হঠাৎ প্রণয় পর্ব-০৩

0
221

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

তৃতীয় পর্ব

সকাল সকাল সারা বাড়িতে মানুষের চেঁ°চা°মে°চিতে ঘুমের বারোটা বেজেছে আমার। জাহানারা আন্টির রুমে আম্মু, আন্টি আর অথৈ আপুর সাথে রাতে শুয়েছিলাম। রাত না বলে ভোর বললেও চলবে, কারণ ৪ টাকে কেউ রাত বলে না ভোর ৪ টাই বলে।

চোখদুটো কোনোমতে খুলে ঝিম মেরে বসে আছি। অথৈ আপু গোসল করে এসে খাটে বসে চুল মুছছে। আমাকে উঠতে দেখে আপু বলল,
“পা কা°টলো কি করে, তন্নু?”

আপুর কথায় পা ব্য°থার কথা মনে পড়লো। পায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কাল দীঘির পাড়ে কে°টেছে।”

আপু বোধহয় রাগ করেছে। ধমকের সুরে বলে উঠে,
“দীঘির পাড়ে কে°টেছে, কথাটা একবার কাউকে বললি না? আর আমার ভাইটাও এতো ইরেস্পন্সিবল।”

অয়ন দায়িত্বহীন, এমন কথা মেনে নিতে কষ্টই হলো আমার। কাল উনার দায়িত্ববোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে, এমন মানুষ আজকাল দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

আপু বকাঝকা করেই যাচ্ছে। আম্মু রুমে ঢুকে আমাকে দেখে বলে,
“কেমন মানুষ দেখ অথৈ? এখনো বিছানায় বসে আছে। (আমাকে বলল) যা, দাঁত ব্রাশ কর।”

ব্যাগ থেকে ব্রাশ বের করে পেস্ট লাগিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আম্মু আমার ড্রেস বের করতে লেগে গেল। আমি ব্রাশ হাতে নিয়ে ঝিমাচ্ছি। অথৈ আপু বলে,
“ব্যান্ডেজ কে লাগিয়েছে?”
“আমিই লাগিয়েছি।”

কথাটা বলে মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যাই। অয়ন রাতে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলতে বললেও আমি তা ভুলে মে°রে দিয়েছি। এরজন্যই সকাল সকাল এতো জেরা চলছে।

মুখ ধুয়ে বাইরে এসে দেখি বিছানায় বসে আম্মুর সাথে এক মধ্যবয়সী মহিলা কথা বলছে, অথৈ আপু রুমের একপাশের চেয়ারে চুপচাপ লাজুক মুখে বসে আছে। এই এক সমস্যা, যখনতখন যে কেউ রুমে চলে আসে। বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ না করে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিই।

আম্মু আমাকে দেখিয়ে উনাকে বলে,
“এই হলো আমার মেয়ে তন্বী। (আমাকে বলে) আর তন্বী, উনি ইত্তাজার আম্মু। তোমার আন্টি।”

আমি হাসিহাসি মুখে সালাম দিলাম, কুশল বিনিময় করলাম। আম্মু একটা ড্রেস আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“যাও, চেঞ্জ করে আসো।”

ওয়াশরুমে গিয়েই ড্রেস পাল্টাতে হলো। সুতির থ্রিপিচ পড়েছি, বিকালে আবারো সেই ভারী ড্রেস পড়তে হবে। আজ অথৈ আপুর হলুদ সন্ধ্যা বলে কথা। মনে মনে ঠিক করলাম হলুদ গাউনটা পড়বো আজ।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চুল আঁচড়ে আপুর সাথে রুম থেকে বের হই। ডাইনিং এ গিয়ে নাস্তা করি। এর মধ্যে অয়নের সাথে একবারের জন্যও দেখা হলো না। আপুকে অয়নের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেও কেমন যেন লাগছে, যদি কিছু মনে করে।

খাওয়া শেষে আপুর সাথে বাগানে যাই। এদিকটা বেশ নিরিবিলি আর শান্ত। ভালো লাগে পরিবেশটা।

“আচ্ছা আপু, তোমার ফ্রেন্ডরা কোথায়?”

আপু হেসে দিলো,
“ওদেরকে খুব পছন্দ হয়েছে বুঝি?”
“আ.. ওই সুমি আপু ছাড়া বাকিরা ভালোই।”
“সুমিও অনেক ভালো, একটু চঞ্চল কিন্তু একদম অন্যরকম।”
“ওহ, তা বলো না ওরা কোথায়?”

আপু হাসলো। একপাশ থেকে পড়ে যাওয়া ওড়না তুলে বলল,
“ওরা ওদের বাসায় চলে গেছে সকালে। বিকালের আগেই আসবে। ওরা আবার সাজগোজ বেশি পছন্দ করে কিনা, সারাদিন ওই পার্লারেই কাটাবে।”

আমি ভ্রূ উঁচিয়ে একটু ভেবে বললাম,
“বিয়েটা ঠিক কার কনফিউজড হয়ে গেলাম।”

অথৈ আপু মিটিমিটি হাসলো। আমার দিকে ফিরে বলল,
“ওদিকে চলো, ভাইয়ার ফুলগাছগুলো দেখে আসি।”

আবার ওই ফুলগাছের কাছে যেতে হবে শুনে গোলাপের কা°টার মতো কা°টা ধরলো আমার শরীরে। তাও আপুর সাথে সাথে গেলাম। গাছের কাছে গিয়েই আপু কালকের ফেলে যাওয়া গোলাপটা তুলে বলল,
“হায় আল্লাহ, এই ফুলটা কে ছিঁড়লো? ভাইয়া একবার জানলে আর রক্ষা নেই।”

আমি মুখ টিপে হাসছি। এমনসময় ইত্তাজা এসে হাজির হলো। আপুকে একটু ধমক দিয়েই বলল,
“ওই ছাগলের দল, সকাল সকাল বাগানে কোন পাতার সন্ধানে এসেছিস।”
“ভাইয়া, রাগাবি না একদম।”

ইত্তাজা ভণিতা করে বলল,
“আহ অথৈ আহ, বিয়ের আগে তোমার উডবি হাসবেন্ড তোমার মাকে কল করে কথা বলে রেখে দিলো। অথচ তুমি পাতা খুঁজছো? যা, একটু কথা বলে আয়।”

আপু একটু লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকালো। আমার মুখে হাসি দেখে একপ্রকার দৌড়েই চলে গেল। আপু যেতেই হো হো করে হেসে দিলো ইত্তাজা, আমিও হাসলাম।

ইত্তাজা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার হাসিটা কিন্তু সুন্দর, ঠিক আপনার কন্ঠের মতো।”

এমন কথায় আমার ঠিক কি রিয়েকশন দেয়া উচিত বুঝলাম না। হা করে তাকিয়ে আছি ইত্তাজার দিকে। এমন মুহূর্তেই অয়নের আগমন ঘটলো।

অয়ন সোজাসাপ্টা ইত্তাজাকে বললেন,
“আম্মু ডাকছে, যা নাস্তা করে আয়। আমি একটু বাইরে যাবো।”
“ওকে। (আমাকে বলেন) আপনি খাবেন না?”

অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
“আ… খেয়েছি।”

ইত্তাজা মাথানেড়ে চলে যেতেই অয়ন আমার দিকে তাকালেন। বললেন,
“বাইরে যাবি?”
“কোথায়?”
“আমাকে যেতে হবে তাই জিজ্ঞাসা করলাম যাবি নাকি? তাছাড়াও এখানে থেকে তুই খুব একটা কাজে লাগবি না। আন্টির ন্যা°ওটা আন্টির সাথে সাথে ঘুরে বেড়াস আর প্যানপ্যান করিস।”

কপাল কুঁচকে তাকাতেই উনি বলেন,
“গেলাম, বাই।”

আমিও উনার পিছুপিছু বাসার বাইরে চলে আসি। উনি বাইকে উঠে বলেন,
“কি হলো?”
“আমিও যাবো।”
“ঠিক কি কাজে লাগবি?”

কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম,
“মানে?”
“মানে আমার সাথে গিয়ে ঠিক কি কাজে লাগবি?”
“জানি না।”

অয়ন হাসলেন। চোখের ইশারায় পিছনের সিটটা দেখিয়ে বললেন,
“বস কিন্তু ন্যাকামী করে চিল্লাপাল্লা করবি না। করলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো।”
“আচ্ছা।”

বাইকে বসে অয়নের শার্টের কলার ধরলে উনি ধমক দিয়ে বলেন,
“ওই, কলার টানছিস কেন?”

আমি উনার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
“তো কি করবো? না ধরলে তো পড়ে যাবো, তখন আন্টি আপনাকেই বকবে।”
“বলি, তারজন্য কলারই কেন চেপে ধরতে হবে? আসামী নিয়ে যাচ্ছিস?”
“আপনি তো আসামীই, স্বামী হবেন নাকি?”
বলেই জিভ কা°ম°ড়ালাম। ভুল কথা যে বলে ফেলেছি তা বলার পর টের পেলাম।

অয়ন আমার দিকে একবার ফিরে তাকায়। তারপর বলেন,
“নেমে দাঁড়া।”

আমি মাথানিচু করে নেমে নাড়ালাম। অয়ন ধমকের সুরে বললেন,
“কান ধরে পাঁচবার উঠবস কর।”
“মোটেও না।”

বসতে ইশারা করায় আমি আবারো বসে পড়লাম৷ এবারে আর কলার ধরলাম না। আলতো করে কাঁধে হাত দিলাম। অয়ন বাইক স্টার্ট দিলেন।

“তুই না আগে অনেক কথা বলতি। কোথায় গেল তোর এতো কথা?”

আমি উনার দিকে তাকালাম, যদিও চেহারাটা দেখতে পারলাম না। নড়ে উঠতেই বললেন,
“বেশি ন°ড়িস না, একটু পর মেইন রাস্তা আসবে। তুই নড়াচড়া করলে আমার মনোযোগ নষ্ট হবে। তুই বরং একটা গান ধর।”
“কেন? আপনার ওই পোলাও বুঝি গান শোনায়নি?”
“শুনিয়েছে, কিন্তু সবাই তো আর তোর মতো নয় তনুশ্রী।”

কথাটার মানে বোঝা আমার পক্ষে কঠিনই হয়ে গেল। এভাবে কেউ কোনোদিন বলেনি। বাবার পর এই প্রথম কোনো পুরুষের এতো কাছে আছি, তারউপর এতো কঠিন কঠিন কথা।

“কিরে? গান শুরু কর।”

মাথাটা হেলান দিয়ে অয়নের পিঠের সাথে লাগিয়ে সুর তুললাম,
“চোখে চোখে কথা বলো, হৃদয়ে রাখো হৃদয়;
মনে মনে ভাসি চলো, হয়ে যাক না প্রণয়।
বুকের ভিতর তোমার জন্য মা°তাল হাওয়া বয়, অনুভবে না বলা কথা বুঝে নিতে হয়।

কি মায়ায় জড়ালে, কি জোছনায় ভাসালে;
লাগেনা কিছু ভালো, সব-ই যে এলোমেলো;
কেন জানি অনুরাগে হারানোর ভয়,
বুকের ভিতর তোমার জন্য মা°তাল হাওয়া বয়, অনুভবে না বলা কথা বুঝে নিতে হয়।”

গান গাইছি আর অয়নের শার্টের চেকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ ঝাঁকুনি পড়ায় ডানহাত পিছনে এনে আমাকে আগলে নেন অয়ন। না ধরলে পড়েই যেতাম। আমি উনার হাতের দিকে তাকালাম, এই কি সেই মানুষটা যাকে অথৈ আপু ইরেস্পন্সিবল বলেছে?

বাইক থামলো একটা ছোট মার্কেটের সামনে। অয়ন নেমে দাঁড়ালেও আমি নামলাম না। ফোন বের করে সময় দেখে বললেন,
“বসে থাকবি এখানে?”
“নোপ।”

উনি কপাল কুঁচকে বললেন,
“এসব কেমন শব্দ? আজব লাগে শুনতে। আয়, দেরি করতে পারবো না।”

আমি নেমে উনার পাশাপাশি হাঁটছি। হঠাৎ উনি আমার হাত ধরলেন। না, কালকের মতো করে না। উনার ডানহাতের পাঁচটা আঙ্গুল আমার বামহাতের পাঁচ আঙ্গুলের ভাঁজে রেখেছেন। ভাবখানা এমন যে ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবো।

কসমেটিকসের দোকানে নিয়ে গেলেন। অথৈ আপুর কোনো কসমেটিকস কেনা বাকি নাকি তা ঠিক বুঝে উঠলাম না। জাহানারা আন্টিও আহামরি তেমন সাজেন না যে ছেলেকে কসমেটিকস কিনতে পাঠাবেন।

অয়ন একটু নিচুস্বরে বললেন,
“কয়েক সেট চুড়ি পছন্দ কর তো, দেখি তোর পছন্দ কেমন?”

আমি চোখ ছোটছোট করে বললাম,
“কার জন্য সেটা আগে বলেন।”
“স্পেশাল মানুষের জন্য।”
বলেই ডান চোখটা টি°পলেন অয়ন।

আমার মুখের দুষ্টু হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। কেন যেন মনে হচ্ছে কথাটা বলে উনি খুব খারাপ করেছে। কেন যেন হিংসা হতে লাগলো। এই কেন কেন আমার মনে চলতেই থাকলো। উত্তর আর পেলাম না, বরং কষ্টটাই বাড়তে থাকলো। মনের মাঝে কোথাও একটা শূণ্যতা, একটা শুষ্ক মরুভূমি আবিষ্কার করলাম।

অয়ন তাড়া দিয়ে বললেন,
“কিরে, চুজ করে দে না।”

কিছু না বলে একটু রাগ দেখিয়েই তিনসেট চুড়ি দিলাম। উনি বললেন,
“নীলটা বাদ দে, সবুজ বা হলুদ রঙের একসেট দেখ।”

আমি কপাল কুঁচকে হলুদ আর সবুজের কম্বিনেশনের এক এক করে চারসেট উনার সামনে দিয়ে বললাম,
“এটা না চললে আমি গেলাম।”
“আরে, চলবে মানে দৌড়াবে।”

চুড়িগুলো কিনে আবারো বাইকের কাছে চলে এসেছি। আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বললাম,
“রিকশা ঠিক করে দিন, আমি আপনার সাথে যাবো না।”

অয়নের খুব একটা হেলদুল হলো না আমার কথায়। স্বাভাবিকভাবে বাইকে উঠে বসে বললেন,
“আমাকে তোর বডিগার্ড ভাবলে তুই ভুল ভাবছিস। চুপচাপ উঠে বস। অতিরিক্ত ন্যাকামি আমার পছন্দ না।”

আমার আগ্রহ খুব একটা না দেখে আমাকে টেনে নিয়ে বাইকে বসালেন উনি। বাইক স্টার্ট দিয়ে বলেন,
“রেগে আছিস কোনো কারণে?”
“না।”

আমার গাল ফুলানো কথায় ফিক করে হেসে দিলেন। আমি চোখ কুঁচকে লুকিং গ্লাসে উনার হাসি দেখছি। আমার অজান্তেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এমনটা আগে কখনো হয়নি, কখনো না।

বাসা পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
“তোকে ঠিক সুবিধার লাগছে না। মে°রে বস্তায় পু°রে ফেলে দিবো।”
“কি?”

চেঁচিয়ে উঠতেই উনি বললেন,
“হুশ, চেঁচামেচি করিস না।”
“আপনি আমার সাথে যা খুশি করবেন আর আমি কি চুপ থাকবো? আমাকে ওইরকম ভাবলে ভুল ভাবছেন, আমি কিন্তু হেব্বি মা°রপি°ট জানি।”

দীঘির পাশে বাইক থামিয়ে উনি নেমে দাঁড়ালেন। আমি বাইকেই বসে আছি। অয়ন ভাই আমার দিকে একটু ঝুঁকে বলেন,
“আমাকে তুই খারাপ ভাবিস নাকি বেশি বিশ্বাস করিস? ঠিক বুঝতে পারছি না।”

আমি বোকাবনে গেলাম। উনি যে আবারো রসিকতা করেছে তা এতোক্ষণে মাথায় ঢুকলো। আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলেন,
“চুল গুছাতে পারিস না, একা একা চলাফেরা করতে পারিস না, ওড়না আটকাতে পারিস না, লিপস্টিক ঠিকমতো দিতে পারিস না। ঠিক কোন কাজটা করতে পারিস? এসব তো মেয়েরা সহজেই করে, তুই এমন কেন?”

আমি বাইকে থেকে নেমে একটু সরে গেলাম। চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে বললাম,
“মেয়েরা এসব সহজেই পারে তা আপনি জানলেন কিভাবে?”

দাঁত বের করে হেসে দিলেন উনি। আমার কথায় ঠিক কেমন জোকস খুঁজে পেলেন তা উনিই জানেন।

অয়ন আমার কাছে এসে দীঘির দিকে মুখ করে আমাকে দাঁড় করিয়ে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বলেন,
“যখন কারো বউ হবি, তখন সব কাজ গুছিয়ে করতে হবে। এখন এতো এলোমেলো হলে চলবে।”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“বউ হলে সব পারফেক্ট কেন করতে হবে? হাসবেন্ড কি করবে তবে? আমি এমনই থাকবো, উনি গুছিয়ে দিবো। যত্ন করে সাজিয়ে দিবে সব।”
“যদি না দেয়?”
“তবে বিয়ে করবে কেন? ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা করতে?”

অয়ন এবারেও হাসলেন। হাসতে হাসতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি কথা শেষ করে পানি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে এই পানিতে ঠিক কেমন মায়া আছে তা জানি না, তবে পাশের মানুষটার হাসিতে মায়া আছে। সহস্র মায়া ওই ঠোঁটজোড়ায় লেপ্টে আছে।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় পার্লার থেকে বাসায় ফিরলাম। হলুদ গাউন পড়তে চাইলেও সেটা আনতেই বেমালুম ভুলে গেছি। তাই জাহানারা আন্টির সুতির সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়িটা পড়েছি, সাথে ফুলের গয়না। নকল ফুলে সুভাস নেই, সৌন্দর্য আছে। চুলগুলো বিনুনি পাকিয়ে একপাশে রেখেছি, সবার মতো আমিও টাটকা বেলীফুলের গাজরা লাগিয়েছি। বেলীফুলের ঘ্রাণে নিজেই বারবার মুগ্ধ হচ্ছি।

অথৈ আপুকে পুরাই পুতুলের মতো লাগছে। এতো কিউট একটা মেয়ে কিভাবে হতে পারে জানি না। আপুর সামনে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, কেক, ফল রাখা হয়েছে। বাটি বাটি হলুদও সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে।

আমার চোখ অয়নকে খুঁজছে। কোথায় আছেন উনি? উনাকে খুঁজতে খুঁজতে দোতলায় চলে আসি। উনার রুমের দরজা খোলা দেখে দুইবার নক করলাম, সাড়াশব্দ না পেয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই পেছন থেকে আচমকা এক ধা°ক্কায় ভিতরে এসে মেঝেতে পড়লাম।

রেগে তাকাতেই দেখি অয়ন মুচকি হাসছেন। আমার রাগটা বাষ্প হয়ে উড়ে গেল। সবুজ সুতির পাঞ্জাবি পড়েছেন উনি, পাঞ্জাবির বুকের দিকটায় হলুদ সুতার কাজ।

আমার দিকে ঝুঁকে বললেন,
“রুমে উঁকিঝুঁকি মা°রা বাজে অভ্যাস তনুশ্রী। ছেলেরা উঁকি মা°রলে মেয়েরা তাকে লু°ই°চ্চা, অসভ্য, অভদ্র উপাধী দেয়। এখন তোকে কি বলবো বল তো?”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
“সরি।”

উনি পর্দাটা টেনে রিডিং টেবিলের কাছে যেতে যেতে বললেন,
“শুকনো সরিতে লাভ নেই।”
“আমি না আপনার গার্লফ্রেন্ডের জন্য চুড়ি পছন্দ করে দিলাম। তাহলে কি সরিটা শুকনো হলো?”

অয়ন একটা বক্স হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে কপাল কুঁচকে বলেন,
“তোকে একবারও বলেছি ওগুলো আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য? বলেছি স্পেশাল মানুষের জন্য।”
“তো আপনার স্পেশাল মানুষ কে কে হতে পারে? আন্টি, উনি কাঁচের চুড়ি পড়েন না। আপু, সে তো আজ অন্য গয়না পড়েছে। আর আংকেল নিশ্চয় চুড়ি পড়তে যাবেন না। তবে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো?”

আমার কথায় হেসে দিলেন অয়ন। হাতের বক্সটা খাটে রেখে খুললেন। ভেতরে চার সেট চুড়ি, এগুলোই তো পছন্দ করেছিলাম আমি।

আমার ডানহাত টেনে নিয়ে সবুজ-হলুদে মেলানো চুড়িগুলো পড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি চুপচাপ দেখেই যাচ্ছি, বাধা দিচ্ছি না। আপাতত বাধা দেয়ার ইচ্ছাও নেই। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে “এগুলো তো স্পেশাল মানুষের জন্য ছিল, তবে কি আমিই সে।”

গালদুটো লাল হচ্ছে ক্ষণেক্ষণে। লজ্জায় মাটিতে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। এদিকে অয়ন ভাবলেশহীনভাবে ডানহাত ছেড়ে বামহাতে চুড়ি পড়ালেন। তারপর দুইহাত একসাথে ধরে বললেন,
“নাও পারফেক্ট তনুশ্রী।”

আমি মাথানিচু করে আছি। উনার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। উনি বক্সটা হাতে দিয়ে বলেন,
“শাড়িতে তোকে পুরো বাঙালি বউ লাগছে। বিশ্বাস কর একটুও ছোটমানুষ লাগছে না। অয়নের তনুশ্রী এমনই হবে জানতাম আমি।”

আমি উত্তর দিলাম না। অয়ন আবারো বললেন,
“বেকার ছেলে, বেশি দামী কিছু দিতে পারবো না। এগুলো গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করো তনুশ্রী।”

আমি বক্সটা নিলাম না। খাটে রেখে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিচে চলে আসলাম। সুমি, মিমি, বিনি, সাইদা আপুরা অথৈ আপুর সাথে হলুদ ছোড়াছুড়িতে মেতে উঠেছে। ইত্তাজা গান গাইছে, সেই তালেই আনন্দে মেতে উঠেছে ওরা।

একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লাম। হৃদপিণ্ডটা এখন বড্ড লা°ফালা°ফি করছে। মাথানিচু করে হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। দুহাত ভর্তি চুড়ি। কখনো চুড়ি পড়ার অভ্যাস নেই, এসবকে জ°ঞ্জাল মনে হতো। কিন্তু আজ আর এমন কিছু মনে হচ্ছে না। মন ময়ূর আজ পেখম তুলেছে, ভালোবাসার ছোঁয়ায় সুখের নৃত্যে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে আর সেই নৃত্যের তালে পাগল করছে আমাকে।

চলবে……….