো না। কেন? ধারার মধ্যে সমস্যাটা কী? তোমার সাথে বিয়ে হলে মা ঠিকই মানতো, সেখানে আমার সাথে বিয়ে হলেই সব সমস্যা, তাই না? যখন আমাকে নিয়েই এত সমস্যা, তখন আমি না থাকলেই ভালো না?”
“এক থাপ্পড় দিব। বড্ড বড় হয়ে গেছিস না? গাল কাটলি কী করে?”
“শেভ করতে নিয়ে কেটে গেছে।”
“ওষুধ লাগিয়ে রেডি হ। তোকে নিয়ে বের হবো।”
“আমি কোথাও যাবো না ভাইয়া।”
“যা বলছি কর।”
“তুমিও দেখি আজকাল আমার মতামতের ধার ধারো না।”
“যা বলছি করবি?”
স্রোত উত্তর দিল না। চুপচাপ গালে মলম লাগিয়ে শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধারার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার কথাটা স্রোতকে বলার জন্য মন আকুল হয়ে আছে তার কিন্তু ধারার শর্তের খেলাপ করাটাও উচিত না। স্রোতকে নিয়েই ইদানিং যত ভয় সৌহার্দ্যের। ছেলেটা অন্যরকম হয়ে গেছে। কখন কী করছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
স্রোত বেরিয়ে এলো গাঢ় লাল রঙা শার্টটা পড়ে। এ শার্ট তাকে এত বছরে কোনদিন পড়ানো যায়নি অথচ আজ স্বেচ্ছায় সে শার্টটা পড়েছে। সৌহার্দ্যের মনে স্রোতকে নিয়ে ভয়টা যেন আরো বাড়লো।
“এই শার্টটা পড়লি যে?”
“ইচ্ছের বিরুদ্ধে করা জিনিসগুলো কেমন হয় একটু দেখতে চাচ্ছি। চলো।”
সৌহার্দ্য লক্ষ করলো স্রোতের চোখের চাহনি। কেমন যেন নির্লিপ্ত সবকিছু। স্রোত ছোট থেকেই অতিরিক্ত চঞ্চল, তার চোখে এমন উদাসীনতা মানা যায় না। সৌহার্দ্য ঠিক করলো সে স্রোতকে বলে দেবে যে তার সাথে ধারার বিয়ে ঠিক হয়েছে। নিচে নামতেই শাহরীন চৌধুরীর মুখোমুখি হলো তারা। শাহরীনের মুখ গম্ভীর, তিনি যে কিছু বলবেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ভণিতা ছাড়াই তিনি বলে ফেললেন,”আগামী সপ্তাহের শুক্রবার তোমার বিয়ে। না করার দুঃসাহস দেখিয়ে লাভ নেই।”
সৌহার্দ্য ধরেই নিল আবার আরেকটা ঝামেলা হবে। তার মা এখন না বললেও পারতেন কথাটা। স্রোতের থেকে তীব্র একটা প্রতিবাদ আশা করছিল কিন্তু স্রোত কিছুই বলল না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল। সৌহার্দ্য অবাকের চরম শিখরে পৌঁছাল। এ পরিস্থিতিতে স্রোতের চিৎকার-চেঁচামেচি মেনে নেওয়া যেত কিন্তু স্রোতের এই চুপ থাকা কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। কী চলছে টা কী স্রোতের মাথায়?
______________
নিস্তব্ধ রাত। জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। স্রোতের কথা ভাবতেই নিঃসঙ্গতা এসে আষ্টেপৃষ্টে জেঁকে ধরছে তাকে। আনমনে আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে নিঃসঙ্গতা অনুভবে ব্যস্ত সে।
সকাল থেকে যা হচ্ছে সবটুকুই হায়ার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। স্রোত না কী জানি নাম, তার সাথে তার আপুর বিয়ে হবে? ছেলেটা দেখতে কেমন হায়া জানেনা। সুন্দর না হলে সে মোটেও ধারার সাথে তার বিয়ে হতে দেবে না। আচ্ছা, ছেলেটা নাকি ডাক্তার? হায়া শুনেছিল ডাক্তাররা নাকি বেশ সুদর্শন হয়। তবে স্রোত ছেলেটাও মনে হয় সুদর্শন। আজগুবি সব প্রশ্নের মাঝে হায়া লক্ষ করলো বারান্দায় ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে। এ মুহূর্তে হায়ার কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছে ধ্রুবর সাথে একটু কথা বলতে। কিছু না ভেবেই দ্রুত ছাদের দিকে এগোলো হায়া। যদিও বা ধ্রুবর এখন ছাদে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই তবুও ছাদে এসে দাঁড়িয়ে রইল সে। খোলা আকাশের নিচে সামনের ছোট ছোট চুলগুলো উড়ছে হায়ার। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলতেই যেন মনে জমাট বাঁধা সমস্ত ক্লান্তি-গ্লানি সব হারিয়ে গেল দূর আকাশের ভীড়ে।
“রাত-বিরাতে ছাদে কী?” রূক্ষ কণ্ঠস্বর পেতেই ঝট করে চোখ খুলল হায়া। যা ভেবেছিল তাই। ধ্রুব সামনে দাঁড়িয়ে। ধ্রুবকে দেখে হায়ার কথা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। ধ্রুব বাঁকা দৃষ্টিতে হায়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
“কী হলো? এই অসময়ে ছাদে কী?”
“আপনাকে বলা লাগবে সেটা?”
“সম্মান দিতে শেখো মেয়ে। নাহলে তোমার কান ধরে…”
“ঐ এক ভিডিও পাইছেন, তাতেই তো সব উদ্ধার করে ফেলছেন তাইনা? যা পারেন করেন। ঢঙের খ্যাতা-বালিশ!”
“কীহ কীহ? কিসের খ্যাতা-বালিশ?”
হায়া কিছু বললো না, চুপ হয়ে গেল। ধ্রুবও আর কিছু বললো না। অদ্ভুত রকমের নীরবতা গ্রাস করলো নিস্তব্ধ প্রকৃতিটাকে।
____________
সকালে ক্যাম্পাসে এসে বেশ অবাক হলো ধারা। তার ফ্রেন্ডদের মধ্যে কেউ আসেনি। ক্লাস করার আর ইচ্ছে হলো না তাই ক্যান্টিনে এসে বসলো। ক্যান্টিনেও অল্প কয়েকজন বসা তাও একেক প্রান্তে। আচমকা কেউ একজন ধারার মুখে রুমাল চেপে ধরলো। প্রায় তিন মিনিটের মতো হাতাহাতি করেও লাভ হলো না। ধীরে ধীরে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলো ধারা এবং কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারালো সে।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল ধারা। চোখ খুলে আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করতেই দেখলো একটা বেঞ্চে সে বসে আছে। পাশে স্রোত বসে বাদাম চিবুচ্ছে। ধারার জ্ঞান ফিরতে দেখে ধারার দিকে কয়েকটা বাদাম এগিয়ে দিল সে। ধারা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
“এখানে কেন নিয়ে এসেছো আমায়?”
“বিয়ে করবো।”
“তোমার তো নিজের পরিবারকে রাজি করানোর কথা।”
“পরিবার রাজি না হলে কি তোমায় ছেড়ে দেবো ভেবেছিলে?”
“তোমায় এভাবে বিয়ে করবো ভাবলে কী করে?”
স্রোত কিছু বললো না, মুচকি হাসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা সিগারেট ধরালো। ধারা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বসে রইল।
“সিগারেট ফেলবে তুমি?”
“একটা উদাহরণ দিলাম। চাইলেই তুমি উঠে চলে যেতে পারতে কিন্তু তুমি আমায় সিগারেটটা ফেলতে বলেছো কারণ তুমি আমাকে ছাড়তে চাও না। অ্যাম আই রাইট, মিস ধারা আহমেদ?”
“ইউ আর নট। আমি যাচ্ছি।”
স্রোত আলতো করে ধারার হাত স্পর্শ করলো। ধারা পেছন ফিরে তাকাতেই স্রোতের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। ধারার চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। ধারার হাতটা ধরে রেখেই অপর হাতটা বুকের বা পাশে নিয়ে গেল স্রোত। আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করলো। আজ সবকিছু যেন সুন্দর। এ গোধূলি বেলা, প্রিয়তমার হাতে হাত রাখা, প্রিয়তমার রাগান্বিত আঁখি, সবকিছুর মাঝেই স্রোত খুঁজে পাচ্ছে ভালোবাসা। এ ভালোবাসার কাঙাল স্রোত। আজ এ ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতেই এত যুদ্ধ নিজের সাথে, পরিবারের সাথে। ধারার মুখপানে চেয়ে স্রোত ধীর স্বরে আওড়ালো,
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
চলবে…