সৎ মা পর্ব-০২

0
335

#সৎ_মা (০২)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

দৌড়ে বাড়ি আসতেই দেখি বাবা মাকে বকাঝকা করছে। মা শুধু মাথা নত করে শুনে যাচ্ছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছি। হঠাৎ মায়ের সাথে আমার চোখাচোখি হয়। মা আমার দিকে কেমন কটমট করে তাকালো। মনে হচ্ছে যেন আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। মা মনে হয় ভাবছে, বাবাকে আমি বলেছি। তাই আমার দিকে এভাবে তাকিয়েছে। মনের ভিতর এবার একটু ভয় হতে লাগলো। কারণ, বাবা ত এখন মাকে বকছে আর তা আমার দিকে কেমন করে তাকিয়েছে। এখন তো আমাকে কিছু করতে পারবে না কিন্তু যখন বাবা বাড়ি থাকবে না তখন আমার উপর তার প্রতিশোধ নিবে। তখন কি করবো ? মনের মধ্যে ভয় থাকলেও খুব আনন্দ লাগছে। কারণ, গত চার বছরে মা আমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে। ঠিক মত খাবার পর্যন্ত দেয়নি।

(আগে সব কিছু ভালো ই ছিল। বাবা-মা, বোন আর আমি সহ ছিল আমাদের ছোট একটা সুখের সংসার। কিন্তু সাড়ে চার বছর আগে হঠাৎ একদিন মা আমাদের না বলে ফাঁকি দিয়ে উপারে চলে যায়। এরপর থেকে শুরু হয় আমাদের খারাপ দিন। আমার ঠিক মনে আছে, মা মারা যাবার ছয় মাস পর বাবা আবার আমাদের বর্তমান মা কে বিয়ে করে। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। প্রথম প্রথম দু-তিন মাস মা (বর্তমান) আমাদের সাথে খুব ভালো ব্যাবহার করেছিল। এরপর থেকে ই খারাপ ব্যাবহার করতে শুরু করে। কিন্তু তা বাবার অগোচরে। বাবা যখন বাড়ি থাকে তখন আমাদের জন্য নিজের কলিজা কেটে দিতে রাজি। কিন্তু বাবা যখন বাহিরে থাকে তখন মা যেন আর মা থাকে না হয়ে যায় একটা ডাইনি। যখন সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছি তখন যেন আরও ভয়ংকর হয়ে গেছে। কারণে অকারণে আমাকে আর আমার বোনকে মারধর করে। বাবার কাছে যদি নালিশ করি তাহলে পরদিন বাবা বাড়ি না থাকলে আরও মারে। বোনকে লেখা পড়া করতেও দেয় না। আমি অনেক কষ্টে লেখা পড়া করে যাচ্ছি। এই লেখা পড়ার জন্য অনেক খোঁটা খেতে হয়‌। তবুও বাবার কথায় লেখা পড়া করে যাচ্ছি। যখন মা বকা দেয় তখন বাবা আমায় ডেকে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”বাবা রে তোরে তোর মায় যত ই মারুক আর বকা দিক না কেন তুই কিছু বলবি না। বরং সব সময় শ্রদ্ধা ও সম্মান করবি। আর সব সময় মনে রাখবি, সব কিছুর প্রতিবাদ করতে নেই। অনেক সময় চুপ থাকতে হয় আবার অনেক সময় একটা মুচকি হাসি ই প্রতিবাদের সমান হয়।” বাবার কথা টা ই মেনে চলার চেষ্টা করি আমি।

বাবা এখনো মাকে বকেই চলছে। আমি আর এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে হাত মুখ ধুয়ে আমার ঘরে চলে এলাম। একটু পর বাবা বোন কে নিয়ে আমার রুমে এলো। আমি বললাম,”কিছু বলবে ?”
বাবা আমার খাটে বসে বলল,”হ্যাঁ রে বাবা বলবো।”
– আচ্ছা বলো।
– শোন বাবা, মানুষের মুখে ত শুনিস ই কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।
– হ্যাঁ বাবা।
– তোর মা ও ঠিক কুকুরের লেজের চেয়ে কম কিছু না। যত ই বকাবকি করি না কেন সে ভালো হবে না। তোদের মারবেই‌। আমি জানি এখন যদি আমি বাড়ি থেকে চলে যাই তাহলে সে আবার তোদের মারবে। কারণ, মৌমাছির চাকে ঢিল দিলে মৌমাছি তেড়ে আসে। এখন আমার বকা খেয়ে তোর মা মৌমাছির মত হয়ে গেছে। এখন সুযোগ পেলে তোদের খুব মারবে‌। তাই আমি চিন্তা করেছি কয়েকদিন আমি দোকানে যাবো না।
– তাহলে দোকান চালাবে কে ? দোকান না চালালে ত আর আমাদের পেটে খাবার জুটবে না।
– এ নিয়েই তো কথা বলতে এলাম।
– আচ্ছা বলো।
– তুই এখন তোর মামার বাড়ি গিয়ে তোর মামাকে নিয়ে আসবি।
– আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।
– এখনি যা।
– আচ্ছা।
– আর শোন সাবধানে যাস। রাস্তায় কোথাও দাঁড়াস কিন্তু কারণ এখন দিন কাল ভালো না।
– ঠিক আছে।

বাবা বোনকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি তারাতাড়ি তৈরি হয়ে বের হয়ে গেলাম। একটা রিক্সা নিয়ে মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মামারনঞট বাড়ি অবশ্য বেশি দূরে না। রিক্সা করে যেতে পঁচিশ মিনিটের মত লাগে আর হেঁটে গেলে চল্লিশ মিনিটের মত লাগে।

রিক্সা এসে মামার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে। রিক্সা থেকে নামতেই দেখি মামা-মামী আর মামাতো বোন কোথাও যাবার জন্য বের হয়েছে। রিক্সা ভাড়া দিয়ে দৌড়ে গেলাম মামাদের সাথে। মামা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন,”কি রে না জানিয়ে হঠাৎ চলে এলি ?”
আমি বললাম,”একটু দরকার আছে তাই।”
– কি দরকার বল।
মামী মামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”দেখছো না ছেলেটা দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছে ? ওকে একটু শান্ত হতে দাও তারপর জিজ্ঞেস করো।”
আমি বললাম,”না না সমস্যা নেই মামী।”
মামী বললেন,”তা কেমন আছো সিফাত ?”
আমি বললাম,”ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো ?”
– ভালো আছি। তোমাদের বাড়ির সবাই কেমন আছেন ?
– ভালো ই আছে।
– এবার বলো কি এমন দরকার যে না বলে হঠাৎ চলে এসেছো।
– তোমরা কোথাও যাচ্ছিলে নাকি ?
– তেমন কোথাও না। তোমার মামা বলছিল আজকে ঘুরতে নিয়ে যাবে তাই বের হলাম আর কি। এবার কি দরকার বলো শুনি।
– বাবা বলেছে মামাকে নিয়ে যেতে।
– কেন কিছু হয়েছে নাকি ?
– না তবে বাবা বলেছে তারাতাড়ি নিয়ে যেতে।
মামা বলল,”মিতালী (মামির নাম) দুলাভাই যেহেতু বলেছে তাহলে ওখানে যাওয়া দরকার। কারণ দুলাভাই কোনো কারণ ছাড়া আমাকে ডাকে না।
মামী বললেন,”হ্যাঁ তা ঠিক বলেছো। তাহলে চলো আজকে আমরা ওখানেই যাই।”
মামা বলল,”ঠিক আছে।”

দুইটা রিক্সায় নিয়ে মাম-মামী, মামাতো বোন আর আমি আমাদের বাসায় চলে আসি। বাবা আমাদের দেখে ঘর থেকে বের হলো। মামা গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর মামা বাবাকে জিজ্ঞেস করল,”দুলাভাই আপনি নাকি আমাকে আসতে বলেছেন ?”
বাবা বললেন,”হ্যাঁ বলেছি।”
– কেন কিছু হয়েছে নাকি ?
– তেমন কিছু না। তোমরা আমার ঘরে আসো পরে বলছি।
– আচ্ছা চলুন।

বাবা ওদের নিয়ে ঘরে গেছেন। আমি ও ওদের পেছন পেছন ঘরে এলাম। বাবা আমাকে দেখে বলল,”সিফাত বাবা বড়দের কথার মাঝে ছোটদের থাকতে নেই। তুই শিফাকে আর তানিয়াকে (মামাতো বোন) বাহিরে খেল গিয়ে।”
আমি,”আচ্ছা বাবা” বলে ওদের দুজনকে নিয়ে বাহিরে চলে এলাম। তানিয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,”মানুষ এতটা হারামী হতে পারে জানা ছিল না।”
আমি বললাম,”কেন আমি কি করেছি ?”
– কতদিন আমাদের বাড়ি যাস না ?
– বেশি দিন না এই ছয় মাস হবে হয়তো।
– ছয় মাস কি বেশি দিন না নাকি ?
– না ত।
– তা দিন কাল কেমন যাচ্ছে এখন ?
– তুই ত বুঝিস ই দিন কাল কেমন যাওয়ার কথা।
– হ্যাঁ তা ঠিক। সৎ মা ত আর নিজের মায়ের মত আপন ভাবে না কখনো। এখনো কি ওনি তোদের মার ধর করেন ?
– তুই শিফার দিকে একটু তাকিয়ে দেখতো।

তানিয়া শিফার দিকে তাকিয়ে হা করে রইল। তানিয়া হচ্ছে, আমার একমাত্র মামা-মামীর একমাত্র মেয়ে। সে আমার তিন মাসের ছোট। তাই তাকে তুই তুই করেই বলি। ছোট থেকেই আমাদের দুজনের মাঝে খুব ভাব ছিল। ছোট বেলায় সপ্তাহে কম করে দুদিন মামার বাড়ি না গিয়ে পারতাম না। তানিয়া ও আমার সাথে আমাদের বাড়ি আসার জন্য কান্নাকাটি করতো।

[চলবে]