সৎ মা পর্ব-২৯

0
291

#সৎ_মা
#পর্বঃ২৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

দুই মা মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আরজার বাবা রুমে প্রবেশ করে বললেন,

“আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুই মা মেয়েতে কি করছে?”

পিছু ফিরে উনাকে বললাম,

“দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে একজন সুখী মায়ের ফিল নিচ্ছি। তাই না আম্মু?”

উনি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

“স্বামীকে সহ নিয়ে দাঁড়ালে নিজেকে আরো বেশি সুখী ফিল হবে।”

আমার গাঁ ঘেঁষে দাঁড়াতেই আমি ছিঁটকে সরে এলাম। আমার এহেম কান্ডে উনি আমার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

“তুমি এভাবে দূরে সরে গেলে কেন?” বলেই আমার কাছে এগিয়ে আসতে নিলে আমি হাত দিয়ে থামিয়ে বললাম,

“দূরে যান। আমার থেকে দূরে সরে যান।”

উনি বিস্মিত হয়ে বলেন,

“আরে কি হয়েছে সেটা তো বলবে?”

নাক মুখ চে’পে ধরে বললাম,

“আমার কাছে আসলে বমি করে দিবো। আপনার শরীরের পারফিউমের স্মেল আর ঘামের দুর্গন্ধ একসাথে হয়ে বাজে স্মেল আসছে। আমার সহ্য হচ্ছে না।”

আমি যে গতিতে দূরে সরে এসেছিলাম আমার কথাটা শুনা মাত্র এর থেকে দ্বিগুন গতিতে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন উনি। আরজার তার বাবার অবস্থা দেখে হাসতে লাগলো।

“আল্লাহর দোহাই লাগে ইনসিয়া বমি করো না। তোমার বমি ধাঁচ ভালো না। শুরু হলে আর বন্ধ হয় না। আমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। আমি এক্ষনি ওয়াশরুমে যাচ্ছি।”

বলেই ড্রেস চেঞ্জ না করে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি আরজাকে স্বরবর্ণ শিখাচ্ছি। এরমাঝে উনি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আমার কাছে এলেন।

“ইনসিয়া এখন শরীর থেকে বাজে গন্ধ আসছে?”

পর পর দুইবার নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম,

“না আসছে না।”

এর মাঝে আরজা বললো,

“আম্মু আমি যা যা শিখেছি দাদুকে বলে আসি?”

আমি মাথা নাড়তেই আরজা দৌড়ে চলে গেলো। আরজা চলে যেতেই আমি উনাকে আমার কাছে এনে উনার পেট জড়িয়ে ধরলাম। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“খারাপ লাগছে শরীর?”

না নেড়ে না বুঝালাম।

“শরীর খারাপ লাগছে না। তবে আপনার স্পর্শ পেতে খুব ইচ্ছে করছিলো।”

উনাকে জড়িয়ে ধরে উনার স্পর্শ অনুভব করছি। আর উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। দু’জনেই নিরব। নিরবতা ভেঙে বললাম,

“আপনার খুব কষ্ট হয় তাই না?”

হাত থেমে গেলো উনার।খানিক চুপ থেকে বললেন,

“কষ্ট কেন হবে?”

“আমি তো আগে আপনার জন্য রোজ রাতে অপেক্ষা করতাম। ক্লান্ত শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্য এক গ্লাস লেবুর শরবত হাতে ধরিয়ে দিতাম। এরপর দু’জনে খুনসুটি করতে করতে রাতের খাবার শেষ করতাম। অথচ এখন? ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে এই রাতের বেলা খাবার গরম করেন। কি খান না খান আল্লাহ ভালো জানে। বেশি ক্লান্ত লাগলে বা খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। মাকেও ডাকেন না আমাকেও ডাকেন না। আবার সকালেও নাস্তা না করে চলে যান। আমার বড্ড ভেতরটা পুড়ে। আপনি দেখেছেন আপনার চোখমুখের কি হাল হয়েছে?”

আমার কপালে উনার ঠোঁট ছুঁয়ালেন।

“আর নিজের কি হাল হয়েছে দেখেছো? জানো তো ইনসিয়া, মাঝে মাঝে বড় কোনো প্রাপ্তির জন্য একটু আধটু কষ্ট করতে হয়। আমি তো কষ্ট করবো আর কয়েকটা দিন। কিন্তু যা পাবো সারাজীবনের জন্য। যে আছে বা যে এই দুনিয়ায় আসছে দু’জন আমাকে “বাবা” বলে ডাকবে আমি যতদিন বাঁচবো। এই মধুর ডাকটার কাছে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কষ্ট কিছুই না।”

উনার পেটের সাথে নাক ঘষে বললাম,

“আপনি এতো ভালো কেন আরজার আব্বু?”

উনি আমার নাক টেনে বললেন,

“আমার বউটা ভালো।”

হঠাৎই উনি আমার পায়ের দিকে নজর দিয়ে বলেন,

“তোমার খুব শারীরিক যন্ত্রণা হয় তাই না?”

মুচকি হেঁসে জবাব দিলাম,

“আমিও কিন্তু আপনার মতো বলতে পারি, ‘মা’ নামক মধুর ডাকটার কাছে এসব শারীরিক যন্ত্রণা কিছুই না। তাছাড়া প্রেগন্যান্সিতে হাত পায়ে এমন পানি আসে। আবার চলে যাবে।”

“কবে পুচকেটা এই দুনিয়ায় আসবে আর কবে তুমি একটু স্বস্তি পাবে?”

____________________________________________

ফুলে থাকা পা গুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। একটু বসে থাকলে পায়ে পানি চলে আসে। পেট আরও উঁচু হয়েছে। আর কয়েকটা দিন গেলেই পুচকেটা আমার কোলে থাকবে। টিভি দেখতে দেখতে মাকে বললাম চিপস ভেজে দেওয়ার জন্য। মা তেড়ে এসে বললেন,

“এখন এসব তেল চিপ চিপে জিনিস খেতে হবে না। ফল আছে ফল খা।বল পাবি। আম কে’টে দেই?”

নাক সিটকে বললাম,

“আম খাবো না মা। চিপস ভেজে দেন না।চিপস খেতে ইচ্ছে করছে।”

মা চোখমুখ পাকিয়ে রান্নাঘরে গেলেন। হাসি পেলো আমার। এই মানুষটাকে যে কত ভাবে জ্বালাই আল্লাহ ভালো জানে। আরজা ঘুমোচ্ছে। না হলে এতোক্ষণ আমার কাছে বসে থাকতো।মিনিট দশেক পরে মা একটা বাটিতে কতগুলো ভাজা চিপস আমার হাতে দিলেন। একটা চিপস মুখে দেওয়ার পর পেটটা কেমন যেন করলো। পুচকেটার কিক ভেবে পাত্তা দিলাম না। ব্যথা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। চোখ মুখ খিঁচে এলো আমার। ব্যথা সহ্যের সীমা অতিক্রম করল তখন আমার হাত থেকে বাটিটা ফেলে পেট চেপে ধরলাম। বাটিটা বিকট শব্দে মেঝেতে পড়ে কয়েক টুকরো হয়ে গেলো। মা তড়িৎ গতিতে আমার কাছে এলেন। আতংকিত তটস্থ গলায় বললেন,

“কি হয়েছে ইনসিয়া?”

কথাগুলো গলায় দলা পাঁকিয়ে আসছে আমার। ব্যথার প্রকোপে নিঃশ্বাস অব্দি নিতে পারছি না। চোখমুখ খিঁচে বললাম,

“মা অসহ্য ব্যথা করছে। আর সহ্য করতে পারছি না।”

মা আমাকে দু’হাতে আমাকে আগলে ধরে বললেন,

“পানি ভাঙছে?”

“মনে হয়। মা আপনার ছেলেকে ফোন করে বলুন গাড়ি নিয়ে আসতে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”

ঠিক কতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে আমার জানা নেই। আধখোলা চোখে দেখলাম আরজার বাবা উদ্ভ্রান্তের মতো হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ঢুকলেন।

আমাকে যখন গাড়ির কাছে আনা হলো তখন দূর্বল চোখে চারপাশে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচে আরজার বাবার হাত ধরে বললাম,

“আরজার বাবা, আমার আরজাকে ভেতরে রেখে চলে আসছেন।আমার মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। আরজা কে নিয়ে আসুন প্লিজ।ঘুম থেকে উঠে কাউকে না দেখলে ভয় পাবে।”

মা দাঁতে জিভ কাটলেন।

“হায় আল্লাহ তোর অবস্থা দেখে আমার নাতনির কথা তো ভুলেই গেছিলাম। দাঁড়া আমার নাতনিকে নিয়ে আসি।”

গাড়িতে উঠার পর আরজার বাবা আমার হাত উনার হাতে মুষ্টি বদ্ধ করে বললেন,

“কোন ধাতু দিয়ে তৈরি তুমি ইনসিয়া? নিজে প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছো। অথচ মেয়ের কথা ঠিকই মনে আছে। তোমার মতো জীবনসঙ্গী সবাই যেন পায়।”

হাসপাতালে আসার পর আরজার বাবা কাগজপত্রে সিগনেচার করছে। মা আরজাকে কোলে নিয়ে আমার কাছে বসে আছে। আরজা সেই কখন ঘুম থেকে উঠে গেছে। আমার কান্না দেখে আরজা পেটে হাত বুলিয়ে বলে,

“মা আমি ভাইকে আদর করে দিয়েছি।ভাই আর ব্যথা দিবে না তোমায়।”

মেয়ের এমন অবুঝের মতো কথা শুনে ভেতর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে আমার। আমি যদি আর না ফিরে আমার মেয়েটা কিভাবে থাকবে? আরজার হাতদুটো ধরে অনবরত ফুঁপাতে লাগলাম। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“এই সময় মনের জোর রাখতে হয়। তুই এমন করলে আমি বাপ মেয়েকে সামলাতে পারবো না।”

ওটিতে নেওয়ার আগে দেখলাম বাবা, ইরফান, হাবিবা, ইকরা ওরা সবাই এসেছে। বাবা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

“তুই না মা। মায়েরা বুঝি এভাবে কাঁদে? মনের জোর রাখ। মনে রাখ তোর অবুঝ মেয়েটা তোর ফেরার জন্য অধির আগ্রহে বসে থাকবে।”

একেবারে শেষ মুহুর্তে আরজার বাবা আমার কাছে আসলেন। কপালে চুমু দিয়ে নির্ণিমেষ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনার একটা হাত ধরে বললাম,

“আরজার বাবা আমি যদি আর বেঁচে না ফিরি আপনি কি আমায় ভুলে যাবেন? আবার সংসার পাতবেন নতুন করে?”

উনি অগ্নিবর্ণ চোখে দাঁত কটমট করে আমার হাতটা ঝাড়া মে’রে চলে গেলেন।

____________________________________________

আমাকে ওটিতে নেওয়ার পর যখন ডাক্তার আসলেন তখন তিনি বললেন

“এখন তো অনেকে প্রসবের সময় তার হাসবেন্ডকে কাছে রাখে মনের জোরের জন্য। যদিও আমাদের দেশে এমনটা হয় না বাহিরের দেশে এটা প্রচলিত। আপনি চাইলে আপনার হাসবেন্ডকে পাশে রাখতে পারেন। আপনার শরীরের যা কন্ডিশন উনি পাশে থাকলে ভালো ছিলো। আমরা কিন্তু কাউকে এলাউ করি না।আপনার অবস্থা দেখে বললাম।”

ডাক্তারের কথায় শুকনো হাসলাম।

“উনাকে ভেতরে নিয়ে এলে আমাকে বাদ দিয়ে উনার চিকিৎসা করতে হবে। উনার মনের জোরই আমি। এই প্রেগন্যান্সি জার্নিতে অতিরিক্ত বমি করেছি বলে উনি আমাকে বাবু এবোর্শনের কথাও বলেছেন। আর প্রসবকালীন সময়ে আমার অবস্থা দেখলে হার্ট অ্যা’টা’ক করবে।”

“খুব ভালোবাসে বুঝি আপনাকে?”

উনার কথায় শুধু হাসলাম আমি। ডাক্তার আবারও বললেন,

“তাহলে তো বলা যায় আপনি খুব লাকি।”

“কেউ এমনি এমনি ভালোবাসে না। ভালোবাসা অর্জন করে নিতে। মানুষটার সাথে এমনভাবে মিশে যেতে হয় যেন সে আপনার অনুপস্থিতির কথা কল্পনা করতেও দ্বিধাবোধ করে।”

____________________________________________

ডাক্তার নরমাল ডেলিভারি করতে ব্যর্থ। আমার শরীর আর সায় দিচ্ছে না। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও পারছি না। মনে হচ্ছে সব শক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তার কে বললেন,

“পেশেন্ট তো শারীরিকভাবে খুব দূর্বল। নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না। ইমিডিয়েট সিজার করতে হবে। উনার ফ্যামিলি মেম্বারদের জানান। আর উনাদের ডোনার রেডি রাখতে বলেন। ডেলিভারির পর পেশেন্টের ব্লাড লাগতে পারে।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।