স্রোতধারা পর্ব-১৫

0
357

স্রোতধারা
পঞ্চদশ_পর্ব
~মিহি

“দেখুন, আপনারা ভুল বুঝবেন না। হায়ার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পরিবারের বাইরে কাউকে জানানো হয়নি। আমি শুধু ওর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।” সৌহার্দ্যের কথায় শায়লা আহমেদ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ছেলেটা কী বলছে তা তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আপাতত এটাই একমাত্র উপায় নিজের মেয়ের মান-সম্মানে কলঙ্ক লাগা থেকে আটকানোর। তিনিও সৌহার্দ্যের কথায় সায় দিলেন।

“হ্যাঁ ভাবী, আসলে হায়ার তো এখনো মেট্রিক ক্লিয়ার হয়নি সেজন্য ওদের বিয়ে আমরা পোস্টপনড করেছি নাহলে আমারো শখ ছিল দুই মেয়েকে একই দিনে নতুন সংসারে পাঠানোর।” শায়লা আহমেদের কথায় উপস্থিত সবার বিভ্রান্তি খানিকটা দূর হলেও ততক্ষণে বেশ হৈ চৈ পড়ে গেছে। সৌহার্দ্য হায়াকে রুমে শুয়ে দিয়ে বের হতেই স্রোতসহ এ বাড়ির সবাই তাকে ঘিরে ধরলো।

হায়ার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। শায়লা আহমেদ শান্ত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন। নওফেল সাহেব এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না আসলে হয়েছেটা কী। সৌহার্দ্যের বাড়ির লোককে খবর দেওয়া হয়েছে। তারাও বেশ চিন্তিত হয়ে উপস্থিত হয়েছেন। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে সবার দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হচ্ছে সৌহার্দ্যকে। পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যে সৌহার্দ্য মিথ্যে না বলে পারেনি কিন্তু হায়া কেন সেখানে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছিল সেটা জানাটাই সকলের মুখ্য উদ্দেশ্য। অবশেষে শাহরীন চৌধুরীই কথা শুরু করলেন।

“সৌহার্দ্য, কী হয়েছে বল তো। হুট করে এভাবে সবাই এত চিন্তিত হয়ে পড়েছে কেন? অবশ্যই কিছু ঘটেছে। কী ঘটেছে তা আমাদের জানতে হবে তো।”

“মা, একটু শান্ত হও। আমি বলছি সবটা।”

শায়লা আহমেদ ছোটদের ঘর থেকে চলে যেতে বললেন। পরিস্থিতি বুঝে সবাই বেরিয়ে গেল। সৌহার্দ্য এখন কিছুটা ভয় পাচ্ছে। তখন মিথ্যে বলাটা দরকার ছিল কিন্তু মিথ্যেটা যে এতদূর আসবে সেটা ভেবে নেওয়া উচিত ছিল। সৌহার্দ্য শুরু থেকে এক এক করে সব ঘটনা বলতেই শাহরীন চৌধুরী নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সবকিছু গুলিয়ে আসছে তার। সৌহার্দ্য শুরু থেকেই হায়াকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তার জন্যই এতসব ঘটনা সাজানো হয়নি তো? নিজের বড় ছেলের উপর যথেষ্ট আস্থা আছে তার। ছেলে আর যাই করুক, এভাবে ষড়যন্ত্রের বীজ বুনবে না। এখন বাকিটা নির্ভর করছে হায়ার জ্ঞান ফেরার পর।

ধারা হায়ার পাশে বসে আছে। বাকিরা সবাই ড্রয়িংরুমে। সবকিছু ঠিক থাকলে এতক্ষণে বাড়িতে কত হৈ চৈ হতো অথচ এখন যেন পরিবেশটা গুমোট হয়ে আছে। হায়ার জ্ঞান ফিরলো ঘণ্টা দেড়েক পর। উঠে মাথার কাছে বোনকে দেখতে পেয়ে হায়ার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো কিন্তু তার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি চারিপাশে ধ্রুবকে খুঁজতে লাগল। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির উপস্থিতি দেখতে না পেয়ে হায়ার মুখ পুনরায় মলিন হয়ে গেল। ধারা হায়াকে পানি দিল। সামান্যটুকু খেয়ে গ্লাসটা যথাস্থানে রেখে দিল হায়া। ধারা মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছে হায়াকে প্রশ্ন করার জন্য। মনের এককোণে একটু হলেও ভয় বাসা বেঁধেছে। হায়া ভুল কিছু না করে বসে এ ভয়!

“হায়া, তুই ঠিক আছিস?”

“হ্যাঁ আপু।”

“ত..তুই এ..এভাবে? স্টেজের কাছে কেন গিয়েছিলি একা?”

“এ..এমনি আপু।”

“দেখ হায়া, তুই নিজেও জানিস তুই আমার কাছে কিছু লুকোতে পারবিনা তবুও কেন চেষ্টা করছিস? কী হয়েছে বল আমায়।”

হায়ার জমে থাকা নোনাজল এবার আর বাধা মানলো না। ধারাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো হায়া। ধারা হায়ার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ পেরোলেও হায়ার ফোঁপানো বন্ধ হলো না। ভারী স্বরেই হায়া বলতে শুরু করলো,

“আমায় ক্ষমা করে দাও আপু। আমি একটা ভয়ানক ভুল করে ফেলছি। ধ্রুব নামক যুবকটার মায়ায় পড়ে ভয়ানক ভাবে শেষ হয়ে গিয়েছি আমি। তাকে নিজের মনের কথা বলতেই গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেলেন আপু, একেবারে চলে গেলেন আমাকে ছেড়ে।” হায়ার কান্নার গতি বাড়লো। ধারা এ মুহূর্তে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কোনমতে হায়াকে সামলে রেখে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমের চিন্তিত চোখগুলোকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা ধারার নেই। কিছু একটা বিহিত করতেই হবে। সৌহার্দ্য যে কথা সকলের সামনে বলেছে তা সত্যি প্রমাণ করা ছাড়া ধারা আর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু হায়া কি রাজি হবে সৌহার্দ্যকে বিয়ে করতে? মনে একজনকে রেখে অন্য একজনের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া কি সম্ভব? তাছাড়া সৌহার্দ্যের পরিবারের মানা-না মানারও একটা ব্যাপার আছে। ধারার মুখের নমনীয়তা যেন একমুহূর্তে উবে গেল। অনিশ্চয়তার কাঠিন্যে মুখখানি মলিন হয়ে উঠলো।

_________________

শাহরীন চৌধুরী শায়লা আহমেদের সাথে একান্তে আলাপ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। শায়লা আহমেদ তাকে নিয়ে বারান্দায় বসেছেন। দুজনের মধ্যে কেউই কোনো কথাবার্তা বলছে না। শাহরীন চৌধুরী ভেবে পাচ্ছেন না কিভাবে কথা শুরু করবেন।

“ভাবী, আমার ছেলের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। ও পরিস্থিতি না বুঝেই আপনাদের এমন দোটানায় ফেলে দিয়েছে কিন্তু আপনারা আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। ধারাকে যে বিশ্বাসে আপনারা আমার ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন, একই বিশ্বাসটা সৌহার্দ্যের উপরও রাখতে পারেন। আর যাই হোক, সে কখনো হায়াকে অনাদর করবে না।”

“এ কী বলছেন ভাবী আপনি? আমার মেয়ের কথা আপনি জানেনই। এলাকা দাঁপিয়ে বেড়ানো ওর স্বভাব। সৌহার্দ্যের মতো ভদ্র সভ্য ছেলে ওকে বিয়ে করবে এ আমার জন্য সৌভাগ্য তবে হায়ার মতামত নেওয়াটাও দরকার। আমি চাইনা ও ভবিষ্যতে আমাকে দোষারোপ করুক। মেয়েটা বড্ড জেদী, ওর মতটা নিয়ে তবেই আমরা কথা এগোই, ভাবী?”

“আলহামদুলিল্লাহ অবশ্যই। হায়া যদি রাজি থাকে তবে আমরা একইসাথে দুজনের বিয়ের আয়োজনটা করতে পারি। আপনি বরং হায়ার সাথে কথা বলুন। আমাদের তরফ থেকে কোনো আপত্তি নেই।”

শাহরীন চৌধুরী উঠে চলে গেলেন। বারান্দায় চুপচাপ বসে আছেন শায়লা আহমেদ। এরই মধ্যে তার শাশুড়ি জোবেদা খানম এসে বসলেন তার পাশে। মুখে পান পুরেছেন তিনি। শায়লার পাশে বসলেন বেশ গম্ভীর মুখ করে।

“দেখো শায়লা, নিজের মেয়েটার সুখ যদি চাও, পরেরটার কথা ভাবা বাদ দাও। হায়ারে দিয়ে কোনকালে কিছু হয় নাই উল্টো এখন পরিবারের মুখে কলঙ্ক লাগাইতেও পিছপা হচ্ছে না মেয়েটা। তুমি ধারার বিয়ে ভালোমতো দাও। হায়াকে আমি গ্রামে নিয়ে যাবো।”

“ও গ্রামে গিয়ে কী করবে? তাছাড়া আপনি তো ওকে সহ্যই করতে পারেন না।”

“ওর ব্যবস্থা আমি করবো। ওসব নিয়ে তোমারে ভাবতে হবে না। ধারার দেবরের সাথে যদি হায়ার বিয়ে দাও, একটা বিয়েও টিকবো না আমি বলে দিলাম। অভিজ্ঞতা আমারো কম নাই। স্রোতের মা নিতান্তই ভদ্রমহিলা তবে হায়াকে সামলানোর ক্ষমতা তার নাই। দিনশেষে তোমার দুই মেয়েই স্বামীহারা হবে দেখো।”

জোবেদা খানমও চলে গেলেন। শায়লা আহমেদের এখন নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে যেন এ বিশাল পৃথিবীতে তিনি অসহায়, একাকী বেঁচে আছেন। হায়ার প্রতি স্বার্থপরতা তিনি দেখাতে পারবেন না কোনভাবেই কিন্তু হায়া যদি এ বিয়েতে রাজি না হয়, তখন কী করবেন তিনি? দ্বিধা দ্বন্দ্বের পাহাড় যেন ক্রমশ চারদিক থেকে চাপ দিচ্ছে তার ওপর। শায়লা আহমেদ ধারার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ পরিস্থিতিতে যদি হায়াকে ঠিকভাবে বোঝানোর ক্ষমতা যদি কারো থাকে তবে সেটা ধারা ব্যতীত আর কারো নেই। শায়লা আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন সংকটে কখনো পড়তে হবে তা ভাবেননি। ধারা বরাবরই চেয়েছিল দুইবোন যেন এক বাড়িতে বউ হয়ে যায়, সৃষ্টিকর্তা বোধহয় ধারার ইচ্ছেটাই কবুল করে নিলেন।

চলবে…