সৎ মা পর্ব-১২

0
189

#সৎ_মা (১২)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

পরেরদিন সকালে সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে, মামা-মামী, তানিয়া আর শিফার থেকে বিদায় নিয়ে ভার্সিটি এসে স্থানান্তর সনদপত্র নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মামা-মামী, তানিয়া, বোন কেউ ই আমাকে আসতে দিতে চায়নি। কিন্তু আমি জোর করে চলে এসেছি। তারা বলেছিল আমার ঠিকানা দিতে তাও দিইনি। কারণ, জন্মদাতা বাবা যেহেতু নিজের ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় সেহেতু আমার মামার বাড়ি থাকার কোনো প্রশ্ন ই আসে না। তবুও থেকে যেতাম কিন্তু, এমনেতেই মামার উপর শিফার ভার দেওয়া হয়েছে তার সাথে যদি আমি ও থাকি তাহলে মামার এই ভার বইতে জুলুম হবে। হয়তো মামা মুখ ফুটে বলত না কিন্তু আমি দেখলে আমার নিজের ই খারাপ লাগতো। এসব ভেবে চলে আসি। আর তাছাড়া সাদ্দাম ভাইয়া বলে দিয়েছে আজকে চলে যেতে। আমি যদি না যাই তাহলে তারা কষ্ট পাবে।

অবশেষে ঢাকা এসে পৌঁছালাম। একটা রিকশা নিয়ে ভাইয়ার কাছে চলে এলাম। ভাইয়া আমাকে দেখে বলে উঠল,”কি রে এত তারাতাড়ি চলে এলি যে ?”
– হ্যাঁ ভাইয়া।
– বিকালে আসলে ই ত পারতি। আচ্ছা সমস্যা নেই কালকে তোকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে আসবো।
– ঠিক আছে।
– আচ্ছা এখন বাড়ি যা গিয়ে বিশ্রাম কর।
– ঠিক আছে। আচ্ছা তোমার মোবাইল টা দাও ত।
– মোবাইল বাড়িতে ই রেখে আসছি।
– আচ্ছা।

বাড়ি এসে শুয়ে শুয়ে ভাইয়ার মোবাইল টিপলাম কিছুক্ষণ। তারপর গোসল করে খাওয়া দাওয়া করে ভাবলাম একটু ঘুম দেওয়া যাক। তাই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

পরেরদিন ভাইয়া আমাকে একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিল। নতুন জায়গায় ভর্তি হয়ে খুব ভালো ই লাগলো। কিন্তু আফসোস, এখানে পুরোনো সেই বন্ধুদের পাবো না‌, আগের মতো আর সবাই মিলে মজা করতে পারবো না‌।

আস্তে আস্তে কেটে গেল ছয়টা বছর। এখন আমি একটি ব্যাংক ম্যানেজার। এই ছয় বছরে আমি সাদ্দাম ভাই আর ওনার পরিবারের কাছে একদম কলিজা হয়ে গেছি। আমার কিছু হলে ওরা যেন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। এই ত গত মাস খানেক আগে আমার খুব জ্বর হয়েছিল। ভাইয়া আর বাবা না পারে হাসপাতাল কিনে বাড়ি নিয়ে আসে। আর মায়ের কথা না বললেই নয়। মা ত আমার মাথার পাশ থেকে একটুর জন্য ও উঠতে চায়নি। নিজের মা বেঁচে থাকলে হয়তো এমনি হতো। কিন্তু সৎ মায়ের কাছ থেকে ত শুধু কষ্ট পেয়েছি। জ্বর হলে বাবা যদি বাড়ি না থাকতো, তাহলে জ্বর নিয়ে ই কাজ করতে হতো। আর এখানে এসে মনে হয়নি যে, ওনারা আমার আপন কেউ না। সত্যি ই এদের মত মানুষ হয় না। তাদের প্রতিদান হয়তো আমি দিতে পারবো না, কিন্তু কখনো কষ্ট পেতে দিব না।

সকাল সকাল ব্যাংকে প্রবেশ করতেই একজন কর্মকর্তা এসে আমার হাতে বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,”কার বিয়ের কার্ড এটা ?”
– আমার ছোট ভাইয়ের স্যার।
– আমাকে কেন দিলেন ?
– স্যার, আপনি আমাকে সেদিন চাকরি টা দিয়ে এত বড় উপকার করলেন। আমি হয়তো আপনার প্রতিদান দিতে পারবো না। তাই নিয়ত করেছি আমার ছোট ভাইয়ের বিয়েতে আপনাকে নিব। আমার মা ও বলেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে। আপনাকে যেতে ই হবে নয়তো আমি ও আমার মা খুব কষ্ট পাবো। আমি যতটা না কষ্ট পাবো, তারচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে আমার মা।
– আচ্ছা ঠিক আছে যাবো কিন্তু বিয়ে কবে ?
– আগামী পরশু।
– পরশু ভাইয়ের বিয়ে আর আজকে আপনি ব্যাংকে কি করেন ? যান বাড়ি যান। বাড়ি গিয়ে টুকটাক যা কাজ আছে তা সেরে নিন। আর চিন্তা করবেন না, আপনি টাকা পেয়ে যাবেন।
– আরে স্যার টাকার চিন্তা করি না। আজকে আমি আসতাম ই না। এসেছি শুধু আপনাকে দাওয়াত করতে।
– ঠিক আছে তাহলে এখন বাড়ি চলে যান।
– আচ্ছা স্যার।

লোকটি চলে গেল। ও লোকটির নাম ই ত বলা হয়নি। ওনার নাম রাকিব। আমার চেয়ে দু-তিন বছরের বড় হবে হয়তো। আমি ওনাকে আপনি আপনি করে ই বলি। বিয়ে, জন্মদিন বা যেকোনো অনুষ্ঠান ই হোক না কেন আমার ভালো লাগে না। রাকিবের ভাইয়ের বিয়েতে ও যেতাম না‌। কিন্তু যেহেতু বলেছে, তার মা কষ্ট পাবে তাই ভাবছি যাবো। কারণ, আমার তো আর মা নেই। আমি মায়ের মর্ম টা বুঝি। আজকে যদি আমার মা বলতো, তাহলে না গিয়ে পারতাম না‌। নিজের মায়ের কথা ত আর রাখতে পারবো না, তাই অন্যের মায়ের কথা টা ই না হয় রাখলাম।

দুইদিন কেটে চলে এলো রাকিবের ভাইয়ের বিয়ের দিন। রাকিব খুব সকালে ই আমার বাড়ি চলে এলো আমাকে নিয়ে যেতে। রাকিবের সাথে রাকিবের বাড়ি চলে এলাম। দেখলাম, বাড়িটা তেমন বড়সড় না। তবে বাড়ির পরিবেশ ভালো। কিছু কিছু বাড়ি আছে খুব বড় কিন্তু বাড়ির পরিবেশ একদম যাতা। এইদিক দিয়ে বলতে হবে রাকিবের বাড়ি টা খুব ভালো। রাকিব আমায় একটা ঘরে এনে বসতে বলল। ঘর টা বেশ পরিপাটি করে রাখা। আমি রাকিবকে উদ্দেশ্য করে বললাম,”রাকিব সাহেব, আপনার ভাই আর মা কে নিয়ে আসেন ত।”
– ঠিক আছে স্যার আপনি একটু বসুন।

একটু পর ওনি ওনার মা ও ভাইকে নিয়ে এলো। আমি ওনার ভাইকে দেখে পুরো ই অবাক। কারণ, সে হচ্ছে আমার পুরোনো বন্ধু আকিব। নরসিংদী তার নানা বাড়ি। সেখানে ই সে থাকতো ও পড়ালেখা করতো। সেখানে থাকতে তার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সৎ মায়ের অত্যাচারের কথা তার কাছে বললে সে সান্তনা দিয়ে বলত,”আরে এসব কিছু না। এখন এমন করছে একদিন দেখবি বুঝতে পারবে তখন আর এমন করবে না। তাই বলছি এসব নিয়ে মন খারাপ না করে একটু মানিয়ে নে।”

আকিব এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। আমি ও জড়িয়ে ধরলাম। দুজনের অজান্তেই দুজনের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল। চোখ গুলো মুছে আমি জিজ্ঞেস করলাম,”কি রে এখানে এলি কবে ?”
– এইতো ভাইয়া চাকরিতে যোগ দেওয়ার তিনদিন পর।
– ওহ্ আচ্ছা, রাকিব সাহেব তাহলে তোর ই ভাই।
– হ্যাঁ।
আকিব তার মা ও ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল,”মা, ভাইয়া তোমাদের আমার এক বন্ধুর কথা বলতাম মনে আছে, যে ওর আপন মা নেই, সৎ মা খুব অত্যাচার করে ?”
তার মা, ভাই মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। তারপর সে আবার বলতে লাগলো,”এই সেই বন্ধু আমার।”
রাকিব বলতে লাগলো,”এ ই তো আমাদের ব্যাংকের ম্যানেজার।”
আকিব আমাকে জিজ্ঞেস করলো,”কি রে সিফাত সত্যি নাকি ?”
আম বললাম,” হ্যাঁ রে বন্ধু। আচ্ছা তোর নাকি আজকে বিয়ে, তাহলে তুই গিয়ে তৈরি হয়ে নে পরে কথা বলা যাবে।”
– ঠিক আছে। আর শোন, তুই কিন্তু আমার সাথে থাকবি।
– আচ্ছা থাকবোনে।

রাকিব তৈরি হতে চলে গেল। ভাবতে লাগলাম, তার সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো। কত ই না মধুর ছিল আমাদের পুরনো দিন গুলো। আকিব ও আমার মত এতিম। আমার মা নেই আর তার বাবা নেই। তবে এখন আমার আপন মা না থাকলে ও একটা মা আছে যে কি না আপন মায়ের চেয়ে কম না।
এক দিন আকিব মজা করে বলেছিল,”তোর বোনকে বিয়ে করে তোকে আমি সুমন্ধী বানাবো।” হঠাৎ ই বোনের কথা মনে পড়ে বুক টা ধুক করে আসলো। সেই ছয় বছর আগে সার্টিফিকেট আনতে গিয়ে যে শেষ দেখা হয়েছে, এরপর আর কখনো নরসিংদী যাই ও নি বোনকে দেখতে ও পাইনি। বোন টা ও এতদিনে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে। হয়তো মামা তার বিয়ে ও দিয়ে দিয়েছে। না অনেকদিন বোনকে দেখিনি। দু-তিন দিনের মধ্যে নরসিংদী গিয়ে বোনকে দেখে আসবো।

রাকিব এসে আমায় বলল,”স্যার মা আপনাকে ডাকছে।”
আমি ওনার দিকে চোখ বড় করে বললাম,”স্যার মানে কি হ্যাঁ ? আমি ত আপনার ছোট ভাইয়ের বন্ধু তাই না ?”
– হ্যাঁ।
– তাহলে স্যার বললেন কেন ?
– তাহলে কি বলবো ?
– নাম ধরে ডাকবেন।
– না স্যার, আপনাকে নাম ধরে ডাকলে বেয়াদবি হবে।
আবার ও চোখ মটকে বললাম,”কিসের বেয়াদবি হ্যাঁ ? আমি কি আপনার বড় নাকি যে, আমাকে নাম ধরে ডাকলে আপনার বেয়াদবি হবে ?”
ওনি কিছু বলতে পারল না শুধু মাথা নিচু করে রইল। আমি আবার ও বললাম,”শোনেন যা বলছি তা ই করবেন। যখন অফিসে মানুষের সামনে থাকবো তখন স্যার বলবেন। অন্য সময় নাম ধরে ডাকবেন আর তুমি করে বলবেন নয়তো তুই করে বলবেন।
– ঠিক আছে। এখন চলো, মা কি যেন বলবে তোমায়।

রাকিব ভাইয়ের সাথে আমি ওনার মায়ের কাছে চলে এলাম। আমাকে দেখে ওনি ই বলতে শুরু করলেন,”সিফাত বাবা, তোমাকে আমি একটা হুকুম দিই ?”
– ঠিক আছে দিন।
– আবার রাগ করবে না ত ?
– আরে না। রাগ করবো কেন ? আপনি কি হুকুম দিবেন দিন।
– দেখ বাবা, তুমি তো জানো ই তোয়ার বন্ধুর বাবা নেই। রাকিব একা ত আর সব ঝামেলা শেষ করতে পারবে না। তাই বলছি, তুমি একটু ঝামেলা গুলো শেষ করে দিও।
– ঠিক আছে আন্টি চিন্তা করবেন না আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো।
– আচ্ছা।

চলব।