সৎ মা পর্ব-১৩

0
184

#সৎ_মা (১৩)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

রাকিব ভাইয়ের সাথে ওনার মায়ের কাছ থেকে চলে এলাম। রাকিব ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিষয়ে রেগে আছে। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,”কি ব্যাপার ভাই, আপনি কারো উপর রেগে আছেন নাকি ?”
– রাগবো না ত কি করবো তুমি ই বলো ?
– রাগার কারণ টা বলেন।
– আরে আর বলো না। আমাদের বাড়ি থেকে বারোটার দিকে বের হয়ে যাবার কথা কিন্তু তোয়ার বন্ধু এখনো তৈরি ই হয়নি। তোমার বন্ধুকে কি বলবো, বাড়ির একটা মহিলা ও এখনও তৈরি হয়নি।
– আরে ভাই, এতে রাগার কি আছে ? আচ্ছা, আমি গিয়ে আকিব কে তৈরি করছি আর আপনি গিয়ে মহিলাদের তাড়া দেন।
– ঠিক আছে।

আমি চলে এলাম আকিবের কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকিব কে তৈরি করে দিলাম। কিন্তু এখনো জানি না সে বিয়ে করবে কোথায় বা মেয়ের নাম কি। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম,”কি রে বিয়ে করবি কোথায় ?”
– নরসিংদী রে।
নরসিংদী শুনেই বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। একটু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”মেয়ের নাম কি ?”
– নাদিয়া।
– ওহ্ আচ্ছা!
– চিনেছিস ?
– আমি চিনবো কীভাবে ?
– কি বলিস এখনো চিনিস নাই ওকে। ওই যে আমাদের সাথে পড়তো নাদিয়া ওর কথা বলছি আমি।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম,”ওই যে হিজড়া বলে ক্ষেপাতাম ওই নাদিয়া নাকি ?”
– আরে হ্যাঁ।
– তা বিয়ে যে করছিস প্রেম করে নাকি ?
– হ্যাঁ।
আকিবের মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে বললাম,”শেষ পর্যন্ত একটা হিজড়ার পালায় পড়লি ?”
আকিব মুখ টা কালো করে বলল,”এখন আর সে আগের মত চলাফেরা করে না। এখন পর্দা করে, নামাজ পড়ে পাঁচ ওয়াক্ত। ছেলেদের সাথে ও আর চলাফেরা করে না আগের মত। এমনকি কোনো ছেলের সাথে নিজে থেকে কোনো কথা ও বলে না।”

নাদিয়া মেয়েটা ছিল খুব ভালো। মুখে যেন সারাদিন মধু লেগে থাকতো। যেকোনো মানুষের সাথে ই খুব সহজে বন্ধুত্ব করে ফেলতে পারতো। তবে তার চাল চলন ছিল একটু ছেলেদের মতো। কথা বার্তা বলতো ছেলেদের মতো। যার কারণে, আমি আর আকিব ওকে হিজড়া বলে ক্ষেপাতাম। একদিন ত আমি ওকে হিজড়া বলার পর, আমার থেকে হিজড়াদের মত তালি বাজিয়ে প্রায় পাঁচশ টাকা নিয়ে নিয়েছিল। তখন আমার জন্য পাঁচশ টাকা অনেক কিছু ছিল।

আমার কথায় যে আকিব কষ্ট পেয়েছে তা আমি খুব ভালো করে ই বুঝতে পেরেছি। তাই তাকে একটু মজা করে বললাম,”দুলাভাই, আমার বকশিশ টা কিন্তু দিয়ে দিয়েন।”
– আমি তোর দুলাভাই হলাম কীভাবে রে ?
– বান্ধবীর স্বামী হয়ে।
– তোর কাছে আগে বান্ধবী নাকি বন্ধু ?
– আগে তুই বল, তোর কাছে বান্ধবী আগে নাকি বৌ আগে নাকি বন্ধু আগে ?
আকিব কিছুক্ষণ ভেবে বলল,”বন্ধু আগে।”
– বন্ধু ই যদি আগে হতো তাহলে আমি মনে হয় তোর বন্ধু না ?
– হঠাৎ এই কথা কেন ?
– আমাকে যদি বন্ধু ই ভাবতি, তাহলে আমার কথা টা এতটা গুরুতরভাবে নিতি না‌।
– কোন কথা ?
– না কিছু না। আচ্ছা চল এখন নিয়ম কানুন শেষ করে আবার আমাদের বেরুতে হবে।

আকিব কে নিয়ে বাহিরে এলাম। দেখি মহিলাদের সাজগোজ শেষ। তারপর বর বের হবার আগের নিয়ম গুলো শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়ি‌। ( বরযাত্রী যাবার আগে বর কি নিয়ম পালন করে তা আমার জানা নেই। তাই আর বিবরণ দিতে পারলাম না। দুঃখিত) আমি আকিব আর আকিবের এক বোন এক গাড়িতে অর্থাৎ বরের গাড়িতে। অন্যরা অন্য গাড়িতে। সব মিলিয়ে দশ টা গাড়ি হয়েছে।

অবশেষে আমরা কনের বাড়ি অর্থাৎ নাদিয়াদের বাড়ি চলে এলাম। গাড়ি থেকে নেমে গেইটের কাছে আসতেই গেইট আটকানো কিছু মেয়ে আর ছোট বাচ্চা আমাদের কাছে টাকা চাইতে লাগলো। প্রথমে ত্রিশ হাজার টাকা পরে অনেক কষ্টে পঁচিশ হাজার টাকায় এসে আটকে গেল। টাকা না দিলে নাকি সারাদিন দাঁড় করিয়ে রাখবে তবুও ভেতরে যেতে দিবে না। কি আর করা, পকেট থেকে একটা খাম বের করে একজনের হাতে দিয়ে দিলাম। যেটাতে আমি আগে থেকে ই কাঁঠাল পাতা কুড়িয়ে আঠা মেরে দিয়েছিলাম। বর যান নিয়ম পালন করছিলো, তখন আমি একটা বাচ্চাকে নিয়ে এসব করেছিলাম। ওরা খাম ভারি দেখে না আর খুলে দেখলো না কি আছে সরাসরি গেইট থেকে সরে গেল‌। পাত্র পক্ষ ও পাত্রী পক্ষ উভয়েই খুশি। পাত্রী পক্ষ খুশি কারণ, ওরা পঁচিশ হাজার টাকা পেয়ে গেল‌ আর পাত্র পক্ষ খুশি কারণ, গেইটে কোনো টাকা ই লাগেনি।

অবশেষে বিয়ের ঝামেলা শেষ হয়ে গেল। এবার আমাদের রওনা দেবার পালা। কিন্তু ঘটলো এক বিপত্তি। আকিব আর আকিবের সাথে যারা ছিলাম আমাদের কারো জুতা ই খুঁজে পাচ্ছি না। বুঝতে আর বাকি রইল না যে, এসব পাত্রী পক্ষ ই করেছে। আমাদের জুতা নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাতে কি ? আসার সময় ই আমরা মার্কেট থেকে আমাদের জন্য অতিরিক্ত জুতা কিনে নিয়েছিলাম। অতঃপর ওই জুতা পরে ই গাড়িতে চলে এলাম। স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম যে, কয়েক জনের মুখ কালো হয়ে গেছে। আরও বুঝতে পারলাম, তারা ই আমাদের জুতা লুকিয়ে ছিল। ভেবেছিল পরে টাকা নিয়ে জুতা ফেরত দিয়ে দিবে। কিন্তু তা আর হলো না।

সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আমি আকিবের কাছে গিয়ে বললাম,”আকিব দোস্ত তোরা যা আমি এখন যাবো না।”
– কেন আর থাকবি কোথায় তাহলে ?
– অনেক বছর বোন কে দেখিনি। একটু মামার বাড়ি থেকে ঘুরে সবার সাথে দেখা করে আসবো, সাথে দূরে থেকে বাবা কে ও এক নজর দেখে আসবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু সাবধানে যাস।
– ও নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। আর শোন, কোনো ঝামেলা হলে আমাকে বলবি।
– আচ্ছা।

আকিবের থেকে বিদায় নিয়ে রাকিব ভাইয়ের কাছে এলাম। রাকিব ভাই জিজ্ঞেস করল,”কিছু বলবে নাকি ?”
– হ্যাঁ ভাইয়া।
– আচ্ছা বলো।
– ভাইয়া আপনারা যান আমি একটু আমার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো। আর কোনো ঝামেলা হলে আমাকে ফোন দিবেন।
– আচ্ছা ভাই।

রাকিব ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় চলে এলাম। একটা সিএনজি নিয়ে মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মনের ভেতর অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। ওরা আমাকে দেখে কি বলে কে জানে ? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ওরা সুস্থ আছে ত ? আমার বোন টা সুস্থ আছে ত ? সাদ্দাম ভাইয়ের পরিবারের সাথে থেকে নিজের আপন মানুষ গুলোর কথা একদম ভুলে ই গেছি। প্রথম কয়েকদিন মনে ছিল কিন্তু পরে আর মনে পড়েনি।

সিএনজি এসে মামার বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। ভাড়া টা মিটিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেখি বাড়িতে কেউ নেই ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। মনে হচ্ছে অনেকদিন যাবৎ তালা খুলা হয়নি। পাশের বাড়ির এক মামীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”মামী, আমার বোন মামা-মামী ও মামাতো বোন ওরা কোথায় ?”
ওনি আমার আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,”তোমাকে চিনতে পারলাম না, কে তুমি বাবা ?”
– আপনাদের পাশের বাসার মতিউর আছে না ?
– হ্যাঁ। তুমি কি হও মতিউর ভাইয়ের ?
– আমি ওনার ভাগ্নে।
– কি বলছো ? তুমি কি সিফাত নাকি ?
– হ্যাঁ মামী।
– এতদিন কোথায় ছিলে ? তোমার বোন টা তোমার জন্য ছাছিলা হয়ে গিয়েছিল। তোমার মামা ও তোমাকে অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি।
– ছিলাম যেখানেই হক‌। এখন বলুন মামা রা কোথায় গেছে ?
– তোমার মামা তো সেই কবে ই সবাই কে নিয়ে ঢাকা চলে গেছে।
– ঢাকা কোথায় আছে বলতে পারবেন ?
– না বাবা, যাবার সময় আমাকে শুধু বলেছে ওরা ঢাকা যাবে আর কিছু বলেনি।
– আচ্ছা মামী ভালো থাকবেন তাহলে। আমি যাই।
– যাই মানে ? মাত্র ত এলে। খাওয়া দাওয়া করে যাও।
– না মামী খেয়েছি।

আর কিছু না বলে বা কিছু শোনার অপেক্ষা না করে আমি বেরিয়ে গেলাম। এখন উদ্দেশ্য, বাবার দোকানে যাবো। বাবাকে দুই নয়নে ভালো করে দেখে চলে আসবো।

[অনেক ই বলছেন যে, ছয় বছরে নিজের বোনের কথা মনে পড়েনি নাকি বা নিজের বাবার খোঁজ খবর নেওয়ার কথা মনে পড়েনি নাকি ?
উত্তরঃ- মাস খানেক যদি কারো সাথে কোনো ভাবে যোগাযোগ করা না হয় তাহলে, এক সময় তাদের কথা মনে ও পড়ে না। আর হঠাৎ যদি কেউ সুখের আভাস পায় তাহলে, পুরোনো দিন গুলো ভুলে যায়। ভুলে যায় পুরোনো কথা, পুরোনো মানুষ, পুরোনো অনেক স্মৃতি ই। তবে মাঝে মধ্যে যদি পুরোনো কিছু সামনে আসে তাহলে আবার পুরোনো সব কিছু ই মনে পড়ে যায়।
উদাহরণঃ একটা গরু, ছাগল, হাঁস বা মুরগি কিনে আনলে, প্রথম কয়েকদিন দেখা যায় যে পুরোনো মালিকের কাছে চলে যাবার জন্য খুব ছটফট করে, খুব পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যখন মাস দুয়েক এক চলে যায়। পরে দেখা যায় যে নতুন মালিকের সাথে ও নতুন বাড়িতে ই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। পুরোনো মালিক বা বাড়ির কথা আর মনে ও আনে না।

হয়তো বুঝতে পারছেন, আবার হয়তো বুঝতে পারেননি তবে কথা গুলো বাস্তব। ধন্যবাদ]