হঠাৎ প্রণয় পর্ব-০৪

0
204

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুর্থ পর্ব

হলুদ, জিনিসটা আমার কিছু অপছন্দই বটে। কারণটা বিশেষ কিছু নয় তবে পছন্দ না, তাও এই বিরক্তিকর জিনিসটা আমার মুখে গলায় মেখে দিয়েছে সুমি আপু। হলুদের সাথে এলোভেরা থাকায় আমায় এলার্জিতে পেয়ে বসলো।

ডাইনিং এর বেসিনে হলুদ পরিষ্কার করছি আমি। আম্মু এতোক্ষণ এখানে আমাকে ব°কাঝকা করছিল, এখন আপুর ফোন পেয়ে কথা বলতে বাইরে গেছে।

মুখ ধুতে গিয়ে হাতও ভরিয়ে ফেলেছি। বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ পর পর ‘আজিব’ শব্দটা উচ্চারণ করছি। জাহানারা আন্টি আমার এই অবস্থা দেখে মুচকি হাসলেন। হাত টেনে আমাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজের গামছা দিয়েই আমার মুখ, হাত, গলা মুছে দিলেন। আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি, এ যেন মায়ের ছোঁয়া। আমার শরীর খারাপ থাকলে আম্মু যেভাবে আদরের পরশ দেয়, এ যেন সেই পরশ।

“কি অবস্থা করেছে মেয়েটার? যে যা পছন্দ করে না তাকে সেটাই কেন দিতে হবে? আচ্ছা করে বকে দিবো সবগুলোকে। ইশ, মুখটা লাল হয়ে গেছে।”

আপন মনে বকবক করছে আন্টি। বাটি ভরে পানি এনে রুমাল ভিজিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছে।

এমনসময় ইত্তাজার মা রুমে আসলেন। আমার অবস্থা দেখে আন্টিকে বললেন,
“এ অবস্থা হলো কিভাবে, ভাবি?”
“আর বলো না শারমিন, তন্নুটার হলুদ পছন্দ না আর সবাই মিলে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছে।”
“আহারে, বাচ্চা মেয়েটা।”

এমনভাবে বাচ্চা মেয়ে বলল যেন আমি মায়ের কোলে শুয়ে আছি। রোজ তিনবেলা ফিডিং বোতলে দুধ খাওয়ায় আর নেড়েচেড়ে ঘুম পাড়ায়। মহিলাদের এমন আজব কনসেপ্ট শুনলে প্রচন্ড হাসি পায়, শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে সামনে হাসি না। আমি তো নিতান্তই এক ভদ্র মানুষ।

আম্মু ডাইনিং এ এসে আমার গলার, মুখের দাগ দেখে আন্টিকে বলল,
“ওকে নিয়ে আর থাকতে পারবো না মনে হয়। কালকেই চলে যাওয়া উচিত।”
“ওমা, কি বলিস এসব? এতোদিন পর আসলি অথচ খাতিরদারি করতেই পারলাম না।”
“আরে, খাতিরদারি অনেক করতে পারবি। যা মনে হচ্ছে এলার্জিতে ধরেছে, ওর এলার্জির গতি জানিস না। অনেক কষ্ট পায়।”

শারমিন আন্টি হায়হুতাশ করে বলল,
“হলুদে সবার এলার্জি দূর হয় আর আপনার মেয়ের এলার্জি আরো ঝেঁ°কে বসলো।”
“আমিও তো এটাই ভাবছি, আগে ওর এমনটা হয়নি।”

আম্মুর কথায় মাথা নেড়ে আমিও সম্মতি জানালাম। বললাম,
“হলুদের জন্য না, হলুদের সাথে থাকা এলোভেরা এই এলার্জির কারণ।”

আম্মু আন্টিকে বলল,
“ওর অবস্থা এমন শুনলে ওর আব্বু রাগারাগি করবে। তাড়াতাড়িই বাসায় যেতে হবে। ডাক্তার দেখিয়ে শিউর হতে হবে সমস্যাটা কি?”

আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তবে কাল অথৈয়ের বিয়ের পর বাসায় এসে দেখা করে যাস।”
“না, আর এদিকে ফিরবো না। কমিউনিটি সেন্টার থেকেই চলে যাবো।”

অয়ন পানি খেতে ডাইনিং এ এসেছে। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
“আন্টি, এইটুকু এলার্জির জন্য কালই চলে যাবে। বউভাতটা অন্তত থেকে যাও।”
“না রে অয়ন, ওর মুখ আরো লাল হয়ে যাবে সারারাতে। জানি রাতে মোটেও ঘুমাবে না, কান্নাকাটি করবে। চিনিস না ওকে।”

আম্মুর কথায় অয়ন মাথা নাড়লেন। আমার দিকে একবার তাকিয়ে চেয়ারে বসে পানি খেলেন। আন্টি টিস্যু দিয়ে এখনো আমার মুখের পানি মুছেই চলেছেন।

অয়ন বেরোতে নিলে আন্টি বলেন,
“অয়ন বাবা?”
“জি, আম্মু।”
“তন্নুকে নিয়ে যা, সাথে সাথে থাকবি। খেয়াল রাখবি আর কেউ যেন ওকে হলুদ না লাগায়।”
“ঠিক আছে।”

বাধ্য ছেলের মতো আন্টির কথায় রাজি হলেন অয়ন। আমি উঠে উনার সাথে বাইরে চলে আসি। মুখের মেকাপ আর একটুও বাকি নেই। বাসার গেইট পেরিয়ে বাইরে চলে আসি দুজন। ঠান্ডা ঠান্ডা মৃদু বাতাসে ভালোই লাগছে এখানে।

“তুই এমনিতেই একটা হলদে পাখি, হলুদ মেখে একদম ফার্মের মুরগির বাচ্চা হয়ে গিয়েছিলি।”

বেনিতে পেছানো বেলীফুলের গাজরাটা খুলতে খুলতে বললাম,
“হলদে পাখি মানে?”
“এটা একধরনের পাখি, দেখতে হলুদ রঙের বলে আমাদের গ্রামে এটাকে হলদে পাখি বলে।”
“হলদে পাখির আসল নাম কি?”
“তনুশ্রী হয়তো।”

গাজরা খোলা বাদ দিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি হাত দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে বলেন,
“হাঁটি?”

আমি আর কিছু না বলে পা বাড়ালাম। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম,
“আচ্ছা, আমাকে হলদে পাখির মতো লাগলো কেন আপনার?”

অয়ন আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,
“তোর গায়ের রঙটা অনেকটা হলদেটে। আই মিন, জন্ডিস রোগী না বাট কিছু হলুদ। তোকে যখন ছোট দেখেছি তখনও এটা নোটিশ করেছি। আর দশটা মেয়ের মতো তুই কালো, সাদা কিংবা শ্যামলা নয়, তুই হলদে পাখি।”

আমি হেসে বললাম,
“একটা মজার কথা জানেন? আমার আব্বুও আমাকে হলদে পাখি বলে। আব্বু তো আমাকে প্রায়ই ছড়া শোনায়,
হলদে পাখির ছানা
ধরতে যাওয়া মানা,
ধরলে যাবে উড়ে
অনেক অনেক দূরে,
ময়নামতি গা
নূপুর দেয়া পা।”
বলেই শব্দ করে হাসলাম।

উনিও হেসে বলেন,
“এখনো তোকে ছড়া শোনায়?”
“হ্যাঁ, ছোটবেলায় বেশি শুনাতো তবে এখনো শোনায়।”
“বাহ, নাইস তো।”

আমি কিছুটা লাফিয়ে উঠে উনার পাঞ্জাবির হাতা খামচে ধরে বললাম,
“আপনার স্পেশাল মানুষের চুড়িগুলো আমাকে কেন দিলেন অয়ন ভাই?”

উনি থমকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকালেন। রাস্তা অন্ধকার হলেও একদম যে আলো নেই ব্যাপারটা তা নয়। আমরা ঠিকই দুজন দুজনের মুখখানা দেখে নিলাম। আমার কথায় উনি বিরক্ত হলেন নাকি রেগে গেলেন ঠিক বোঝা গেল না।

অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমাকে শুধু অয়ন বল, তনুশ্রী।”
“বড়দেরকে আমি নাম ধরে বলি না।”

অয়ন আবারো হাঁটা শুরু করলেন। হয়তো আমার জবাবটা উনার ঠিক পছন্দ হলো না। আমি দৌড়ে উনার পাশাপাশি হলাম। আবারো একই প্রশ্নই করলাম,
“বলুন না, চুড়িগুলো আমাকে কেন দিলেন? ওগুলো তো আপনার স্পেশাল মানুষের ছিল।”
“প্রশ্নটা নিজেকে কর, তনুশ্রী। উত্তর তুই জানিস।”

কপাল কুঁচকে চোখ ছোটছোট করে ফেললাম। এ কেমন হেয়ালিপনা? যদিও আমি উত্তরটা জানি, কিন্তু আবারো জানতে চাচ্ছি। শুনতে চাচ্ছি উনার মুখ থেকে। কারণ আমি তো ভুলও হতে পারি।

“চল, বাসায়ই ফিরে যাই।”
“আচ্ছা।”

বাসার গেইটের সামনে গিয়ে উনি হঠাৎ আমার গালে হাত ছোঁয়ালেন। উনার দিকে তাকাতেই বলেন,
“তোর এই অসুস্থ মুখটা দেখেই বিদায় দিতে হবে, তাও এতো দ্রুত।”

আমি হেসে বাসায় ঢুকে গেলাম। উনি ভেতরে আসলেন। খোলা বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখছি, এমনসময় ইত্তাজার আগমন ঘটে। আমাকে দেখে বলল,
“তন্বীর মুখে কি হয়েছে?”

আমি কিছু বলার আগেই অয়ন বললেন,
“এলার্জি সমস্যা।”

ইত্তাজা নিজের হাত দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
“হলুদ লাগাতে পারি?”

ইত্তাজার হাতে হলুদের বাটি দেখে আমি একটু সরে গেলাম। এই ভ°য়ংকর জিনিসটা আমি আর দেখতেও চাই না। কে এতো পাকনামি করে এতে এলোভেরা মিশিয়েছে।

অয়ন ইত্তাজার কাঁধে হাত দিয়ে বলেন,
“হলুদের কারণেই বেচারীর এ অবস্থা হয়েছে, ইত্তাজা।”
“ওমা, সে কি কথা? হলুদেও কারো এমন হয় নাকি?”

আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম,
“হতেই পারে, এখানে অবাক হওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না।”

চুপচাপ প্রস্থান করলাম, সবার এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে মোটেও ভালো লাগছে না। পুরো মুখ জ্ব°ল°ছে, যেন কেউ আগুন লা°গি°য়ে দিয়েছে। না খেয়ে আবার ওষুধও খেতে পারবো না।

অথৈ আপুর রুমে এসে পর্দা টেনে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। অয়নের কথার অর্থ মিলানোর চেষ্টা করছি। আমি যা বুঝছি তা সত্য নাও হতে পারে, আমি কেন অয়নের স্পেশাল কেউ হবো? এই “কেন” আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

গাজরা খুলে ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখলাম। গলা ও কানের গয়নাগুলোও খুললাম। হাতের চুড়িগুলোর দিকে চোখ যেতেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়লো। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছি অয়নের স্পর্শটা। ঠিক কেন এতো ভালো লাগছে বুঝতে পারছি না। ইশ, আবারো সেই কেন? বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল এভাবেই।

দরজায় নক পড়তেই চমকে তাকালাম, আম্মু এসেছে। আমার হাতে একটা ওষুধের টিউব দিয়ে বলল,
“অয়নকে দিয়ে আনিয়ে নিয়েছি। লাগিয়ে নাও, ব্য°থায় কান্নাকাটি করো না এখানে। আমার একটু কাজ আছে, না হলে আমিই লাগিয়ে দিতাম।”
“ব্যাপার না আম্মু। আমি লাগিয়ে নিবো।”

আম্মু চলে গেল। অথৈ আপুর বিয়ে কাল। সে উপলক্ষ্যেই পিঠা বানাচ্ছে সবাই। আম্মুর না গেলেও খারাপ দেখায়। বেনী খুলে চুল আঁচড়ে উঁচু করে ঝুঁটি করছি এমনসময় আবারো দরজায় নক পড়ে।

উঁচু গলায় বললাম,
“আসো, আম্মু।”
“আমি তোর আম্মু বুঝি?”

অয়নের গলা শুনে বললাম,
“আবার বাইরে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, তোর ওষুধ আনিস নি সেটা আন্টি বলল ওষুধের নাম জেনে কিনে আনলাম।”
“শুধু শুধুই কষ্ট করলেন।”

উনি টিউবটা হাতে নিয়ে ওষুধ বের করে গালে লাগাতে লাগাতে বললেন,
“আমার ইচ্ছা আমি গিয়েছি, তোকে সেসব কেন বলতে যাবো?”
“আবার সেই কেন?”
“মানে?”
“কিছু না।”

আমি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলি। উনাকে দেখার চেয়ে অনুভব করতেই বেশি ভালো লাগে। অয়ন বলেন,
“চুলে কালার করিস?”

আমি উনার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,
“কই, না তো।”
“তবে এমন লাল কেন?”

আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,
“জন্ম থেকেই এমন। শুধু আমার না, আমার আম্মু-খালামনি সবারই এমন।”
“র°ক্তবাহিত রঙ এটা।”
“মানে? র°ক্তবাহিত রঙ আবার কি জিনিস?”

অয়ন হাসলেন। আস্তে আস্তে গালে মালিশ করতে করতে বলেন,
“আন্টিরও এমন তাই বললাম। জেনিটিক্যালি এসেছে আরকি।”

আমি হেসে ঘুরে বসে চুলের ঝুঁটিটা সামনের দিকে এনে বললাম,
“ঘাড়ে বেশি জ্বলছে।”

হঠাৎ অয়নের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিরে দেখলাম উনি রুমে নেই। ওমা, এমন বিড়ালের মতো নিশব্দে কেউ চলে যায় নাকি? আজব, আজব আচরণ উনার।

আমি নিজে নিজেই মলমটা লাগিয়ে নিলাম। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করি, ঘুমাতে পারছি না। চোখ বন্ধ করলেই অয়নের কথাই মনে পড়ছে। কিভাবে আমার হাত ধরে চুড়ি পড়িয়ে দিচ্ছিল। মলম লাগানোর সময় উনার মুখটা একদম আমার মুখের সামনে চলে এসেছিল। বালিশে মুখ গুছে মুচকি হাসছি, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরও পাইনি।

সকালে আম্মু আমাকে টেনে তুলে। আমি ঘুমঘুম চোখে আম্মুর দিকে তাকাই। ফোন হাতে নিয়ে দেখি মাত্র সকাল ৬ টা বাজে। আম্মুকে ধরে মাথা হেলিয়ে আবার চোখ বন্ধ করতেই আম্মু তেতিয়ে উঠে বলে,
“আর কত ঘুমাবা? উঠো, অথৈয়ের সাথে পার্লারে যাবা না?”

আম্মু আমাকে টেনে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে বলল,
“একটু পরে সবাই বেরিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো।”

আমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে জবাব দিলাম,
“আম্মু, শাড়ি খুলে দাও।”
“মেয়েটা জ্বালিয়ে মারবে তো। এতো ন্যাকা মেয়ে নিয়ে আর পারি না।”

৩০ মিনিট পর গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে সুতির থ্রিপিচ পড়ে রুমে আসলাম। অথৈ আপু হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল,
“চুল শুকাবি?”
“ঘুমাবো।”
বলে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

আম্মু খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে এসে আমাকে টেনে তুলে ধমক দিয়ে বলল,
“রাতে তো না খেয়েই ঘুমাইছিলা, এতো ডাকলাম উঠলেই না। খাও এখন চুপচাপ।”

আম্মু খাইয়ে দিচ্ছে আর আমি চুল মুছছি। গালে খাবার ঠু°সে নিয়ে গাল ফুলালেই আম্মুর ধমক খেতে হচ্ছে। আপু হেয়ার ড্রায়ার আমার হাতে দিয়ে শাড়ি পড়তে গেল। কমলা রঙের সুতির শাড়ি পড়ে পার্লারে যাবে আপু আর সেখানে বিয়ের সম্পূর্ণ সাজ দিবে।

আম্মু তাড়াতাড়ি আমাকে খাইয়ে হাত ধুতে বেরিয়ে গেল। আমি চুল শুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। খাওয়ার পর ঘুমটা অনেকটাই কেটে গেল। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি মুখের লাল দাগগুলো অনেকটাই কম, ফোলা ভাব কিছুটা থাকলেও কালকের মতো এতো নেই। ঘাড়ের দিকে জ্ব°ল°ছে এখনো, হাত দিয়ে বুঝলাম এখনো বেশ ফুলে আছে।

আম্মু রুমে এসে আবারো এক রা°ম ধমক দিলো,
“ব্যাগ গুছিয়ে নাও, একেবারে বেরিয়ে যাবো আমরা।”
“আচ্ছা, গুছাচ্ছি। আগে আমার সাদা গাউনটা বের করে দাও।”

ব্যাগ গুছিয়ে আর সাদা গাউনটা আলাদা একটা শপিংব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। রুম থেকে বেরিয়ে দেখি সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। আমি আপন মনে হেঁটে বাগানে চলে গেলাম। বাগানে গিয়ে সাদা গোলাপ গাছটার দিকে তাকিয়ে আছি। একটা ফুলও নেই শুধুই পাতা। হয়তো এই কয়েকদিন এটার যত্ন করেনি কেউ, কুঁড়িও শুকিয়ে যাচ্ছে।

হাতের ফোনটা বেজে উঠতেই দেখি মানহা কল করেছে। রিসিভ করলাম,
“কিরে দোস্ত, বিয়ে খেতে গিয়ে তো আমাকে ভুলেই গেছিস। কোনো ম্যাসেজ না, কল না, ছবিও দিলি না।”

মানহা, আমার বেস্টফ্রেন্ড, যাকে বলে জানে জিগার দোস্ত। আমার ডিএনএ-র নিউক্লিক এ°সি°ডের গঠনও বোধহয় তার মুখস্ত।

“তেমন কিছু না। তবে একটা ঘটনা হয়ে গেছে দোস্ত।”
“কিরে? তাত্তারি (তাড়াতাড়ি) বল।”

আশেপাশে তাকিয়ে নিচুস্বরে বললাম,
“এখানে একটা ছেলে আমাকে চুড়ি গিফট করেছে।”

মানহাও ফিসফিসিয়ে বলল,
“তাই নাকি? আর?”
“আইলাইনারও দিয়ে দিলো আবার কালকে আমাকে এলার্জির ওষুধও লাগিয়ে দিয়েছে।”

মানহা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলল,
“ওহো, আহা, তনুমনু আমার প্রেমে পড়েছে।
একটা ছেলে মনের আঙিনাতে ধীর পায়েতে…”

আবার থেমে স্বাভাবিকভাবে বলল,
“তোর দিকটা কি তা তো বল দোস্ত?”
“বলছি।”

“তনুশ্রী।”

অয়নের ডাকে ফিরে তাকিয়ে ফোন রেখে দিয়ে বললাম,
“জি।”
“শরীরের কি অবস্থা?”

আমি নিজের মুখে হাত বুলিয়ে বললাম,
“এখন তো ঠিক আছি। (একটু থেমে) কাল রাতে আচমকা কোথায় চলে গিয়েছিলেন?”

অয়ন কপাল কুঁচকে বললেন,
“ওই ভাবে কখনো কারো সামনে নিজের ঘাড় উন্মুক্ত করিস না, বিষয়টা বেমানান। তুই এ°ডা°ল্ট তনুশ্রী, এসব তোর বোঝা উচিত।”

আমি মাথানিচু করে ফেললাম। ঠিকই তো এটা করা তো একদমই উচিত হয়নি। ওড়নার কোণা হাতের আঙ্গুলে পেঁচাচ্ছি আর খুলছি। অয়ন এগিয়ে এসে বলেন,
“তোর সাদা গোলাপ পছন্দ?”
“হ্যাঁ, অনেক।”
লাফিয়ে উঠে বললাম।

অয়ন হাসলেন, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দুএকটা দাঁতও আমার দৃষ্টিগোচর হলো। হঠাৎ অথৈ আপুর ডাকে কিছু বলতে নিয়েও না বলে নিরবে চলে গেলেন। আমি একবার পুরো বাগানে চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে এলাম।

১০-১৫ মিনিট পড়েই মেয়েরা সবাই পার্লারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে অথৈ আপু নিজের বাড়ি থেকে বিদায় নিবে। আবেগময় সময় কাটলো কিছুক্ষণ। একপাশে দাঁড়িয়ে শুধু এইদৃশ্যটা দেখেই যাচ্ছি। অয়নকে জড়িয়ে ধরে জোরে শব্দ করে কান্না করে দেয় আপু। অনেকক্ষণ পর কিছুটা টেনেই আপুকে বাড়ির বাইরে আনা হলো। সকাল থেকে চুপচাপ থাকলেও এতোটা কান্না আপু করবে আগে বুঝিনি।

অয়নের সাথে মাইক্রোবাসে উঠে আপু। বাসা থেকে পার্লার আর সেখান থেকে কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত যাওয়ার জন্য এটা ভাড়া করা হয়েছে। মেয়েদের সাথে গার্ডিয়ান হিসেবে অয়নকে পাঠানো হচ্ছে। সে হিসেবে গাড়িতে ড্রাইভার আর অয়ন ছাড়া সবাই মেয়ে। আমি, সুমি আপু, রিনি আপু আর মিমি আপু পেছনের সিটে বসেছি। ড্রাইভারের পাশের সিটে অথৈ আপুর ছোট ব্যাগ আর শাড়ি রাখা হয়েছে। মাঝের সিটে অয়ন আর সাইদা আপুর মাঝে অথৈ বসেছে।

অথৈ আপুর চোখ টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে অয়ন বললেন,
“কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেললে শশুড়বাড়ির লোকেরা ভাববে আমরা তোকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছি।”

সুমি আপু ওপাশ থেকে বলে উঠে,
“আরে ভাইয়া, জোর করে না তো। ওর ভাব দেখে ভাববে ওকে মে°রে°ধ°রে বিয়ের জন্য রাজি করানো হয়েছে।”

সাইদা আপু অথৈ আপুর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,
“চোখমুখ ফুলে থাকলে বেচারা দুলাভাই বিয়ে না করেই পালাবে।”
“পালাবে মানে? বেঁ°ধে বিয়ে করাবো। বিয়ে না করে যাবে কোথায় হুহ?”

অয়নের কথায় হো হো করে হেসে উঠে সবাই। আমিও হেসে দিলাম। অয়ন পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে সুমি আপুকে বলেন,
“মিস সুমি, আপনার পাশেই কেন যেন ঘুরে ফিরে এলার্জি ম্যাডাম বসে বুঝি না।”

সুমি আপু আমার গাল টেনে দিয়ে বলে,
“এসব আপনি বুঝবেন না ভাইয়া। এগুলো মনের টান।”

অয়ন কিছুটা নাক সিটকিয়ে বললেন,
“ছি, কিসব বাজে কথা?”
“আজব, বাজে কথা হওয়ার কি আছে? তন্নু অর তন্বীর সাথে আমার ভালোই মনের মিল হয়ে গেছে। তন্বীর বিয়েতে যাবো বলে ওর নাম্বারটাও কালেক্টে রেখেছি।”

অয়ন হালকা কেশে বলেন,
“এই এলার্জি ম্যাডামকে কে বিয়ে করবে? জীবনেও বিয়ে হবে না দেখে নিও।”

আমি রাগী গলায় বলি,
“যদি হয়?”

অয়ন ভাই একটু নড়েচড়ে বসে বলেন,
“যদি হয় তবে হুম, (একটু ভেবে) ছেলেটা একদম নিরীহ প্রানী হবে, এক্কেবারে গরু। ওই বেচারার কথা ভেবে আমার হেব্বি টেনশন হচ্ছে মিস. এলার্জি ম্যাডাম।”

সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। সুমি আপু তো কয়েকবার “গরু, গরু, গরু” বলে আঙ্গুল মাথার উপর রেখে শিং ইশারা করছে। অথৈ আপুও মুখ টিপে হাসছে। অয়নের চেহারাটা ঠিক দেখতে পেলাম না, দেখলে হয়তো দুষ্টুমি ভরা হাসিটাই দেখতাম।

আমার ইচ্ছে করছে উনার চুলগুলো টে°নে°টু°নে ছিঁ°ড়ে ফেলি। একা থাকলে ঠিক এটাই করতাম। শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিয়ে এখন করলাম না। আমি নিতান্তই একটা ভদ্রমানুষ বলে আজকের মতো অয়ন বেঁচে গেলেন।

চলছে…………