হঠাৎ প্রণয় পর্ব-০৬

0
188

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষষ্ঠ পর্ব

কলেজ শেষে বের হয়ে রাস্তার একপাশ ঘেষে ধীরে ধীরে হাঁটছি৷ কয়েকদিন পর এইচএসসি এক্সাম, সেটা ভুলে গিয়ে অয়নের চিন্তায় মজে গেছি। একমাস হয়ে গেল অথৈ আপুর বিয়ের আর অয়নকে দেখারও। শূণ্যতা নাকি ভালোবাসার জানান দেয়, আমার ব্যাপারটাও কিছুটা এমনই হলো। অয়নের শূণ্যতা প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে তার জন্য আমার ভালোবাসার প্রাসাদটা কতটা বড়৷

ভুল তো আমিও করেছি, অয়নের ফোন নাম্বারটা না এনে। ফেসবুক ঘেটেও তার আইডির হদিস পাইনি। আরো বড় ভুল করেছি তাকে ভালোবেসে।

হাবিজাবি চিন্তার মাঝেই মানহা এসে হাজির হলো। পিঠে একটা চা°প°ড় দিয়ে বলল,
“কিরে, কলেজ খোলার পর থেকেই দেখছি তুই কেমন যেন অগোছালো। কি হয়েছে রে?”

বেস্টফ্রেন্ড হওয়া সত্ত্বেও অয়নের কথা পুরোটা মানহাকে বলা হয়ে উঠেনি। সংকোচ কাজ করছে ভেবে নিজের উপরই রাগ উঠছে৷

“আমার ভালো লাগছে না কিছু।”
“কেন?”

হাঁটা থামিয়ে দিয়ে মানহার দিকে তাকালাম৷ সে এখনো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

“কিরে বল কি হয়েছে?”
“অয়ন ভাই।”

মানহা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“অয়ন ভাইটা কে?”

আমি আবারো হাঁটতে শুরু করলাম। মানহা আমার পাশেপাশে হাঁটছে। অয়নের ব্যাপারে জানার আগ্রহ তার চোখেমুখে। বেশি আগ্রহ হওয়ার কারণ হয়তো একটা ছেলেকে নিয়ে আমার ব্যকুলতা।

“অথৈ আপুর বিয়েতে গিয়েছিলাম আমি। মনে আছে তোকে বলেছিলাম না একটা ছেলে আমাকে সাজিয়ে দিয়েছিল, সেই অয়ন।”

মানহা মাথা নেড়ে বলল,
“ওহ, আচ্ছা।”
“অথৈ আপুর বড় ভাই অয়ন।”
“আচ্ছা, বুঝলাম। সেই অয়নের জন্য তোমার দিলে কুচ তো হনে লাগা।”

মানহার সুর তুলে ঠে°স দেয়া কথাটা ভালোই বুঝলাম। ইচ্ছে করছিল থা°প্প°ড় দিয়ে ওর তিনইঞ্চি দাঁতগুলা ফা°লা°ই দেই। নিতান্তই ভদ্র মেয়ে বলে সিনক্রিয়েট করলাম না।

ওর সাথে আর কোনো কথা না বলে বাসায় চলে আসলাম। যদিও আমাকে বেশ কয়েকবার ডেকেছে সে।

রুমে ব্যাগ রেখে আম্মুর কাছে গিয়ে বুঝলাম আম্মু খুব ব্যস্ত। ব্যস্ততার কারণ জানতে চাওয়ায় বলল,
“বাসায় মেহমান আসবে, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।”
“কে আসবে আম্মু?”
“তোমার বড় মামা আর মামী। যাও নিজের রুম গুছিয়ে রাখো।”
“মেহমান আসবে বাসায় বুঝলাম, আমার রুম গুছাতে হবে কেন? উনারা তো আর আমার রুমে আসছেন না।”

আম্মু চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই বললাম,
“যাচ্ছি যাচ্ছি। চে°তো কেন?”

পুরো রুম গুছিয়ে, গোসল সেরে বারান্দায় চুল শুকাতে গেলাম। আকাশে ছুটে চলা প্লেনের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেছি। আমার কল্পনায় অয়ন, আমার ভাবনায় অয়ন, আমার স্বপ্নে অয়ন, শুধু বাস্তবে তার শূণ্যতা।

ফোন বেজে উঠায় চমকে রুমে গিয়ে রিসিভ করলাম, অচেনা একটা নাম্বার।

“হ্যালো, কে বলছেন?”
“তনুশ্রী।”
“অয়ন।”

দুদিকেই নিরবতা, হঠাৎ কলটা কেটে গেল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভাবছি এটা আমার স্বপ্ন নাকি সত্যি। কল লিস্ট চেক করে বুঝলাম সত্যি।

কলব্যাক করার সময় সুকন্ঠী নারী জানিয়ে দিলো আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই। এই এক সমস্যা জীবনেও আমার ফোনে ব্যালেন্স থাকে না।

আবার কল এলো, এবারে অন্য নাম্বার৷ রিসিভ করলাম।

“কেমন আছিস?”

মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছি না।

“কথা বলবি না? রাগ হয়েছে আমার উপর?”
“হ্যাঁ, অনেক রাগ হয়েছে।”
“কেন?”
“বলবো একদিন, ওয়েট করেন।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অয়ন বলল,
“আজকে বের হবি?”
“কোচিং এ যাবো।”
“কয়টায় যাবি?”
“৪ টায়।”
“ঠিক আছে, রাখছি। (একটু থেমে) আ.. কোচিং টা কোথায়?”

আমি হেসে বললাম,
“খিলগাঁও রেলগেইটের কাছে।”
“আমি ঠিক চারটায় ওখানে থাকবো। আজ তোর কোচিং ফাঁ°কি।”

আমি ফোন রেখে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আজ অয়নের সাথে দেখা হবে। কতদিন পর আজ তার সামনে যাবো।

বিকেলে বের হলাম। ব্যাগে লিপস্টিক আর কাজল নিয়ে নিছি, রাস্তায় বের হয়ে দ্রুত এসব দিয়েই চলে গেলাম খিলগাঁও প্লাস পয়েন্টের সামনে।

আশেপাশে অয়নকে দেখছি না। ফোন বেজে উঠলো, রিসিভ করলাম।

“কোথায় তুই?”
“প্লাস পয়েন্টের সামনে।”
“রেলগেইট বলে এখন প্লাস পয়েন্টে কি করিস? (একটু থেমে) দেখেছি তোকে, আসতেছি আমি।”

রাস্তার অপরপাশে অয়নকে দেখেছি। ফোন কানে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ডার্ক অলিভ রঙের শার্ট আর কালো জিন্স পড়নে, চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। সে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাস্তা পার হয়ে এসে সোজা আমার সামনে চলে এসেছে।

“কোচিং কোথায় তোর?”

হাত দিয়ে পাশের কমার্স ব্যাংক দেখিয়ে বললাম,
“এর তিনতলায়।”
“ওহ, চল।”

অয়ন আমার হাত ধরে রাস্তা পার করে নিয়ে গেল। রাস্তা পার হয়ে গিয়ে বাইকে উঠলাম। শাহজাহানপুর পার হয়ে রাজারবাগের কাছে ট্রাফিক সিগনালে পড়েছি।

এতোক্ষণ ধরে চুপচাপ অয়নকে দেখছি। বাইকের লুকিং গ্লাসে তার মুখটা স্পষ্ট। মনে একটা গানই চলছে, শুধু মুখে আসছে না।

“শুধু তোমার প্রেমে আমি পড়েছি,
বেঁচে থেকেও যেন মরেছি
তোমার নামে বাজি ধরেছি, ধরেছি।”

“তনুশ্রী, ওই তনু, ঘুমিয়ে গেলি নাকি?”

অয়নের ডাকে হুশ হলো। চমকে উঠে বললাম,
“কি?”
“কোথায় তাকিয়ে কি ভাবছিস?”
“কিছু না।”
“কোথায় যাবি?”
“নিয়ে যাও যেখানে খুশি।”

অয়ন হেসে বলল,
“সামনে সিপিএইচ আছে, ওখানে যাবি?”
“ওখানে আমার কি কাজ?”
“বললি না যেখানে খুশি নিয়ে যেতে, তাই নিয়ে যেতে চাইছি আরকি।”
আমি হেসে দিলাম, সেও হাসলো।

জ্যাম ছাড়লে অয়ন আর কোনো কথা বলল না। সে বাইক চালাচ্ছে আর আমি তাকে দেখছি৷ অয়নকে আজ বেশিই সুন্দর লাগছে।

বেইলি রোডের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। তার সাথে আমিও চুপচাপ ভিতরে গিয়ে বসলাম।

“কি খাবি?”
“যেটা খাওয়াবে সেটাই।”
“সা°পে°র বি°ষ?”
“হ্যাঁ”

বলে থেমে একটু রেগে বললাম,
“না।”

অয়ন হেসে পেস্ট্রি আর কফি অর্ডার দিলো৷ ওয়েটার চলে গেলে বলল,
“রাস্তায় ওরকম করে আমাকে দেখছিলি কেন?”
“দেখেছি আর তোমাকে? হুহ, তোমাকে দেখার কিছু নেই।”
“এভাবে দেখলে আমার তো লজ্জা করে, বুঝিস না কেন?”

আমি মুখ ভার করে বসে রইলাম। তবে মনে মনে খুব নাচছি। সেও তো আমাকে দেখেছে, না হলে কিভাবে বুঝলো আমি তাকে দেখেছি কি না।

খাবার আসলো, আমি চুপচাপ খাচ্ছি। অয়ন বলল,
“জিজ্ঞাসা করলি না এখানে কেন এনেছি?”
“উহু, জানতে চাই না।”

আমি আবারো খাওয়া শুরু করলাম। অয়ন আমার বাম হাতটার উপর নিজের হাত রাখলো। চোখ বড় করে তাকাতেই বলল,
“এ পর্যন্ত বহুবার আমি তোর হাত ধরেছি, আমার কোলেও চ°ড়ে ফেলেছিস। তবে এখন নিশ্চয়ই বাধা দিবি না?”

দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিলো। লজ্জা নাকি ভয় জানি না, তবে অয়নের দিকে তাকাতে দ্বিধা হচ্ছে।

“বলেছিলাম না আমাদের দেখা হওয়াটা ঠিক হবে না। দেখা হলে বি°পদ হবে, সত্যিই আজ অনেককিছু হচ্ছে। ঝ°ড় হচ্ছে, সু°না°মি হচ্ছে।”

অয়নের কথায় বাইরে তাকিয়ে বললাম,
“তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। বাইরে গাছ ফাটা রোদ।”

আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“ঝ°ড় তো বাইরে না, এই আমার মনে হচ্ছে।”

কথার অর্থ পরিষ্কার। আমার আর অয়নের মনে একই অনুভূতি, তবে আমি এখনই কিছু বলবো না৷ দেখি সে আমাকে ইমপ্রেস করতে কি কি করতে পারে।

গলা ঝে°ড়ে হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম,
“মনে একটা বাঁধ তৈরি করো। ঝ°ড়ে সমস্যা নেই, বন্যা যেন না হয়।”
“ঝ°ড়ে যে সব ল°ণ্ড°ভ°ণ্ড হয়ে যাচ্ছে।”
“কই? সব তো ঠিকই আছে।”

অয়ন হেসে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল,
“খেয়ে নে।”

সে যে বিরক্ত হয়েছে তা ভালোই বুঝতে পারছি। মিটিমিটি হেসে বললাম,
“বাই দা ওয়ে, অথৈ আপু কেমন আছে?”
“ভালো আছে।”
“আন্টি?”
“ভালো।”
“আংকেল?”
“ভালো আছে।”
“আর আন্টি-আংকেলের ছেলে?”

অয়ন আমার দিকে তাকালো।
“তোর সামনে বসে আছে। একদম মুখোমুখি।”

আর কথা বাড়ালাম না৷ লাগাম থাকতেই চুপ করলাম, অয়ন আগেই লাগাম ছাড়া হয়েছে আর এখন আমিও হচ্ছি।

খাওয়া শেষে গেলাম রমনার দিকে। বিকেলের দিকে ক°পো°ত-ক°পো°তীর অভাব নেই এখানে। বাইক রেখে একটু দূরে দুজনে হাঁটছি।

আমি তার একহাত জড়িয়ে ধরতেই বলল,
“এভাবেই তো কাবু করেছিস আমাকে।”

অয়নের নিচুস্বরের কথাটা কানে আসলেও কিছু বললাম না। এমন একটা ভাব আমার মধ্যে যেন আমি বিশ্বসুন্দরী আর বিশ্বের সব রাজপুত্ররা আমার জন্য পাগল। নিজের ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা পেলে সবাই কি নিজেকে এটাই ভাবে।

“অয়ন ভাইয়া, আপনি এখানে?”

এক মেয়ের ডাকে অয়ন দাঁড়িয়ে আমার হাত ছেড়ে বলল,
“আরে হাই, কি অবস্থা?”
“এইতো ভালো। বিকেলে ঘুরতে এসেছেন নাকি?”

অয়ন একগাল হেসে আমাকে দেখিয়ে বলল,
“এই তোমার আপুকে নিয়ে একটু হাঁটতে আসলাম।”

মেয়েটার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছি। সুন্দরী, যথেষ্ট স্মার্ট তা বোঝাই যাচ্ছে। অয়নের হাসিতে এখন গা জ্ব°লে যাচ্ছে। প্রণয় হিং°সার ব°হ্নি°শিখা গ্রা°স করছে আমাকে।

কিছুক্ষণ মেয়েটির সাথে কথা বলে অয়ন আবারো হাঁটতে শুরু করে। আমি উলটো পথে হাঁটতে লাগলাম।

অয়ন দৌড়ে আমার পাশাপাশি এসে বলল,
“কি রে?”
“বাসায় যাবো।”
“সে তো আমিও যাবো, তোকে পৌঁছেও দিবো। এরকম বিহেভের কি আছে?”

চোখ সরু করে তাকিয়ে বললাম,
“মেয়েটা কে?”

অয়ন ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“হবে কেউ, তোর তাতে কি?”
“আমার কিছু না, জাস্ট ইন্টারেস্ট।”
“ওওও, মেয়েটা আমার ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।”
“র‍্যাগ দেও।”

অয়ন শব্দ করে হেসে বলল,
“আমার হাসিতে মেয়েরা পাগল হবে, ভয় পাবে না।”
“ভাব দেখাও বেশি।”
“না ম্যাডাম, আচ্ছা চল আইসক্রিম খাই।”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম,
“ওকে।”

দুহাতে দুইটা আইসক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অয়ন আইসক্রিমের টাকা দিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো।

“কিরে, আমারটাও খাচ্ছিস নাকি?”
“ছি, ছি, এসব ভ্যানিলা ফ্লেভার আমি খাই না।”
“এমনভাবে নাক ছি°টকালি যেন আমি জোর করে তোকে আইসক্রিম খাওয়াতে এনেছি।”

একটু রেগে বললাম,
“দেখো, আমার কোচিং ফাঁ°কি দিয়ে চলে এসেছি। সো, কেন এনেছো সেটা বলো?”
“সময় মতো জেনে যাবি।”
“তাহলে আজকে কেন ডাকলে?”
“এমনিই।”

কথাটা বলেই অয়ন অন্যদিকে তাকালো। তার চেহারাটা দেখতে ইচ্ছা করলেও দেখতে পেলাম না।

সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে আসলাম। গলির মুখে আমাকে নামিয়ে দিয়ে অয়ন চলে গেছে। অয়নকে বাসায় আসতে বললাম কিন্তু রাজি হলো না। নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল।

“কি আছে এতে?” জিজ্ঞাসা করায় হাসিটাই দিলো, উত্তর আর দিলো না।

বাসায় ঢুকেই মামা-মামীর সাথে দেখা হলো। আম্মু চোখের ইশারায় কথা বলতে বলল।

আমি মুচকি হেসে বললাম,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কেমন আছো মামুনি?”
মামা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন।

“এইতো ভালো আছি, আপনারা কেমন আছেন?”
“ভালো আছি।”

মামানী আমার আরেক লাইন যুক্ত করে বলল,
“তোমরা আমাদের বাসায় যাও না, তাই আমরাই চলে আসলাম আর কি।”

মুচকি হাসলাম, কোনো জবাব দিলাম না। কুশল বিনিময় শেষে নিজের রুমে চলে আসলাম।

রুমে থেকে অয়নের দেয়া প্যাকেট খুলে ভিতর থেকে শিফন কাপড়ের শাড়ি আবিষ্কার করলাম। হালকা গোলাপী ও লাল-সাদার মিশ্রণে শাড়িটা নজর কাড়তে বাধ্য। অয়ন এটা আমাকে দিলো? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

তড়িঘড়ি করে অয়নের নাম্বারে কল দিলাম। কল পিক করেই বলল,
“শাড়ি পছন্দ হয়েছে?”

আমি তো বাকরুদ্ধ, তার মানে শাড়িটা সত্যিই আমাকে দিয়েছে।

“শাড়ি কেমন লাগলো?”
অয়নের কথায় চমকে উঠে কল কেটে দিলাম৷

রুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখি আপু এসেছে। আমার হাতে শাড়ি দেখে চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে। চোরের মতো চেহারা করে বললাম,
“মানহা এটা আমাকে দিয়েছে?”

আপু শাড়িটা নিয়ে বলল,
“শিফনের শাড়ি মানহা তোকে কেন দিবে?”

যুক্তিযুক্ত কোনো উত্তর না পেয়ে বললাম,
“মানহা এটা টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনেছে। ওর খুব শখের, কিন্তু বাসায় ব°কা দিবে তাই এটা আমাকে দিয়ে বলছে যেন আমি ওকে গিফট দেয়ার নাটক করি।”

আপু হেসে বলল,
“ও এই ব্যাপার। ঠিক আছে।”

মানহা আর আমার বন্ধুত্ব নিয়ে আপুর সন্দেহ হবে না। এখন মানহাকে পুরোটা বলে দিলেই হবে।

সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসে ছিলাম, কিন্তু পড়া হলো না। রাতে খাবার খেলাম না, আসলে ইচ্ছেই করছে না। অয়ন কয়েকবার কল দিয়েছে কিন্তু রিসিভ করিনি।

বারান্দায় এসে বসে আছি। আজকের দিনটা এমন কেন? যেন একটা স্বপ্ন, ঘুম ভাঙলেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। এমন স্বপ্ন শেষ না হোক, এমন ঘুমেও সুখ থাকে।

“কিরে ঘুমাবি না?”

আপুর কথায় চমকে উঠলাম। নিজের ভাবনায় এতোই বিভোর ছিলাম যে আপুর ডাক শুনতেই একপ্রকার লাফিয়ে উঠলাম।

“আপু, কিছু বলছিলা?”
“কি ভাবছিস এতো?”
“না, তেমন কিছু না।”

আপু একটু চুপ থেকে বলল,
“ঘুমাতে আয়।”
“আসছি।”

আপু রুমে বিছানা ঠিক করতে করতে বলছে,
“পড়াশুনায় তো মনোযোগ নেই। প্রতি বছর বছর অটোপাশ দিবে না। তিন সাবজেক্ট পরীক্ষা তাও আবার ফেইল নাম্বারে, তাই বলে কি পড়া লাগবে না নাকি?”

আপুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছি৷ বড় হলে মেয়েদের মাঝে নাকি মাতৃসুলভ আচরণ প্রকাশ পায়, আমার আপু পুরাই আমার আম্মুর কপি হচ্ছে। হুদাই চি°ল্লা°চি°ল্লি করা আপুর স্বভাবে পরিণত হয়েছে।

আপু আবারো ধমক দিয়ে বলল,
“কথা কি কানে ঢুকতেছে?”
“না।”
বলেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলি।

আপু রাগি রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল,
“ঘুমাতে শুয়ে কোনো কথা না, ফোন নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি না।”
“ওকে।”

ঘুমাতে শুয়েছি ঠিকই, কিন্তু ঘুম পাখি কোথায়? সেও কি অয়নের কাছেই চলে গেছে? অনেক চেষ্টা করে ভোরের দিকে দুচোখ লেগে আসে।

সকালে আবারো আপুর চি°ল্লা°চি°ল্লিতে ঘুম ভাঙ্গে। কোনোমতে চোখ খুলতেই দেখি আমার বই খাতা ছুড়ে ফেলছে সে।

“কি হলো এতো সকালে?”

আমার ঘুম জড়ানো কন্ঠে কিউটনেস থাকলেও আপুর কথায় বিন্দুমাত্র কিউটনেস নেই।

“কি হয়েছে? পড়তে বস, উঠে বস।”
“কলেজে যাবো তো।”
“কলেজ সেই নয়টায়, আটটায় বের হবি৷ এখন মাত্র ছয়টা বাজে, চুপচাপ দাঁত ব্রাশ করে এসে পড়তে বস।”
“হুম।”

হেলেদুলে ব্রাশ করছি, আপু খোঁচা দিয়ে বলল,
“মহারানী তাড়াতাড়ি আসেন।”

পড়তে বসে আগে ফোন হাতে নিয়ে দেখি অয়ন ম্যাসেজ দিয়েছিল রাতে,
“তনুশ্রী, কল রিসিভ কর।”

তার কিছুক্ষণ পর আরেকটা ম্যাসেজ দিয়েছিল,
“ঘুমিয়ে গেছিস? ওকে, গুড নাইট। সুইট ড্রিম।”

আমার আবার গুড নাইট আর সুইট ড্রিম। সারারাত তো ওই শাড়ি আর শাড়ি দাতার চিন্তায় ছিলাম।

ফোন রেখে পড়া শুরু করলাম। সাড়ে সাতটার দিয়ে রেডি হয়ে নাস্তা করতে গেলাম ডাইনিং এ। আব্বু সেই সকালে অফিসে গেছে। আম্মু, মামা আর মামানী ড্রইংরুমে নাস্তা করছে, এখন আমি আর আপু খেতে বসেছি।

“অনিপা কে?”

আপুর কথায় রুটি মুখে দিতে গিয়ে ফেলে দিয়েছি। তাড়াহুড়ো করে রুটি মুখে দিয়ে বললাম,
“আমার ফ্রেন্ড।”

অয়নের নাম্বার অনিপা দিয়ে সেভ করেছি। আপু যেহেতু দেখে ফেলেছে তার অর্থ আর লুকানো যাবে না, তবে এখন বলাও যাবে না কারণ আম্মু শুনতে পাবে।

আমার কান্ড দেখে আপু আমার কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনি। না করাই স্বাভাবিক, আমার ফ্রেন্ডদের সবাইকেই আপু চিনে।

“রাতে ম্যাসেজ করেছিল।”
“হয়তো কোনো কাজ ছিল।”
“এতো রাতে? তাও আবার তনুশ্রী?”
“স্বাভাবিক, কোনো পড়া বুঝে না বা প্র‍্যাকটিক্যাল নিয়ে কোনো সমস্যা। ও আবার খুব ভালো স্টুডেন্ট, অনেক পড়াশুনা করে। আমার থেকে পড়া জানতে হলে তো মিষ্টি করেই বলতে হবে।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে দিলাম। আপু হেসে আম্মুকে ডেকে বলল,
“আম্মু, তোমার মেয়ের থেকে ভালো স্টুডেন্টরাও পড়া বুঝে নেয়। এমন বিল্লিং পুষতেছো।”

খো°টা দেয়া কথাটা ভালোই বুঝছি৷ কোনোরকম খেয়ে উঠে গেলাম। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি।

“আম্মু, আমি গেলাম।”
“সাবধানে যেও।” (আম্মু)

আপু আবারো বলল,
“তোর ফ্রেন্ডকে বলিস মাঝরাতে যেন আর ম্যাসেজ না দেয়।”

শুনেও না শুনার ভান করে চলে এলাম। রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটছি। বাসার রোড পার হয়ে এদিকে আসতেই অয়ন এসে আমার পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলো।

আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম,
“শাড়ি কেন দিয়েছো?”

অয়ন হেসে আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“শাড়ি দিয়ে কি করে?”
“সেসব আমি জানি, তুমি কেন শাড়ি দিয়েছো?”
“আমি বলেছিলাম তুই শাড়ি পড়বি আর আমি দেখবো। তোর যে নিজের কোনো শাড়ি নেই তা আমি জানি, তাই এটা দিয়েছি।”

অয়নের হাতটা একটু শক্ত করে ধরে বললাম,
“এতো সহজে মন পড়ে নিচ্ছো কেন অয়ন?”

কথাটা বলেই চুপসে গেলাম। আয়হায়, কি বললাম এটা? অয়ন যে হাসছে।

কলেজের কাছাকাছি চলে আসায় অয়নের হাত ছেড়ে দ্রুত হেঁটে ভিতরে চলে এলাম। ক্লাসে গিয়ে হাসিহাসি মুখে মানহার গা ঘেঁষে বসে পড়ি। মনোযোগ দিয়ে ফিজিক্স পড়ছিল বেচারী, আমি খোঁ°চা দিতেই বলল,
“পড়া কমপ্লিট হয়নি দোস্ত, প্লিজ শেষ করতে দে।”

আমি বই বন্ধ করে দিয়ে বললাম,
“এ পড়া জি°ন্দি°গিতেও শেষ হবে না। তুই আমার কথা শুন।”
“ওকে বল।”

গতকাল থেকে আজকে পর্যন্ত সব ঘটনা মানহাকে খুলে বললাম, শাড়ির কথাটাও বললাম। মানহা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“যাক, তোর এতোদিনের লুকানো প্রেম তবে সামনে এলো।”

আমি ওর কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,
“সামনে আর এলো কই? ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলতে চাইলো, সুন্দর মতো সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করতে পারতো। আমি কি আর না করতাম?”
“আরে ওই যুগ কি এখনো আছে নাকি? ওসব পুরানা হয়ে গেছে।”
“তাই?”
“হুম।”

মানহা বই খুলতে খুলতে আমাকে বলল,
“তা এসবে আমাকে জড়ালি কেন?”
“আর তো কিছু মাথায় আসলো না। শাড়িটা ব্যাগে আছে। তোকে দিয়ে দিবো, তুই রাখবি।”
“তা রাখলাম, কিন্তু..”

মানহাকে থামিয়ে বললাম,
“কোনো কিন্তু না, তুই রাখবি। আমি একদিন সময় করে গিয়ে পড়বো। তুই আমাকে সাজিয়ে দিবি।”
“এহেম, এহেম।”

মানহা একটু কাশি দিয়ে বলল,
“কত প্রেম আসে যায়, দেখি কয়দিন থাকে।”
“এমনে বলিস না।”

মানহার কথায় একটু ভাবনায় আমিও পড়লাম। প্রেম যদি হারিয়ে যায় তবে তা আকর্ষণ আর যদি তা চিরকাল রয়ে যায় তবে সেটা ভালোবাসা। আমি ভালোবাসতে চাই, খুব করে চাই তোমাকে। কিন্তু সে সারাজীবন এমন করে ভালোবাসবে তো?

চলবে………..