হঠাৎ অদ্ভুতুড়ে পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব | বাংলা রোমান্টিক প্রেমের গল্প

0
2402

#হঠাৎ_অদ্ভুতুড়ে(পর্বঃ-০৯/শেষ)
লিখাঃ- সুহাসিনী

অনেক রাত। অপেক্ষা করতে করতে কখন জানি ঘুমের ঘোর এসে গেল। এমন সময় সেদিন রাতের মতো আবার সেই রিনিঝিনি আওয়াজ। কেউ একজন চুড়িগুলো তুলে নিচ্ছে। স্পষ্ট সেই আওয়াজ কানে আসছে। আমি জানতাম, এই চুড়িই আমাকে আসল রহস্য খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। ঘুম ভেঙে গেল তড়িৎগতিতে। তবু ভান করে শুয়ে রইলাম। আরো একটু অপেক্ষা। কারো একজনের হাতে চুড়ি ভারি হবার আওয়াজ বাড়ছে।

বেশ কিছুক্ষণ সুযোগের অপেক্ষায় থেকে একসময় চট করে বিছানা ছেড়ে বালিশের নিচ থেকে লাইটটা বের করে টেবিলের পাশে গিয়েই তাকে জাপ্টে ধরলাম। মুহুর্তেই কেমন যেন উত্তাপ। অন্যরকম অনুভূতি। শরীরের মধ্যে একেবারে আলাদা কিছু স্পর্শ করার অনুভূতি পাচ্ছি। চোখ বন্ধ করলাম না। সে আমার উপর জোর করে চলেছে হরদম। কিন্তু এই মুহুর্তে আমাকে মেরে ফেললেও আমি আর পিছুপা হবো না। অনেক সাহস করে আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফাঁদ তৈরি করেছি।
তার অদ্ভুত ভয়ংকর দুটো চোখ দিয়ে কীভাবে যেন ঘুরে তাকালো। ভয়ে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে যেন বমি চলে আসার উপক্রম। আমার চোখে তার চোখ স্থির। আমিও পলক ফেলছি না।
এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, আরো কিছু মুহুর্ত। আস্তে আস্তে সে যেন নিস্তেজ হয়ে এল । আমি কোথায় আছি, কি করছি-এতকিছু খেয়াল নেই। শুধু তার চোখের দিকেই চেয়ে আছি। মানুষটা আর নিজেকে ছাড়ানোর জন্য জোর না করে বরং ভীষণ শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
-এত সাহস তোমার? কী দরকার ছিল এত রিস্ক নেবার? আমি তোমাকে এখন মেরেও ফেলতে পারি।

-যা ইচ্ছে করুন। যত ভয়ংকর রুপ আছে আপনার, সবটা দেখাতে পারেন। তবু আমি ছাড়বো না। মরলে মরবো।

একবার মনে হল পাশের বিছানা থেকে ত্রাত্রিকে ডেকে তুলি। কিন্তু ওর দিকে ফিরেও তাকাতে পারছি না। যেন সামান্য এদিক ওদিক হলেও এ পালিয়ে যেতে না পারে। সে আবার বলল,
-তুমি খুব ভাল করেই টের পেয়েছো,আমি তোমাকে মারতে পারিনা। আমার এরুপ দৃশ্যে তোমার শরীরে জ্বর আসবে। আর স্বাভাবিক হয়ে এলে তুমি সহ্য করতে পারবে না। আমি কোনদিকে যাবো?

-যাই হোক,স্বাভাবিক হোন। আমি আপনাকে ছাড়ছি না।

-সত্যি তো?

-আমি দম নিয়েই বলছি, যত বড় কঠিন সত্যিই হোক না কেন,আমি প্রস্তুত।

আমার কথা শেষ হতেই চোখের পলকে আস্তে আস্তে অবয়বটা দৃশ্যমান হতে শুরু করলো। ঠোঁট, চোখ, ভ্রু, কপাল। মুহুর্তেই পুরোটা আমার চোখের সামনে। আস্ত একটা মানুষ। মানুষ? একি! ত্রাত্রি! আমার রুমমেট। আমার কাছের বন্ধু!
চমকে উঠে অজান্তেই ওকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
-ত্রাত্রি! তু.তু.তু…

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

কথা বলতে পারছি না আর। নিজের চোখকে বিশ্বাস করানোটা এই মুহুর্তে কষ্টকর। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ত্রাত্রির বিছানার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখি,সেখানে আরাম করে পা দুলিয়ে ত্রাত্রি বসে আছে। ত্রাত্রি ওর বেডে? তাহলে আমার টেবিলের ওখানে কে? আবার এদিকে ফিরে দেখি টেবিলের কাছের ত্রাত্রিটা নেই। ভয়ে এবার সত্যি সত্যিই গলা শুকিয়ে আসছে। হা পা যে কাঁপছে, তা স্পষ্ট বাইরে থেকেও বুঝে ফেলা যায়। ত্রাত্রির বিছানা থেকে ওর গলার সুরে বলল,
-ওখানে খুঁজে লাভ নেই। আমি এখানেই আছি। এদিকে এসে চুপটি করে বস।

-আমি তোর পাশে বসতে চাই না। কে তুই? সত্যি করে বল ত্রাত্রি।

-অনেকটাই তো জেনে গেছিস। এখন এখানে এসে বস তো দেখি।

এতক্ষণ যতটা ভয় পেয়েছিলাম, এই মুহুর্তে কেন জানি আর ভয় কাজ করছে না। ত্রাত্রি বলেই হয়ত এমনটা অনুভব করছি। কিন্তু ওর কাছে যাবার ইচ্ছেও নেই আমার। এতদিন এমন কারো সাথে আমি ছিলাম? আর কোনো মানুষ কী এমন অদৃশ্য হতে পারে? কী সমস্যা ওর ভিতরে? ভয়ংকর কিছুও তো হতে পারে। নাহ, আমার পক্ষে ওর পাশে বসা সম্ভব না। টেবিলের দিকে আরো একটু সরে দাঁড়াবো ঠিক সেই মুহুর্তে কেউ যেন টেনে ধরলো আমার হাত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম ত্রাত্রির বেডে ওরা পাশেই। ত্রাত্রিই আমাকে অতদূর থেকে টেনে নিল। তার মানে আমার বাসাতেও যে একজন লম্বা হাত দিয়ে বুকশেলফ থেকে কালার কলম নামিয়ে দিয়েছিল,ওটাও ত্রাত্রি!

ত্রাত্রি আমার হাতে হাত রাখলো। খুব স্বাভাবিক। একটু আগেকার সেই অনুভূতি নেই। ওর দুই হাতের ভাঁজে আমার একটা হাত চেপে ধরে নিজের গালে ছুঁইয়ে ও বলল,
-আমাকে এত ভয় পাচ্ছিস কেন,সুহাসিনী? এই দেখ না, আমি কত স্বাভাবিক। আমার গালে হাত দিয়ে দেখ।

আমি জবাব দিলাম না। ও আবার বলল,
-জানি, তোর মনের ভিতর এখন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি তোর সব প্রশ্নের জবাব দেবো। তার আগে আমার সাথে একটু নরমাল আচরণ কর। এখানে আমার ভরসাযোগ্য কেউ বলতে কেবল তুই।

-কি চাস তুই?

-কিছুই না৷ শুধু পড়াশোনা শেষ করবো। মেডিকেল প্রায় শেষের দিকে। শেষ করেই চলে যাবো আমার ঠিকানায়। আমার বাচ্চাটা প্রায়ই এখানে এসে কান্না করে। ওকে রেখে দূরে থাকাটা সম্ভব বল?

-তোর বাচ্চা মানে?

-সেদিন বলেছিলি না? ছাদে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিস-ওটাই তো আমার বাচ্চা। ওকে তো আর তোদের সামনে নিয়ে আসতে পারিনা। ছোট বাচ্চা একটা।

-তোর বাসা কোথায় বল তো, ত্রাত্রি? কেমন মানুষরে তুই, আজ অব্দি তোর গ্রামের বাসার ঠিকানা বলিসনি।

ত্রাত্রি আরো একটু যেন পা দুলিয়ে বসলো। আমার হাত তখনও ওর হাতের মাঝে বন্দি। আমার পাশে সামান্য সরে এসে বসার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি কড়া দৃষ্টিতে তাকাতেই থেমে গেল। মলিন মুখ মেয়েটার। দেখলেই ভারি মায়া লাগছে। কিন্তু এখন মায়ার সময় না।
ত্রাত্রি বলল,
-আমার বাসা অনেকদূর। তোদের এই চেনা ভিড় থেকেও অনেকদূর। আমি মানুষ না রে সুহাসিনী। আমি একটা জ্বীন। আমার আরো দুইবোন আছে। তোদের মতো আমরাও পড়াশোনা করি। পড়াশোনার জন্য আগে যেখানে থাকতাম,ওখানে একটা মেয়ের টেবিল থেকে নিজের বিছানার উপর বসে হাত লম্বা করে বই নেবার সময় সে টের পেয়েছিল। ভয়ে জ্বর বাধিয়েছিল। অনেক কষ্টে সেটা ম্যানেজ করেছিলাম। এরপর এলাম তোর এখানে। তুই এতটাই মিশুক যে, বন্ধু হিসেবে তোকে অনেক পছন্দ হলো। খুব ভালোবাসি রে তোকে। কিন্তু সাজগোজের জিনিসের উপর আমার বড্ড দুর্বলতা। তাই তো তোর চুড়িগুলো…

কিছুক্ষণ থেমে ত্রাত্রি আবার বলতে লাগল,
-আর আমার মেকাপ বক্স হারায়নি। আমিই সরিয়ে রেখেছিলাম,যাতে তুই আমাকে সন্দেহ না করিস। একটা সত্যি কথা শুনে রাখ, আমার খুব কাছের বন্ধু বলতে তুই ছাড়া এখানে কেউ নেই। তাই তুই যেখানেই গেছিস,আমি পিছু পিছু গেছি। এমনকি তোর বাসাতেও। কেবল তুই বলেই আজ অব্দি তোর গায়ে সামান্য আঘাত আমি করতে পারিনি। আর জানিস তো, অধিকাংশ জ্বীনদের মিষ্টি অনেক পছন্দের। আমিই মিষ্টিগুলো খেয়েছিলাম। সেদিন তোর থেকে ছাড়াতে গিয়ে তোর মাথায় আঘাত লাগল। অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলি। আমার তো আর তোর মতোন এমন গ্রামের বাসা না। তবু তোকে বিশ্বাস করাতে, বাসায় যাবার মিথ্যে নাটক করেছিলাম। কিন্তু তোর থেকে দূরে যাইনি। তোকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে আমার খুব খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি নিজে হাতে তোর মাথায় বরফ দিয়েছিলাম ব্যথা কমাতে। আমাকে ভুল বুঝিস না প্লিজ।

ত্রাত্রি আমার গলা জড়িয়ে ধরলো হঠাৎ। এই কয়েকটা দিনে আমিও মেয়েটাকে কম ভালোবাসিনি। রুমমেট ব্যাপারটাই হয়ত এরকম। তার উপর সে আমার ব্যাচমেট। ও যে একটা জ্বীন মেয়ে, সেটাই ভুলে গেছি এই মুহুর্তে। সবকিছু ভুলে ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমিও। ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। আজ অব্দি সত্যিই তো এই মেয়েটা কখনো আমার সাথে বেঈমানি করেনি। অথচ মানুষ কতটা বেঈমান, তা রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাই। দুইচোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে আমার। অথচ ত্রাত্রির মধ্যে কোনো অনুভূতিই পেলাম না। ওর কী আমাদের মতো অনুভূতি নেই? না থাকার তো কারণ দেখছি না। কিছুদিন আগে আমাকে ফ্ল্যাটে একা রেখে যেতে চাইছিল না। এমন একজন বন্ধু পাওয়া অনেক ভাগ্যের বাপার, অনেক। আমার কাঁধে মুখ রেখেই সে বলল,
-সুহাসিনী, আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি রিদমের উপর আঘাত করেছিলাম। আসলে আমার বিছানায় কোনো পুরুষের স্পর্শ থাকাটা আমার সহ্য হয়না।সেখানে রিদম আয়েশ করে বসেছিল। আমার বিছানা ছুঁয়ে ফেলার অপরাধেই আমি ওর উপর আক্রমণ করেছিলাম। ফাইজা আপুর চোখ ফাকি দিয়ে একবার রিদমকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আমার মনে হলো, ও হয়ত আমার ব্যাপারে সব জেনে গেছে। তাই অমন জঘন্য কাজ করতেও….
আমাকে ক্ষমা করিস সুহাসিনী। রিদম ছেলেটা তোকে অনেক কেয়ার করে। পরে আমি জানতে পেরেছি,ও বেঁচে আছে। কিন্তু কেবলমাত্র তোকে কেয়ার করে বলেই আমি ওর ধারেকাছেও যাইনি।

আমি কোনো জবাব দিচ্ছি না। অনেক প্রশ্ন ছিলো। অধিকাংশই জানা হয়েছে। আরো বাকি পড়ে আছে প্রশ্নের খাতায়। কিন্তু এর বেশি আমার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই। অন্ততঃ বিগত এই কয়েকটা দিনে আমার প্রতি ত্রাত্রির মায়াটা আমি খুব কাছ থেকেই অনুভব করে নিয়েছি।

ত্রাত্রি কেন জানি আমার গলা ছাড়লো না। বড্ড উদাস লাগছে মেয়েটাকে। নিজেই এবার আগ বাড়িয়ে বললাম,
-সব ভুলে যা। আর এমন উদাস কেন তুই?

-তোকে অনেক মিস করবো রে।

-মিস করবি মানে? আমি কি চলে যাচ্ছি নাকি?

-কিছু না। এমনি।

-আচ্ছা ত্রাত্রি, তুই তো জ্বীন। চাইলেই তো পরীক্ষায় সব দেখে দেখে পাশ করতে পারিস। তোকে কেউ ধরতেও পারবে না। এতকিছু রেখে এই মেডিকেলেই যত ইন্টারেস্ট তোর?

ত্রাত্রি আমার নাক টেনে ধরে হেসে জবাব দিলো,
-এখানেই মানুষ আর আমাদের পার্থক্য। তোরা কেবল পাশ করতে আর চাকরি করতেই পড়িস। আর আমরা জানার জন্য পড়ি, শেখার জন্য। পাশ নাহয় করলাম,কিন্তু যদি আমার সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানই না থাকে,তবে পাশ করে লাভটা কী?

ত্রাত্রির কথাগুলো কী গভীর! ঠিকই তো। আমরা বোকার মতোন পাশ আর সিজিপিএ ৪ পেতেই পড়াশোনা করে গেলাম। জানার জন্য আর কতই বা পড়েছি?

যদিও ঘুম ছিলো না চোখে, তবু সারাদিনের জার্নি। ক্লান্তিতেই দুচোখের পাতা এক হয়ে এলো।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি আমার বিছানায়। জানালাটা খোলা। মৃদু আলো আসছে আজও। ঘরটাও কেমন যেন সুন্দর করে গোছানো। ত্রাত্রিটা কোথায় গেল কে জানে? “ত্রাত্রি, এই ত্রাত্রি”। কোনো জবাব নেই। পাশ ফিরে ওর বেডের দিকে তাকাতেই বুকটা শূণ্যতায় হু হু করে উঠলো। ত্রাত্রির বসবাসের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই আর। বই, ক্যালেন্ডার, ঘড়ি, কলম, পেন্সিল কিচ্ছু নেই। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওর চিহ্ন নেই আর। শুধু ও যেখানে ঘুমাতো ,সেই দেওয়ালে ওর আর্ট করা একটা ডিজাইন। একটা সুন্দর গাছের ডালের পাতার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে।
ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলাম। বারান্দায় দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায়। পুর্বদিকে ভোরের দিকে সূর্য উঠছে তার আভা ছড়িয়ে।
শুধু ত্রাত্রি নেই। ওরা হয়ত নিজের পরিচয় দিয়ে দিলে আর থাকেও না। ও চলে গেছে। কোনো দূরের ঠিকানায়। এখনো অনেককিছুই জানা হলো না ত্রাত্রি…।চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
ঘরের ভিতর যেন কেউ ধীর পায়ে হাঁটছে.!

(সমাপ্ত)