সৎ মা পর্ব-০৩

0
267

#সৎ_মা (০৩)
#সামসুজামান_সিফাত

তানিয়া শিফার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,”কিরে ওর এই অবস্থা কেন ?”
আমি বললাম,”মা মেরেছে।”
– ওনি কি মানুষ নাকি অন্য কিছু।
আমি কিছু বললাম না। তানিয়া ই আবার বলতে লাগলো,”আমার তো মনে হয় না ওনি মানুষ। কারণ কোনো মানুষ ই একটা ছোট বাচ্চাকে এভাবে মারে না।”
আমি বললাম,”বাদ দে।”
– বাদ দিব ? আচ্ছা ঠিক আছে বাদ দিলাম। কিন্তু একটা বার ভেবে দেখ আজকে কীভাবে মারছে। এভাবে আরেকদিন মার খেলে কি তোর বোন বেঁচে থাকতে পারবে ?
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। কারণ, তানিয়া ঠিক ই বলেছে। তানিয়া শিফার হাত ধরে বললো,”শিফা তুই চল ত দেখি।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম,” কোথায় যাবি ?”

তানিয়া কিছু না বলে শিফাকে নিয়ে হনহন করে চলে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম লেখাপড়া ছেড়ে দিব নাকি চালিয়ে ই যাবো। কারণ, আমাকে এই লেখা পড়ার জন্য প্রচুর খোঁটা শুনতে হয়। স্কুলের পোশাক, বই, জুতা ও স্কুলের বেতন দেয় না। বাবা দেয় ঠিকি। কিন্তু বাবা চলে গেলে মা এসে মারধর করে নিয়ে নেয়। এখন স্কুলের সব খরচ আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক বহন করেন। তিনি আমাকে খুব আদর করেন। না না লেখাপড়া ছাড়া যাবে না। লেখা পড়া ছেড়ে দিলে আমি মাকে জবাব দিতে পারবো না। মায়ের জন্য আমি আমার লেখাপড়া কেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবো। আর তাছাড়া আমি যদি লেখা পড়া ছেড়ে দিই তাহলে বাবা আর রহমান স্যার (প্রধান শিক্ষক যিনি খরচ বহন করেন) খুব কষ্ট পাবে।

কিছুক্ষণ পর তানিয়া এসে বলল বাবা নাকি আমায় ডাকছে। সাথে সাথে আমি বাবার কাছে চলে এসে জিজ্ঞেস করলাম,”বাবা আমায় নাকি ডাকছো তুমি ?”
বাবা বললেন,”হ্যাঁ ডেকেছি। কিছু কথা আছে।”
– হ্যাঁ বলো।
– তুই আর শিফা তোর মামার বাড়িতে থাকবি আজকে থেকে।
– না বাবা, শিফা থাকবে আমি বরং এখানেই থেকে তোমাকে সাহায্য করবো আর লেখা পড়া করবো।
– না তুই তোর মামার সাথে চলে যা।
– না বাবা আমি এখানেই থাকবো আর তোমার কাছে ই থাকবো।
– এখানে থাকলে ত মার খেতে হবে।
– খেলে খেলাম তবুও আমি এখানেই থাকবো।
পাশ থেকে মামা বলল,”দুলাভাই সে যখন বলছে আপনার কাছে থাকবে তাহলে থাকুক না।”
বাবা বলল,”দেখো মতিউর (মামার নাম ) আমি চাই না আমার ছেলে তার সৎ মায়ের মার খেয়ে অকালে জীবন হারাক।”
আমি বললাম,”কিছু হবে না আমার। আর জীবন হারালে হারিয়েছি তবুও আমি তোমার কাছে ই থাকবো।”
বাবা বললেন,”আচ্ছা ঠিক আছে। আর মতিউর তোমরা স্বর্ণা (সৎ মায়ের নাম) আসার আগেই চলে যেও। নয়তো ও এসে আবার তোমাদের অপমান করবে।”
মামা বলল,”এই ত শিফা তৈরি হয়ে আসলেই চলে যাবো আমরা।”
বাবা আমাকে বললো,”সিফাত দোকান থেকে তানিয়া আর শিফার জন্য কিছু মজা নিয়ে আয় ত।”
আমি বললাম,”ঠিক আছে।”

দোকানে এসে কিছু ললিপপ, বিস্কুট, চকলেট সহ কিছু খাবার মজা নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। দেখি সবাই বেরিয়ে পরার জন্য তৈরি হয়েছে। আমি মজা গুলো তানিয়ার হাতে ধরিয়ে দিলাম। ওরা বিদায় নিয়ে চলে গেল। বোন অবশ্য যেতে চায়নি খুব কান্না করেছিলো। আমার ও মন চাইছিলো না বোন কে মামার বাড়ি পাঠাতে। কিন্তু এখানে রেখে মার ও খাওয়াতে চাইনি তাই আর বাঁধা দিইনি। স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাবার চোখে পানি। আমি বাবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম,”কাঁদছো কেন বাবা ?”
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। বাবা বললেন,”এমনি রে বাবা এমনি, কপালে কান্না লেখা ছিল তাই কাঁদতে হচ্ছে রে বাবা।”
– মা কোথায় ?
– সে তার বাবার বাড়ি গেছে কিছু শয়তানি বুদ্ধি নিয়ে আসতে। আচ্ছা শোন, তুই দোকানে যা আমি আসছি।
– ঠিক আছে।

আমি দোকানে এসে দোকান খুলে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা দোকানে আসলো। আমার বই খাতা দোকানেই থাকে। আমি বই নিয়ে পড়তে লাগলাম। মাঝে মধ্যে লোকেদের সদাই দিচ্ছি। দোকানদারি করতে আর পড়তে পড়তে রাত দশটার মত বেজে গেছে। বাবা বলল,”সিফাত আজকে রাতে আর ভাত খাওয়া হবে না তাই মুড়ি আর চানাচুর নিয়ে নে।”
আমি বললাম,”ঠিক আছে বাবা।”
– তারাতাড়ি নে আজকে ভালো লাগছে না এখনি দোকান বন্ধ করে ফেলবো।

কিছু না বলে মুড়ি আর চানাচুর নিলাম। পরে মনে হলো দুপুরে বাড়ি নেওয়া থেকে ষোলো হাজার টাকা এখনো আমার কাছেই আছে। বাবাকে টাকা দিতে গেলে বলে বলল, আমার কাছে রাখতে বাড়ি গিয়ে নিবে। আর বলল, দোকানে যা টাকা আছে সব নিয়ে নিতে। দোকানে লাখ দেড়েক টাকা ছিল। টাকা গুলো একটা ব্যাগে নিয়ে নিলাম উপরে কিছু সদাই নিলাম যেন ব্যাগে টাকা আছে তা বুঝা না যায়।

দোকান বন্ধ করে তুই বাবা-ছেলে বাড়ি চলে এলাম। দেখি মা বাড়ি আসেনি। তাই দুজনে চানাচুর-মুড়ি খেয়ে আমার রুমে ই ঘুমিয়ে রইলাম। সকালে বাবা ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়। হাত মুখ ধুয়ে এসে চানাচুর-মুড়ি খেয়ে পড়তে বসি। সাড়ে আটটার মতো বাজলে গোসল করে এসে দেখি বাবা ভাত তরকারি রান্না করেছেন। বাবা রান্না করতে পারেন তাই রাঁধতে ওনার কোনো সমস্যা হয়নি। মা মারা যাবার পর বর্তমান মাকে বিয়ে করার আগে পর্যন্ত বাবা ই আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন। আজকে অনেক দিন পর বাবার হাতের রান্না খাবো।

দুই বাবা-ছেলে খেতে বসলাম। বাবা ই খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। মন বলছে আজকে বাবার হাতে খাবো। তাই বাবাকে বললাম,”বাবা তুমি খাইয়ে দাও।”
বাবা বললেন,”তুই কি এখনো ছোট নাকি যে খাইয়ে দিতে হবে ?”
– ছোট হতে হবে নাকি ? আজকে খুব মন চাচ্ছে তোমার হাতে খেতে।
– আচ্ছা ঠিক আছে হা কর খাইয়ে দিই।

বাবা খাইয়ে দিচ্ছে। আজকে মনে হচ্ছে আমি সবচেয়ে সুখী সন্তান। বাবার হাতে খাবার জন্য আলাদা সৌভাগ্যের প্রয়োজন পড়ে। কয় জনের ই বা বাবার হাতে খাবার সৌভাগ্য হয়। যাইহোক খাওয়া শেষ হলে তেরি হয়ে বাবার সাথে দোকানে এলাম স্কুলের ব্যাগ নেওয়ার জন্য। বাবা ব্যাগ করে করে দিয়ে সাথে কিছু হাত খরচের টাকা দিয়ে বলল,”যা খেতে মন চায় খেয়ে নিবি।”
আমি বললাম,”ঠিক আছে বাবা।”
– আর শোন, কারো সাথে ঝগড়া করিস না। কেউ যদি গালি দেয় কিছু বলিস না। কেউ মারলেও কিছু বলিস না চুপচাপ বাড়ি চলে আসিস।
– ঠিক আছে।
– আর হ্যাঁ, সাবধানে যাস কিন্তু।
– ঠিক আছে বাবা।

বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্কুলের উদ্যেশ্য রওনা দিলাম। স্কুলে এসে সোজা ক্লাসে গিয়ে বসে রইলাম।

স্কুল ছুটির পর দোকানে চলে এলাম। বাবা যে টাকা গুলো দিয়েছে ওগুলো আমি খরচ করিনি। কারণ টাকা গুলো কোনো দরকারে আস্তে পারে। বাবা কিছু টাকা দিয়ে বললেন,”সিফাত এক কাজ কর, হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আয়।”
আমি বললাম,”ঠিক আছে।‌”

হোটেলে গিয়ে খাবার কিনে নিয়ে আসলাম। তারপর দোকানের সাটার ফেলে দুই বাবা ছেলে খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া করে আবার দোকান খুললাম। কিছুক্ষণ পর বাবা বললেন,”সিফাত বাড়ি থেকে কালকের টাকা গুলো নিয়ে আয়।”
আমি বললাম,”ঠিক আছে।”
– তারাতাড়ি আসিস, তুই টাকা নিয়ে আসলে মাল আনতে যাবো।
– আচ্ছা।

তারাতাড়ি হেঁটে বাড়ি আসলাম। ঘরে ঢুকতেই মা আমাকে টেনে ধরল। মা আসল কখন ? এখন তো বুঝা ই যাচ্ছে আমার কপালে শনি আছে। তবুও কিছু বললাম না।

চলবে।