হঠাৎ প্রণয় পর্ব-০৭

0
201

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তম পর্ব

আজকেও কোচিং ফাঁ°কি দিবো, অয়নের সাথে টিএসসিতে যাবো। এমনটাই প্ল্যান করেছি। ব্যাগ নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। মানহাকেও আসতে বলেছি। শাড়িটা মানহাকে দিয়ে দিবো এটা বলে আপুর থেকে নিয়ে এসেছি। কাল কলেজ থেকে আসার সময় শাড়িটা দিতে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম।

মানহা আসতেই বললাম,
“শাড়ি কোথায় পড়বো?”
“শাড়ি কোথায় পড়ে তুই জানিস না? ছি, ছি, এই মেয়েকে অয়ন ভাই শাড়ি কেন দিয়েছে?”

মেজাজের চৌদ্দটা বেজে গেছে৷ এমনিতেই আমি ভ°য়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি আর এই মেয়ে মজা করছে। দাঁত কি°ড়°মি°ড়িয়ে বললাম,
“গাধা, আমি কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেঞ্জ করবো?”
“ওমা, সেসব করবি কেন? পার্লার আছে কি করতে?”

বুদ্ধিটা ভালো, কিন্তু টাকা কোথায় পাবো? জমানো টাকা থেকে মাত্র পাঁচশ টাকা নিয়ে এসেছি।

ব্য°ঙ্গসুরে বললাম,
“টাকাটা কি তোর জামাই দিবে?”
“না, তোর জানের থেকে উসুল করবো। এখন চল।”

দুজনে মিলে পার্লারে গেলাম। মানহার পরিচিত এক আপুর পার্লার, তাই তেমন ঝামেলাও হবে না বলেই মনে হচ্ছে। শিফনের শাড়ি পড়া যে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। প্রায় একশ পিন দিয়ে আটসাট করে দিলো, তবুও মনে হচ্ছে খুলে খুলে যাচ্ছে। এ যাত্রায় মানসম্মান বাঁচুক, তারপর দেখাবো অয়নকে মজা।

ব্যাগ থেকে লিপস্টিক আর আইলাইনার বের করে মানহা আমাকে সাজাতে সাজাতে বলল,
“তুই বলেছিলি না আমি যেন তোকে সাজিয়ে দিই, এই নে সাজিয়ে দিলাম।”

এরমধ্যেই অয়ন কল দিলো। রিসিভ করতেই বলল,
“কোথায় তুই?”
“তুমি বাসাবো বিশ্বরোডের কাছে ডেইলি শপের সামনে আসো, আমি আসছি।”
“ঠিক আছে।”

ফোন রেখে মানহাকে বললাম,
“তুই কোচিং এ যা, কি কি পড়ায় আমাকে বলিস।”
“ওকে।”

আমি রিকশায় উঠে পড়লাম, মানহা চলে গেল। ডেইলি শপিং এর কাছাকাছি এসে দেখি অয়ন আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। সে হয়তো আমাকে খেয়াল করেনি, আপন মনে ফোন গু°তাচ্ছে। একটু দূরেই রিকশা থেকে নেমে রাস্তা পেরিয়ে অয়নের পিছনে গিয়ে বললাম,
“টুকি।”

অয়নের পিছনে ফিরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে সে। প্রথমে তার দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকলেও এখন খুব লজ্জা লাগছে।

কিছুটা ইতস্ততভাবে একটা কাশি দিয়ে বললাম,
“রাস্তার মধ্যে এভাবে তাকিয়ে থেকো না, লোকে খারাপ বলবে।”

অয়ন ভ্রু উঁচিয়ে মুচকি হাসলো। কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে তারপর বলল,
“চল।”

অয়ন সিএনজি ঠিক করে নিলো। ঘড়িতে চারটা বেজে গেছে, তবুও ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁ°টাটা টিকটিক টুকটুক করে ঘুরে চলেছে অবিরাম। অয়ন আর আমি পাশাপাশি বসে আছি কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই।

“তনুশ্রী।”

আমি চমকে উঠে অয়নের দিকে তাকালাম। অয়নের দৃষ্টি এখনো আমার দিকে। লক্ষ কথা, সহস্রাধিক ভাবনা তার চোখেমুখে৷ ঠোঁট জোড়ার কম্পন যেন আমার মনেও ঢেউ তুলেছে৷ দাঁড়ির ফাঁকে তার গালের তিলটার দিকেও নজর পড়েছে।

“ওরে আমার সিটিস্ক্যান মেশিন, ভদ্রতাটুকু বাকি রাখ।”

অয়নের কথায় সরে গিয়ে অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে চোখ খিঁ°চে বন্ধ করে ফেললাম। তার কতটা কাছে চলে গিয়েছিলাম আমি, ভাবতেই লজ্জায় হাতপা কাঁ°পতে শুরু করেছে।

অয়ন একহাত আমাকে পেছন থেকে আগলে ধরে বলল,
“আজকে আমাকে অ°ত°র্কিতে গ্রে°ফ°তার করেছিস।”
“মানে?”
“শাড়িতে সুন্দর লাগছে।”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। তার দিকে তাকালাম না পর্যন্ত, আমার কাঁধের পাশে থাকা তার হাতের আঙ্গুল চারটি দেখছি। সে আমাকে স্বাভাবিক করতে চাইছে আর এতে আমি আরো লজ্জায় ম°রছি।

টিএসসিতে পৌঁছে সিএনজি থেকে নেমে আমি সোজা হাঁটা লাগালাম। অয়ন ভাড়া দিতে দিতে আমাকে ডেকে বলছে,
“দাঁড়া, নাহলে রেখে চলে যাবো।”

আমি রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। অয়ন আমার হাত ধরে একপাশে নিয়ে বলল,
“এজন্যই যেখানে সেখানে পড়ে যাস, আন্টি ঠিকই বলে তুই আসলেই কা°না।”

চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছি। অয়ন হেসে বলল,
“শাড়ির সাথে সাজটা একদমই মানানসই হয়নি৷ কিছু একটা কম আছে।”

আমি চুলগুলো খোঁপা করতে করতে বললাম,
“মোটেও কম নেই, সব বেশি বেশি আছে।”
“কচু°ঘে°চু আছে।”

পাশের দোকান থেকে বেলির গাজরা এনে যত্ন করে খোঁপায় পরিয়ে দিলো৷ আমার দিকে একটু চেয়ে থেকে আবারো দৌড়ে রাস্তার ওপারে বসা এক চুড়িওয়ালী আন্টির কাছ থেকে গোলাপী ও লাল রঙের অনেকগুলো চুড়ি এনে আমার দুহাতে পড়িয়ে দিলো। আমি তো মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছি, ভুলেই গেছি যে আমাকে একসময় বাসায় যেতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে অয়ন বলল,
“খোঁপায় গাজরা, হাতে চুড়ি। এখন কিন্তু পাক্কা গিন্নি লাগছে।”

আমি একটু রাগ দেখিয়ে বললাম,
“মানে বলতে চাচ্ছো বিয়ের পর আমি এভাবে চুড়ি আর ফুল পড়ে বসে থাকবো? পাগল নাকি তুমি? এভাবে সেজেগুজে বসে থাকলে তোমার সংসার লা°টে উঠবে। আর তুমি অফিস থেকে ফিরে আবার হাত পু°ড়িয়ে রান্না করবে।”

অয়ন মুচকি হাসছে দেখে আমিও মুখে হাত চেপে চুপ হলাম। অয়ন জোরে হেসে বলল,
“কতো এডভান্স রে তুই? একেবারে বিয়ে, সংসারের চিন্তা করতেছিস। কয়েকদিন পর তো বাচ্চাকাচ্চার চিন্তা শুরু করবি। ভেরি ব্যাড, তনুশ্রী।”

একটু অভিমানের সুরে বললাম,
“তুমি খুব খারাপ।”

অয়ন আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“কখনই ভালো ছিলাম না।”

অয়নের মুখের দিকে তাকালাম। তেমন বিশেষ কিছু না থাকলেও আমার কাছে খুব বিশেষ লাগলো।

“কটন ক্যান্ডি খাবি?”

সামনে তাকিয়ে দেখি রংবেরঙের হাওয়াই মিঠাই নিয়ে বসে আছে এক আংকেল। মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
“এতো স্মার্টনেস দেখাও কেন? হাওয়াই মিঠাই বলো, শুনতে ভালো লাগে।”
“একই হলো।”

দুজনে সেই আংকেলের কাছে গেলাম।

“মামা, দুইটা কটন ক্যান্ডি দিয়েন।”

অয়নের কথায় আংকেল গোলাপী দুইটা হাওয়াই মিঠাই নামালে আমি বললাম,
“গোলাপী না, সাদা আর বেগুনী রঙেরগুলো নিবো।”

সাদাটা হাতে পেয়ে আবারো বললাম,
“সাদা না, কমলাটা নিবো।”

কমলাটা হাতে নিয়ে কিছু বলার আগেই অয়ন বলল,
“এটাই লাস্ট, আর কাহিনী না।”

অয়ন টাকা দিয়ে এগিয়ে গেল। দুই হাতে দুইটা মিঠাই নিয়ে আমি পিছু পিছু যাচ্ছি।

দৌড়ে তার সমান হয়ে বললাম,
“আমি কাহিনী করি?”
“উনাকে দিয়ে বারবার এটা ওটা নামাচ্ছিস যে উনার কি কষ্ট হয় না? বাপের ঘা°ড়ে আছো তো এসব বুঝো না।”

কপাল কুঁচকে গেলেও পরক্ষণেই হেসে ফেললাম। অয়ন সাধারণ, তবুও সে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ।

সবুজ ঘাসের উপর পাশাপাশি বসলাম দুজনে। একটা মিঠাই খুলে আমার মুখের সামনে ধরে বলল,
“ভার্সিটির প্রথম বছর খুব এক্সাইটেড ছিলাম। ঢাবিয়ান হয়েছি, ঘুরবো ফিরবো, এখানে বসে সময় কাটাবো কত কি ভেবেছি। কিন্তু কিছুই হয়নি।”

আমি উৎসুক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। সে হয়তো আমার দৃষ্টিটা বুঝেছে। মুচকি হেসে বলল,
“প্রথম এখানে এসেই বুঝেছিলাম এতো এতো কাপলের মাঝে আমি এক ছা°ড়পো°কা। তারপর আসা যাওয়া হলেও আর বসা হয়নি।”
“কোনো মেয়ে পাত্তা দেয়নি বুঝি?”

অয়ন তাকাতেই হেসে দিলাম। সেও হেসে বলল,
“বিষয়টা তা নয়। আসলে সিরিয়াস প্রেম বলে কিছু হয়নি। একটু আধটু ফ্লাটিং হয়েছে, তবে সেটা ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত। এ অব্ধি আসেনি।”
“এখানে আসতে হলে সিরিয়াস প্রেম হতে হয় নাকি?”

অয়নের হাসি চওড়া হলো,
“আমার তো সেটাই মনে হয়।”

আমি খেতে খেতে বললাম,
“এখন ভার্সিটিতে আসো না?”
“ফাইনাল ইয়ার, কেমন যেন একটা টায়ার্ডনেস আর একটা অবহেলা কাজ করে, খুব একটা ক্লাস করা হয় না। ক°রো°নার বন্ধের পর এখন আর ক্লাস করি না।”

একটু ভেবে বললাম,
“আমি শুনেছিলাম তুমি মাস্টার্সে পড়ো, এখন বলতেছো ফাইনাল ইয়ারে।”
“কোথায় শুনেছিস?”
“অথৈ আপুর বিয়েতে কেউ একজন বলেছিল।”

অয়ন নিজের মুখটা আমার মুখের সামনে এনে বলল,
“তারমানে তুই আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিস?”

প্রথমে চোখ বড়বড় করে ফেললেও পরক্ষণেই তা বন্ধ করে একচোখ খুলে একটু দেখলাম, অয়ন হাসছে। স্বাভাবিক হয়ে একটু নড়েচড়ে বসতে বসতে বললাম,
“হাসবা না, রাগ হচ্ছে।”
“কেন?”
“কি কেন?”
“রাগের কারণ।”
“তোমার হাসি দেখে রাগ হচ্ছে, হিং°সা হচ্ছে।”
“ও, তাই বুঝি?”

অয়ন আমার কাঁধে মাথা রেখে একহাতে আমার কোমর ধরে বসে পড়লো।

“তোদের বাসায় যাবো একদিন।”
“যেও।”
“আন্টি-আংকেলের সাথে কথা বলবো।”
“কি ব্যাপারে?”

অয়ন আমার একহাত নিয়ে তার গালে রাখলো। তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো আমার হাতে লাগছিল।

“উনাদের মেয়ে কোচিং ফাঁ°কি দিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা তো উনাদের জানানো উচিত।”

আমি লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম,
“আমি বাসায় যাবো।”

অয়ন হেসে দিলো। আমি কাঁদোকাঁদো ভাব করে বললাম,
“সত্যি আমি বাসায় যাবো। কোচিং ছুটির সময় হয়ে গেছে। আপু টের পেলে খবর আছে।”
“ঠিক আছে, চল। এটা নে।”

একটা মিঠাই খাওয়া হয়েছিল৷ আরেকটা আমার হাতে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, চল তোকে পৌঁছে দিই।”
“হুম, তবে এবার সিএনজি না রিকশায় যাবো।”
“রিকশায়?”
“হুম।”
“ওকে।”

রিকশা ঠিক হলো। উঠে বসে অয়নকে বললাম,
“বাসায় যাবো তো বলেছি বাট আগে তো আমাকে চেঞ্জ করতে হবে।”

অয়ন কিছু না বলে আমার দিকে তাকালো। আমি আবারো বললাম,
“ড্রেস তো মানহুর কাছে, ও নিশ্চয়ই কোচিং এ আছে। তবে এখন কি হবে?”
“সেটা আমি কি জানি?”

তার কথা হেয়ালি টের পেলাম। রাগ দেখিয়ে বললাম,
“তোমার জন্যই তো শাড়ি পড়েছি আর এখন তুমিই জানো না। তুমি অনেক স্বা°র্থ°প°র।”
“তুই আমার জন্য শাড়ি পড়েছিস?”

আবারো নিজের লাগামহীন মুখের জন্য বেকায়দায় পড়লাম। অয়ন হেসে বলল,
“কোচিং কয়টা পর্যন্ত?”
“সাতটা।”
“এর আগেই আমরা পৌঁছে যাবো, ডোন্ট ওরি।”

কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করলাম,
“তুমি আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছো?”
“পেয়েছি কোথাও।”
বলেই অন্যদিকে তাকালো। নাম্বারটা ঠিক কার থেকে নিতে পারে ভেবেও পেলাম না। মস্তিষ্ক বোধহয় আজকাল কম কাজ করে।

সাড়ে ছয়টার দিকে খিলঁগাও পৌঁছে গেলাম। সারা রাস্তা অয়নের কাঁধ আর একহাত দখল করে রেখেছিলাম। ঢাকার রাস্তার জ্যামে বসে থাকার অভ্যাস নেই, ক্লান্ত লাগছে খুব।

কোচিং থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মানহাকে দুবার ম্যাসেজ দিয়েছি। কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই এলো, “ক্লাসে আছি, স্যার বের হতে দিবে না।”

অয়নের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমি শেষ।”
“আবার কি?”
“মানহা এখন বের হতে পারবে না। আর একটু পর কোচিং ছুটি হবে। আমি কি করবো? কি করবো?”

আমি টেনশনে ম°রি ম°রি আর অয়ন এখনো মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছে। আমি রাগ দেখিয়ে তাকাতেই অয়ন অন্যদিকে ফিরে জোরে হেসে দিলো। তার হাতে দুইতিনটা ঘু°ষি দিলাম।

“ইশ, এগুলা হাত না ইস্পাত? এতো জোরে কেউ মা°রে?”

অয়নের কথায় আরো দুইটা ঘু°ষি দিলাম। তারপর বললাম,
“আমি কি করবো সেটা বলো।”
“তুই চাইলে আপাতত আমার সাথে প্রেম করতে পারিস, আমি মোটেও মাইন্ড করবো না।”

কপাল কুঁচকে তাকাতেই আমার নাক টেনে দিয়ে বলল,
“ওলে লে লে, রেগে গেছিস আবার?”
“বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু এবার।”
“মোটেও না।”

ঝগড়া করতে করতে সময় চোখের পলকে বোধহয় চলে গেল। মানহা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে আমার হাতে ব্যাগ দিয়ে বলল,
“পার্লারে গিয়েই চেঞ্জ করবি, চল।”

আমি যাওয়ার সময় ফিরে অয়নের দিকে তাকাতেই অয়ন বলল,
“বাই, আজকের মতো।”

আমিও হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। অয়ন হালকা হাসলো। একটু দূরে এসে ফিরে দেখি অয়ন এখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

পার্লারে ড্রেস চেঞ্জ করে শাড়ি, চুড়ি মানহার কাছে দিয়ে দিলাম। ফুলগুলো আমার কাছেই রইলো।

পার্লার থেকে বেরিয়ে দেখি অয়ন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলাম। আমাকে দেখে হেসে বলল,
“কাল কলেজে যাবি?”
“হ্যাঁ, না যাওয়ার কোনো কারণ নেই।”
“তবে ঠিক আছে।”
“কি?”

অয়ন একটু এগিয়ে এসে বলল,
“কালই বলবো।”

সে হেলেদুলে চলে গেল। মানহা ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে এসে বলল,
“অয়ন ভাই খুব কেয়ার করে?”

অয়নের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কেয়ারের চেয়ে বেশি ভণিতা করে।”
“মানে?”
“মানে কিছু না, চল বাসায় যাই।”

বাসায় আসতেই আপু দরজা খুলেই দিলো এক ধমক,
“কিরে, এতো দেরি করলি কেন? সন্ধ্যাবেলা রাস্তাঘাটে না ঘুরলে হয় না? কোথাও যদি ম°রে পড়ে থাকতি?”

এমন বোনও নাকি কারো ভাগ্যে জোটে, যে কিনা নির্দিধায় বোনের ম°রে যাওয়ার কথা বলে তাও আবার রাস্তাঘাটে।

ভিতরে আসতে আসতে বললাম,
“আপু, ক্লাস থেকে বের হয়ে একটা আন্টিকে দেখলাম ফুল বিক্রি করছে। ওখানে একটু দাঁড়িয়েছিলাম, তাই লেইট হয়েছে।”
“তুই যে কি করিস তা তো আর আমি জানি না।”

আপু রুমে চলে গেল। আমি সোফায় বসে পড়লাম৷ মামা, মামানী, আম্মু নাস্তা করছে আর নানান বিষয়ে কথা বলছে।

মামানী আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা, ফ্রেশ হয়ে এসো, নাস্তা করবে না? ক্ষুধা তো লেগেছে নাকি?”
“হ্যাঁ, তা একটু লেগেছে।”

“চা রান্নাঘরে আছে, গরম করে নিও।”
রুমে আসার সময় আম্মু একটু জোরে বলে দিলো।

ব্যাগ রেখে খোঁপা থেকে গাজরা খুলে হাতে নিলাম। অয়ন আমাকে পড়িয়ে দিয়েছে, ভাবতেই শিহরণ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছি অয়নকে।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। নিশ্চয়ই আপু এসেছে, এখন আবার পড় পড় করে মাথা খারাপ করে ফেলবে। গাজরাটা ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে।

নাস্তা খাওয়া শেষে চুপচাপ পড়তে বসলাম। পড়ায় মন বসাতে খুব কষ্ট হচ্ছে, সারা বিকাল ঘুরাঘুরি করে রাতে পড়া যায় নাকি?

বিছানায় বসে আপু পড়ছে। কিছুক্ষণ পর আমাকে বলল,
“তোর জন্য বাসায় টিচার রাখবো। কিন্তু সমস্যা হলো দুমাসের জন্য কেউ পড়াতে রাজি হয় না।”
“টিচার রাখার কি দরকার?”
“কোচিং এ যাওয়া আসায় টাইম ওয়েস্ট হয় তাই।”

কিছুই বললাম না। কোচিং এর টাইমটুকুই অয়নের সাথে দেখা হয়, এটাও যদি না থাকে তবে আমি কি করবো?

রাতে আর আমার খাওয়া হলো না। পড়ার নাম করে টেবিলেই বসে রইলাম, রুম থেকে বের পর্যন্ত হলাম না। মামা, মামানী, আব্বু দুইএকবার ডাকলেও গেলাম না। পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম তাই টের পাইনি।

“তন্বী, এই তন্বী। উঠ।”

আপুর ডাকে চোখ খুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে। টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।

“আয়, নাস্তা করে কলেজে যাবি। কলেজ থেকে এসে ঘুমাইস নাহয়, আজ থেকে আর কোচিং এ যাওয়া লাগবে না।”
“আপু, সব ডিসিশন তুমিই নিবে নাকি?”

আপু হেসে বলল,
“না, আব্বু ডিসিশন ফাইনাল করে দিয়েছে। তুমি আর কোচিং করছো না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্রেশ হতে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ডাইনিং এ এসে দেখি মামা-মামানী যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নাস্তা শেষে দুজনেই রেডি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। সোফায় বসে আম্মুর সাথে কথা বলছে, সামনে রাখা আছে উনাদের ব্যাগ।

“মামা, আজকেই চলে যাবেন। আরো কয়েকদিন থাকেন।”

আপুর আহ্লাদী কথায় মামানী হেসে বলল,
“তোমার আপুরা তো বাসায় একা আছে। আজ না গেলে হবে না। তোমরা বাসায় যাবে, কেমন?”
“জি, তন্বীর পরীক্ষার পর যাবো।”

মামা আমার হাতে হাজার টাকার নোট গুজে দিয়ে বললেন,
“ভালো করে এক্সাম দিও আম্মু, এ প্লাস পেতে হবে কিন্তু।”
“জি।”
দাঁত কেলিয়ে বললাম।

আপু মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ফে°ইল নাম্বারে এক্সাম দিবে তাতে আর এমন কি?”
“আহা তানিমা, এভাবে বলে না।”

মামার কথায় আমি আরো দাঁত বের করে আপুর দিকে তাকালাম। আপু একটু গম্ভীরমুখে বলল,
“আচ্ছা, বলবো না।”

মামা-মামানীকে বিদায় দিয়ে আমি রুমে রেডি হতে আসলে আম্মু এসে জানিয়ে গেল আজকে যেন কলেজে না যাই। বিশেষ কোনো কারণ বলল না তবে বাসায় থেকে পড়তে আদেশ করলো।

আপু ভার্সিটিতে যাবে। আমাকে বাসায় রাখার অভিনব কৌশল যে আপুর সেটা ভালোই বুঝেছি। নিশ্চয়ই সে কিছু সন্দেহ করছে, তবে শিউর না বলে ডিরেক্ট কিছুই বলছে না।

আজ দিনটা খারাপ কাটবে বলেই মনে হচ্ছে। কলেজে যাবো না, মানহার সাথে দেখা হবে না, অয়নের সাথেও দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। কথা বলার সুযোগটাও বোধহয় শেষ হয়ে গেছে, কারণ অলরেডি আমার ফোন আম্মু নিয়ে গেছে। অয়ন তো জানেও না যে আজ আমি কলেজে যাবো না।

চলবে…………