সৎ মা পর্ব-২৫+২৬

0
293

#সৎ_মা
#পর্বঃ২৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

মা উনার কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ গরম করে বললেন,

“তুই এসব কি বলছিস সোলাইমান, তোর মাথা ঠিক আছে?”

উনি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আহা মা বড্ড বেশি বকো তুমি। আমার কথা তো শেষ করতে দাও।”

আমি এখনো উনার দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছি। উনি রিংকির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

“ওহ যা বলছিলাম মিসেস,,,,,,,, হোয়াটএভার। হুম আমার বড্ড মন কেমন করে। তবে কার জন্য জানেন? আমার সন্তানকে যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য মন কেমন করে। এই মানবীর যদি জ্বরও আসে তাহলে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। এই বুঝি আমার প্রাণ পাখিটা খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিবে। এই মানবী অভিমানে গাল ফুলালে আমার ভেতরটা বড্ড পুড়ে। আমি যে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি কয়েক বছর আগে আমাকে ছেড়ে না গেলে এই অনন্যময়ী নারীর দেখা আমি পেতাম না। আর না তাকে জীবনসঙ্গিনীর রূপে দেখতে পেতাম। আমি যে শুধু স্ত্রী পেয়েছি তা না। আমার মেয়ে মা পেয়েছে আর আমার মা মেয়ে পেয়েছে। আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আপনি চলে যাওয়ার পরে আমি আলহামদুলিল্লাহ উত্তম কিছু পেয়েছি। এখানে উপস্থিত তিনটি নারী আমার শক্তি, মনোবল আর অণুপ্রেরনা।”

আরজার বাবার কথা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বাবার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। মায়ের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। আমি এখনো উনার দিকে নিমেষহীন তাকিয়ে আছি। তখন তাকিয়ে ছিলাম অজানা আতংকে। অপ্রত্যাশিত কিছু শুনবো বলে। আর এখন তাকিয়ে আছি বিস্মিত হয়ে। আমার প্রতি উনার অনুভূতি গুলো কেমন অল্প কথায় অকপটে সবার সামনে বলে ফেললেন। রিংকি ক্রোধান্বিত হয়ে আরজার বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করলো। মনে হলো ক্রোধাগ্নির অনলে এখনই আরজার বাবাকে ভস্ম করে দিবে। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,

“আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদালত অব্দি যাবো।আর তুমিও আমার সাথে সংসার করবে।”

আরজার বাবা ধূলো ঝাড়ার ভঙ্গিতে দু’কাঁধে ফুঁ দিলেন। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,

“আমার সাথে সংসার করার চিন্তা ভুলে যান। কারন অলরেডি আমি একজনের সাথে মন দিয়ে সুখের সংসার করছি। আর তাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। বাকি রইলো আরজার কথা, আপনি মহাশয়া কোর্ট চত্বরে ঠিক কয়টা চক্কর দিতে পারেন আমি দেখে নিবো।”

রিংকি রাগে ফোঁস ফোঁস করে আবারও বললো,

“তোমার স্ত্রী তো আমাকে দেখেই কেঁদেকেটে সব এক করে ফেলেছে।সেও তোমার শক্তি?

” মাঝে মাঝে প্রেয়সীর চোখের পানিও শক্তি যোগায়। আপনি তো রোমিও জুলিয়েট ক্যাটাগরির লোক আপনার তো এগুলো সবার আগে বোঝার কথা। এখন বেশি কথা না বলে আপাতত আমার বাড়ি থেকে বের হন। নতুবা ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করতে বাধ্য হবো।”

তখনই রিংকির ভাই ভেতরে প্রবেশ করলেন। দাঁত কটমট করে রিংকি বললেন,

“চাপকে গাল একদম লাল করে দিবো। সেই কখন থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তোকে পালকি করে নিতে হবে? আমরা সব কথা শেষ করে চলে গেছি তোর আবার কিসের কাজ এখানে?” বলেই হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন।

আরজার বাবা গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে এলেন। বাবা আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। বাবাকে দেখে আরজা “নানুবাই” বলে বাবার কোলে চলে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

“আম্মু আমাল কি দুইতা নানুবাই আল দুইতা মামা?”

মাথা নেড়ে সায় জানালাম। বাবা মাকে বললেন,

“বেয়াইন আমাকে আর ইরফান কে যেতে হবে এখন।অনেক্ক্ষণ তো হলো এলাম যে।”

“কি বলেন বেয়াই? দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আপনি আর ইরফান যাবেন।” বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন মা।

ইরফান মাকে বললো,

“আন্টি অন্যদিন খাওয়া দাওয়া করা যাবে।আজ একটু মোহাম্মদপুর যেতে হবে প্রোডাক্টসের সেম্পলের জন্য। তারপর আবার একটু ভার্সিটি যাবো প্রেজেন্টেশন আছে একটা। বন্ধুদের সাথে দেখা করবো।”

“হুম বেয়াইন। তাছাড়া আমাকে বাড়ি যেতে হবে হাবিবা টা বাড়িতে একা। নিশ্চয়ই ভয় পাবে। আর বেয়াইন মাঝে মাঝে কুটুমের বাড়িতে খাওয়ার চেয়ে তাদের কথায় আর ব্যবহারে মনটা ভরে যায়। এতোদিন ধারণা করলেও আজ সত্যি সত্যি বুঝলাম আমার মেয়েটা আপনাদের চোখের মনি। একজন বাবার কাছে এর চেয়ে খুশির কি হতে পারে বলেন? আমার ছোট মেয়েটার জন্যও দোয়া করবেন।”

____________________________________________

বাবা আর ইরফান চলে গেলো। মা আমাকে বললেন,

“আজকে আর রান্না করার দরকার নেই। আজ আমরা সবাই বাইরে দুপুরের খাবার খাবো। যা ইনসিয়া গোসল করে নে। সোলাইমান নামায শেষে এলে আমরা রেডি হয়ে বেরিয়ে যাবো।”
বলেই নিজের রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। আরজা মায়ের আচঁল টেনে বললো,

“দাদুন পান খাবো।”

আমি চোখ গরম করে তাকাতেই মা বললেন,

“আহ্ বকিস না তো একটু দিবো।” বলেই আরজাকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন। আরজার বাবা রুমের দিকে এগুতেই আমিও উনার পিছু পিছু যেতে লাগলাম। রুমের ভিতরে গিয়ে ঠাস করে দরজা আটকালাম। দরজা আটকানোর শব্দে উনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আমি উনার কাছে গিয়ে উনার বুকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি দিতে লাগলাম। উনি আমার হাত দু’টো ধরে বললেন,

“আরে আরে মা’র’ছো কেন? কি করলাম আবার? এভাবে মা’র’লে হৃদপিণ্ডে ব্যথা লাগে তো।”

নাক টেনে টেনে জবাব দিলাম,

“আপনি তখন ওভাবে বললেন কেন? জানেন আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

উনি আমার হাত দু’টো ছেড়ে দিয়ে আমাকে আশ্লেষ করলেন। অনুরাগের সাথে আমার মাথায় চুমু দিয়ে বললেন,

“কি ভেবেছিলে? আমি বলবো আমার ওই থার্ড ক্লাস মেয়েটার জন্য মন কেমন করে? যেখানে আমার সুখপাখি দন্ডায়মান সেখানে কোনো মরীচিকার জন্য ভাবার সময় আছে? যাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছি তাকে নিয়েই তো ভাবনার শেষ নেই।”

উনার বুক থেকে মাথা তুলে বললাম,

“আমি আবার কি করেছি?”

“ওই আপদটাকে দেখার পর তো কেঁদেই চলেছেন। খেয়েছেন কিছু সকাল থেকে? অসুস্থ হলে কি ওই আপদটা এসে সেবা করবে? আমাকে এটা বলো, আমি কি ম’রে গেছি? এতো সোজা আমার মেয়েকে নিয়ে যাওয়া?” আমাকে ছেড়ে কথাগুলো বললেন উনি।

আমি কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই উনি বললেন,

“এখন কোনো কথা না। আজ শুক্রবার এমনি অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি হলে জামাআত পাবো না।”

____________________________________________

হাঁটি হাঁটি পা পা করে অনেকগুলো দিন চলে গেলো। সন্ধ্যায় ড্রয়িং রুমে বসে আমি আর মা চা খাচ্ছি। আরজা ফ্লোরে বসে নতুন খাতায় আঁকিবুঁকি করছে। তার মাথায় লেখাপড়া করার ভূত চেপেছে। ভাবনার মাঝেই সেলফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি ইকরা কল করেছে। কল রিসিভ করতেই ও বললো,

“এই আপু তুই ফাইয়াদকে বোঝা না।”

ইকরার কথা শুনে আমার ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে এলো।

“কি বুঝাবো আমি ফাইয়াদকে?”

“সে আমাকে সেমিস্টার ফাইনাল দেওয়ার জন্য প্রেশার দিচ্ছে। আচ্ছা আপু বল এতোদিনের এতো ঝামেলায় আমি কোনো প্রিপারেশন নিতে পেরেছি? আবার বলে রেজাল্ট খারাপ করা যাবে না।”

“তাহলে ভালো রেজাল্ট করার দিনরাত পড়াশোনা কর তাহলেই তো হয়।”

“আমি বলেছি আমি আর লেখাপড়া করবো না। যতটুকু করেছি আলহামদুলিল্লাহ। সে কি বলে জানিস? আমার মতো অশিক্ষিতের সাথে নাকি আর সংসার করবে না। সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আবার আমার বিয়ে দিবে। এগুলো কোনো কথা। আচ্ছা বল আমি কি অশিক্ষিত?

ইকরার কথা শুনে আমি ফিক করে হেঁসে দিলাম। আমার হাসির শব্দে ইকরা রাগ করে বললো,

” তোরা সব এক যা তোদের কাছে আর কিছু বলবই না।” ঠাস করে কল কেটে দিলো।

____________________________________________

আরজার বাবা যখন বাসায় এলেন তখন ঘড়িতে সোয়া দশটা বাজে। উনার সামনে শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম। কিন্তু উনার কোনো ভাবান্তর নেই। অন্যমনস্ক দেখে জিজ্ঞেস করলাম,

“কি হয়েছে আরজার আব্বু কি নিয়ে এতো চিন্তিত?”

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“তোমাকে কিভাবে যে বলি। এসব শুনলে তো আবার টেনশন করবা।”

“না বললেও টেনশন করবো। এখন বলে ফেলেন কি হয়েছে।”

উনি ইতস্ত করে বললেন,

“আসলে কয়েকদিন যাবৎ রিংকি বিভিন্ন নাম্বার থেকে কল দিয়ে বিরক্ত করছে, জ্বালাচ্ছে। নাম্বার ব্লক করি তো নতুন নাম্বার দিয়ে কল করে।”

“ওর বাবা ভাইকে জানান।”

“এখন এগুলো বললে ওর ভাই ওকে মে’রে’ই ফেলবে। ওর ভাই খুব রাগী মানুষ। অন্যায় সহ্য করতে পারে না। আজ কি করেছো জানো? মিরপুর থানার উসির নাম্বার থেকে কল করেছে। উসি নাকি ওর কেমন ভাই হয়। আমাকে হুমকি ধামকিই ও দিলো। কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না। এই মেয়েটা বোধ হয় আমাদের শান্তি দিবে না।”

“উনিই বা কেমন পুলিশ কোনো কিছু যাচাই না করে তোমাকে হুমকি দেয় কিভাবে?”

“আসলে যখন আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিলো তখন তো সবাই জানতো আমিই ওকে ইচ্ছে করে তালাক দিচ্ছি। সেটার ফয়দা ও নিচ্ছে। আমার মাথা কাজ করছে না।”

চিন্তায় লোকটা রাতের খাবারটাও ঠিকমতো খেতে পারলো না। সারারাত ঘুম তো দূরের কথা। সকালেও নাস্তা না করে চলে গেলো। আমি আমার মতো কাজ করে চলেছি। মাকে এসব জানানো যাবে না। টেনশন করে ব্লাড প্রেশার বাড়িয়ে ফেলবে।

রাতে যখন আরজার আব্বু বাসায় এলো তখন উনার গাঁ থেকে কোটটা খুলতে খুলতে প্রশ্ন করলাম,

“আজ কি রিংকি কল করেছিলো?”

উনি মনমরা হয়ে জবাব দিলেন, “হুম।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কখন করেছে ফোন?”

উনি ওয়াশরুমে যেতে যেতে জবাব দিলেন, “দুপুরে।”

উনি ওয়াশরুম যেতেই আমি উনার মোবাইলটা হাতে নিলাম।কল লিস্ট চেক করে দেখলাম কয়েকটা নাম্বার থেকে কল এসেছে। সবগুলো সেইভ করা থাকলেও একটা আননোন। নাম্বারটা টুকে নিলাম।

____________________________________________

সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে উনি বেরিয়ে যেতেই আমি আড়ালে গিয়ে নাম্বারটায় ফোন দিলাম। ভাগ্য সহায় ছিলো তাই রিংকিই কল রিসিভ করলো। দেখা করার কথা বলতেই না করে দিলো। হাজার অনুনয়ের পর রাজি হলো সে। বিকেলে আরজাকে মায়ের কাছে রেখে দরকার আছে বলে বেরিয়ে পড়লাম। পার্কের এসে দেখলাম আগে থেকেই রিংকি বসে আছে। কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই বললাম,

“আমাদের এমন বিরক্ত আর হেনস্তা করার মানে কি?”

“বিরক্ত কই করলাম? আমি তো আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো।”

“এতো বছর কই ছিলো মাতৃত্ব?”

“যেখানেই থাকুক না কেন।আমি তো আমার মেয়েকে নিয়ে যাবোই। কেউ আটকাতে পারবে না। কারন সবাই জানে সোলাইমানই আমার থেকে আমার মেয়েকে আলাদা করেছে। পরিস্থিতি তখনও আমার অনূকূলে ছিলো আর এখনো।”

আমি হুট করে রিংকির পায়ে ধরে বললাম,

“আল্লাহর দোহাই লাগে আমার থেকে আমার মেয়েকে আলাদা করবেন না। এই মেয়েকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আপনি তো এতোদিন মেয়ে ছাড়াই ছিলেন, তাহলে?”

হঠাৎই কেউ একজন আমাকে বসা থেকে উঠিয়ে ঠাস করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিলো। গালে হাত দিয়ে মানুষটাকে দেখে আমি চকিত হয়ে গেলাম।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ২৬
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

আরজার বাবার র’ক্তি’ম বর্ণ চোখ দেখে গলা শুকিয়ে এলো আমার। দুই বছরের উপরে সংসার জীবন এখনো অব্দি গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক রাগারাগি করেনি।আজ সেই মানুষটাই কিনা খোলা পার্কে এত এত মানুষের সামনে আমার গায়ে হাত তুললো? কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আরজা বাবা আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলো। চিৎকার করে বললেন,

“আমি ম’রে গিয়েছিলাম তাই না? আমাকে কি তোমার এতোটাই অপদার্থ মনে হয়? নিজের মেয়েকে নিজের কাছে রাখার ক্ষমতা কি আমার নাই? আমার শরীরে যতক্ষণ পর্যন্ত একফোঁটা র’ক্ত আছে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের আগলে রাখার দায়িত্ব আমার। কিন্তু তুমি এটা কি করলে? কার পায়ে ধরলে ইনসিয়া? এই থার্ডক্লাস মেয়েটা তো তোমার নখেরও যোগ্য না।আর তুমি কি না এই ইউজলেস মেয়েটার পা ধরলে? জানো আমার নিজেকে শে’ষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।”

মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি আর উনার কথা শুনছি। কারন উনার র’ক্তি’ম বর্ণ চোখের দিকে তাকানোর শক্তি আমার নেই। আরজার বাবা রিংকিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“এন্ড ইউ, আপনার নাটক এতোদিন অনেক সহ্য করেছি। কি যেন বললেন? পরিস্থিতি তখনও আপনার অনুকূলে ছিলো আর এখনো আছে। ভুল বললেন। আমি তখন পরিস্থিতি আপনার অনুকূলে যেতে দিয়েছি। কারণ আপনার গর্ভে আমার নিষ্পাপ মেয়েটা ছিলো। নিজের সন্তানের কথা চিন্তা করে আপনার সকল কথা মেনে নিয়েছিলাম। মুক্তির জন্য হলেও আমার সন্তানের ক্ষতি করবেন না। ভেবেছিলাম সন্তানের মুখ দেখলে আপনি সব ভুলে যাবেন। কিন্তু আপনি তো আপনিই। কুকুরের লেজ কি কখনো সোজা হয় নাকি। আপনি তো কুকুর থেকেও নিকৃষ্ট।”

“সোলাইমান মুখ সামলে কথা বলো।” হুঙ্কার দিয়ে উঠলেল রিংকি।

আরজার বাবা আঙুল উঁচিয়ে বললেল,

“এই আওয়াজ নিচে। আপনার মতো মেয়েদের এই সোলাইমান সাদিক গুনেও না। স্টে আউট ফ্রম আস।”

পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাকে যেন কল দিলেন। কয়েক সেকেন্ড পরে কোনো রকম আড়ম্বরপূর্ণ সূচনা ছাড়াই বললেন,

“ভেবেছিলাম আপনার বোনের কু-কৃর্তির কথা আপনাদের না জানিয়ে নিজে নিজে মিটমাট করবো।কিন্তু আপনার বোন সবকিছুর লিমিট ক্রস করে ফেলেছে। আপনার কেমন ভাই যেন মিরপুর থানায় আছে? উনাকে দিয়ে আমাকে হুমকি দিয়েছে। আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। আমাদের জীবন বিষিয়ে তুলছে। যদি পারেন সময় করে বিকেলের দিকে সবাই নিয়ে একটু থানায় আসবেন। বাকি কথা আমি সেখানেই বলবো।”

বলেই গটগট করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। আমি মাথা তুলে দেখি অনেক উৎসুক জনতা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও আরজার বাবার পিছু নিলাম। গেট থেকে বেরিয়ে দেখি উনি একটা রিকশায় বসে আছে। চট করে উঠে বসলাম। উনার হাতটা ধরে কিছু বলতে যাবো উনি উনার হাতটা ঝাড়া মে’রে সরিয়ে নিলেন। চোখ মুখ লাল করে বললেন,

“না আমাকে তুমি কিছু বলার চেষ্টা করবে।আর না কিছু বোঝানোর। যা কিছু দেখার আমি নিজের চোখে দেখে নিয়েছি। ভাগ্যিস খুব দরকারী কাজে বাসার দিকে এসেছিলাম। না হলে তো জানতেই পারতাম না আমার বউ আমাকে ঠিক কতটা অপদার্থ মনে করে। আর কিছু বলে আমার মাথা গরম করো না।হিতে আমি উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলবো।”

অগত্যা আমি নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম। বাসার নিচে আসার পর উনি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে আমাকে ফেলে চলে গেলেন। বাসার ভেতরে ঢুকে দেখলাম উনি সজোরে সোফার পায়ায় একটা লা’থি মা’র’লে’ন। মা ভয় পেয়ে বললেন,

“কি হয়েছে সোলাইমান? এমন করছিস কেন?”

মায়ের হাত দু’টো উনি বললেন,

“মা তোমার ছেলে কি এতোটাই অপদার্থ যতটা তোমার বউমা মনে করে? কি করে করতে পারলো ও মা এমনটা?”

“কি করেছে ইনসিয়া সেটা তো বলবি?”

“কিছু করেনি মা। এখন নিজের রুমে যাও। বিকেলের দিকে আরজাকে নিয়ে রেডি থেকো এক জায়গায় যাবো। আরজাকে রেডি তুমি করাবে অন্য কারো কাছে দিবে না।”

“কিন্তু,,, ”

“কথা না বলে ভেতরে যাও মা।”

মা বাধ্য হয়ে রুমে চলে গেলেন। আমি উনার শেষের কথাটা শুনেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আরজাকে আমার কাছে দিতে নিষেধ করলেন। পরক্ষণেই মনে পড়লো উনার পায়ের কথা। ফ্রিজ থেকে বরফ টুকরো বের করে উনার পায়ের কাছে বসলাম। উনি কপালে হাত ঠেকিয়ে সোফায় নিজের শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। পায়ে ঠান্ডা অনুভব করতেই কপাল থেকে হাত সরিয়ে দেখলেন। আমাকে দেখামাত্র তৎক্ষনাৎ দূরে সরে গেলেন।

“আপনার পা,,,।”

“আমার পা যা হওয়ার হউক। বাট স্টে এওয়ে ফ্রম মি। তোমাকে দেখলে আমার সেই ঘটনা মনে পড়ে যাবে।”

____________________________________________

বিকেলে থানায় বসে আছি আমরা সবাই। আরজার বাবা তো কথা বলছেই না। আর এখন মাও আমার থেকে দূরে দূরে থাকছে।এখানে সবাই উপস্থিত থাকলেও রিংকির আসার কোনো খবর নেই। কয়েকবার ফোন করারও পরেও আসছি আসছি করে এখনো এলো না। আর মিনিট ত্রিশ বাদেই মাগরিবের আযান দিবে। থানায় হেলেদুলে পা রাখলেন রিংকি। পা রাখা মাত্রই রিংকির ভাই ওর গালে সপাটে চড় মা’র’লে’ন। ওসি সাহেব বললেন,

“ভাই এটা থানা।এভাবে তুমি রিংকির গালে চড় দিতে পারোনা।”

রিংকির ভাই লোকটার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

“এটা থানা এটা এখন তোর মনে পড়লো? কোনো কিছু যাচাই না করে তুই কি করে পুলিশ হয়ে আরেকজন কে হুমকি দিস? উনি তোর বিরুদ্ধে লিগ্যাল স্টেপ নিলে তুই কিছু করতে পারবি? এই মেয়েটার জন্য আমাদের মান সম্মান সব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। যখন যা ইচ্ছে তাই করছে। নিজের সাজানো গোছানো জীবনটা নিজের হাতে শেষ করেছে। এখন আমাদেরও শান্তি দিচ্ছে না আর আশেপাশের মানুষকেও শান্তি দিচ্ছে না। একে বোন বলতেও লজ্জা হয় আমার।”

রিংকির বাবা বসা থেকে উঠে এসে রিংকির সামনে এসে দাঁড়ালেন।

“বলতে পারো ঠিক কোন অন্যায়ের শাস্তি আমাকে দিচ্ছো? নাকি তোমাকে জন্ম দেওয়াটাই আমার অপরাধ ছিলো। বার বার তোমার কারণে আমি অপদস্ত হচ্ছি। এভাবে বার বার মে’রে ফেলার থেকে একেবারেই মে’রে ফেলো না।”

রিংকি অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন,

“বাবা,,?

“তোমাকে তখন কেউ বাধ্য করেনি সংসার ছাড়ার জন্য। তুমি নিজের দোষ ওই ছেলেটার উপর চাপিয়ে সংসার ছেড়েছো। তাহলে এখন কেন পাগলামি করছো?”

“আমি আবার সংসার করতে চাই বাবা।”

“সেটা আর এখন সম্ভব না।”

এতোক্ষণ সবকিছু চুপচাপ শুনলাম আমরা। আরজার বাবা একটা খুব পুরোনো কাগজ টেবিলে রাখলেন।রিংকির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আপনার মনে আছে, আপনি যখন বলেছিলেন আপনার সন্তান দরকার নেই তখন আমি আপনার থেকে একটা কাগজে সই নিয়েছিলাম? এটা সেই কাগজ। এখানে স্পষ্ট লিখা আছে, আপনি কখনো সন্তানের দাবি নিয়ে আমার কাছে আসবেন না। এতোদিন আপনার পাগলামি সহ্য করার কারণ হচ্ছে এই কাগজ। কাগজটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আজ অফিসে যাওয়ার পরে কাগজটা কোথায় রেখেছি সেটা মনে পড়তেই বাসার দিকে রওনা দেই।আর পথে আপনাকে আর আমার স্ত্রী কে দেখতে পাই। আশা করবো আজকের পর আর আমাদের জ্বালাতন করবেন না। আজ আইনী ব্যবস্থা না নিলেও কাল যে নিবো না তা কিন্তু না।”

ওসি সাহেবের দিকে ফিরলেন আরজার বাবা।

“ক্ষমতা হাতে আছে বলেই যে তার অপব্যবহার করবেন তা কিন্তু না। সঠিক জেনে তারপর বিচার করুন। কর্মক্ষেত্র স্বজনপ্রীতি দেখানোর জায়গা না। এমন কোনো কাজ করবেন না যেন আপনার ক্যারিয়ারে দাগ লাগে।”

____________________________________________

আজ তিনদিন হলো কেউ আমার সাথে ঠিক করে কথা বলে না।আরজার বাবা রাতে বিছানায় এসে ঘুমায়ও না।বারান্দায় কাটিয়ে দেয়। ছুটির দিন হওয়ায় উনি শুয়ে আছেন। উনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

“আর কত রাগ করে থাকবেন? আপনিও কথা বলেন না। মাও কথা বলেনা। আমার দমবন্ধ লাগে। মনে হয় সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাই।”

“তো যাও না।আমি তো তোমাকে ধরে রাখিনি? তোমাকে সামনে দেখলে সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। তুমি ওই নিকৃষ্ট মহিলার পায়ে ধরেছো। তুমি কিভাবে পারলে এতোগুলো মানুষের সামনে নিজেকে ছোট করতে? দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভাসে। ইচ্ছে করে নিজেকে শে’ষ করে দেই।”

____________________________________________

পরদিন ঘুম থেকে উঠার পর সোলাইমান সবকিছু নিরব দেখে চট উঠে বসে। কয়েকবার ইনসিয়াকে ডাকার পর কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। হন্তদন্ত মায়ের রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“মা ইনসিয়া কোথায়?”

“রান্নাঘরে হয়তো।”

“নেই মা।”

“অন্য কোথাও দেখ।”

“কোথাও নেই মা। সব জায়গায় খুঁজে দেখেছি।”

“তুই কি কিছু বলেছিস?”

“কালকে কয়েকটা কথা বলেছিলাম। বলেছি চলে যেতে।”

উনি দপ করে বসে পড়লেন।

“হয়েছে না শান্তি। আরজারকে যেন কেউ নিতে না পারে সেজন্য না হয় একটা ভুল করে ফেলেছে। তাই বলে এমন করবি?”

____________________________________________

রাতের বেলা বাসায় আসে সোলাইমান। সোলাইমানের মা জিজ্ঞেস করে,

“কোনো খুঁজ পেয়েছিস বাবা? আরজাটা সারাদিন কিছু খায়নি।”

সোলাইমান অসহায় গলায় বলল,

“সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি মা কোথাও যায়নি। খুব অসহায় লাগছে আমার। কোথাও গেলো ও। আমি না হয় কয়েকটা কথা বলে ফেলেছি তাই বলে চলে যাবে?”

আরজা গুটি গুটি পায়ে সোলাইমানের কাছে এসে দাঁড়ালো। সোলাইমানের হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

“বাবাই আম্মুল কাতে দাবো। আমাল আম্মুকে এনে দাও।”

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।