স্রোতধারা পর্ব-০৯

0
327

স্রোতধারা
নবম_পর্ব
~মিহি

“আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে কী মজা করছেন আপনারা? বড় ছেলের সাথে বিয়ে ভেঙে দিয়ে এখন ছোট ছেলের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন?”

“আমায় ভুল বুঝবেন না আপা। আমার ছোট ছেলে আপনার মেয়েকে খুব ভালোবাসে। ওদের মধ্যে যদি কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা যেন একমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ক হয়, তা নিশ্চিত করতেই আমি এসেছি।”

“আপনার ছোট ছেলে আমার মেয়েকে ভালোবাসে?”

“জ্বী।”

“আপনার ছোট ছেলের সম্বন্ধে তো আমরা কিছুই জানিনা।”

“ও আপনার মেয়ের সাথেই পড়ছে। একই মেডিকেলে একই বর্ষে পড়ছে দুজন।”

“সমবয়সী দুজন! এ বিয়ে সম্ভব না।”

কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেলেন শায়লা আহমেদ। সমবয়সী ছেলের সাথে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেবেন না তিনি। নওফেল আহমেদ এখনো কিছু বলেননি, তিনি চুপচাপ সবটা শুনলেন অতঃপর ধারাকে ডাক দিলেন। ধারার সাথে সাথে হায়াও এলো। সৌহার্দ্যের চোখ পড়ল হায়ার দিকে। গোধূলী বেলায় ঢলে পড়া সূর্যের ন্যায় মলিন হায়ার মুখটা। এলোকেশী কন্যাটি বারে বারে সৌহার্দ্যের পাথরতুল্য মনটাতে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। সৌহার্দ্য চেষ্টা করছে হায়ার দিকে না তাকাতে তবুও চোখ নির্লজ্জের মতো সেদিকেই যাচ্ছে। হায়া ভ্যাবলার মতো নিজের বোন আর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কী হচ্ছে তা তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ধারাও নিশ্চুপ পুতুলের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। নওফেল সাহেব ধারার অভিব্যক্তি অনুধাবনের চেষ্টা করলেন।

“ধারা, স্রোতকে বোধহয় তুমি চেনো। ইনি স্রোতের মা, উনি তোমার আর স্রোতের বিয়ের কথাবার্তা বলতে এসেছেন। আমরা তোমার সিদ্ধান্ত জানতে চাচ্ছি।”

“তোমাদের সিদ্ধান্তের বাইরে আমার কোনো সিদ্ধান্ত নেই বাবা।”

“না ধারা। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত সবসময় তুমি নিজেই নিয়েছো। এবারও সিদ্ধান্তটা তোমারই হবে। তুমি বলো।”

ধারার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। এমন পরিস্থিতিতে মাথাটাও যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ধারার অবস্থাটা বুঝতে মোটেও অসুবিধে হলো না শাহরীন চৌধুরীর। তিনি ধারার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ধারার কপালে হাত বুলিয়ে বললেন,”আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি ধারার সাথে কিছুক্ষণ একাকী কথা বলতে পারি?” এ প্রশ্নে ধারার হৃদয় ধক করে উঠলো। নওফেল আহমেদ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। ধারা সাথে সাথে ঢোক গিলল। স্রোতের পাগলামি এসব নাকি সত্যিই ভালোবাসা? এত তাড়াতাড়ি সব সামলালো কী করে সে?

শাহরীন চৌধুরীকে নিজের ঘরে আনতে লজ্জা লাগছিল ধারার।সারা ঘর এলোমেলো, বইখাতা আর কাপড় যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা ধারার অভ্যেস। ধারার ঘরে চোখ বুলিয়ে ধারার লজ্জিত মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন শাহরীন।

“এত লজ্জা পেও না। স্রোত বেশ গোছালো ছেলে। তোমার সব এলোমেলো হওয়া জিনিস সে সযত্নে গুছিয়ে দিবে।”

“আন্টি, স্রোত আমায় ভালোবাসে এ কথা আমি গতকাল জেনেছি মাত্র।স্রোত আমায় জোর করেনি বরং বলেছে সে বিয়ে ব্যতীত আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। সত্যি বলতে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম কিন্তু হুট করেই শুনলাম ও হাত কেটেছে। এ কাজটা না করলে হয়তো আমি স্বাভাবিকভাবেই ওকে মেনে নিতাম কিন্তু ওর পাগলামি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।”

“স্রোত ছোট থেকেই এমন স্বভাবের ছিল। জানিনা তোমার ক্ষেত্রেই কী করে সে এতটা ধৈর্যশীল হলো। দুই বছর ধরে দেখছে অথচ তোমায় নিজের মনের কথা বলেনি।”

“আমার একটা স্বপ্ন ছিল। জানিন আন্টি, আমি চাইতাম আমরা দুই বোন সবসময় একসাথে থাকবো। তাই দুজনে এক বাড়ির বউ হবো তবে স্রোত আমাকে বুঝিয়েছে আমার সাথে থাকলেই যে হায়া সুখে থাকবে তার কোনো মানে নেই। বরং হায়া যদি অন্য কোথাও সুখী থাকে, সেটা আমার মেনে নেওয়া উচিত।”

“একটা গোপন কথা শুনবে? একদম টপ সিক্রেট।”

“জ্বী আন্টি।”

“আমার বড় ছেলেটা বড্ড পরোপকারী গো মা। স্রোতের সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার জন্য সে হায়াকে বিয়ে করতেও তৈরি হয়ে গিয়েছিল।”

“সৌহার্দ্য?”

“হ্যাঁ। সৌহার্দ্য যদি দু-তিন বছর কম বয়সী হতো কিংবা হায়াই যদি আর একটু বড় হত, আমি নিজেই হয়তো দুজনকে বিয়ে দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিতাম।”

“বুঝতে পেরেছি আন্টি।”

“এখন বলো আমার পাগল ছেলেটাকে বিয়ে করে তার পারসোনাল ডাক্তার হতে কি ইচ্ছুক তুমি? শত শত রোগীর ভীড়ে রোজ একটা মুখ দেখতে প্রস্তুত?”

ধারা কিছু বলছে না। লজ্জায় সে মাথা নিচু করেছে। অদ্ভুতভাবে আজ সে লজ্জায় চোখটাও তুলতে নারছে না। হৃদস্পন্দনের ওঠা-নামা যেন ক্রমশ বাড়ছে। শাহরীন ধারার কানে কানে বললেন,”তবে কি মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিব?” ধারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,”বিয়ে করবো তবে শর্ত আছে আন্টি। স্রোত একেবারে বিয়ের দিন জানবে তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। বিয়ে শেষ হওয়ার আগে এ কথা আপনি তাকে বলতে পারবেন না।” শাহরীন চৌধুরী মুচকি হাসলেন। এ মেয়ে তার ধাঁচেই গড়া। স্রোতের সুখ-দুঃখ সব আগলে রাখতে পারবে নিঃসন্দেহে। তিনি সায় দিলেন।

শাহরীন চৌধুরী বাইরে এসে দাঁড়াতেই নওফেল আহমেদ খানিকটা তড়িৎ গতিতেই জিজ্ঞাসা করে বসলেন,”কী বললো ধারা?” শাহরীন চৌধুরী টেবিল থেকে খানিকটা মিষ্টি নওফেল সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,”মিষ্টিমুখ করেন বেয়াই সাহেব।” নওফেল আহমেদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

______________

স্রোতের মনের উপর দিয়ে ঠিক কী যাচ্ছে সে নিজের বুঝে উঠতে পারছে না। ধারার জন্য যে ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তবুও স্রোতের কিছুই করার নেই। মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে সে যথেষ্ট অনুতপ্ত তবে মায়েরও তো বোঝা দরকার। স্রোতের অবস্থা এখন শাঁখে করাতে, এদিকে গেলেও কাটে ওদিকে গেলেও কাটে। চাইলেই সে এখন ধারার সাথে কথা বলতে পারবে না, ধারার সামনে দাঁড়াতে গেলে নিজের চোখে নিজেই ছোট হয়ে যাবে। আড়াল থেকে হয়তো বার বার বেহায়া চোখটা পড়বে ধারার উপর। তখন প্রশ্নবিদ্ধ বিবেকের কাছে কোন মুখে দাঁড়াবে সে? নানান প্রশ্ন পেঁচিয়ে ফেলেছে মনটাকে। চোখ বন্ধ করলো স্রোত। চোখের সামনে ভেসে উঠলো নবীন বরণের সেই রাতটা…

লাল শাড়ি পড়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল ধারা। খোলা চুলে মোহনীয় ধারার প্রেমে আগে থেকেই ডুবতে থাকা স্রোত সেদিন যেন পুরোপুরি ডুবে গেল প্রেমে। কত ঢোক পানি যে গিলল! লুকিয়ে ধারার একটা ছবিও তুলেছিল সে।ল্যাপটপের গোপন ফোল্ডারে থাকা ছবিটাই স্রোতের সমস্ত আবেগের সাক্ষী। দিনশেষে ছবির কাছে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত না করলে স্রোতের হয় না। ধারার সে হাসিমাখা মুখের ছবি যেন স্রোতের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

কী ভেবে যেন ল্যাপটপটা বের করলো স্রোত। ধারার ছবি বের করতেই চোখের কোণের নোনাজল গড়িয়ে পড়তে চাইল। হাতের ওল্টোপিঠে তা মুছল সে।

“ধারা, কেন এত যন্ত্রণা তোমার ভালোবাসায় বলতে পারো আমায়? তোমায় পাওয়া কি ভাগ্যে নেই আমার? তোমায় ছাড়া আমি বাঁচতে পারবোনা বিশ্বাস করো। নিঃশ্বাসে মিশে গেছো তুমি এখন। তোমায় ভালোবাসাটা হয়ে উঠেছে আমার সবচেয়ে বাজে অভ্যেস যা আমি ছাড়তে চাই না। এ বাজে অভ্যেসটা আমি রাখতে চাই। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্ত কেবলমাত্র তোমাকেই ভালোবাসতে চাই। তোমার এলোকেশে মুগ্ধ হয়ে বার বার তোমার আঁখি কর্তৃক খুন হওয়ার অধিকারটা কেবল আমার, বুঝেছো? তোমার চোখের কোণে জমে থাকা জলকণা মুছে দেওয়ার অধিকারটাও আমার। তোমার হাতে হাত রেখে দূর-দূরান্ত পাড়ি দেওয়ার অধিকারও আমার। এ অধিকারগুলোর স্বপ্ন বুনেছিলাম আমি ধীরে ধীরে অথচ দেখো সামান্য এক ঝড়ে আমার স্বপ্নগুলো কেমন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল ধারা। নতুন করে স্বপ্ন বুনতে তোমায় আমি পাশে চাই। তুমি না থাকলে স্রোতও থাকবে না।” স্রোতের কণ্ঠ অন্যরকম শোনালো। নজরটা পড়ল সাইড টেবিলের ছুঁড়ির উপর।

চলবে…