হঠাৎ তুমি এলে পর্ব-০২

0
763

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২

তুলি রুমে প্রবেশ করে চমকে গেল।কারণ রুমটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোনো মেয়ের রুম।ভাবতে লাগল লোকটা একটু আগে বলল ব্যাচেলর তাহলে এতগুলো মেয়েলি জিনিসপত্র দিয়ে কী করে?তাহলে কি লোকটা ভালো না? এসব ভাবতেই তার মনটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল। তাই সে মনে মনে ভাবছে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হয় তাহলে একদম খুন করে দেবে তবুও নিজের ইজ্জত কারও কাছে তুলে দেবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই অরন্য এসে তুলিকে বলল-

– আপনি এখনো ফ্রেশ হন নি?

তুলি অরন্যের হঠাৎ এমন ডাকে চমকে উঠে বলল-

– হ্যাঁ হচ্ছি। আচ্ছা আপনি তো বলেছেন আপনি ব্যাচেলর তাহলে এ রুমে এত মেয়েলি জিনিসপত্র কেন? এ রুম দেখেই মনে হচ্ছে এটা কোনো মেয়ের রুম।

অরন্য হেসে বলল-

– এটা আমার স্ত্রী রুপার রুম।

অরন্যের এরকম জবাবে তুলির বিস্ময়ের পরিমাণটা বেড়ে গেল। বিস্মিত হয়ে অরন্যকে বলল-

– আপনার স্ত্রীর রুম হলে আপনি নিজেকে কেন ব্যাচেলর দাবি করছেন?

একটু রহস্যময় হেসে অরন্য বলল-

– আমাকে আপনি বলতে পারেন বিবাহিত ব্যাচেলর।

তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে উৎসুক চোখে বলল-

– আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বিবাহিত আবার ব্যচেলর কীভাবে সম্ভব?

অরন্য পুনরায় রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলল-

– সময় হলে ঠিকেই বুঝবেন। এখন এত কিছু বুঝতে হবে না। আপনি ফ্রেশ হয়ে কী পরবেন? বিয়ের শাড়ি পরেতো ঘুমাতে পারবেন না। বাসার থেকে পালানোর সময় মনে হয় কাপড় চোপড় নেওয়ার সুযোগ পান নি তাই না?

কর্কশ গলায় তুলি বলল-

– আপনি বড্ড বেশিই বকবক করেন। আমি এভাবেই থাকব।

– এত ভারী শাড়ি পড়ে ঘুমাতে পারবেন?

– হ্যাঁ পারব।

অরন্য একটু হেসে রূমে প্রবেশ করতেই তুলি ছুরিটা ধরে পিছিয়ে গিয়ে বলল-

– একদম এগুবেন না। কিছু করার চেষ্টা করলে খুন করে দেব।

অরন্য তুলির দিকে না গিয়ে আলমিরা বরাবর এগিয়ে আলমিরা থেকে কাপড় বের করতে করতে তুলিকে বলল-

– আমি আপনার জন্য কাপড় বের করতে রুমে ঢুকেছিলাম। এতটাও খারাপ না যে আপনাকে একা পেয়ে কিছু করে বসব। বারবার এ ছুরির ভয় দেখাবেন না তো। এমনেই দুর্বল চিত্তের মানুষ তার উপর ছুরির এমন ভয় দেখালে এমনেই মরে যাব। মরে গেলে কি দায়ভার আপনি নিবেন?

অরন্যকে যতই দেখছে তুলি ততই ভিন্ন মাত্রার একটা রহস্য খুঁজে পাচ্ছে। অরন্য কেন এতকিছু করছে সেটাও তার বুঝার অন্তরায়। তাই ছুরিটা নীচে নামিয়ে নীচু গলায় অরন্যকে বলল-

– আমি কোন মানুষকে বিশ্বাস করি না। মানুষ অনেক রকমের মুখোশ পড়ে থাকে যা সহজে উন্মোচন করা যায় না।

অরন্য আলমিরাটা খুলতে খুলতে বলল-

– বিশ্বাস করাটা বোকামি তবে আস্থা রাখাটা বোকামি না। আমাকে বিশ্বাস করার দরকার নেই তবে কিঞ্চিৎ আস্থা রাখুন।

এ বলে অরন্য তুলির জন্য কাপড় বের করে দিয়ে বলল-

– এগুলো রূপার কাপড়। আপনি দরজা লাগিয়ে কাপড় পাল্টে নিন, আমি আপনার খাবার গুলো এখানে নিয়ে আসছি।

তুলি অরন্যকে যতই দেখছে ততই যেন অবাক হচ্ছে।এদিকে মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে। দরজা লাগিয়ে কাপড়টা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল লোকটার বউ কোথায় তাহলে? আরও অনেক ভাবনায় মাথায় আসছে , তবে কোন উত্তরেই পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর শাড়িটা খুলে পাল্টে নিল। এখন বেশ ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে তার। জামাটাও একদম গায়ে সুন্দর করে লেগেছে। সে বুঝতেই পারছিল অরন্যের স্ত্রী ও তার গড়নের। কিছুক্ষণ পর অরন্য আসলো খাবার নিয়ে।

খাবারগুলো সামনে পেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় হাতটা না ধুয়েই খেতে লাগল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এক প্লেট ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলল । তুলির খাওয়ার শেষে অরন্য বলে উঠল-

– সারাদিন মনে হয় কিছু খেতে পারেন নি। বিয়ে বাড়িতে তো অনেক রান্না হয়, কিছু লুকিয়ে নিয়ে আসতেন। আমি হলে তো খাবার লুকিয়ে নিয়ে আসতাম। কত মজাদার করে রান্না হয় বিয়ে বাড়িতে। মনে হয়ে এখনেই জিভে জল চলে আসছে।

অরন্যের এরকম গা ছাড়া কথা শুনে তুলির মাথায় রাগ চড়ে গেল। অরন্যের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই অরন্য এঁটো প্লেটগুলো নিয়ে চলে গেল। আর তুলি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে অরন্যের ডাকে তুলির ঘুম ভাঙ্গল। দরজা খুলতেই অরন্য তাকে আলমিরা থেকে আরও কাপড় বের করে দিল, সবসময় পরার জন্য। বাসায় কোথায় কি আছে সব বুঝিয়ে দিল।

এভাবেই থাকতে লাগল তুলি। সে খেয়াল করল অরন্য সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি করে আর রাতে বাসায় ফিরে খাবার খেয়ে আবার রাত এগারোটায় কোথায় যেন চলে যায়। তুলি বুঝতে পেরেছিল অরন্য খুব খামখেয়ালে স্বভাবের। কেন জানি না অরন্যের সাথে কথা বলতে বেশ ভালো লাগত। অরন্যের চোখে ভালোবাসার ছন্দ খুঁজে পেত। তবুও নিজেকে সামলে নিত কারণ অরন্য বিবাহিত। আশ্চর্যের বিষয় হলো দেখতে দেখতে এ বাসায় দুমাস পার করে ফেলল তুলি। কিন্তু অরন্যের কোনো পরিবর্তন হলো না আর রূপার ও দেখা পেল না। অরন্যের প্রতি একটা ক্ষীণ বিশ্বাস জাগল।

অপরদিকে অরন্যের ও মনে হলো তুলির বিষয়ে জানা উচিত। তাই তুলির কাছে আসলো। সবসময় খামখেয়ালে হয়ে কথা বললেও সেদিন অরন্য তুলির পাশে বসে সিরিয়াস হয়ে বলল-

– আমার বাসায় তো দুমাস যাবৎ আছেন। আশাকরি আমি কেমন বুঝতে পেরেছেন। এখন পর্যন্ত আপনার নামটা বলেন নি। আমি কী জানতে পারি আপনি কে?আর কেন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন যদি ভরসা করতে পারেন তাহলে বলুন।

তুলি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলল-

আমার বিয়ের এক বছরে আমি যে কষ্ট সহ্য করেছি বলে বুঝাতে পারব না।

ফেসবুকে পরিচিত হয়ে আমি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখাতেই আমার স্বামী আমাকে জোরপূর্বক তুলে এনে বিয়ে করেছিল। তখন আমার স্বামীর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল শুধু। আর সে বন্ধুত্বের দাবি নিয়েই দেখা করতে গিয়েছিলাম।

প্রথম দেখাতেই বসেছিলাম একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া আর পরিচয় পর্ব শেষে আমার স্বামী আমাকে বলল-

– আমি সাথে গাড়ি নিয়ে এসেছি চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিই।

আমিও ভরসা করে গাড়িতে উঠেছিলাম। কিন্তু কে জানত মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষটা এত কুৎসিত। গাড়িতে উঠিয়েই আমাকে তুলে নিয়ে গেল উনার বাসায়। যে রুমে জোর করে বসাল সে রুমটায় খেয়াল করে দেখলাম বাসর সাজানো।বাসর সাজানো দেখে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

– আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন?

লোকটা আমার কাছে এসে বলল-

– আমি তোমাকে প্রথম কথা বলাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।তোমাকে যেন না হারাতে হয় তাই এ ব্যবস্থা করেছি। তুলি আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।

আপনাকে তো আমার পরিচয় দেওয়া হয় নি। আমি তুলি, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। আর আমাকে যে তুলে এনেছে তার নাম নিলয়। ঘটনার দুমাস আগে ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল। বলেছিল একটা সরকারি চাকুরি করেন।

ঘটনায় আসা যাক। মুখোশধারী ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার শরীরটা রাগে গিজগিজ করতে লাগল। রাগী গলায় বললাম-

– আপনার সাথে তো আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না তাহলে এমন করছেন কেন? দয়াকরে আমাকে যেতে দেন।

আমার স্বামী আমার কোন কাকুতি মিনতি সেদিন শুনেনি। জোর করে কাজী এনে আমাকে বিয়ে করল। আর রাতে তার পুরুষত্ব দেখাল।
সেদিনের পর থেকে আমার জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরু। বিয়েটা যেমন করেই হোক না কেন ভেবেছিলাম বিয়েটা যেহুত হয়ে গিয়েছে তাহলে মেনে নেওয়ায় শ্রেয়। সেদিন রাতে নিলয় ঘুমানোর পর আমার ফোনটা চুপিচুপি নিয়ে মাকে কল দিলাম । মা আমার কন্ঠ শুনে আঁৎকে উঠে বলেছিল-

– তুলি তুই কোথায়? তোকে সবাই খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।

ভেবে পাচ্ছিলাম না মাকে কী উত্তর দিব। চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। মা আমার নীরবতা দেখে ছটফটাতে ছটফটাতে বলল-

– কী রে তুলি কথা বলছিস না কেন? তোর ফোন এতক্ষণ বন্ধ পাচ্ছিলাম কেন? এত বড় মেয়ে, না বলে বাসার বাইরে থাকলে কতটা চিন্তা হয় সেটা কী তুই জানিস না?

এভাবে যে আমি ফেঁসে যাব কে জানত? মাকে তো আর এতকিছু বলা যাবে না। তাই মাকে সরাসরি বললাম-

– মা আমি পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। ছেলেটার নাম নিলয়। সরকারি চাকুরি করে।

মা কাঁদতে কাঁদতে বলল-

– আমাদের বললে কী হত না? সবার কাছে আমাদের মাথাটা এভাবে নীচু করতে পারলি? কাজটা করার আগে আমাদের কথা একবারও ভাবলি না?

কর্কশ গলায় জবাব দিলাম-

– পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর সকালে কথা হবে। এত রাতে আর কথা বলতে পারব না।

এ বলে ফোনটা কেটে ঘরে প্রবেশ করে খেয়াল করলাম আমার স্বামী রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল-

– এত রাতে কার সাথে কথা বলেছিস। নিশ্চিত তোর আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথে।

নিলয়ের মুখে এমন ভাষা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কারণ এক তো জোর করে বিয়ে করেছে তার উপর বিয়ের রাতে তুই তোকারি। আমার স্বপ্নের আকাশটা নিমিষেই হুমরি খেয়ে পড়ল। কি বলব খুঁজে না পেয়ে ঠাঁই চুপ হয়ে রইলাম।

নিলয় আমার দিকে তাকিয়ে আমার বাহু দুইটা তার দুহাত দিয়ে চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল-

– কিরে তুই চুপ হয়ে আছিস কেন?

আমি নিজেই নিলয়ের এরকম ব্যবহারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ করতে চাইলেও যেন করতে পারছিলাম না। নিলয় আমার প্রশ্নের কোনো জবাব না পেয়ে আমার গালে একটা চড় দিয়ে বলল-

– মুখ দিয়ে কথা বলছিস না কেন?

এ বলে দুই আঙ্গুল দিয়ে মুখটা চেপে ধরে বলতে লাগল-

– জবাব না দিলে আজকে তোর মুখটাই ভেঙ্গে ফেলব।

এমন ভাবে চেপে ধরেছিল যে আমি কোন নিঃশ্বাসেই নিতে পারছিলাম না। কোনো রকমে আওয়াজ করে বললাম-

– মাকে ফোন দিয়েছিলাম।

আমার উত্তর শুনে মুহুর্তের মধ্যে নিলয় কেমন জানি বদলে গেল। আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল-

– এ কথাটা আগে বললে কী আমি তোমাকে এভাবে আঘাত করি বলো? মায়ের সাথে কথা বলতে মন চাইলে আমাকে বলেই বলবে।তবে আমাকে না বলে কিছু করলে মোটেও ভালো হবে না।

সেদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার স্বামী মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ।সেদিন রাতটা কোনো রকমে কাটালাম।

সকালে উঠে মাকে কল দেওয়ার পর মা বলল-

– তুলি যা করেছিস তো করেছিস আমি তোদের মেনে নিয়েছি। এবার একটা অনুষ্ঠান করে তোকে বিদায় দেই, না হয় মানসম্মান থাকবে না।

এমন সময় নিলয় আমার কান থেকে ফোন নিয়ে বলল-

– মা কিছু মনে করবেন না। আপনাদের কে কে আসবেন বলুন আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। আমার বাবা,মা কেউ নেই আর আত্নীয়স্বজনও নেই। আপনারা যা করার আমার বাসায় করুন।

খেয়াল করলাম মা ও নিলয়ের কথায় রাজি হয়ে গেল। পরদিন সকালে আমার মা,বাবা, আর কাছের কাজিনগুলো আসলো আমার বাসায়। নিলয় সব ঠিক করে গুছিয়ে রাখল।

এর মধ্যে হুট করে আমার চাচাতো ভাই পরশ আমার চোখ চেপে ধরে বলল-

– বলতো কে আমি?

পরশ আমার বড় চাচার ছেলে। পিঠাপিঠি হওয়ার দরুণ আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটাও বেশ ছিল।আমি পরশের কন্ঠ শুনে হাসিমাখা গলায় বললাম-

– তোরে চিনব না। চোখ খুল পরশ।

পরশ হতাশ গলায় বলল-

– আরে যাহ…চিনে ফেলেছিস।

ঠিক এ মুহুর্তে আমার স্বামী আমাকে ডাক দিল-

– তুলি একটু রুমে এসো তো। কথা আছে।

নিলয়ের ডাক শুনে পরশকে বললাম

– তুই এখানে দাঁড়া আমি এখনেই আসতেছি।
এ বলে নিলয়ের কাছে গেলাম।

চলবে?