সৎ মা পর্ব-২৭+২৮

0
400

#সৎ_মা
#পর্বঃ২৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

মেয়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো সোলাইমান। হাঁটু গেড়ে বসে মেয়ের চোখের পানি মুছে পানি মুছে বলে,

“তোমার আম্মু খুব দরকারে বাহিরে গেছে। তুমি খেয়ে নাও মা। তোমার আম্মু যদি এসে দেখে তুমি সারাদিন কিছু খাওনি বকবে তো। তুমি না তোমার আম্মুর ভালো মেয়ে।”

আরজা সোলাইমানের হাত নিজের গাল থেকে সরিয়ে বলে,

“মিত্তে কতা, আম্মু আল আতবে না।আমি দেকেচি তুমি আমাল আম্মুকে বকেতো।”

সোলাইমান অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো তার মায়ের দিকে। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“সবকিছুর একটা সীমা থাকে সোলাইমান। তোকে না বলে ওই রিংকির সাথে দেখা করতে গিয়েছে বলে তুই অভিমান করে মেয়েটার সাথে কথা বলা বন্ধ করলি। হ্যা ইনসিয়ার ভুল হয়েছে। স্বীকারও তো করেছে নাকি? আবার নাকি যা নয় তাই বলেছিস। ওই মেয়েটার দিকটাও একবার ভাব। মেয়েটা কিন্তু আরজার জন্য তোকে বিয়ে করেছে। এখন কেউ হুট করে এসে বলে সে আরজাকে নিয়ে যাবে তাহলে তার মানসিক অবস্থাটা কেমন হবে? হয়তো আরজাকে হারানোর ভয় থেকে ওই নিকৃষ্ট মেয়েটার পায়ে পর্যন্ত পড়েছে। ভুলে যাস না সোলাইমান এই পুরো সংসার ইনসিয়ার উপর নির্ভরশীল। আমাদের কথা বাদ দে তুই থাকতে পারবি ইনসিয়াকে ছাড়া?”

সোলাইমান বিষন্ন স্বরে বললো,

“আর বলো না মা। অন্তর্দহনে পুড়ে যাচ্ছি। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। এতোটুকুই চাই ও যেন নিজের কোনো ক্ষতি না করে।”

____________________________________________

সোলাইমান অপলক তাকিয়ে আছে মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে। আরজাা কাঁদতে কাঁদতে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। সারাদিনের অনাহারে মেয়েটার মুখ এইটুকু হয়ে গেছে। প্রায় মধ্যরাত, হঠাৎই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। ভাবনাচ্ছেদ হলো সোলাইমানের।প্রথমে মনের ভুল মনে করলেও দ্বিতীয় বার কলিং বেল বেজে উঠায় ধীর পায়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে কলিজায় পানি আসে সোলাইমান এর।

____________________________________________

অভিমানী দৃষ্টিতে আমি আরজার বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি একটানে ভেতর নিয়ে শক্ত করে উনার বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন। এলোমেলো ভাবে সারা মুখে উনার অধর স্পর্শ করাতে লাগলেন। উনার বাহুডোর থেকে নিজেকে কোনোরকম ছাড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখে বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। চোখের কোণে পানি শুকিয়ে লেপ্টে আছে। আমি জানি মেয়েটা আমার না খেয়ে নেই আছে। আমি কত বাহানা করে খাবার মুখে দেই ওর। ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে তুলে নিলাম। আগে ওকে কিছু খাওয়াতে হবে। চলে যেতে চেয়েছিলাম দূরে। কিন্তু মেয়েটাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো? তাই ফিরে আসতে হলো।

নুডলস রান্না করে মেয়েকে ঘুম থেকে তুললাম। আরজা চোখ কঁচলে আমাকে দেখে ঝাপিয়ে পড়লো আমার বুকে।

“আমি তোমাকে এত্তি গুলা মিত কলেচি আম্মু। আমাকে ফেলে আল দাবে না তো?”

আরজার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,

“না আম্মু আর কোথায় যাবে না তোমাকে ছাড়া। আম্মু তার প্রিন্সেসকে ছাড়া থাকতে পারবে নাকি। দেখি এখন হা করো। নিশ্চয়ই আমার প্রিন্সেস এর খিদে পেয়েছে।”

আরজা মাথা নেড়ে “হ্যা” বুঝালো। আরজার বাবা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন। আমি এটাসেটা বলে আরজাকে খাওয়াচ্ছি। আরজা খিলখিল করে হাসছে। খাওয়ানো শেষ করে আমি ড্রয়িং রুমের সোফায় আরজাকে ঘুম পাড়াতে লাগলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পরে আরজা ঘুমিয়ে পড়লো। আরজাকে রুমে শুইয়ে আমি একটা কাঁথা আর বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লাম। এতোক্ষণ আমার গতিবিধি লক্ষ্য করে আরজার বাবা আমার কাছে এসে একটানে কাঁথাটা সরিয়ে শুয়া থেকে বসালো। চোখ গরম করে বললো,

“রুমে চলো। এখানে শুয়েছ কেন? এটা শোয়ার জায়গা?”

উনার দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম,

“আমার জন্য তো এটাই পারফেক্ট জায়গা। কেউ একজন তো বলেছে আমি যেন চলে যাই। তারপরও চলে গিয়েও বেহায়ার মতো ফিরে এসেছি শুধু মেয়েটার জন্য।”

“রাগ করে না হয় কয়েকটা কথা বলেই ফেলেছি তাই সত্যি সত্যি চলে যাবে?”

“একজন মানুষের রাগ কয়দিন থাকে বলতে পারবেন? কতবার স্যরি বলেছি তারপরও আপনার মন গলেনি। শুধু নিজের দিকটাই ভাবলেন আমার টা না। ট্রেনের নিচে মা’থা দিতাম ভালো ছিলো। কেন যে স্টেশন থেকে আবার ফিরে এলাম? সারাজীবনের মতো আপনাকে মুক্ত করে দিতে পারলে ভালো ছিলো। ”

উনি দাঁত কটমট করে বললেন,

“সেদিন ডান গালে চড় দিয়েছিলাম, আর আজ বাম গালে দিবো। কি বলতেছো তুমি তোমার মাথা ঠিক আছে? সারাদিন পাগলের মতো এখানে ওখানে তোমাকে খুঁজেছি, তুমি জানো? এমন চিন্তা ভাবনা করার আগে আমাকে শেষ করে তারপর নিজের জী’ব’ন দিও। আমাকে তো তুমি মানুষই মনে করো না।”

“মানুষই যেহেতু মনে করি না, তাহলে সকাল হলে আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে চলে যাবো।”

উনি পরপর কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বললেন,

“তোমাকে সাবধান করছি ইনসিয়া এই রাতের বেলা আমাকে রাগিও না। খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম। ভালোয় ভালোয় বলছি রুমে চলো।”

(জোরে জোরে কথার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ইনসিয়ার শ্বাশুড়ির। ইনসিয়াকে দেখে দুশ্চিন্তা কমলো উনার। ছেলে আর ছেলের বউয়ের মান অভিমান দেখে নিরবে সেখান থেকে চলে গেলেন উনি।)

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

“আমি যাবো না আপনার রুমে। সকাল অবলীলায় বলে ফেললেন, ‘চলে যাও ধরে রাখছি নাকি?’ তো এখন ইনসিয়া প্রয়োজন কেন?”

উনি দাঁত কেলানি দিয়ে বললেন,

“কারন সোলাইমান সাদিক তার বউকে প্রচন্ড ভালোবাসে।”

“কিন্তু ইনসিয়া বাসে না।”

“ইমসিয়াকে ভালোবাসতে হবে না।সোলাইমান সাদিক এর একার ভালোবাসাই যথেষ্ট। এখন রুমে চলো।”

“যাবো না বললাম তো।” বলেই রাগ দেখিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। উনি প্রশ্ন করলেন,

“এখন আবার কোথায় যাচ্ছো?”

অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,

“জাহান্নামে যাচ্ছি। যাবেন জাহান্নামে আমার সাথে?”

উনি “দাঁড়াও আমিও যাবো তোমার সাথে জাহান্নামে।” বলেই আমার কাছে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করছি,

“নামান কোল থেকে আমি আবার চলে যাবো। ফিরে এসে ভুল করেছি।”

উনি বললেন,

“আগের থেকে ভারী হয়ে গেছো ইনসিয়া।”

____________________________________________

দরজা আটকে উনি আমার কাছে এসে বসলেন।আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে বললেন,

“স্যরি! আমি বোধ হয় একটু বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছি।”

নিরবে কেঁদে চলেছি আমি। উনি মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

“স্যরি বললাম তো। তুমি জানো আজ আমার কি অবস্থা হয়েছিল? সারাটাদিন কিভাবে কাটিয়েছি শুধু আমি জানি। শুধু দোয়া করেছি তোমার যেন কিছু না হয়। সত্যি করে বলেতো সারাদিন কোথায় ছিলে?”

নাক টেনে টেনে জবাব দিলাম,

“বিমানবন্দর স্টেশনে।”

উনি আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুমি কি সত্যি সত্যি,,, ”

“আমি কি সত্যি সত্যি? ম’র’তে গেছি? এতো সোজা? আমি ম’রে যাই আর উনি আরেকটা বিয়ে করুক। যতদিন বেঁচে আছি জ্বালিয়ে শেষ করে যাবো। এতো তাড়াতাড়ি মুক্তি দিচ্ছি না মশাই।”

“তাহলে কেন গিয়েছিলে সেখানে?”

“ভেবেছিলাম চলে যাবো দূরে কোথাও। দেখতাম যে আমাকে ছেড়ে আপনি কিভাবে থাকেন। পরে এনাউন্সমেন্ট হলো ট্রেন লেইটে আসবে। সেখানে বসে বসে সবকিছু দেখছিলাম। ঝোঁকের বসে চলে গেলেও আরজার কথা যখন মনে পড়লো তখন ইচ্ছে করছিলো স্টেশনেই গড়াগড়ি করে কান্না করি।কিন্তু আপনার উপর রাগটাও প্রখর ছিলো। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারলেও আরজাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”

উনি আমার কপালে উনার অধর স্পর্শ করে বললেন,

“কিন্তু আমার যে আরজা আর আরজার মা দুইজনকে প্রয়োজন। তুমি ছাড়া আমি বা আমরা সবাই অচল। তোমাকে একদিন না দেখে যেই অবস্থা হয়েছিলো আর একদিন গেলে হসপিটালে ভর্তি হওয়া লাগতো। আচ্ছা আজকে সারাদিন কিছু খেয়েছিলে?”

আরজার দিকে তাকিয়ে বললাম,

” আমার মেয়েটাকে কত বাহানা করে আমি খাবার মুখে দেই। আমার অনুপস্থিতিতে সে কতটা খাবে আমার জানা আছে। আর আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে? আচ্ছা আপনি খেয়েছেন?”

“প্রান ভোমরাকেই খুঁজে পাচ্ছি না আবার খাওয়া। আমি একটা কিছু বানিয়ে আনি?”

“না আরজার আব্বু আমার এখন খাওয়ার মুড নেই।”

“সারাদিনের অভুক্ত থেকে অসুস্থ হয়ে যাবে তো।”

“আপনি আছেন তো সেবা করার জন্য।

বলেই চট করে উনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আবারও বললাম,

“আপনি যে আমার সাথে এই কয়দিন কথা বলেন নাই? এর শাস্তি স্বরূপ আপনি আগামী এক সপ্তাহ আমাকে ছুঁবেন না।”

উনি কপাল কুঁচকে বললেন,

“হুম আরজার বাবা কত শাস্তি মানবে।”

___________________________________________

সকালে রুটি বানানোর জন্য কন্টেইনার থেকে আটা নিচ্ছি এমন সময় মা এসে বললেন,

“আজ আর রুটি বানাস না ইনসিয়া। খুদে ভাত আর ভর্তা কর।প্রতিদিন রুটি খেতে আর ভালো লাগে না।”

আমি কোনো কথা না বলে আটা আবার জায়গায় রেখে। খুদের কন্টেইনারে হাত দিয়ে দেখি খুদ নেই। জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বললেন,

“কি হলো কথা বলছিস না কেন?”

আমি এবারও কোনো জবাব না দিয়ে মাকে পাশ কাটিয়ে রুমে এলাম। আরজার বাবাকে মুদির দোকানে পাঠাবো খুদ আনার জন্য। আমি জানি মা আমার এমন ব্যবহার ঠিক হজম করতে পারছেনা। ঘুম থেকে ডেকে তুললাম আরজার বাবাকে। উনি ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন,

” কি হয়েছে ইনসিয়া সারারাত ঘুম হয়নি।এখন একটু ঘুমোতে দেও।”

উনাকে টেনে তুলে বসিয়ে বললাম,

“পরে ঘুমোবেন। আগে আমাকে খুদ এনে দেন মুদির দোকান থেকে। মা খুদের ভাত খাবে বলেছেন।”

উনি বাহিরে যাওয়ার পর ভর্তার আয়োজন করতে লাগলাম। এক চুলোয় ডিম আর আলু সিদ্ধ অন্য চুলোয় ডাল সিদ্ধ বসিয়ে শুকনো মরিচ ব্লেন্ড করছি। মা ড্রয়িং রুম থেকে একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে,

“আমার হয়েছে যত জ্বালা। ছেলের কথা শুনে বউয়ের সাথে কথা বন্ধ করলাম। এখন বউই আমার সাথে কথা বলে না। বলি কথা না বলে থাকা যায়?

মায়ের কথা শুনে হাসি পেলো আমার। তারপরও নিজেকে গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছি।বুঝুক মজা কেউ কথা না বললে কেমন লাগে।

____________________________________________

টেবিলে খাবার দিলাম। আজকের আয়োজন খুদের ভাত, ডিম ভর্তা, ডাল ভর্তা, আলু ভর্তা, শুকনো মরিচের ভর্তা আর কাঁচা মরিচ দিয়ে মাছ ভর্তা। আরজার বাবা এসব দেখেই বললো,

” ইনসিয়া তাড়াতাড়ি খেতে দাও। এসব দেখেই পেটের খিদে আরো বেড়ে গেছে।”

উনাকে বললাম মাকে ডাকুন আমি আরজাকে ঘুম থেকে তোলে ফ্রেশ করে নিয়ে আসি।

আরজাকে নিয়ে এসে দেখি উনারা বসে আছে কেউ খাচ্ছে না। বললাম,

“কি হলো আপনারা খাচ্ছেন না কেন?”

আরজার বাবার শান্ত গলা,

“এতোক্ষণ সব রান্না করলে এখন তোমাকে ফেলে খেয়ে নিবো? একটু অপেক্ষা তো করতেই পারি। তাই না?”

মুচকি হেসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে উনাদের দেখছি।কি তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন উনারা। একজন রাধুনির সার্থকতা এখানেই। মুখের খাবারটা শেষ করে বললাম,

“আরজার আব্বু আপনার লাঞ্চ তো আজকে রেডি করতে পারিনি।”

উনি বললেন,

“আজ আর দরকারও নেই। লাঞ্চের আগেই চলে আসবো আমি।আজ আমার শুধু একটা মিটিং আছে।”

“বাহ্ বাহ্ আমে দুধে মিশে গেলো আর আমি আঁটি হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি।”

মায়ের কথা শুনে হেঁসে দিলাম আমি। মাও মুচকি হাসলো।

____________________________________________

সময় কত দ্রুত চলে যায়। আরজা এখন পাঁচ বছরে পা দিলো। রিংকি আর বিরক্ত করেনি। শুনেছি সে নাকি মানসিক ভাবে অসুস্থ। মেন্টাল এসাইলামে আছে।

আরজা বাবা অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। উনি গলায় টাই বাঁধছিলেন, আমি কাঁদতে কাঁদতে উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমাকে কাঁদতে দেখে আঁতকে উঠলেন উনি। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন?”

ছোট্ট একটা জিনিস উনার হাতে দিলাম । উনি দেখা মাত্র হতবিহ্বল হয়ে গেলেন।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ২৮
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

আরজার বাবা প্রেগ্ন্যাসি কিটে ভেসে থাকা দু’টো দাগের দিকে একবার তাকাচ্ছে তো আমার দিকে একবার। উনি কান্না সংবরণ করার জন্য পর পর কয়েকবার ঢোক গিলেন। অতঃপর আমাকে বললেন,

“এটা কি সত্যি ইনসিয়া?”

মাথা নেড়ে হ্যা বুঝালাম।

“কেন আপনি খুশি হননি?

উনি আমার দিকে শান্ত চাহনি নিক্ষেপ করলেন। তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,

“বাবা হওয়ার অনুভূতি কাউকে ব্যক্ত করা যায় না ইনসিয়া। সন্তান যতই থাকুক না কেন একজন পুরুষকে পুনরায় বাবার হওয়ার সংবাদ পুলকিত করে। দ্বিতীয় বারের মতো বাবা হবো। আবারও একজন পৃথিবীতে আসবে। ছোট ছোট হাত-পা ছোট ছোট আঙুল। আরজার মতো আধো আধো বুলিতে বাবাই বলে ডাকবে। আমার অনুভূতি তোমাকে বোঝাতে পারবো না।”

জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“রেডি হয়ে নাও। হাসপাতালে চেক-আপ করে একেবারে সিউর হবো। কিটে মাঝে মাঝে ভুল আসে। আর ডাক্তার দিকনির্দেশনাও দিবে। আপনার তো মাশা-আল্লাহ খাবার দাবারের ঠিক নেই।”

মাথা তুলে বললাম,

“মাকে কিছু বলবেন না?”

“আপাতত বলবো না।আগে সিউর হয়ে নেই। আরজা মায়ের কাছে থাকুক। আমাদের সাথে নেওয়ার দরকার নেই।”

ইউরিন টেস্ট করে ওয়েটিং রুমে বসে আছি। এখনো রিপোর্ট আসেনি। আরজার বাবা উনার বসকে কল করে জানিয়েছে উনার আসতে ঘন্টা খানিক দেরি হবে। ডাক পড়লো আমাদের। কেবিনে ঢুকা মাত্রই ডাক্তার আমাদের দেখে মিষ্টি হাসলেন।চেয়ারে বসতে বলে ডাক্তার বললেন,

“কনগ্রেচুলেশন মিস্টার এন্ড মিসেস।”

আমি আরজার বাবার হাত খাঁমচে ধরলাম। ডাক্তার আবার বললেন,

“মিসেস,মা হওয়ার খুশিতে শুধু হাসলেই হবে না। নিজের খেয়ালও রাখতে হবে। আপনার কিছু শারীরিক দূর্বলতা আছে। বেশি বেশি ফলমূল খাবেন। ভারি কিছু উপরে তুলবেন না। এটা খুব রিস্কি। যতই বমি হউক না কেন একটু পর পর খাওয়ার চেষ্টা করবেন। নিজের জন্য না হউক অন্তত অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে হলেও খেতে হবে। আর আয়রন ট্যাবলেট তো আছেই।”

কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার পর উনি সতর্কতার সাথে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমার কপালে উনার ঠোঁট ছুঁয়ালেন।

“শুনলে তো ডাক্তার কি বলেছে? আর কোনোরকম অনিয়ম চলবে না।”

আমাকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে উনি অফিসের দিকে পা বাড়ালেন।

____________________________________________

বিকেল নাগাদ বাসায় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। সবাই এসেছে এই বাসায়। মায়ের মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না। আমি লজ্জায় কারো চোখে চোখ মিলাতে পারছি না। আরজা আমার হাত ধরে টান দিলো। চোখের ইশারায় “কি” বলতেই আরজা বললো,

“আম্মু তোমার এইখানে (আমার পেটের দিকে আঙুল তুলে) কি ভাই আছে?”

আরজার এমন কথায় মাথা নাড়লাম আমি। আরজা আবার বলল,

“আম্মু ভাই কবে পেট থেকে বের হবে?”

আরজার কপালে চুমু দিয়ে বললাম,

“ভাই তো এখন এইটুকু, যখন হাত পা হবে আরো একটু বড় হবে তখন বের হবে মা।”

আরজা আমার পেটে হাত বুলিয়ে বলল,

“আম্মু তুমি যেমন আমার চুল দিয়ে ঝুঁটি করে দাও ভাইকে ও কি ঝুঁটি করে দিবে?”

“না মা। ছেলেরা ঝুঁটি করে না মা। আচ্ছা তোমার যদি ভাই না এসে বোন আসে তখন?”

“তাহলে কি বোনকে ঝুঁটি করে দিবে?”

“হুম।”

“আগে বোনকে ঝুঁটি করে দিবে তারপর আমাকে?”

“না, আগে আমার আরজা তারপর অন্য কেউ।”

____________________________________________

বাবা আমতা আমতা করে মাকে বললেন,

“বেয়াইন, যদি কয়টা দিনের জন্য আমার মেয়েটাকে দিতেন।কতদিন হলো মেয়েটা ও বাড়িতে যায়না।”

“আমার ঘরটা যে ভাই সাহেব একেবারে খালি হয়ে যাবে।”

“আপনারাও চলেন না। সবাই কয়েকটা দিন আমার বাড়িতে বেড়িয়ে আসবেন। মেয়ে দুটোকে বিয়ে দেওয়ার পর বাড়িটা আমার মরুভূমিতে পরিনত হয়েছে। হাবিবা টা একা একা থাকে। আমি বুড়ো মানুষ নিজের মতো থাকি। ইকরাকেও বলেছি। আপনারাও গেলে বাড়িটা প্রাণ ফিরে পেতো।”

“তাহলে তো ভাই সাহেব বেশি দিন থাকা যাবে না।”

“যে কয়দিনই থাকেন।”

____________________________________________

আজ দু’দিন হলো আমরা সবাই এই বাড়িতে। যেদিন এই বাড়িতে এলাম সেদিনই ইরফান আমার কোলে মাথা রেখে বলল,

“আমার কিন্তু ভাগ্নী আছে আপু।আমার একটা ভাগিনা চাই। ইকরার দিকে তাকিয়ে বলে, আর ইকরা ভবিষ্যতে আমাকে ভাগিনা আর ভাগ্নী একসাথে উপহার দিবে। তাই না রে ইকরা?”

ইকরা দাঁত কটমট করে বলল,

“ইরফাইন্না আমি উঠলে তোর খবর আছে কিন্তু। বড়দের সামনে এসব কি বলিস?”

“ভুল কি বললাম? ভাগিনা ভাগ্নীতে ভরে উঠবে আমার বাড়ি।”

আরজার বাবা বাদাম মুখে দিতে দিতে বললেন,

“সেক্ষেত্রে শা’লা সাহেব নিজে বাবা হয়ে গেলেও পারো।”

“আমি এখনো ছোট বাচ্চা দুলাভাই।”

ফাইয়াদ বলল,

“ওরে বাপরে ছেলে বিয়ে করে বউয়ের সাথে সংসার করছে এখনো নাকি ছোট।”

মজা, আড্ডায়, তিন ভাইবোন এর খুনসুটিতে কিভাবে যে সাতদিন চলে গেলো বুঝতেই পারলাম না। আজ যে যার গন্তব্যে ফিরে যাবো। বিদায় বেলা বাবা টলমল চোখে বললেন,

“মেয়ের বাবা হতে নেই। মেয়েরা বাবার ঘর শূন্য করে আরেকজনের ঘর আলোকিত করে। মেয়ের বাবাদের বুক সারাজীবন খাঁ খাঁ করে মেয়েদের শূন্যতায়।”

দু’বোন জড়িয়ে ধরলাম বাবাকে।

____________________________________________

প্রথম কয়েকদিন ভালো থাকলেও বেশ কিছুদিন হলো আমার বমির মাত্রাটা বেড়েছে। কিছুই পেটে রাখতে পারি না। লাস্ট কবে মাছ মাংস খেয়েছি আমার মনে নাই।এসবের গন্ধ আমার অসহ্য লাগে। সাদা ভাতই খেতে পারি। তাও কিছুক্ষন পর আবার বমি করে দেই। এখন আর আমি কিছু করি না। মা’ই করে আস্তে ধীরে। রান্নাঘরের ভেতরে গেলে আমার নাড়ীভুঁড়ি উল্টে আসে। মজার ব্যপার হলো আমি যখন আমার দূর্বল শরীরটা নিয়ে নড়াচড়া না করতে পারি তখন আরজা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে আমার মুখে তুলে দেয়। কে’টে রাখা ফল আমাকে খাইয়ে দেয়। সবচেয়ে বেশি জ্বালাই আরজার বাবাকে। লোকটা সারাদিন অফিস করে আমার জন্য রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারে না। সারারাত আমি ঘুমোতে পারি না ছটফট আছেই। রাতে ঘুম থেকে উঠেও বমি করি। লোকটা আমার জন্য অনিদ্রায় থাকে। আবার সকালে না খেয়ে অফিস যায়। আরজাকেও সাথে রাখি না। আরজাকে ছাড়াতে ঘুমোতে খুব কষ্ট হয়। আমার জন্য মেয়েটাও ঘুমোতে পারে না। সেজন্য এখন ঘুম পাড়িয়ে মায়ের কাছে রেখে আসি। প্রথম দু’দিন মাঝরাতে কেঁদেকুটে আবার আমার বুকে এসে ঘুমিয়ে যেতো।

মধ্য রাত! সামনে বালতি নিয়ে হড়হড় করে বমি করছি। আরজার বাবা আমার পিঠে মালিশ করে দিচ্ছে। একবার আরজার বাবা কাঁধে শরীর এলিয়ে দেই তো আরেকবার বমি করি। আর শরীর দিচ্ছে না দূর্বল শরীর নিয়ে আরজার বাবার বুকে মাথা রেখে বসে আছি। উনি বললেন,

“আমার সন্তান লাগবে না ইনসিয়া। আমার তুমি হলেই চলবে। তোমার এই অবস্থা আমি আর দেখতে পারছি না। আমি সারাক্ষন ভয়ে ভয়ে থাকি। এই বুঝি তোমার কিছু হয়ে গেলো। তোমার কিছু হলে আমি বাঁ’চ’তে পারবো না ইনসিয়া। তুমি এই বাচ্চা এ’বো’র্শ’ন করে ফেলো।”

আমার শরীরে শক্তির সঞ্চার হলো কোথা থেকে বুঝলাম না। উনার থেকে ছিটকে সরে এলাম। নিচ থেকে বালতি নিয়ে পা বাড়ালাম বারান্দার দিকে। অসুস্থ শরীরে উনার কথা গুলে যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো ছিলো। উনি পিছন থেকে ডেকে বললেন,

“এই রাতের বেলা বারান্দায় যাচ্ছো কেন?”

“তুই আর আমার সাথে কোনো কথা বলবি না।”

বলেই বারান্দার দরজা ঠাস করে আটকে দিলাম। ওখানে বসেই দাঁতে জিভ কাটলাম। রাগের বশে উনাকে তুই করে বলে ফেলেছি।

“বাব্বাহ্ আপনি থেকে ডিরেক্ট তুই? ভালো ভালো। এখন দরজা খুলো।”

“না খুলবো না। আপনি আমার সন্তানকে মে’রে ফেলার কথা বলেছেন। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।”

“আচ্ছা মাফ চাই। আমার ভুল হয়েছে এখন বেরিয়ে এসো।”

“না বেরবো না। আপনি আর কখনো আমার কাছে আসবেন না আর আমার বাবু ভূমিষ্ট হওয়ার পরও তাকে আপনি কোলে নিবেন না”

“আচ্ছা ঠিক আছে তোমার কাছেও যাবো না তোমার সন্তানকে কোলেও নিবো না। আমি আমার সন্তানকে কোলে নিবো আর আমার স্ত্রীর কাছে যাবো। এবার দরজা খুলো।”

“না খুলবো না।” বলেই আবার বমি করতে লাগলাম।
উনি আতংকিত গলায় বললেন

“দরজা খুলো না ইনসিয়া। তুমি আবার বমি করছো দূর্বল শরীর তোমার। এই সময় পাগলামি করো না। এখন তোমার একটা সাপোর্ট দরকার। স্যরি বললাম তো।”

আমি যেন চোখেমুখে সরষে ফুল দেখতে লাগলাম। কোনোরকম ছিটকিনি খুলে ঢলে পড়লাম আরজার বাবার শরীরের উপর। জ্ঞান আছে আমার কিন্তু কথা বলার শক্তি নেই। উনি আমাকে আগলে ধরে বললেন,

“শরীর বেশি দূর্বল লাগছে?”

মাথা নড়লাম আমি। উনি বললেন,

“একটা স্যালাইন গুলে দেই?”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও সায় জানালাম। আমার একটু এনার্জি দরকার। আমার দূর্বলতা দেখলে আরজার বাবা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়বে।

____________________________________________

দিন পনেরো অতিক্রম হওয়ার পর ইকরা আমাকে দেখতে এলো। আমাকে দেখা মাত্র দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। আমার চোখে মুখে হাত বুলিয়ে বলল,

“আপু মা হওয়া বুঝি এতো কষ্ট? তোর শরীরের কি অবস্থা দেখেছিস? শুকিয়ে একেবারে হাড্ডিসার হয়ে গেছিস। চোখের নিচে কালো দাগ। তোকে দেখে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে আপু।”

“কিছু বলে যাও মা। আমি বুঝি এই ইনসিয়াকে ছেলের বউ করে এনেছিলাম? মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায়। খাবারের কথা বললে ছোট বাচ্চাদের মতো ব্যবহারর করে।” ইকরার পিছন থেকে মা শান্ত গলায় এসব বলতে লাগলেন।

____________________________________________

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। গলার নিচের হাড়গুলো দৃশ্যমান। চোখের নিচের ডার্কনেস, মুখে অসংখ্য স্পট।সাত মাসের উঁচু পেট জানান দিচ্ছে আমার মাতৃত্বের কথা। কিন্তু আমি যে এর আগেই মা হয়ে গেছি। আমার আরজার মা। কোথা থেকে আরজা “আম্মু” বলে আমার পা জড়িয়ে ধরলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো আমার। এই তো আমার বড় সন্তান। আর ছোটটা আমার গর্ভে একটু একটু করে বড় হচ্ছে। একটা মায়ের মত শ্বাশুড়ি, পাগলাটে স্বামী আর দু’টো সন্তান ব্যস একটা মেয়ের আর কি চাই।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।