হলদে প্রজাপতি পর্ব-৪০+৪১

0
199

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

চল্লিশ

সেরোটোনিন । আমি তখন আনহ্যাপি হরমোনের চূড়ান্ত পর্যায়ের সিক্রেশনের ভুক্তভোগী । যে ক’টা মাস পুরুলিয়ায় ছিলাম, কোন দিন ভালো করে খেতে পারিনি, ঘুমোতে পারিনি । কত রাত্রি যে বিনিদ্র কাটিয়েছি, তেমনি আবার অবেলায়, রাস্তার ধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা, খেতে না পাওয়া কুকুরগুলোর মত ঘুমিয়ে পড়েছি, বলতে পারিনা । সে যেন এক অন্য আমি । আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে চমকে উঠতাম । রাজ্যের সমস্ত কালি কে যেন আমার মুখে লেপে দিয়েছে । অন্ধকার ঠেলে চোখের সাদা অংশটা বেরিয়ে রয়েছে । চুলে জট পাকিয়ে ফেলেছিলাম । খাওয়া-ঘুম যেখানে লাটে উঠেছে, সেখানে আর নিজের শরীরের যত্ন কে নেয় । নেবোই বা কেন ? কিছুই বুঝতে পারতাম না । আমি এখন কোথায় আছি , কেন আছি , কোন প্রশ্নেরই কোন উত্তর ছিল না আমার কাছে। বাবা সেই যে বহু দূরে চলে গেল, তা যেন চলেই গেল । আমার চোখের দিকে তাকালেই আমি সেটা টের পাই । কয়েক আলোকবর্ষ দূরে বসে আছে বাবা মানুষটা । যে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল । সারাটা মন জুড়ে শুধুই সোনু দা । আমি যে ওর কাছে নেই । ও এখন কোথায় ? কেমন আছে , কি করছে? আমি চলে আসায় ওর মন খারাপ কিনা, এ প্রশ্ন আমি বাবা বা মাকে তো করতে পারতাম না, তবে আকাশকে, বাড়ির পেছনের কল্কে ফুলগুলোকে, মাঠের ওপর দিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে ঝোপঝাড়ের ধুতরো গাছগুলোকে এ প্রশ্ন আমি করতাম । শুনেছি নাকি ধুতরা গাছের গোল গোল কাঁটাওয়ালা যে ফলগুলো ধরে , সেগুলো থেঁতো করে খেলে মৃত্যু অবধারিত । করে দেখবো একবার ? মৃত্যু কেমন ? সে কি খুব শীতল ? কষ্ট হয় খুব ? এই মুহূর্তে আমি মরে গেলে , মা বাবার কি হবে ? আমি যে ওদের একটাই মাত্র সন্তান । ওরা খুব কাঁদবে নিশ্চয়ই । বাবা যতই আমার দিকে ওই ভাবে তাকাক্, আমি না থাকলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে । আর সোনু দা? আমি নেই , মরে গেছি , শুনলে সোনু দা ঠিক কতটা কষ্ট পাবে? কতটা কাঁদবে আমার জন্য ? মরে গিয়ে দেখতে হয়। মরে গেলে , প্রেতাত্মায় ভর করে সেসব কি চোখ মেলে দেখা যায়? কি হয় মৃত্যুর পারে? ডিপ্রেশনের চূড়ান্ত লেভেলে গিয়ে তখন আমি প্রায় প্রেতাত্মার মতই দেখতে হয়ে গেছিলাম । কতদিন যে খাবারের কোন স্বাদ পাইনা, গাঢ় ঘুম ঘুমোইনি, হাসিনি, গল্প করিনি .. পাহাড়ের কোন চূড়ো থেকে সেই সব যেন বহু যুগ আগের ফেলে আসা স্মৃতি আমায় হাতছানি দেয় । আমি শুধু পাহাড়ের এক অলৌকিক খাঁজে দাঁড়িয়ে সেই হাতছানি দেখতে পাই । ইহজীবনে কখনো ছুঁতে পারব বলে আর মনে হয় না ।

যখন ফিরে গেলাম অজিত কাকুদের বাড়িতে , তখন নিতান্ত বাধ্য হয়েই বাবা-মা আমাকে গিয়ে দিয়ে এসেছিল । টেস্ট পরীক্ষা হবে । তারপরে ভ্যাকেশন পড়বে কিছুদিনের জন্য। তারপর ইউনিভারসিটির থার্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম শুরু হবে। আমি যখন গিয়ে পৌঁছলাম, তখন সোনু দা সেখানে আর থাকে না । এইযে ‘সোনু দা বিহীন আমি’ — এর সাথে পরিচিত হওয়া আমার পরীক্ষার ভয় , একেবারে বিনা প্রিপারেশনে যে পরীক্ষায় আমায় বসতে হবে তার ভীতি, খুব উঁচু কোন পাহাড় চূড়ো থেকে পড়ে যাওয়ার ভয় , নির্জন ধূ ধূ মরুভূমিতে একা একা হারিয়ে যাওয়ার ভয় , সর্বোপরি মৃত্যু-ভয় — সব ধরনের আতঙ্ককে ছাপিয়ে গেল, আমি কিভাবে এই বাংলোয় রয়েছি বা থাকবো, সেই ভয় ! এতদিন পুরুলিয়ায় ছিলাম। বেঁচেছিলাম শুধুমাত্র এই আশায় , ফিরে গিয়ে সোনু দা’কে আবার দেখতে পাবো । কি হলো , কেন হল , কেমন করে হলো , আমার সেই অসমাপ্ত ডায়েরি লিখন হঠাৎ কেন থমকে গেল, তার পরবর্তীতে কি লিখব আমি ! সেখানে এই প্রশ্নই আমি শত সহস্রবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কল্পনার সোনু দার সামনে করে গেছি। মাত্র একটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল আমাদের মধ্যে । হয়তো খুবই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে । তবুও ভুল-বোঝাবুঝি বই তো কিছু নয় । কিরকম যেন গোলমাল হয়ে গেছিল মাথার মধ্যে। হঠাৎ করে উঠে চলে এসেছিলাম । তারপরেই এত কাণ্ড ! কিন্তু আমার তার কাছে করা ভুল বা দোষ যাই হোক , সেটা তো ওইটুকুই । আমার ঐভাবে চলে আসার জন্য রাগ করা যায়, অভিমান করা যায় , তবে গল্পটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় না । আমাদের গল্প পূর্ব নির্ধারিত । আমি লাল বেনারসি, চন্দনের ফোঁটা, রজনীগন্ধার মালা, এক মাথার সিঁদুর পরে যাব ওদের বাড়ি । সেই কবে থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে সে কথা। যেন আমার জন্মের আগে থেকে । যেন আগের কতগুলো জন্ম ধরে । তাই এই জন্মে নতুন মনে হয় না । কিন্তু সেই সব গল্পের পসরা সাজিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি, সে নেই !

কয়েকটা দিন শুধু চোখ , মন , পঞ্চ ইন্দ্রিয় সবই পড়ে থাকত ম্যানেজারের বাংলোর দিকে । যদি সে থাকে সেখানে। অসীম ভয় তখন বাসা বেধেছে আমার মধ্যে । তার সাথে সংকোচ। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি কিছু। প্রত্যেকে, এমনকি বান্টিও আমার সামনে সোনুদার কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন করত না । এইরকম করে সপ্তাহ খানেক প্রায় কেটে গেল । আমিও নিশ্চিত ভাবে বুঝলাম , সোনুদা নেই ।

তারপর একদিন লজ্জা-শরম, সংকোচ , সবকিছুর মাথা খেয়ে বান্টিকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম,
— সোনুদা কি চলে গেছে রে?
বান্টি কয়েক সেকেন্ড আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল ।
তারপর বলল, মা যদি জানতে পারে তুই আবার সোনুদার কথা জানতে চাইছিস, সাংঘাতিক কান্ড হবে কিন্তু। ওর কথা বলিস না , থাক্ ।
চোখের ভেতরে তখন আমার বাষ্পের নদী ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে । কোনরকমে একটা ঢোঁক গিলে কান্নাটাকে ঠেলে-গুঁজে ফেরত পাঠিয়ে, ওর হাতটা চেপে ধরলাম দুই হাতে।
— প্লিজ ! আর কখনো জিজ্ঞাসা করবো না । তুই শুধু একবার বলে দে আমায়, সোনুদা কি নেই এখানে ? ও কি আর আসবে না?
যেন ঘরগুলোর দেওয়ালেরও কান আছে, এমন করে চারিদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে মুখ নামিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে বান্টি বলল, সোনুদার প্রজেক্ট এর কাজ শেষ হয়ে গেছে । ও ফিরে গেছে । তবে আসবে আর একবার। দু’দিন পরেই আসবে।
তারপর হরর স্টোরির ট্রেলার শোনানোর মত করে বলল, খবরদার কিন্তু তরুদিদি! ওর কি যেন একটা ইম্পর্টেন্ট রিসার্চের ডেটা এখান থেকে কালেক্ট করার আছে , তাই জন্য আসছে । বোধহয় ওয়ান উইক থাকবে, তারপর একেবারে চলে যাবে। এখানে ওর কিছু জিনিসপত্র রয়েছে, সেগুলোও নিয়ে যাবে । তুই কিন্তু ভুলেও এক বারও ওর সঙ্গে দেখা করিস না। কথা বলিস না। ওই দিকে যাস না। তাহলে কিন্তু রক্ষে থাকবে না। আর মা যে তোকে কি করবে, জানি না ।
আমি আর কিছু বললাম না । বান্টির হাতটা ছেড়ে দিয়ে ওকে বললাম, তুই যা!
ও আমার দিকে বারকয়েক সন্দেহজনক ভাবে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে ।
আমার গাল দুটো নোনা জলের খামখেয়ালী নদী, উপনদী-শাখানদীতে ভরে গেছে । এলোমেলো, বাঁধভাঙ্গা , প্লাবিত ! আমি আস্তে আস্তে বসে পড়লাম খাটের ওপর । মাথায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো — ‘ ও ফিরে গেছে, তবে আসবে আর দুদিন পরে-‘

দুদিন পরে এল ও । আমি চোখে না দেখেও কিভাবে যেন দেখতে পেতাম, জানতে পারতাম । ও এলো এ বাড়িতে । অজিত কাকুর সঙ্গে দেখা করে গেল । কাকিমার সাথে কথা বলল। বান্টির সঙ্গেও । শুধু আমি বাদ পড়লাম। চোখের দেখাও দেখা হলো না । আমার ওপর যা বিধিনিষেধ রয়েছে , ওর ওপর কিন্তু নেই। ও স্বচ্ছন্দ, সচল । আর আমি যেন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছি ।

একদিন কাটলো । দুদিন কাটলো । ও নাকি মাত্র সাত দিন থাকবে। তিনদিনের দিন কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফিরছি, ও তখন কিছু একটা ফিল্ডওয়ার্ক করছিল। এক সেকেন্ডকে হাজার ভগ্নাংশে ভেঙে ফেললে যে মুহূর্তটা দাঁড়ায়, সেই এক মুহুর্ত আমার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হলো ! আমার দেহের সমস্ত রক্ত হৃদপিণ্ডে গিয়ে ভিড় করলো। আমি ঘরে ফিরে এসে জড় পদার্থের মত শুয়ে পড়লাম বিছানায় । এমনি করেই কি সাতটা দিন পেরিয়ে যাবে আমার জীবন থেকে? সোনুদা আর আমি এক জায়গাতেই রয়েছি। আমার কাছে যে প্রতিটা মুহূর্ত মহার্ঘ । সেখানে তিনটে দিন এইভাবে কেটে গেল ? আরো চারটে দিনও কেটে যাবে ! সোনুদার সঙ্গে আমি একটাও কথা বলতে পারব না ! একবারও কাছে যেতে পারবো না ! ও আমায় আর একবারও ছুঁয়ে দেবে না ! তারপর বিরাট এই পৃথিবীতে কোথায় খুজবো আমি ওকে ? কি করে খুঁজবো? আমার যে সোনুদার ব্যাপারে মনের মধ্যে কয়েক কোটি প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও একটাও আমি মুখ ফুটে কাউকে করতে পারিনা। তাহলে এই কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে যেদিন ও হারিয়ে যাবে, তারপরে আমি ওকে কি করে খুঁজে পাবো ?

ঈশ্বর বোধহয় আমার কথা শুনলেন । তখন তাই মনে হয়েছিল । ঈশ্বর আছেন । তিনি আমার মত একটা তুচ্ছ মেয়ের মনের খবর রাখেন । না হলে এমন আশ্চর্য হয় কি করে? পরের দিন বেলার দিকে ভামিনী কাকিমা আর অজিত কাকু দুজনেই বেরিয়ে গেলেন। ভামিনী কাকিমার ভাইয়ের মেজর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। মাথায় চোট । লাইফ রিস্ক । কাকিমা পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বেরোলেন ঘর থেকে । এমনকি বেরোনোর সময় আমাকে শাসিয়ে যাওয়ার কথাও মনে থাকল না । মানুষের যে কত রকম বিচিত্র সময় আসে এই জীবনে ! একসময়ের ভীষণ প্রয়োজনীয় একটা কাজ, আরেক সময়ে গিয়ে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। আর আমি ? একজন মানুষের এত বড় একটা অ্যাক্সিডেন্টে খুশি হলাম। কারণ, কাকু আর কাকিমা বাড়ি থেকে চলে গেলেন। মানুষ ভালবাসলে বড় স্বার্থপর হয়ে যায় । বান্টির সামনেই টেন্থ স্ট্যান্ডার্ড এর বোর্ড এক্সাম ছিল । ও কাকু কাকিমার সাথে যায়নি। রয়েই গেল । আর দুজন মেয়ের টেম্পোরারি গার্জেন হয়ে কয়েকটা দিনের জন্য এলেন অজিত কাকুর ছোটভাই , বান্টির ছোটকা ।

প্রথমে মনে হল যেন , বহুযুগ ধরে আমি এমন একটা গুহায় আটকা পড়ে গেছিলাম যেখান থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে পাওয়া তো দূর, সামান্য আলোর রশ্মিটুকুও দেখতে পাওয়ার কোন আশা ছিল না । সেখান থেকে হঠাৎ করে রাজপথে এসে পড়লাম । কাকু নেই , কাকিমা নেই , সোনু দা আছে ! তারপরে বুঝতে পারলাম , রাজপথে এসে পড়লেও আমার পক্ষে এক পা’ও চলা সম্ভব নয়। কারণ আমার পা তখন পিছন থেকে শিকল দিয়ে বাঁধা । সেই শিকল জড়ানো রয়েছে লজ্জা , সংকোচ আর গ্লানিবোধের পাহাড়ে । সেই পাহাড় টেনে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব !

তারপর একটা সময় বুঝলাম, আসলে জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই । তেমন পরিস্থিতিতে পড়লে অতি বড় সাধুও চোর হয় , অতি বড় ভীরুও ঘুরে দাঁড়ায় , অতি বড় নিরীহ মানুষও খুন করে ফেলে ! আমিও দুপায়ে পাহাড় টানতে টানতে ম্যানেজারের বাংলোয় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম । সোনুদার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ও দরজা খুলে আমাকে দেখেই দড়াম্ করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার মুখের ওপর। আবার গিয়েছিলাম । আবারও তাই করেছিল । কেন এরকম করছে , আমাকে কি বলার আছে, সেটা সোজাসোজি বলুক । প্রচন্ড মরুভূমিতে পথ হারানো পথিক ঠান্ডা পানীয় জল যেভাবে চাইতে পারে , আমি ঠিক সেইভাবে নিজের ঘরের জানলায় ঠায় বসে থাকতাম ওকে একটিবার দেখার আশায়। ছ’দিনের দিন দেখলাম ও কিছু ফিল্ড ওয়ার্ক করবে বলে বোধহয় বেরিয়েছে । আমি একেবারে বাঘের তাড়া খাওয়া হরিণের মত ছুটে গেলাম ওর কাছে ।
বললাম , আমার সাথে কথা বলছো না কেন ? একটিবার কথা বলো আমার সঙ্গে ! আমি যে কিছুই বুঝতে পারছিনা ।
ও কোন উত্তর না দিয়ে পিছন ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করল । আমিও যাচ্ছি ওর পেছন পেছন। ও গতি বাড়ালো । আমিও বাড়ালাম ।
এক সময় বাংলোর ভেতর ঢুকে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে , আমি কপাটটা দু’হাতে ধরে বললাম ,
–প্লিজ আমায় বলো, কথা বলছো না কেন আমার সঙ্গে ?
না বলেনি । কিছুতেই কথা বলেনি আমার সঙ্গে সোনু দা ।

সাতটা দিন কেটে গেল। সেদিন ওর সমস্ত লাগেজ , বইপত্র, ফাইনালি গোছগাছ করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। এবার বেরিয়ে যাবে । আমি নিজের মাথায় পৃথিবীর সব গ্লানি আর অপরাধবোধ তুলে নিয়ে চোরের মত গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম রাস্তার ধারের সেই সোনাঝুরি গাছটার নিচে । আমার চোখে তখন উন্মাদের দৃষ্টি ! মনে তখন মোজেইক প্যাটার্নের ছবির ওপর আলকাতরা ল্যাপা ! বুকে তখন একশ জালিয়ানওয়ালাবাগ ! আর আমি নিজে তখন একজন ভিখারি !

সোনুদার সাদা গাড়িটা যখন রাস্তায় একরাশ ধুলোর মেঘ বুনে চলে গেল আমার চোখের সামনে দিয়ে , তখন আমি সেই ধুলোর কুয়াশার ওপারে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চেয়েছিলাম – একটা কথা , একটা শব্দ , একটা চিহ্ন , একটা কিছু.. ! কি ভিক্ষা চেয়েছিলাম জানিনা । হয়তো সবটাই । হয়তো কিছুই না । শুধু ভিখারিনী হয়ে শতচ্ছিন্ন আঁচলটা মেলে দাঁড়িয়েছিলাম । ফিরে এসেছিলাম শাড়ির খাঁজে খাঁজে লেপ্টে থাকা ধুলোর আঁকিবুকি কথা নিয়ে ।

সেই শেষ দেখা ! বহুযুগের বাঁধানো ফ্রেমের মত গাড়ির উইন্ডো সিটে সোনুদার সাইড ফেসটা । খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে স্মোকি সানগ্লাস । সাইড ফেসটাই বাঁধানো আছে । ও আমার দিকে তাকায়নি তো একবারও । আমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছি বুঝেই আরো তাকায়নি । আমি জানতাম সে কথা । সেই অন্তিম বাঁধানো ছবিই রয়ে গেছে আমার কাছে আজও । ছবির পিছনে লিখে রেখেছি অজস্র প্রশ্ন । হিমোগ্লোবিনের গুঁড়ো দিয়ে !

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

একচল্লিশ

সেই ছোটবেলায় শেখা ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডের হিসাব জীবনে কিছু কিছু সময় এসে একেবারে গুলিয়ে যায় । আমারও ঠিক তাই হয়েছিল । সোনুদা চলে যাওয়ার পরে সেই যে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম , তারপরে ঠিক কতখানি সময় যে বাইরে বেরোই নি, বলতে পারিনা । তবে মনে হয় যেন তিন রাত হবে । ওই সময়টার জন্য আমি আমার জীবন থেকে সমস্ত কিছুই প্রায় বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম । খাওয়া-দাওয়া, স্নান, কথা বলা, সবকিছু । আধো আচ্ছন্নের মধ্যে বুঝতে পারতাম না আমি ঘুমোচ্ছি না জেগে রয়েছি। শুধু প্রাত্যহিক টয়লেটের কাজকর্মগুলো আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস যেগুলো কিনা মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, সেই কাজগুলো বাদ দিলে , বাকিটা ‘আমি আছি’ আর ‘আমি নেই’ এর মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল বুঝতে পারতাম না । বান্টি প্রতিদিনই একবার করে এসে আমাকে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানোর চেষ্টা করে যেত ওর নিজের মত করে ।
তিনদিন পরে এসে বলল, তরু দিদি , আজকে ওঠ্ এই বিছানা ছেড়ে । চান করবি চল্ । বাবা-মা আসবে আজকে । বুঝতে পাচ্ছিস তুই ? মা ফিরে আসবে । তোকে এই অবস্থায় দেখলে কি করবে বোঝার চেষ্টা কর্ । চল্ ওঠ্ । ওয়াশরুমে চল্ । চান করে যা হোক কিছু খাবি ।
আমার কান কথাগুলো শুনছে, কিন্তু মাথা পর্যন্ত যাচ্ছে না । সবক্ষেত্রেই তাই হত । ইন্দ্রিয় তাদের কাজ করে যেত । কিন্তু কিছুই মাথা পর্যন্ত পৌঁছত না । দিনের আলো, রাতের আঁধার চোখ দেখতে পেত । তবু আমি জানতাম না দিন চলছে কি রাত।
— কিরে ?
কিছু চেষ্টা তাও নিশ্চয়ই অনুভূতিতে আসত, কিন্তু সেসব অনুভূতি মাথায় গিয়ে গুরুত্ব হাসিল করে উঠতে পারতো না । বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিলাম ।
বান্টি হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মেরে বলল, মা ফিরে এসে ভীষণ বকবে। উঠে আয় ।
আমি নড়লাম না । ও এইবারে প্রায় ওর সর্বশক্তি দিয়ে একটা হ্যাঁচকা টান মারলো । বিছানার ধারে ছিলাম। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে গিয়ে পড়লাম। কিছুটা হয়তো ব্যথা পেয়েছিলাম । তবে সেই সমস্ত অনুভূতি আমার তখন কিছুই ছিল না । কিন্তু বান্টি ভয় পেয়ে গেল । আমার পাশে বসে আতঙ্কিত গলায় অনেক কিছু বলে যেতে লাগলো । ওর বোধহয় ধারণা হয়েছিল আমি আর জীবনে কোনদিনই সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাব না । কথা বলতে বলতে চোখ দুটো জলে ভরে এল ওর । মানুষের কম বয়সের সম্পর্কগুলো, ভালোবাসাগুলো অনেক নিখাদ হয় । পরবর্তী জীবনে মানুষ অনেক সম্পর্ক গড়ে তুললেও নিখাদ সম্পর্কের খোঁজে সেই ছেলেবেলায় গলিঘুঁজিতেই খুঁজে বেড়ায়। বান্টিও আমায় নিঃস্বার্থভাবে বোনের মত ভালবাসত । এই পৃথিবীতে হয়তো বা যেকোন সমগোত্রীয় বা বস্তুর প্রতি ভ্যান্ডার ওয়ালস্ ফোর্স কাজ করে । বান্টির চোখের জল দেখে সেদিন প্রথম আমার দুটো চোখ জলে টলটল করে উঠলো । মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি শুনেছি , দেখিনি কোনদিন। তবে মন-ভাঙ্গা কান্নার সঙ্গে হয়তো একটা মিল থেকেই যায়। দুটোকেই সর্বশক্তি দিয়েও বাঁধ মানানো যায়না। বান্টি সেই দিনের জন্য আমার বড়দিদি হয়ে গেছিল । ওর বুকের মধ্যে নিজের মুখটাকে যতদূর সম্ভব লুকিয়ে ফেলে সে এক অস্বাভাবিক অনন্ত কান্নাই কেঁদেছিলাম আমি ।

আমার ইন্সটিংক্ট বলছে পূবের জানলাটা খুলে দূরে ওই অনেক দূরে চোখ মেলে চাইলে, আকাশে গোলাপী আভা দেখতে পাবো। ঊষাকাল। ভোর হয়ে এসেছে । অনেকদিন পর আবার একটা রাত্রি বিনিদ্র কাটলো । অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে আরো বেশ কিছুক্ষন শুয়ে রইলাম বিছানায় । মোবাইলটা অন করে টাইম দেখলাম । এখন ছ’টা বাজছে । আরো ঘন্টাখানেক এভাবেই শুয়ে থাকা যায় , অসুবিধা নেই তাতে । আজ রবিবার । সময় করে ঘরে ফিরে গেলেই হবে । অফিসে যাওয়ার সময়ের ধরাবাঁধা ব্যাপার নেই । সাতটার পরে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বিছানা ছেড়ে ওঠা আর ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে । বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সারা শরীরে-মনে এতটাই ক্লান্তি থাকে যে, মেজাজটাই থাকে খিঁচড়ে । বান্টি বলছিল, লাঞ্চ সেরে একেবারে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরতে। সেই মতই করব ভাবছিলাম । কিন্তু ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসতে যাচ্ছি, এমন সময় বাবা ফোন করলো। বললো , আজ বিকেলে নাকি ইন্দ্রাশিষ বাবু আসবেন বলেছেন । আমি যেন অবশ্যই তার আগে ফিরে যাই । আমি আর ওখানে লাঞ্চ করার ঝামেলা রাখিনি । ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে এসেছিলাম ।

অদ্ভুত একটা মন-কেমন-করা’কে সঙ্গে নিয়ে ফিরছি আমি। মন-কেমন-করা একটা নির্দিষ্ট বয়স পেরোনোর পর প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হয়ে পড়ে । সময় সুযোগ মত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । কিন্তু আমার মন খারাপের মধ্যে অনেকখানি জ্বালা মিশে আছে । অপমানের জ্বালা । এই জ্বালা অনেক দিন , অনেক বছর আগেই সঙ্গি হবার ছিল। কিন্তু আমি তাকে জোর করেই আসতে দিইনি। নিতান্ত অবাক হয়ে থাকার ভান করেছিলাম। আজকে এতগুলো বছর নিজের কাছে নিজেই অভিনয় করে গেছি। সেই অভিনয়ে দিব্যি ভুলেও ছিলাম সোনুদা যে আমাকে বরাবরই মনে-মনে ছোট করেছে, হেয় করেছে । না সব সময় মনে মনেও নয় , সামনাসামনিও করেছে বৈকি । তবু সে সমস্ত সত্যই জেনেও আমি না জানার ভান করে ধামাচাপা দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। ভালোবেসে দুঃখ পাওয়ার মধ্যে যে গর্বটা থাকে, সেইটুকুই সম্বল করে আজকে এতগুলো বছর বিরহের মহীরুহ রচনা করে চলেছি । যেন আমি নিজেই জানিনা ও ঠিক কি কারণে চলে গেছিল, কোন যোগাযোগ রাখেনি , যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি , ইচ্ছে করেছে কাছে এসেছে , আবার ইচ্ছা হয়েছে ছেড়ে চলে গেছে — এই সাধারন সত্যটার মধ্যে প্রতি বিন্দুতে যে অসম্মান , যে অপমান মিশে রয়েছে, সেইটাকেই আমি সযত্নে এত বছর ধরে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিইনি। সেটাকেই আজকে এত বছর পরে ঝেড়েপুছে একেবারে নগ্ন সত্য হিসেবে বান্টি আমার চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । তাই বিষের জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছে আমার অঙ্গ ।

ইন্দ্রাশিষ বাবু বাড়িতে এলেন ঠিক বিকেল পাঁচটা নাগাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডাক পড়ল সেখানে। গিয়ে দেখলাম, সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি বেশ থমথমে। তিনজন মানুষ, বাবা-মা, ইন্দ্রাশিষ বাবু, তিনজনেই গম্ভীর মুখে বসে রয়েছে।
আমি যেতে বাবা বলল, ইন্দ্রাশিষ তোকেই ডাকছিল। তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে । তোরা কথা বলে নে।
বলে বাবা আর মা উঠে পড়ল সেখান থেকে । আমার তেঁতো মনটা পরিস্থিতি থমথমে দেখে আরো তিক্ততায় ভরে গেছিল । কিছু বললাম না, শুধু চুপচাপ গিয়ে বসলাম।
উনি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন , ইয়ে .. , একটা সমস্যা হয়েছে আর কি ..
কিছু বললাম না । চুপ করে রইলাম ।
উনি বললেন , আসলে সমস্যাটা হয়তো-
আমার ভেতরটা কেমন যেন চিড়বিড়িয়ে জ্বালা করে উঠলো । বললাম , সমস্যাটা যাইহোক । প্রপোজালটার তো একটা উত্তর হয় ইন্দ্রাশিষ বাবু ?
— না আসলে সমস্যাটা বেশ-
আমার অন্তঃকরণটা পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের ওপর বিতৃষ্ণায় ভরে গেছে। বিষে নীল হয়ে গেছে ।
আমি বললাম , সমস্যাটা পরে শুনছি । আমার বাবাকে এভাবে সরাসরি অপমান করার অধিকার আপনাকে কে দিল?
উনি অবাক হয়ে আমার দিকে চাইলেন।
আমি বললাম , যেহেতু আ্যপ্রোচটা আমাদের দিক থেকে এসেছে, সেইজন্যই বোধহয় আপনি এতদিন পর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার ফুরসত পেলেন ?
মুখটা কালো হয়ে উঠল ওনার । বললেন , আসলে আমি একটু কাজে-
— কাজ ?
আমি বুঝতে পারছিলাম আমার গলা ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে ।
— কাজ তো আপনার সবসময় রয়েছে । আর এত কিসের কাজ দেখান আপনি ? কাজ কি জগতে শুধু আপনার একারই ? আমরা কি কেউ কাজ করি না?
— না আসলে ব্যাপারটা –
— ব্যাপারটা যাইহোক , আপনার কিছু একটা সমস্যা হয়েছে , আপনি প্রপোজালটায় ‘ হ্যাঁ’ বলতে পারছেন না এইতো ? এই সোজা কথাটা বলতে আপনি এতগুলো দিন সময় কেন নিলেন ? নাকি আমাদের সমাজের চিরাচরিত ধারাটাই বজায় রইল ? পাত্রীপক্ষ তো উপযাজক হয়ে বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে, না বলতে হবে, তা সে একরকম সময় করে বলে দিলেই হলো আরকি-

উনি যেন স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে ।
আমি বললাম , আর সমস্যা হয়েছে তো এর আগের দিন অতগুলো কথা কেন বলে গেলেন ? আমাকেই বা ঐ সমস্ত প্রশ্ন করার কী প্রয়োজন ছিল ? সমস্যার কথাটা সরাসরি বললেই কি ল্যাটা চুকে যেত না ? আমার বাবা সরাসরি একটা প্রপোজাল এনেছেন মাত্র । আপনার সামনে তো আর গলায় গামছা দিয়ে দাঁড়ান নি, যে আপনি কিছুতেই ‘না’ বলতে পারছেন না ? আপনার সমস্যার কথাটা বলতে পারছিলেন না কিছুতেই ?

উনি আর কিছু বলার চেষ্টা করলেন না। মাথাটা নামিয়ে চুপ করে বসে রইলেন । কিন্তু আমি ছাড়বো কেন ? আমার ভেতরে তখন পুরুষ জাতটার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার চলছে ।
বললাম , আমারই ভুল । আপনাকে একটু অন্যরকম ভেবেছিলাম । আসলে আপনাদের অন্যরকম ভাবার কোন স্কোপ নেই । পুরুষ জাতটা এমনই।
বেশ খানিকগুলো কথা শোনাতে পেরে আমার মন্দ লাগছিল না । দেখলাম উনি চুপচাপ বসে আছেন । মুখ নিচু । বোধহয় একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়ল । চুপ করে গেলাম । দুজনেই বেশ কিছুক্ষন চুপ ।
তারপর উনি বললেন , আপনি আর কিছু বলতে চান ?
— হ্যাঁ , আপনার কি যেন একটা সমস্যা হয়েছে বলছিলেন? যদিও আমি লিস্ট ইন্টারেস্টেড । তবুও আপনি বোধহয় সেই সমস্যাটা জানাতেই এসেছিলেন । সেটা আপনি বলে ফেলতে পারেন ।
— হ্যাঁ আমি একটা সমস্যার কথা জানাতে এসেছিলাম বটে । তবে এখন মনে হচ্ছে, সেই সমস্যার চেয়েও বড় সমস্যা রয়েছে ।
— বলে ফেলুন সব এক এক করে । কাউন্ট করে রাখতে হবে কি ? চার্ট তৈরি করবো একটা ?
আমার কথার রঙ নীল । আমি দেখতে পাচ্ছি ।
উনি বললেন , না চার্ট করে রাখতে হবে না। এমনি শুনলেই চলবে । আসলে আমাদের চোখের সামনে যে সমস্যাগুলো এসে দাঁড়ায়, সেগুলোকেই আমরা খুব বড় সমস্যা বলে ভাবি। যেগুলো চোখের আড়ালে থেকে যায় , সেগুলোকে আর দেখতে পাই না।
— ভূমিকা তো অনেক করলেন । এবার আসল সমস্যাটার কথা বললে বোধহয় ভালো হয় ।
— হ্যাঁ , একচুয়ালি আমি –
উনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন , আমি মাঝখানে বাধা দিয়ে বললাম , আচ্ছা একটা কথা বলুন তো ? আপনার সমস্যাটার কথা ডিসকাস করতে আসতে এতদিন দেরি হল কেন ?
উনি শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , আপনি গোটা ব্যাপারটা শুনলে বোধহয় বুঝতে পারবেন । এই দেরি হওয়াটা সমস্যারই একটা পার্ট ।
— আচ্ছা বলুন শুনি ।
উনি আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলতে লাগলেন, আমি গত শনিবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরেই দেখি মায়ের শরীরটা খারাপ হয়েছে। দুটো দিন মাকে নিয়ে বেশ ভালোরকম টানাপোড়েন গেল। আর তারপরেই আমার ট্রানস্ফার অর্ডারটা চলে এলো । ট্রানস্ফার একেবারে সুন্দরবনের ঐদিকে । কোথায় এক্সট্রিম নর্থ আর কোথায় এক্সট্রিম সাউথ । আমার পুরোটাই সমস্যা হয়ে যাবে । আমি এ কদিন ধরে অনেক চেষ্টাই করছি ট্রানস্ফার অর্ডারটাকে যাতে ক্যানসেল করা যায়। ছুটোছুটিও করতে হচ্ছে । তবে এখনো পর্যন্ত বিশেষ কোনো আশা দেখতে পাইনি । হয়তো শেষমেষ অর্ডারটা এক্সেপ্ট করে চলে যেতে হবে । সেইজন্যেই আমি একটু সময় নিচ্ছিলাম । যদি অর্ডারটা ক্যান্সেল হত, তাহলে কোন সমস্যা থাকতো না । কিন্তু যেহেতু এখনও সেরকম কিছু হয়নি, তাই আমি এসে কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আর এই সমস্ত ক্ষেত্রে ওভার ফোন কোনরকম কনভারসেশন হয় বা করে কোন লাভ হয় , সেটা আমি মনে করি না । যেহেতু ম্যারিটাল ইস্যু নিয়ে কথাবার্তা , সেখানে অটোমেটিক্যালি একসাথে থাকার, সংসার করার একটা প্রশ্ন চলে আসে । সেকারণেই আমি ঠিক কি বলবো, আসলে হঠাৎ করে অর্ডারটা চলে এসেছে তো –
উনি চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ । আমিও চুপ । ব্যাপারটা যে এইরকম, সেই সম্ভাবনা একবারও আমার মাথায় আসেনি । আসবেই বা কেন? উচিত কোনো সম্ভাবনাই আমাদের মাথায় আসেনা । শুধু কাল্পনিক প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নে নীল বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরে গেছিল আমার মনের প্রতিটা কোণ ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উনি বললেন , কিন্তু আজকে আপনার সাথে কথা বলতে এসে মনে হলো, সমস্যাটা ঠিক সেখানে নয় । সমস্যাটা আরো গভীরে । আমার এক্স ওয়াইফেরও আমার এই কাজ-পাগল ব্যাপারটা নিয়ে সমস্যা ছিল । টাইম ডিম্যান্ড প্রতিটা স্ত্রীরই থাকতে পারে তার হাসবেন্ড এর কাছে। আফটার অল, নতুন করে অ্যাডজাস্টমেন্টের সমস্যা হোক, এটা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয় । ভালোই হয়েছে আপনি কথাগুলো বললেন। তাতে করে আমার মনে হল, সাংসারিক যেকোনো ছোটখাট ব্যাপারে ঠিক কী করা উচিত না নয় , সেটা সম্পর্কে আমার ধ্যান ধারণা খুব দুর্বল । এই যে বিয়ে করতে গিয়ে বা আফটার ম্যারেজ যদি আ্যডজাস্টমেন্টের প্রবলেম হয়, তার মত বিশ্রী কান্ড আর কিছুই হবে না । তাই এই বোধহয় ভাল হল ।

কথাগুলো বলে চুপ করে গেলেন তিনি । বোধহয় একটা ছোটো দীর্ঘশ্বাসও ফেললেন ।
তারপর বললেন , মেসোমশাইকে একবার ডাকুন । ওনাকে জানিয়ে যাই ।
আমি আর কি বলবো বুঝতে পারলাম না । বাবাকে ডাকলাম।
বাবা এসে বসতে তিনি বললেন , মেসোমশাই আমার একটা সমস্যা হচ্ছিল । আমি সেটা জানিয়েছি । আমার মনে হয় , আমাদের দুজনেরই জীবন শুরু করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দেরি হয়েছে । আরো একটু দেরি হলেও কোন অসুবিধা নেই । তবে খুব ভালো করে চিন্তা ভাবনা করেই এরপরের স্টেপ ফেলা উচিত । কারণ এরপরেও ভুল স্টেপ খুব কিছু কাজের কথা নয় ।
কথাগুলো বলে তিনি আমার দিকে ইশারা করে বাবাকে বললেন , আমি দায়িত্বটা ওনাকেই দেবো । যদি কোন অ্যাডজাস্টমেন্টের অসুবিধা হবে বলে মনে হয় , বা হোয়াট এভার , সমস্ত কিছু ভেবেচিন্তে নিয়ে উনি যদি আমাকে পজিটিভ জানান, তাহলে ভবিষ্যতে আবার আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু আপাতত এই আলোচনা এই পর্যন্তই থাক । এক্ষুনি আর এটাকে নিয়ে আলোচনা করার মত বোধহয় কিছু নেই।
বাবা বোধহয় ভাল করে কিছুই বুঝতে পারলো না । জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো ইন্দ্রাশিষ বাবুর দিকে।
উনি আর কিছু বললেন না । উঠে পড়লেন ।
বললেন , আজ আমি আসি মেসোমশাই । আপনার যা কিছু জানার আছে ডিটেইলস ওনার কাছে জেনে নেবেন ।

চলে গেলেন তিনি ।

ক্রমশ..