হঠাৎ অদ্ভুতুড়ে পর্ব-০৪

0
2710

#হঠাৎ_অদ্ভুতুড়ে (পর্বঃ-০৪)
লিখাঃ- সুহাসিনী

চিৎকার দিয়ে রিদমকে ডাকবো, ঠিক সেই মুহুর্তে কেউ একজন বাজখাঁই গলায় বলছে,
“তোর সাহস কী করে হয়, একটা ছেলে হয়ে আমার বিছানায় বসতে.?এতক্ষণ অব্দি আমি সহ্য করেছি। এবার তোকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এই বিছানাটা আমার। শুধুই আমার। এখানে এভাবে বসার শাস্তি তোকে না দিতে পারলে আমি শান্তি পাবো না।”

কয়েক মুহুর্ত যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কার গলার স্বর এটা? কে কথা বলছে এভাবে এত ভয়ংকর গলায়? কথা বলতে গিয়েও একটা আওয়াজ যেন আর করতে পারছি না। অন্ধকার ঘরে ভয়ংকর আওয়াজ আর রিদমের করুণ চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করেও কিছু বলতে পারছি না আর। রিদমের কষ্ট হচ্ছে অনেক। ছেলেটা গোঙানির আওয়াজ করছে অনবরত। অথচ আমি ওকে ওই বাজখাঁই গলার মেয়েটার থেকে ছাড়াতেও পারছি না।

অন্ধকারেই নিজের উপর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। এভাবে আর কিছুক্ষণ চললে ছেলেটা তো মরেই যাবে। মেঝেতে পা দিতেই অদ্ভুত অনুভূতি হলো। সব যেন কেমন উষ্ণতায় লেপে আছে। চাপচাপ তরল পদার্থ। পায়ের পাতার সাথে বিচ্ছিরিভাবে লেপ্টে আসছে।চিৎকারটাও থেমে আছে এখন। একটা শক্ত হাতের আঙুলগুলো মেলে রয়েছে। পায়ের স্পর্শে কেমন যেন কেটে যাওয়া ক্ষতের মতোন মনে হলো। দূর থেকে ত্রাত্রি আমার নাম ধরে ছুটে আসছে। ওর গলার স্বর শুনতে পারছি। কিন্তু জবাব দিতে পারছি না কিছুই।

ত্রাত্রি হাতে একটা টর্চের লাইট নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। আমার দিকে অসহায়ভাবে চেয়ে থেকে মুখের উপর টর্চলাইট ফেলে বলল,
-অন্ধকার দেখে এত চিৎকার করার কী আছে? আর এভাবে অদ্ভুত চিৎকার করারই বা কী হলো,শুনি?

ত্রাত্রির কথার উত্তর দিতে পারলাম না। তেমনি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। ও আমার দিকে টর্চলাইটটা ভাল করে তাক করে ধরে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে চমকে উঠলো,
– “সুহাসিনী! এটা কী হলো?”

-কী?

-তোর পায়ের নিচে।

ত্রাত্রির কথায় মেঝের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। পায়ের নিচে তরল রক্ত গড়াগড়ি খাচ্ছে অবিরত। বিভৎস হাতের কিছু আঙুল মুঠি ছেড়ে আছে। একটা শরীর থেকে তাজা রক্ত ঝরে পড়ার গতি যেন বেড়েই চলেছে। আঙুলগুলোতে খুব বিচ্ছিরিভাবে ক্ষত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ-ই রিদমের কথা মনে হলো। মেঝেতে ওই হাতের দিকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেই দেখতে পেলাম, রিদমের দুটো চোখ যেন এক্ষুণি বের হয়ে আসবে ওর চোখের কোটর থেকে। ভয় আর কষ্ট একসাথে সেই চোখে বসবাস করছে। ত্রাত্রি আমার দিকে লাইটটা নিয়ে ছুটে এসে দাঁড়ালো। রিদমের নাম ধরে চিৎকার দিয়ে ডাকলাম,
-“রিদম, এই রিদম। কী হয়েছে তোমার.?”

রিদমের তরফ থেকে কোনো প্রতুত্তর এল না। আমি যেন কান্না করতেও ভুলে গেছি এখন। আবার বেশ জোরে জোরে ডাকতে লাগলাম,
-রিদম, এই রিদম। ওঠো না, প্লিজ। এভাবে চুপ করে থাকলে আমার কষ্ট হবে।”

রিদম কোনো কথাই বলছে না আর। শরীরে,মুখে আঁচড়ের দাগ। দিগ্বিদিকশূণ্য হয়ে কিছুক্ষণ ওর পাশেই দাঁড়িয়ে রইলাম। রিদমকে ছাড়া আমার এক মুহুর্ত চলে না। ওর কী হলো? বেঁচে আছে তো? নাকি…
উফফ! এর বেশি আর ভাবতে পারছি না। একমাত্র মা ছাড়া ওর কেউ নেই। আমি আন্টিকে কী জবাব দেবো,সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ত্রাত্রি মেডিকেলের স্টুডেন্ট। এখানেই মেডিকেলে কলেজে পড়ছে।কিন্তু আমার ইয়ারমেট। প্রায় সমবয়সী আমরা দুজন। আগে অন্য কোথাও মেস ভাড়া থাকতো। এখন আমাদের ফ্ল্যাটে। সে রিদমের শরীরে আরো ভাল করে চেক করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বললো,
-রিদম আর নেই।

-নেই মানে!

-মানে ও মারা গেছে। সত্যিই মারা গেছে। কিন্তু ওর এমনটা হলো কীভাবে? মাত্র এইটুকু সময়ের মধ্যে কীভাবে সম্ভব? আর ওকে মারলো কে?

ত্রাত্রির কথায় আমি কিছুক্ষণ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। রিদমের দিকে ফিরে তাকাতেই ওর করুণ মুখের দৃশ্যটা ছবির মতো চোখে আটকে গেলো। এই দৃশ্য আর কোনোদিনই আমার স্মৃতি থেকে সরবে না একবিন্দুও। চোখ দিয়ে আজ আমার পানি পড়ছে না। এইজন্যেই হয়ত মানুষ বলে, “অধিক শোকে মানুষ নাকি পাথর হয়ে যায়।” ত্রাত্রি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে তখনো। ওর দিকে চিৎকার করে বলে উঠলাম,
-তুই রিদমকে মেরে ফেলেছিস,তাই না? আমি সব জানি। তুই তো সেদিন এখানে থাকিসনি। তবে জানলি কী করে যে, আমার মাথায় আমি আঘাত পেয়েছি? তোর ভিতরে নিশ্চয় কোনো আত্মা জাতীয় কিছু আছে।

ত্রাত্রি আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন বিশালভাবে শক খেয়েছে। বিস্ময়ে হা হয়ে দুই ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেলো। চোখের দৃষ্টি একেবারে স্থির। শুধু স্থির নেই কেবল আমি। রিদমকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। ত্রাত্রির মধ্যেই সমস্যা আছে নিশ্চয়। ও রান্নাঘর থেকে এখানে এসে রিদমকে মেরে ফেলেছে। বেডটা তো ওরই। মলিনভাবে ত্রাত্রি আমাকে বলল,
-কীসব আজেবাজে বকছিস তুই? বন্ধুকে হারিয়েছিস, প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছিস জানি আমি। তাই বলে আমাকে কেন মিথ্যে দোষারোপ করছিস, সুহাসিনী?

-কেন করছি, এখনো বুঝতে পারছিস না? ন্যাকামি করবি না ত্রাত্রি। তোর শরীরে আত্মা ভর করেছে। তুই অন্ধকারে রিদমকে মেরে ফেলে আমার কাছে ভালো সাজতে এসেছিস। আমি তোর রুমমেট বলে আমাকে সেদিন রাতে মারিসনি। চুড়িগুলো কে পরেছিলো? তুই, না? আমি সব বুঝতে পারছি।

-আরে, আমাকে তো ফাইজা আপু বলেছিলেন। রুমে ফিরতেই তো আপু আমাকে তোর সমস্যার কথাগুলো শেয়ার করলো। বিশ্বাস না হয়, এই দেখ। আমি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করছি,” আমার শরীরে কোনো আত্মা ভর করেনি রে।”

ত্রাত্রি ওর ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে সত্যি সত্যিই বলে দিলো, ওর শরীরে কোনো আত্মা ভর করেনি। বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস, কোনোটাই এই মুহুর্তে আর কাউকে করতে ইচ্ছে করছে না। ফাইজা আপু.!! আপু কোথায় গেলো? অনেকক্ষণ তো দেখিনি আপুকে। এই এতবড় ঘটনা ঘটে গেলেও আপুর খোঁজ তো করাই হয়নি। ত্রাত্রির থেকে চার্জার লাইটটা কেড়ে নিয়ে সারা ঘরে সেটার আলো ফেললাম। দরজার এককোণে একটা আস্ত নারী শরীর পড়ে আছে। চোখে মুখে ভয়ার্ত চিহ্ন এখনো স্পষ্ট। জ্ঞান হারিয়েছে। অনেক কষ্টে আমি আর ত্রাত্রি মিলে আপুর জ্ঞান ফেরালাম। চোখ মেলে তাকিয়েই আপু রিদমের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। আমাদের তিনটে নারীর মাঝে একটা লাশ। পুরুষ লাশ। কষ্ট পাবার চেয়েও অধিক বোধহয় ভয়টা অধিক গ্রাস করে ফেলছে। বেঁচে থাকলে মানুষ ভয়ংকর সব কাজ করলেও আমরা তো এমন ভয় পাই না। অথচ লাশ হয়ে গেলেই কোনো কিছু করার ক্ষমতা না থাকলেও তাকে আমরা এত ভয় পাই কেন?

ফাইজা আপু বললেন,
-রিদমের শরীরে অমন বিভৎস ক্ষত কেন?

আপুর প্রশ্নে আমার কেন জানি বড্ড রাগ হল। বেশ চড়া গলায় আপুকে বললাম,
-ক্ষত কেন এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আপনি কিছুই জানেন না? না জানলে অমন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন কেন?

-আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম?

– তো কী? আপনি তো এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।একদম এই জায়গাটাতেই। আপনি কী দেখে ভয় পেয়েছেন? নাকি ভয় পাবার নাটক করছেন, সত্যি করে বলুন তো।

ফাইজা আপু বেশ করুণ দৃষ্টিতে কয়েক পলক আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমার প্রশ্নগুলো সম্ভবত উনার পছন্দ হয়নি। না হবারই কথা। পরোক্ষভাবে আমি যে তাকে সন্দেহ করছি, সেটুকু বুঝার মতোন জ্ঞান তার নিশ্চয় আছে।

ফাইজা আপু রাগী স্বরে হয়ত আরো কিছু বলতে যাবেন, ঠিক সেই সময় আমার চিন্তা হলো রিদমকে নিয়ে। এখন এই লাশটা আমরা কী করবো? মেয়েদের একটা ফ্ল্যাটে একটা ছেলের লাশ। তাও আবার আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমি তো কাউকে খুন করিনি। তবে কী ওদের মধ্যে কেউ? আবার ওরাও হয়তো একইরকম ভাবছে। তাহলে খুনটা করলো কে? এই মুহুর্তে এই লাশটা এখানে রাখলে কাল সকালেই আমরা পুলিশ কেসে ফেঁসে যাবো। ওরা কেউ অপরাধী হলেও পুলিশের আমার নাম থাকবেই। এই মুহুর্তে আমি যেন বড্ড স্বার্থপর হতে চলেছি। কী করবো,নিজেও জানি না।

ফাইজা আপু করুণ সুরে বললেন,
-সুহাসিনী আমার মধ্যে কোনো আত্মা আসেনি। প্লিজ বিশ্বাস কর। আমাদের এই খুনের মামলার মধ্যে জড়ালে,তুইও জড়িয়ে যাবি।

আমি কোনো কথা বলতে পারছি না। জোর করেও না। ত্রাত্রি হঠাৎ বলে ফেললো, লাশটা সে কোথাও গুম করে রাখবে কিংবা ফেলে রাখবে।

বুদ্ধিটা কতখানি স্বার্থপরতা কিংবা অমানবিক হলো, তা আমার জানা নেই। ভাবার মতো মস্তিষ্কও যেন নেই আর। শুধু ওরা যেটা পরামর্শ করছে, সেগুলোই মনোযোগী হয়ে শুনে যাবার চেষ্টা করছি। মনোযোগ অবশ্য দিতে পারছি না ওদের কথায়। আবার নিষেধও করছি না।

ত্রাত্রি আর ফাইজা হঠাৎ কোথায় জানি রিদমকে টেনে নিয়ে গেলো আমার চোখের সামনে দিয়েই। প্রায় বেশ কয়েক মুহুর্ত পর ত্রাত্রি আমাকে কল দিয়ে বলে উঠলো- সুহাসিনী, আমরা দুজনে রিদমের লাশ নিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ গাড়ির ভিতর থেকে রিদমের লাশ মিসিং।”

(চলবে…)