সৎ মা পর্ব-১৪

0
202

#সৎ_মা (১৪)
#সামসুজ্জামান_সিফাত

বাবার দোকানের সামনে এসে দেখি দোকানে চৌদ্দ কি পনেরো বছর বয়সের একটি ছেলে বসে আছে। হয়তো বা বাবার কর্মচারী হবে। দোকানের উপরে তাকিয়ে দেখি, দোকানের নাম এখনো আগের টাই আছে। দোকানে এলাম। এখন দেখা যায়, এখানে চা ও বিক্রি করা হয়। তাই দোকানের ছেলেটাকে বললাম,”ছোট ভাই, এক কাপ চা দাও ত।”
– আচ্ছা ভাইয়া বসেন দিচ্ছি।

কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেটা চা এনে দিল। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম,”ভাই বিস্কুটের প্যাকেট দাও ত একটা।”
ছেলেটি কিছু না বলে, একটা বিস্কুটের প্যাকেট এনে দিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,”তোমার নাম কি ভাই ?”
– আরিয়ান।
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না এটা আমার সৎ মায়ের ছেলে আরিয়ান। সেই ছয় বছর আগে শেষ দেখেছিলাম। ছয় বছরে সে বেশ বড় হয়ে গেছে। চেহারা ও পাল্টে গেছে তাই চিনতে পারিনি। আমি তাকে আবার ও জিজ্ঞেস করলাম,”ভাই তোমার বাবা কোথায় ?”
– বাবা দোকানের জন্য মাল আনতে গেছে। এসে পড়বে এখনি।
– আচ্ছা ঠিক আছে।

চা বিস্কুট খেতে খেতে আরিয়ানের সাথে গল্প করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা মাল নিয়ে চলে এলো। বাবাকে দেখে চেনার মতো অবস্থা নেই। আগের চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে। শরীর ভেঙ্গে গেছে। কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকার পর চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি বের হয়ে গেল। বুঝতে পারছি এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারবো না। তাই তারাতাড়ি চা আর বিস্কুটের টাকা দিয়ে একটু দূরে চলে এলাম। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছি, বাবার কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। না আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। বাবাকে এই অবস্থায় দেখে আমার নিজেকে খুব বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। চোখ দিয়ে ত পানি পড়ছে ই। একটা রিকশা ডেকে রেল স্টেশনে চলে এলাম।

অবশেষে ঢাকা এসে পৌঁছালাম। চোখের মধ্যে এখনো বাবার চেহারাটা ই ভেসে উঠছে। চুপচাপ বাসায় এসে নিজের ঘরে চলে এলাম। কাপড় না পাল্টে ই শুয়ে পড়লাম। শুয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে চোখ লেগে এলো।

হঠাৎ সাথী এসে ডাকতে লাগলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রাত হয়ে গেছে। আমি উঠে জিজ্ঞেস করলাম,”কি হয়েছে‌ ডাকছিস কেন ?”
– বাবা তোমাকে ডাকছে।
– আচ্ছা যা আমি আসছি।

সাথী চলে যায়। আমি হাতমুখ ধুয়ে বাবার কাছে এলাম। বাবা আমাকে দেখে ই বলে উঠলো,”সিফাত বাবা তোর আজকে কি হয়েছে ?”
– কিছু ত হয়নি কিন্তু কেন ?
– সেই বিয়ে খেয়ে আসার পর যে কাউকে কিছু না বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছিস আর উঠিসনি।
– শরীর টা ক্লান্ত লাগছিল তাই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
– তোর চোখ ত বলছে অন্য কিছু।
– আরে না বাবা।
– দেখ আমাদের সাথে মিথ্যা বলার চেষ্টা করিস না কখনো। যা সত্যি তা বল।
আমি ওনাকে আমার বাবার অবস্থার কথা বললাম। তিনি কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে বলল,”তুই একটা জিনিস ভুল করেছিস।
– কি ভুল করেছি!
– এতদিন পর বাবার সামনে গেলি কিন্তু বাবার সাথে কথা বললি না বা তোর বাবাকে তোর পরিচয় দিসনি‌।
আমি কিছু বললাম না। তিনি আবার ও বলতে লাগলো,”আচ্ছা যা হবার হয়ে গেছে। তবে আমি বলি কি, সপ্তাহ খানেক পর গিয়ে তোর বাবার সাথে দেখা করে আয়।”
– ওনি যদি আমাকে দেখে কিছু বলে ?
– আশা করি বলবে না বরং খুশি হবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে তবে তার আগে আমাকে আরো একটা কাজ করতে হবে।
– কি কাজ ?
– আগে আমার বোন, মামা-মামী আর মামাতো বোনকে খুঁজে বের করতে হবে। শুনেছি ওরা নাকি ঢাকা এসেছে‌।
– তাহলে তো সহজ হয়ে গেল। কিন্তু তাদের কি তুই চিনতে পারবি ?
– হ্যাঁ অবশ্যই চিনতে পারবো।
– আচ্ছা তাহলে কালকে থেকে ই খুঁজতে শুরু করিস। এখন খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড় গিয়ে। কালকে আবার তোর ব্যাংক আছে।
– তোমরা খেয়েছো ?
– তকে ছাড়া আমরা কখনো খেয়েছি বল ?
– না। তার মানে আজকে ও খাওনি। আচ্ছা তারাতাড়ি খেতে আসো।

সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করে আমি আমার ঘরে এসে শুয়ে পড়ি। ভাইয়ার সাথে কিছু কথা ছিল কিন্তু ভাইয়া কোনো কথা না শুনে আমাকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিল। ভাইয়া এখন আর অন্যের দোকানে কাজ করে না। ভাইয়া নিজেই দোকান খুলেছে। আমি কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভাইয়া আমার থেকে টাকা নেয়নি। এ নিয়ে অনেকদিন আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য ছিল। পরে আবার ভাইয়া নিজেই এসে বলে পরে দরকার পড়লে নিবে।

এখনো মাথায় শুধু বাবার কথা ই ঘুরপাক খাচ্ছে। আর বাবার ভেঙ্গে যাওয়া চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে। মনে হচ্ছে যে, আজকে আর ঘুম হবে না। তাই ড্রয়ের থেকে দুইটা ঘুমের ট্যাবলেট বের করে খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে ঘুম এসে পড়লো।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া করে ব্যাংকে চলে এলাম। ব্যাংকের কাজ শেষ করে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেলাম। লক্ষ্য একটাই বোন, মামা-মামী আর তানিয়াকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু এই ব্যস্ত শহরে আমি একা তাদের কোথায় খুঁজবো ? আমি কি তাদের দেখা পাবো ? তারা কি সত্যি ই ঢাকা এসেছে নাকি অন্য কোথাও গেছে ? মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কি করি কিছু ই মাথায় আসছে না। তাদের কোনো ছবি ও নেই আমার কাছে যে, ছবি দেখিয়ে মানুষকে জিজ্ঞেস করবো। মাথায় হাজার চিন্তা নিয়ে অফিস থেকে দেওয়া গাড়ি টা এক রাস্তা শেষ করে আরেক রাস্তায় চালাতে লাগলাম। যে তাদের দেখা পাই।

পাঁচদিন ধরে খুঁজে ই চলছি কিন্তু তাদের দেখা নেই। দেখা মিলবে কীভাবে শহর টা তো আর ছোট না যে খুঁজে বের করে ফেলবো। তাছাড়া তাদের একটা ছবি ও নেই আমার কাছে। হঠাৎ গাড়িটা একটা থেমে থাকা ট্রাকের পেছনে গিয়ে লাগিয়ে দিলাম। কপালে একটু আঘাত পেয়েছি।

কপাল টা ব্যান্ডেজ করার জন্য একটা হাসপাতালে এলাম। কপাল ব্যান্ডেজ শেষে টাকা দিয়ে বের হয়ে যাবো ঠিক সেই সময় রিসিপশনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোকের মুখের দিকে নজর টা আটকে যায়। মুখটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু স্পষ্ট মনে করতে পারছি না। আমি লোকটির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম,”চাচা একটু বাহিরে আসতে পারবেন ?”
জনি আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,”কেন বাবা ?”
– একটু কথা আছে।
– আচ্ছা চলো।

লোকটি আমার সাথে বাহিরে এসে ওনি আমাকে জিজ্ঞেস করল,”বাবা তোমার না কি কথা আছে ?”
– হ্যাঁ। আসলে আপনার মুখ টা আমার খুব চেনা চেনা লাগছে কিন্তু পুরো চিনতে পারছি না।
লোকটি অবাক হয়ে বললেন,”আমাকে চেনা লাগছে!”
– হ্যাঁ চাচা।
– আমাকে চিনবে কীভাবে ? আমি ত এই শহরে আগে কখনো আসিনি যে আমাকে কোথাও দেখেছো যার কারণে চেনা লাগছে।
– শহরে না আসলেও শহরের বাহিরে হলে ও কোথাও আপনাকে দেখেছি মনে হচ্ছে।
– এটা হতে পারে।
– হ্যাঁ। আচ্ছা আপনার বাসা কোথায় ?
– আমি বাসা তো নরসিংদী।
– নরসিংদী ?
– হ্যাঁ নরসিংদী।
– নরসিংদীর কোথায় ?
– নরসিংদীর পলাশে আমার বাড়ি।
– আচ্ছা আপনার নাম কি ?
– রশিদ।
– আচ্ছা চাচা, আপনি কি সিফাত নামে কাউকে চিনেন ?”
ওনি আমার মুখে সিফাত নাম শুনে কি যেন ভাবতে লাগলো। আমি আবার বললাম,” বাবার নাম কামাল।”
ওনি শুধু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম,”কি চাচা চিনেন নাকি ?”
তিনি কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার বুঝতে বাকি রইল না এটা রশিদ চাচা। যার সাথে একটা সময় আমার খুব ভাব ছিল। আর ওনার সাথে আমার বাবার ও খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। দেখলাম ওনার চোখের কোণে পানি টলমল করছে। আমি বললাম,”আচ্ছা চাচা আপনি এখানে কেন ?”
– তোমার চাচিকে নিয়ে এসেছি।
– চাচির কি হয়েছে ?
– হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
– ওহ্ আচ্ছা।
– হ্যাঁ বাবা।
– আচ্ছা চিন্তা করবেন না। আপনি আমার সাথে চলেন আমি দেখছি। রশিদ চাচাকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকে চাচির চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়ে চাচাকে নিয়ে একটা হোটেলে এলাম।