হঠাৎ তুমি এলে পর্ব-০১

0
1295

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১

অরন্য ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে একা একাই বিড়বিড় করছিল। রাত তখন বারোটা। অরন্যের রোজকার অভ্যাস এ ব্রিজের পাশে এসে ধূলি মিশ্রিত বাতাসে এক ঘন্টা কাটানো। আজকেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। যখন এক ঘন্টা কাটিয়ে বাড়ি যেতে পেছনে ঘুরল ঠিক তখন তুলি ব্রিজের পাশে এসে দাঁড়াল। তার পরনে ছিল লাল বেনারসি শাড়ি আর শরীরে হালকা গহনা। মনে হচ্ছে বিয়ের আসর থেকে এই মাত্র পালিয়ে এসেছে। তাকে দেখে কেন জানিনা তার মতিগতি অরন্যের কাছে ভালো ঠেঁকল না। তাই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে তুলির দিকে নজর দিল। সে যখনই ঝাঁপ দিতে যাবে তখনই অরন্য তুলির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল-

-বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছেন? যার জন্য পালিয়েছেন উনি আসে নি। তাই ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিতে এসেছেন তাই তো।

তুলি অরন্যের কথা শুনে শাড়ির আঁচলের নীচে রাখা ছুরিটা বের করে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল। তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ বিকটভাবে যেন প্রতিধ্বনি তুলছিল।প্রচন্ডভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুরিটা হাতে নিয়ে অরন্যের দিকে তাক করে বলল-

– একদম আমার কাছে আসবেন না। আমার কাছে আসলে খুন করে দেবো।

অরন্য দুহাত উপরে তুলে ভয় ভয় চোখে বলল-

– আরে আরে কী করছেন? আমি আপনাকে কিছুই করব না। শুধু শুধু ছুরিটা এভাবে ধরে ভয় দেখাবেন না। বেশ ভয় পাচ্ছি।

তুলি ছুরিটা হাতে নিয়েই একটু হাঁপিয়ে দম নিয়ে ছুরিটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলল-

– এসব বলে ভুলানোর চেষ্টা করবেন না। কাছে আসলে সত্যি সত্যি আপনাকে মেরে দেবো।

ভয় ভয় চোখ নিয়ে অরন্য বলল-

– আসব না তো বললামেই। তা বিয়ে করবেন না বলে পালিয়েছেন ভালো কথা কিন্তু হাতে ছুরি নিয়ে পালিয়েছেন কেন? নাকি স্বামীকে বাসর রাতে মেরে চলে এসেছেন।

কর্কশ গলায় তুলি বলল-

– একদম আজেবাজে কথা বলবেন না।

হালকা হেসে অরন্য বলল-

– বুঝেছি যার জন্য পালিয়েছেন উনি লাপাত্তা। লজ্জায় এখন বাসায় গিয়েও মুখ দেখাতে পারছেন না আবার বিয়েটাও করতে পারছেন না। তাই ঝাঁপ দিতে এসেছেন।

– ঐরকম কিছুই না। আপনি এরকম হাবিজাবি বলা বন্ধ করুন। অসহ্য লাগছে আমার।

– আচ্ছা, আর হাবিজাবি কিছু বলব না! তবে আপনার বেশভূষা দেখে এর বাইরে অন্য কিছু মনে আসছে না। যাহোক, আমি অরন্য(পুরো নাম তানভীর রহমান অরন্য)। এখান থেকে একটু দূরে আমার বাসা। এই মুহূর্তে যদি কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকে, তাহলে আমার বাসায় যেতে পারেন। কাল সকালে ভেবে সিদ্ধান্ত নেবেন কোথায় যাবেন বা কী করবেন। অবশ্য চাইলে আমার বাসায় কয়েকদিন থাকতেও পারবেন। তবুও আত্নহত্যা করবেন না। কারণ, আত্মহত্যা কোনো সমাধানের পথ নয়।

অরন্যের এরকম প্রস্তাবে তুলি বুঝতে পারছে না কী করবে? এ মুহুর্তে ব্রিজের পাশে থাকাও তুলির জন্য বিপদজনক। কী করবে বুঝতে না পেরে একদম চুপ হয়ে রইল। তুলির নীরবতা দেখে অরন্য পুনরায় বলল-

– আমাকে হয়তো আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু শুধু শুধু জীবনটাকে কেন নষ্ট করবেন? একজনকে ভালোবেসে পাননি তাই বলে কী জীবন নষ্ট করে দেবেন। দেখুন আমি একজন ডাক্তার। একটু দূরে যে হাসপাতালটা আছে আমি ঐ হাসপাতালেই কর্মরত অবস্থায় আছি। আপনি চাইলে নির্ভয়ে আমার সাথে যেতে পারেন।

তুলি অরন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে কেন জানি না একটা ভরসার আলো খুঁজে পেল। শত অবিশ্বাসের পরও অরন্যকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল। তুলির এরকম চাহুনি দেখে অরন্য চমকে গেল। কারণ অরন্যের কাছে এ চাহুনিটা বড্ড চেনা চেনা লাগছে।

অপরদিকে তুলি চিন্তা করল অরন্যের সাথে যাওয়ায় উত্তম হয়। কোন ঝামেলা হলে সাথে ছুরিতো আছেই।তাই অরন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল-

– আপনি বড্ড বেশি বকবক করছেন। আপনার বাসাটা এখান থেকে কত দূরে? কতক্ষণ সময় লাগবে যেতে?

অরন্য ভরসামাখা মুখে বলল-

– খুব বেশি সময় লাগবে না। এখন রাস্তা ফাঁকা এইতো আধা ঘন্টার মতো লাগবে।আমি সাথে গাড়ি নিয়ে এসেছি।

তুলিকা হালকা দম নিয়ে বলল-

– চলুন যাই। একটু তাড়াতাড়ি গেলে ভালো হয়। নাহয় আমাকে যারা খুঁজছে তারা ধরে নিয়ে যাবে।

অরন্য মুচকি হেসে বলল-

– আপনার বাবা বুঝি পেছনে গোন্ডা লাগিয়েছে ? আগে বাংলা সিনেমায় এমন কাহিনি দেখতাম। আজকে সামনাসামনি দেখছি। নিজেকে কেন জানিনা মনের অজান্তেই হিরো মনে হচ্ছে।

রাগী গলায় তুলি বলল-

– আপনি বড্ড বেশি বকবক করেন দেখি গাড়িতে চলুন।

অরন্য পুনরায় হেসে তুলিকে নিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে পেছনের দরজা খুলে দিল। কিন্তু তুলি গাড়ির পেছনের সিটে না বসে অরন্যকে বলল-

– আমি গাড়ির সামনের সিটে বসব। আপনি যদি কোনো উল্টা পাল্টা করতে চান তাহলে পেছনে থেকে টের পাব না। আমাকে সামনে বসতে দিন। আর সাবধান কোন ঝামেলা করার চেষ্টা করলে কিন্তু খুন করে দেবো।

অরন্য খেয়াল করল তুলির হাতটা কাঁপছে। অরন্য হাতটা এভাবে কাঁপতে দেখে বলল-

– ছুরি ধরেই তো আপনার হাত কাঁপাকাঁপি শুরু করছে।খুন করার সময় কী হয় কে জানে।

এবলে একটা অট্ট হাসি দিল। অরন্যের হাসি দেখে তুলি রাগে হালকা চেঁচিয়ে দাঁত কামড়ি দিয়ে বলল-

– কতবার বলতেছি তাড়াতাড়ি করুন। এখানে আমার থাকাটা বিপদজনক।

অরন্য গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে বলল-

– যান গিয়ে বসুন। বিয়ে করবেন না ভালো কথা, বিয়ের আগেই বাবাকে বুঝাতে পারতেন। বিয়ের সময় কেন এমন করলেন। বেচারা যে বিয়ে করতে এসেছে তার কপালটা পুড়ল।

এ বলে অরন্য হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বলল-

– সিট বেল্টটা একটু লাগান তো।

তুলি ছুরিটা হাতে নিয়ে সিট বেল্টটা লাগাতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়ে গেল। না পারছিল সিট বেল্ট লাগাতে না পারছিল ছুরিটা রাখতে। বলা যায় উভয় সংকটে পড়ে গেছে।

অরন্য তুলির বেহাল দশা দেখে একটু মুচকি হেসে সিট বেল্ট লাগানোর জন্য হাতটা বাড়াতেই তুলি ছুরিটা অরন্যের দিকে ধরে বলে উঠল-

– একদম কিছু করতে আসবেন না খুন করে ফেলব।

বিরক্ত গলায় অরন্য বলল-

– আরে বাবা! এভাবে ছুরি হুটহাট সামনে আনলে তো আমি ভয়েই মরে যাব। আমি সিট বেল্ট লাগানোর জন্য হাতটা বাড়িয়েছি আপনাকে কিছু করার জন্য না। কী যে ভাবছেন নিজেকে কে জানে?

অরন্যের কথা শুনে তুলি একদম চুপ হয়ে গেল।অন্যদিকে অরন্য তুলির সিট বেল্টটা লাগানোর পর গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়িটা আপন গতিতে চলছে। গাড়ির জানালা দিয়ে আকাশটার দিকে তাকাল তুলি। খেয়াল করল গাড়ির গতির সাথে চাঁদটাও বেশ গতিশীল হয়ে গাড়ির সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে সমবেগে চলছে।তারা গুলো চাঁদের আশেপাশে জোনাকি পোকার মত জ্বলছে আর নিভছে । বাইরে একটা ধূলি মিশ্রিত বাতাস শরীরটাই লাগছে আর শরীরটাও বেশ নেতিয়ে পড়ছে।এই বুঝি চোখটা বুজে এলো। তবুও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। কারণ এখন ঘুমালে চলবে না। কোন উদ্দেশ্যে কোন গন্তব্যে যাচ্ছে তার কাছে সবকিছুই অজানা। কখন কী হয় বলা যায় না। তাই ঘুমের সাথে লড়াই করতে লাগল। চোখ গুলো বারবার বুজে গেলেও টেনে টেনে তাকাবার চেষ্টা করছিল। ঘুম ঘুম ভাবটা যেন চোখ থেকে কোনোভাবেই কাটছে না। এর মধ্যেই সে লক্ষ্য করল গাড়িটা থেমে গেছে। অরন্য গাড়ি থেকে নেমে তুলিকে বলল-

– বাসায় চলে এসেছি, এবার নামুন।

তুলি গাড়ি থেকে নেমে দেখল একটা ছয়তলাবিশিষ্ট বাড়ির সামনে গাড়িটা থেমে আছে। তুলি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল-

– কয়তলায় থাকেন আপনি?

শান্ত গলায় অরন্য বলল-

– পাঁচ আর ছয় তলা মিলিয়ে থাকি। আপনার ভয় নেই আপনি আলাদা রূমে থাকতে পারবেন। ভাববেন না আমি একটা রূমে থাকি আর আপনাকে সে রূমে থাকতে হবে। বাংলা নাটকে এমন হয় বাস্তবে না।

তুলি অরন্যের দিকে যতবারই তাকাচ্ছিল ততবারই একটা আশার সুক্ষ্ম আভাস পাচ্ছিল। তাই তেমন কোনো কথা না বলেই অরন্যের পেছন পেছন যেতে লাগল।সিঁড়ি বেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছে । কারণ শরীরে একদম শক্তি নেই। মনের জোরটা বাড়িয়ে অনেক কষ্টে পাঁচতলায় উঠল। পাঁচ তলায় উঠার পর অরন্য দরজার লকটা খুলে বলল-

– এ হলো আমার বাসা। আশাকরি আপনার এখানে থাকতে মোটেও সমস্যা হবে না।

তুলি ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরের ভেতরে তাকিয়ে দেখল অনেক পরিপাটি করে সাজানো। অরন্য তুলিকে একটা রুম দেখিয়ে বলল-

– আপনি এ রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন। দেখি আপনার জন্য কোন কিছু রান্না করতে পারি কিনা। ব্যাচেলর মানুষ তাই খাওয়া দাওয়ার কোনো নিয়ম মাফিক নেই।

তুলি অরন্যের দেখানো রুমের মধ্যে ঢুকে চমকে গেল।

চলবে।